তিনটি ভ্রমণ কবিতা ।। কাজী জহিরুল ইসলাম।। পুবাকাশ

ক্রোটন পার্ক

আমাকে এ-কথা বলতে এসো না তুমি কতো জ্ঞানী, 
বরং এ-কথা বলো, তুমি কতোখানি পথ হেঁটে এখানে এসেছো। – হযরত মুহাম্মদ (স.)

আমি তো হাঁটছিই
এক দূর থেকে ছুটে যাই অন্য দূরে…

আজ সকালেও ছুটে যাই ক্রোটন পয়েন্ট পার্কে
খোদার সৃজনশৈলী দেখার আগ্রহ আশৈশব, 
তৃষ্ণার্ত দুচোখ খুলে রাখি অহোরাত্র।

দুরন্ত অডিসি ছুটে চলে হাডসন-উপকূল ধরে।
স্টিয়ারিং-এ হাত রাখলেই কি যাওয়া যায়?
আমি কি চালাই গাড়িখানি 
বাতাসের অদেখা দেয়াল ঠেলে ঠেলে
না-কী গাড়িই  আমাকে চালায়?
নাকি অন্য কেউ আমাদের পৌঁছে দেয়
হাডসন নদীর নাভীতে,
অনিন্দ্য সুন্দর এ-ক্রোটন উপকুলে, 
যেখানে স্বাধীন ঢেউয়েরা এসে দ্বিধাহীন 
চুমু খায় পাথরের ঠোঁটে, 
বিচপাম রসালো যৌবন নিয়ে নগ্নবক্ষে জানায় উদার আমন্ত্রণ,
সী-গাল পাখিরা ক্রমাগত 
ছবি তোলে স্যাটেলাইট চোখে উড়ে উড়ে মাথার ওপর
প্রতিদিনের জর্নাল ঘাসের খাতায় 
লিখে রাখে মিশ্রবর্ণ মানুষের অনুসন্ধানী পা।

এই যে আমার কৈশোরের বন্ধু 
কাজী ফৌজিয়াকে কোনো এক ঝড় 
উড়িয়ে আনলো এই দেশে,
অন্য এক ঝড়ে কবি মাহবুব হাসান এলেন উড়ে উড়ে,
কি অদ্ভুত উপায়ে সোশ্যাল মিডিয়া মিলিয়ে দেয় 
মঞ্জু ভাই, মনি ভাবী দম্পতিকে,
এই যে সবাই এক অডিসির ভেতরে নিমগ্ন,
গাইছি অভিন্ন গান, দীর্ঘ হও, হে পথ সুন্দর হও…
এর সবই কি পথ-সঙ্গীতের 
অনিবার্য সঙ্গত যন্ত্রানুসঙ্গ নয়?
পথ আমাদের পৌঁছে দেয় কত কত সুন্দরের কোলে।
জলের নরোম দোলনায়  
শুয়ে শুয়ে পান করি সুন্দরের স্তন্য
নভো-নীল ক্যানভাসে 
ঘুড়ির রঙিন নিব দিয়ে ক্রমাগত আঁকি 
স্বপ্নের সুদীর্ঘ রেখা প্রতিদিন।

যদি না অ্যাডিরোন্ডেক পর্বত 
দুভাগ হয়ে অশ্রু ঝরাতো, এখানে এই নিসর্গ হতোনা,
ওপারে উঠতো না গড়ে সুউচ্চ 
নয়নাভিরাম প্রমোদ-নগর রকল্যান্ড কাউন্টি, পাথরগৃহ সারি সারি;
এই জল আছড়ে পড়তো না হৃদয়ে আমাদের;
দক্ষিণ এশিয়া থেকে 
কোন ঝড়ে উড়ে এলো বিশেষত্বহীন ক্রোটন ফুল 
এই দূর পাশ্চাত্যের কোলে?

উইপিং উইলো সবুজ চোখে কেনো কাঁদে
পাতার অশ্রুশেকল দুলিয়ে এখানে, এই হলুদ ক্রোটন উপদ্বীপে?

আমি তো হাঁটছিই
হাঁটতে হাঁটতে একদিন খুঁজে পাই পথের নতুন সঙ্গী,
এরপর থেকে
প্রতিদিন চারপায়ে হাঁটি সুনীল গ্রহের জল-কাদা, পাথর-অরণ্যে…

প্রতিদিন সকালে নতুন সঙ্গী হাতে হাত রেখে বলে, 
চলো এক্ষুণি বেরিয়ে পড়ি পৃথিবীর পথে,
চাই গতি, জীবনের জন্য ইতিবাচক উত্তেজনা,
চলো মন্টেনিগ্রোর সুউচ্চ কালো কালো 
পাহাড়ের পেটের ভেতরে ঢুকে পড়ি
দেখে আসি অগ্নিগিরির আগুন আমাদের চেয়ে উষ্ণ কিনা,
চলো নেমে যাই সমুদ্রের গভীরে, মাছের সংসার দেখে শিখে নিই 
কতোটা গভীরে গেলে ভাসিয়ে নেবে না জলোচ্ছ্বাস,
সাহসে গ্লাইড করে দেখে আসি পাহাড়ের চূড়ো,
ঈগল কি করে তার শিশুদের 
উড়াল শেখাতে শেখাতে নামিয়ে আনে সমতলে,
মেঘের ওপারে গিয়ে আমাদের দেখে নিতে হবে  
মেঘের পুত্রেরা কতটা নীলের ভার বইছে নরোম কাঁধে।

এই যে বাতাসে পাক খেয়ে 
পাথরে গড়িয়ে পড়লেন কবি 
সত্তুরের জ্বরাভার তুড়ি মেরে উঠে দাঁড়ালেন হাসতে হাসতে
এই ইতিবাচক উত্তেজনার নামই তো জীবন
হেঁটে হেঁটেই তো এ জীবন তুলে আনি 
প্রতিদিন প্রকৃতির অতল গহন থেকে।

হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০।

ওয়ান্টাগ পার্ক

পৃথিবী একটি গ্রন্থ, যে ভ্রমণ করে না 
সে এই গ্রন্থের কেবল একটি পৃষ্ঠাই পাঠ করে। – সেইন্ট অগাস্টিন

আমি তো পড়তে চাই পুরো গ্রন্থ,
সূচীপত্র, ভূমিকা, প্রিন্টার্স লাইনের
ঠিকানা ও মুদ্রকের নাম, সব।

শনিবার এসে যখন কাচের শার্সি ঠেলে
পায়ের ওপর ঢেলে দেয় ভোরের রোদ্দুর,
বেরিয়ে পড়ার উন্মাদনায় অস্থির হয়ে উঠি
এবং আরো যারা পাঠতৃষ্ণায় উন্মাদ, পৃষ্ঠা উল্টাতে অক্ষম,
তাদেরও তুলে নিই আমার উদ্দিপ্ত কাঁধে,
হেঁটে হেঁটে পার হই এক পৃষ্ঠা থেকে আরেক পৃষ্ঠায়।
দেখি অক্ষরের অনবদ্য
সাঁতার বার্লির পাতায়, ভূট্টার বিস্তৃত সবুজে।
চোখ মেলে আরো দেখি কি করে ঋতুচক্রের ইরেজার
মুছে দেয় পাতার সবুজ;
হেমন্ত হঠাৎ এসে কী এক ফুঁ দিয়ে
সহসা উড়িয়ে দেয় দাঁড়ি, কমা, যতিচিহ্নের বাহুল্য।
আবার কখনও দেখি ঝরে গেছে বাঙময় অক্ষরেরা,
বিমূর্ত অর্থের আলো-ছায়া বুকে নিয়ে
সহাস্যে দাঁড়িয়ে আছে
অর্থহীন যতিচিহ্নের সন্ত্রাস।

বাতাসেরা ঋতুর বিচিত্র রঙ মাখে বৃক্ষপত্রে,
গ্রন্থের পাতায় পাতায় বিমূর্ত ছবি
ক্ষণে ক্ষণে মূর্ত হয়ে ওঠে আপন প্রত্যয়ে।

গুগল-ম্যাপের সূচীপত্র সোল্লাসে ঘোষণা করে
ওয়ান্টাগ পার্কের পৃষ্ঠা-নম্বর
দৃষ্টির তীব্রতা নিয়ে ছুটে চলে যান্ত্রিক শকট।
বর্ণবাদ এখানেও হাত তোলে,
নিষিদ্ধ দেয়ালে বাঁধা পড়ে অদম্য উচ্ছ্বাস,
মানুষের স্বাধীনতা।
ছোটো যে শিশু, পাঠতৃষ্ণায় কেঁপে ওঠে গতির ভেতর,
সেও প্রশ্ন তোলে, সুন্দর কী করে
হয় কারো একার, বিশেষ কোনো সম্প্রদায়
বা পাড়ার অধিবাসীদের? 
কেনো ওয়ান্টাগ পার্কের বিশেষ ওই পৃষ্ঠাখানি 
কেবল ওরাই, যারা নাসাউ কাউন্টির অধিবাসী, পড়তে পারবে,
এটি কি তাহলে এক সত্য-গ্রন্থের নিষিদ্ধ পৃষ্ঠা?

নিষিদ্ধ ফলের জ্ঞান ফেটে পড়ে দ্রোহে,
দেয়াল ভাঙার বৃষ্টি
নেমে আসে বুদ্ধির আকাশ থেকে।
ঢুকে পড়ি নিষিদ্ধ পৃষ্ঠার ভেতরে, অক্ষর-শিল্পে।

বেলমোর ক্রিক থেকে একদল শ্বেতাঙ্গ পুরুষ টেনে তুলছে আনন্দ-পার্চ
নদীবক্ষে মুখ করে কোল পেতে বসে আছে
সারি সারি পরিচ্ছন্ন বেঞ্চ
প্রয়াত নামের মাহাত্ম ধারণ করে বুকে।
ডানকিনা মাছের কৈশোর
জলকিশোরীদের নামায় জলে;
সেই কাশফুল সারি
এখানেও স্যাঁতস্যাঁতে জলাভূমি-তীর ধরে
বিধবা-থানের মতো হেলেদুলে শরৎ নামিয়ে আনে।
একঝাঁক সবুজ টিয়ার ডানা দুলে দুলে
কি আঁকে পৃথিবী গ্রন্থের মধ্য-পাতায়
এই পড়ন্ত গ্রীষ্মের নরোম বিকেলে?

এখানে বিহঙ্গ ওড়ে নিয়মনিষ্ঠ দ্রোনের পাশাপাশি
জেলেরা যান্ত্রিক বোট থেকে ছুঁড়ে দেয়
মাছশিকারের নানাবিধ অস্ত্র
পথ থেকে কুকুরের বিষ্ঠা তুলে নেয় ধনকুবের স্বহস্তে
কেউ ছুঁড়ে দেয় না সোডার ক্যান
অথবা উচ্ছিষ্ট, কোনো খাবারের, ঘাসের সবুজে।
ওয়ান্টাগ পার্কের সবুজ পৃষ্ঠায় রচিত সুন্দর শেখায়
পরিচ্ছন্নতার গল্প,
যার পেছনের পাতা সমৃদ্ধির স্বর্ণালী শস্য-ভান্ডারে পূর্ণ।

পৃথিবী গ্রন্থের পাতায় পাতায়
রচিত গল্পের নানারঙে প্রতিদিন ডুব দিই
গভীরের থেকে আরো অধিক গভীরে,
অভিনিবেশের সঙ্গে পাঠ করি ক্রমাগত
লাল-নীল, হলুদের গল্প, সবুজ প্রবন্ধ,
কুয়াশার কোমল কবিতা, অলস ডানার 
গাংচিল পাখিদের প্রত্যহ ওড়ার উপন্যাস,
আর বাতাসের অনবদ্য ধর্মশ্লোক।

এই যে শেষ-গ্রীষ্মের কিছুটা শীতল হাওয়া উপেক্ষা করে
পুরো এক শনিবার করেছি রোপন 
ওয়ান্টাগ পার্কের নিবিড় জলে,
একশ এগারো একর ঘাসের গালিচায়,
এলোমেলো বেড়ে ওঠা হঠাৎ অরণ্যে,
এ-তো আর কিছু নয়
এক ভূখা পাঠকের পাঠতৃষ্ণা ছাড়া।

হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০।

ওয়েডিং রিভার

বনের ভেতরে রাস্তাটি দু’ভাগ হয়ে গেল, 
আমি সে-পথে পা বাড়ালাম যে পথে খুব কম পা পড়েছে 
এবং তা-ই ভিন্ন করে দিল সব কিছু। – রবার্ট ফ্রস্ট

ওয়েডিং রিভার স্টেইট পার্কের রাস্তাটি যখন দুভাগ হয়ে গেল
আমি সেই পথে বাড়ালাম পা, যেখানে পায়েরা সশব্দ।

কখনো কখনো নতুন আবিস্কারের চেয়ে 
আবিস্কৃত সুন্দরের পাশে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়, 
নৈশব্দের নিগুঢ় মগ্নতা ভেঙে বেরিয়ে আসতে হয়, 
ডুব দিতে হয় কোলাহলের গভীরে।

কোলাহলের ভেতরে যে হাজারো মানুষের মুখ,
বিচিত্র ধ্বনি-তরঙ্গ, সেখানে এমন কিছু আছে
যা নির্জনতার রহস্যকে চিনতে সাহায্য করে।

ওয়েডিং রিভার প্রকৃতপক্ষে একটি নির্জন লোকালয়, 
এটি কোনো খরস্রোতা নদী নয়।
এখানেই ওয়াইল্ডউড পার্কের ছ’শ একর জল-জঙ্গল, সমুদ্রের তটরেখা,
অতিকায় অশরীরী দানবদের সমাধিক্ষেত্র, 
সারি সারি গ্রেভস্টোন।
সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ থেকে গলে গলে নামছে সবুজ, জীবনের আলোবাহ।

পদগুঞ্জনের সরব প্রবাহে ভেসে ভেসে নেমে আসি নিচে,
এই ঢালু রাস্তাটি আমাকে হঠাৎ দাঁড়-করিয়ে দেয় বৃহত্তের মুখোমুখি 
জলের ওপরে আকাশ, নীলের সাথে লেপ্টে আছে নীল,
পাহাড়ের দেয়ালে আছড়ে পড়ে জলের গুঞ্জন,
নুড়িসম্ভারে সমৃদ্ধ তটরেখা।

শামুকের ফসিলে বাঁ কান পেতে শুনি এক জনপদের দুখের আর্তনাদ,
নুড়িপাথরে খুঁজতে থাকি প্রাজ্ঞ কচ্ছপের ডিম।
লুনেটিক – কেউ একজন গালি দেয়, 
পাহাড় তা পুনর্বার উচ্চারণ করে ভয় দেখায় আমাকে।

বাতাসে মৃত্যুর তাপ টের পায় বেপথু পাতারা
টুপটাপ ঝরে পড়ে সর্বংসহা মৃত্তিকার কোলে।

সৈকতে হাঁটছি বৃহৎ হবো বলে।

শুনেছি মানুষ সমুদ্রের কাছে এসে ক্ষুদ্র হয়ে যায়,
আমার তা হয় না কখনোই।
বরং সমুদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে আমিও ওর সহোদর হই, 
কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটতে থাকি
                    সকল ক্ষুদ্রতা মাড়িয়ে পায়ের নিচে।
মানুষ কি জানে সে কতোটা বড়ো?
সে কি কখনো দেখেছে ভেবে তার দেহের সুতোয় 
এ-পৃথিবী চারবার বাঁধা পড়ে?

চোখ বন্ধ করে দেখে নিই সমুদ্রের তলদেশ, 
ওপারের জিব্রাল্টার।
আমি শুয়ে পড়লে কি সমুদ্র হবো না?
গজিয়ে উঠবে না আমার দেহ থেকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অরণ্য?
আমি দাঁড়ালে কি 
পাহাড়ের ছায়া পড়ে না মুহূর্তে পৃথিবীর নাভীমূলে?
আমার দুচোখ থেকে কোন জল ঝরে পড়ে অন্ধকারে 
স্বচ্ছ ঝর্ণাধারা ছাড়া?

এই যে উড়ন্ত গাংচিল পাখিরা খবর দেয় উড়ে উড়ে আগমনী জাহাজের 
ওরা কি আমারই জামার পকেট থেকে বের হয়ে গেল না এখন?

কতো জল তুমি ধারণ করো হে বিস্তৃত জলধি?
কত-সহস্র নদীর বুক ভাসে তোমার বিপুল নুনে?
আমার দেহের খুনে নিয়ত প্লাবিত হয় এক লক্ষ মাইল নদীর বুক
জানো কি সে-গল্প তুমি?

হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০।

কাজী জহিরুল ইসলাম: কবি ও ঊনবাঙাল কর্মী, নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন