ননকোভিড রুবিনা ।। পান্থজন জাহাঙ্গীর

সারাদুপুর বৈশাখী রোদ মেখে পিসি রোড এখন ঝিমুচ্ছে। কোনো ব্যস্ততা নেই। দু’পাশের নিয়ন
লাইটগুলো জ্বলছে। মাঝে মাঝে কয়েকটি ট্রাক কিংবা কাভার্ড ভ্যানের ধুপধাপ আওয়াজে নিঃসঙ্গতায় কাঁপন তুলছে। অনেক দূরে কোনো লোকালয়ে দু’একটা কুকুর চিৎকার করে যাচ্ছে। এই শহরে কুকুরের এমন বিলাপ যুগান্তরে কেউ শুনেছে কিনা জানিনা।

মনে হয় সারাদিন কিছুই খেতে পায়নি। আকাশটাও কেমন গুমোট। তারমধ্যে কয়েকটি তারা মিটিমিটি জ্বলতেও দেখা যাচ্ছে। নিচে শহরের বাসাবাড়িগুলো নিষ্প্রাণ। জনমানব থেকেও যেন নেই। সবাই গোরখোদকের মতো লুকোচ্ছে –
আড়ালে,আবডালে জানালার ফোঁকর দিয়ে হয়তো তাকায়। কিন্তু বুঝা মুসকিল কার দৃষ্টি কোথায়।
আকাশচুম্বী দু’একটা বিল্ডিংয়ের কোনো কোনো এপার্টমেন্টের জানলায় ছোট্ট একটা কপাট খোলা।
হয়তো গৃহকর্ত্রী খুব সাহসী। নাহলে কি তোড়াই কেয়ার করে? আর যারা বেশি সচেতন তারা
জানলা বা বেলকনির কোনো ফাঁকফোকরও রাখেনি। একেবারে চাদর বা পর্দা দিয়ে এমন করে এটে দেয়া দিয়েছে যাতে বাইরের কোনো আলো বাতাসও গায়ে না লাগে। কেউ কেউ হয়তো ভীরুও বলবে তাদের। জমজম টাওয়ারের পঞ্চম তলায় ওমর আলীর ফ্ল্যাটটির জানলা শুধু ভিন্নরকম।
কারণ,পুরো জানলা খোলা। যেন কিছুই হয়নি দেশে।
চারতলায় দক্ষিণ ফ্ল্যাটে থাকে রাফানের পরিবার। বড় মেয়েটি আর ছোট্ট ছেলেটি হঠাৎ জেগে
উঠছে। তারা ঘুমিয়েছিল বেশিক্ষণ হয়নি। শিশুটিকে দেখে তার শিশু দুটিও চমকিত। রাফানের স্ত্রী প্রথমে এগিয়ে আসেনি। তাই শিশুটি হঠাৎ কোনো অপরিচিত পুরুষের পরিচর্যা পেয়ে আরো নিচুস্বরে কাঁদছে। রাফান তখন শিশুটিকে ডেটল পানি দিয়ে হাতমুখ মুছে দিচ্ছিলেন। তারপর পুরো শরীর। জ্বর-টর হলে আমরা যেভাবে মুছি। উদোম গা, শিশুটি শুধু একটি ট্ররাউজার পরিহিত।
উপরে র্স্কাট ছিল। ভিজে যাবে বলে খুলে ফেলেছে রাফান। কারণ,তারা যাওয়ার সময় শিশুটির জন্য
বাড়তি কোনো কাপড় দিয়ে যায়নি। শিশুটি কাঁদছে আর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। সেও বুঝতে
পেরেছে ভিন্ন পরিবেশ। তাই অতিরিক্ত চেঁচামেচি করছেনা। আর পাশের রুমে দরজার চৌকাঠের
নিচে নিরাপদ দূরুত্বে নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জাফরিন । পাহারারতও বলা যায়
কারণ,তিনি মনে-প্রাণে চাচ্ছেন এক পৃথিবী কৌতূহল নিয়ে যারা তাকে অনবরত প্রশ্ন করে যাচ্ছে তারা যেন এই অচ্ছুৎ শিশুটির সংস্পর্শে না আসে।

[দুই]

মেয়েটির আবার জিজ্ঞাসা, আব্বু তাকে পরিস্কার করছে কেন আম্মু? ও কাদঁছে কেন আম্মু ?
এবার ছেলেটি বলল, ও কি ভাত খায়নি আম্মু? নিজের শিশুদের এসব প্রশ্নে মা মহা বিরক্ত। তাই
জাফরিন দাঁত দাঁতে লাগিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। যেন সব দোষ রাফানের কিন্তু রাফানের কোনো টু
শব্দও নেই। ভাবটা এমন যেন যতই রাগ দেখাক জাফরিন এই মুহুর্তে মাথা ঠান্ডা রাখাই
বুদ্ধিমানের কাজ। তাই বলে কি বিল্ডিংএ কেউ রাখতে চায়নি এরকম একটা শিশুকে রেখে সে কি আপদ ডেকে আনবে? তাহলে আর এত পরিস্কা-পরিচ্ছন্নতা কার জন্য? দিন-রাত এতো গতর খাটুনি কার জন্য? জাফরিনের প্রশ্নগুলো সরব হয়না।
মেয়ে শিশুটি অনবরত কেঁদে যাচ্ছে। হয়তো সেও বাসায় ঘুমিয়েছিল। হঠাৎ জাগরণে শিশুরা মা-
বাবার সামনেও কাঁদে। আর এখন অপরিচিত লোকজন দেখে আরো কুঁকড়ে গেছে সে। মাঝেমাঝে জাফরিনের দিকে তাকায় সে। কিন্তু তার চেহারায় প্রশ্রয়ের কোনো আভাস নেই। তাই ধোয়ামোছা শেষে বেসিনের পাশ থেকে কোনোভাবেই সরাতে পারছেনা শিশুটিকে। কখন থেকে বেঁকে বসে আছে।
পাশের রুমের দরজার অড়াল থেকে জাফরিন টিপ্পনী কাটল, ‘এবার মজা বুঝো।কতোবার বলছি না রাখতে,দরোজা না খুলতে অথচ কানেও নিলে না।’ রাফান কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সে বুঝে শুধু এই মুহূর্তে তার জাফরিন বেগমের সাহায্য খুব দরকার। কারণ, পুরুষদের চেয়ে
মহিলাদের কাছে বাচ্চারা হার মানে বেশি। শিশুটি একটু একটু কথা বলা শিখছে। সম্পর্কবাচক
শব্দগুলো স্পষ্ট । বাকিটা অস্পষ্ট বা পারস্পরিক। তাছাড়া এতো রাতে শিশুকে ধোঁয়ামোছা করলে
তো জ্বর সর্দিও হতে পারে কিন্তু না করে উপায়ও নেই। এই অবস্থায় এ রকম একটা শিশু ঘরে
রাখাও ঝুঁকিপূর্ণ।

[তিন]
শিশুটি এখনও আতংকগ্রস্ত কারণ,ভুতগুলো বারবার তার বাসাতেই আসছে। চারদিন আগে তার বাবাকে নিয়ে গেল তারা। আজ আবার মা ও তার অন্য ভাই-বোনদের। তার কিবা দোষ সবাই তাকে এভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো কেন? তাই একবুক অভিমান নিয়ে ফুঁসে উঠছে সে।মুহূর্তেই অচেনা পরিবেশে কারোর আপন হওয়ার অভিনয় শিশু তো নয় বড়দের পক্ষেও অসম্ভব । হয়তো এই ভেবেই জাফরিন বাধা দিয়েছিল। কিন্তু কি করবে রাফান?এই মুহুর্তে বেঁচে থাকাটাই জীবন।
জীবনের আর কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। তার নিজেরও দুটি শিশু। কাকে সামলাবে সে?
হয়তো এই শিশুটিকে এটা ওটা দিবে। নিজের বিছানায় নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিবে।এ করতে করতে
বাকি রাত পার করে দিবে-এটাই ভাবছিল কিন্তু তারপর?
লাল রঙের কাঠের ওয়্যারড্রবের উপরের থাকে লুকানো আছে চারপাতা সিভিট, পুলিশকে ফাঁকি
দিয়ে লকডাউনে বের হয়ে চোরের মতো পা ফেলে কিনে নিয়ে আসা ছোট্ট ছেলেটার বায়না বা
ফ্রিজের ভেতরে সংগ্রহে রাখা শরবতের মোসাম্বি,ইফতারের পরান জুড়ানো টাটকা তরমুজ,উপরে লুকিয়ে রাখা চকলেটের বয়াম আর লেক্সাস বিস্কুটের কাটন। এগুলো ছাড়া চলেনা তার শিশুদের।
রাফান ভাবছে হয়তো তুলে রাখা এই এসব থেকে বের করে আনবে সাময়িক শিশুভুলানো কোনো
না কোনো পদের নাস্তা। এই সব খাবার রাফানের ঘরে দোকানের মালের মতো এখন পড়ে থাকে।
চকোলেট,বিস্কুট,সিভিট,মন্ডা মিটাই,ললিপপ,মাকড়ির ডিম,সুইটবল ইত্যাদি চাট্টা-মাট্টা এগুলো কোনোটি হাতে নিয়ে রাফান পালিয়ে যায় শৈশবের স্বপ্নের দোকান থেকে। কি লোলুপ দৃষ্টি তার। বয়ামে বয়ামে সাজানো সাজু বেপারীর এই শিশু পাগল করার দোকান। রাফান দাঁড়িয়ে আছে তার বড় বোনের সাথে। একছটাক সরিষার তেল মাপছে সাজু বেপারী। এর মধ্যেই ছোঁ মেরে একটা মিটাই নিয়ে পালিয়ে গেল সোজা ঘরের দিকে। তারপর পেছনে রব উঠে ‘‘ধর ধর ধর…।’’
আহা! মিটাই। এতো লোভ! কিন্তু লজ্জায় লজ্জাবতির মতো কুঁকড়ে যায় বড় বোনটা! তারপর ঘরে মায়ের শাস্তি আর বাইরে তিরস্কার। কি লজ্জা! কি লজ্জা!! কি অবুজ চুরি!!! আজ তার শিশুদের জন্য দোকানের মতো সাজিয়ে রাখে সে এসব পন্য। শিশুটির হাতে একটি চকোলেট তুলে দিল রাফান।
তারপর বিছানায় তার পাশে শুয়ে দিল তাকে। কান্না থামছে। কিছুক্ষণ পরপর শিশিুটির দীর্ঘশ্বাসে
নরাফানের চোখ ভিজে যায়। সে ভাবে যদি বিপদটা তার পরিবারে ঘটতো? তখন কি হতো?
রাফান শিশুটির কপাল টিপে দিচ্ছে,মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। একটা স্বভাবসুলভ চুমু, বাসনার
দেয়াল ডিঙাতে পারছেনা শুধু ।

[চার]
শেষরাতে শিশুটি আবার ডুঁকরে কেঁদে ওঠে। বিরক্ত হয় রাফান, ভাগ্যিস কাল কোনো অফিস নেই।
চাইলে দিনেও ঘুমানো যাবে। ছেলেমেয়েদেরকে স্ত্রীর সাথে ঘুমাতে দিয়েছে। তাদের চোখেও ঘুম নেই।
মাঝে মাঝে বড়টি উঠে এই বাবার রোমের দরজায় এসে উঁকি দিয়ে যায়। তার চোখে বিরাট
কৌতুহল। এ কৌতুহল মিটছেনা আপাতত। রাফান ভাবছে এই মুহূর্তে তার ছেলেমেয়েদের একসাথে
রাখতে পারলে হয়তো শিশুটি কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হতো। কিন্তু তিনি সাহস পাচ্ছেন না।
জাফরিন ভয়ে দক্ষিণে বেলকনির ফাঁক-ফোঁকর পর্যন্ত পর্দা বা কাপড় দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে।
সুতরাং তার কাছে এই আবদার রাখে কেমন করে? রাফানের বুকটা দুরুদুরু করে। কিভাবে বলে
সে তার স্ত্রীকে অথচ এমন হলে বেশ মানবিক হতো। আর এখন বিরোধী শিবিরে রাফান শত্রুর
মতো শিশুটি কে নিয়ে সে রাত যাপন করছে।
ওদিকে জাফরিনের বিরক্তির শেষ নেই। একদিকে অফিসের বসের প্যাদানি। অনলাইন অফিস করতে
হচ্ছে। আজকে এটা দিতে হবে। কাল ওটা লিখতে হবে। এটা হয়নি, ওটা হয়নি ইত্যাদি নানা
গ্যানজ্যাম। মোবাইলে একের পর এক রিং আর মেইলের পর মেইল।বসের উপর জাফরিনের
অভিসম্পাত এরচেয়ে অফিস খোলা থাকলেই ভালো হতো৷ অন্যদিকে ঘর গোছানো,নিয়মাফিক
পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা। নিজের ছেলেমেয়েদের সামালাতে হিমশিম খেতে হয় নিয়মিত। তার উপর উটকো এক ঝামেলা আগুন্তুক শিশুকে নিয়ে।

সকালে দুধ গরম করে দেয় শিশুটিকে। আলাদা বাথরুমে শৌচকার্য সারায়। আলাদা মগ, বালতি,
সাবান আবার বিছানা,তাই এই বন্দিদশা আর ভালো লাগছেনা তার । একরাতেই একইঘরে যেন
আলাদা আরেক সংসার শুরু হয়ে গেল। হোসনা বলল,‘‘তুমি এখনই ফোন করো ওসি সাহেবকে।
আমি আর পারছিনা। আমাকে মুক্তি দাও।’’
পুলিশের নাম শুনেই শিশুটি আবার ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল। গায়ে শাদা পিপি, মুখে মাস্ক,
চোখে শাদা গগলস, হাতে গ্লাভস আর পায়ে বুট জুতা যেন মায়ের সাথে ঘুমিয়ে শুনা গল্পের ভুত।
রাজ্যের ভয় নিয়ে তার সামনে হাজির। রাতে এসে তার বাবা মা, ভাই বোন কে ধরে নিয়ে গেছে
ভুতগুলো। থানা পুলিশের নাম ধরতেই তাই শিশুটির কান্নার গমক আবার বেড়ে গেলো। রাফান কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। ফ্রিজ থেকে তরমুজ বের করে ফালি ফালি করে কেটে দিল। না শিশুটি কিছুতেই খাচ্ছে না। বয়াম থেকে চকোলেট তুলে দিল, তাও নিচ্ছে না। ওয়্যারড্রব থেকে সিভিট এর পাতা বের সিভিট খুলে গালে পুরে দিল। এবার এবার শিশুটি কান্না থামল। রাফান বলল,‘‘কেঁদো না আব্বু,গ্রামে তোমার মামাকে ফোন করছি এখনই চলে আসবে। তুমি চলে যেতে পারবে।’’এতোক্ষণ নুরুল ওাফানের ছোট্ট ছেলেটি খানিক দূরে দাঁড়িয়ে শুনছিল। অপরিচিত কোনো মানব শিশুকে আব্বা সম্বোধন শোনার পর শিশুটির মধ্যে ঈর্ষার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে।
তাই রাত থেকে মায়ের বাহুবন্ধনে থাকা ছেলেটি এক লম্ফে বাবার কোলে উঠে বসে, হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।
অচ্ছুৎ থাকা গেলনা আর শিশুর সাথে শিশু মিশে গেল। এদিকে জাফরিনের চেহারায় আষাঢ়ের
কালো মেঘ। তার সারারাতের অচ্ছুৎ থাকার চেষ্টা সকালে ভেসে গেলো। তাকে দেখে রাফান বুঝতে
পারছেনা হাসবে না কাঁদবে। তবে কিছু দৃশ্যপট বারবার হানা দিয়ে যায়। নিরবতার দেয়াল ভেঙে
সাইরেন বাজাতে বাজাতে এম্বুলেন্সটি মেইন রোডে থামে। সেই রাতে আকাশে ধুসর চাঁদ ছিল। চাঁদের
আলোতে নিচে সারি সারি কয়েকটি বস্তির জংধরা টিনের চাল বাতাস টেনে নিচ্ছে। অন্যদিন এ
সময়ে তাদের ব্যস্ততার শেষ থাকেনা। কমলা ও হলুদ রঙের বস্তির খুপরি ঘরগুলোর কোনোটার
দরজা খোলা নেই। জানলা দিয়ে সবাই উঁকি মারছে। বস্তি ও বিল্ডিং এর মাঝে তাদের চলাচলের একটা সরু রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে চারজন লোক চলে আসলো। পরনে শাদা বেশ। মাথা ও চোখ পর্যন্ত ঢাকা। একজনের হাতে হ্যান্ড মাইক। মেইন রোডে গাড়িটি থামা মাত্র ঘোষণা দিল ,‘‘ জমজম টাওয়ারের ওমর আলী নিচে নেমে আসুন।’’ হঠাৎ চারদিকের বিল্ডিংয়ের বেলকনিগুলো ছায়ামূর্তিতে ভরে গেলো। আগ্রহ কোন ওমর আলী? ঘোষণা শুনে সবার বুক ধুকপুক করছে। সরু রাস্তার আমগাছের নিচ দিয়ে কিছুক্ষণ পর একজন একজন করে জমজম টাওয়ারের গেটে এসে দাঁড়াল তারা। মাইকে আবার ঘোষণা,‘‘দয়া করে নিচে নেমে আসুন। আমরা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছি।
আপনি নিচে নেমে আসুন।’’এ বলে গেইটের অদূরে একটি খুপরি ঘরের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ওসি। দিদারের দোকানের ঝাঁপি বন্ধ। মালামালগুলো বিস্রস্তভাবে পড়ে আছে। হাঁটার বা বসার কিংবা দাঁড়িয়ে থাকারও কোনো জায়গায় নেই। শুধু ছোট্ট চকির মধ্যে বিছানো পুরানো একটা কাঁথা আর তার মধ্যে পড়ে থাকা একটা মলিন বালিশে মাথাটা ফেলে চোখ বন্ধ করে থাকা
ছাড়া। এর মধ্যেও কষ্ট করে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে সে। দোকানের সরু চিদ্র দিয়ে ট্যাঁরা
চোখে তাকায় সে। ওসি হারুনের পকেটে নেভী ব্লু নেমপ্লেটে শাদা লেখা ‘‘কাজী হারুন ’’ তার
চোখ এড়ায় না। নেমপ্লেটের আড়ালে সে দেখছে বিগত সন্ধ্যায় ওমর আলি তার দোকানে বসে চা-
সিগারেট খাচ্ছে। তার এই ভয়ের সাথে এখন একরাশ ঘৃণাও যোগ হয়েছে। চারদিকে বন্ধ থাকার
সুবাদে ভালোই চলছিল দিদার। হয়তো কাল থেকে এই এলাকায়ও লকডাউনের সিল মারা হবে সাথে
তার কপালেও। কিন্তু এটা তেমন উদ্বেগের বিষয় নয়, বিষয় হচ্ছে এখন ওমর আলী ও তার
পরিবার। এই উদ্বেগ শুধু দিদারের নয়, পুরো মহল্লাবাসীর। তাই বাড়িওয়ালা খাটের নিচে লুকিয়ে
থাকে! তার পরিবর্তে বাড়িওয়ালি মাথায় হিজাবপরে বসে আছে দরজার পাশে। কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে কলিংবেল টিপলে অজুহাত প্রস্তুত, ‘‘ওনি বাড়িতে নেই। আমি মহিলা মানুষ হাঁটতে পারছিনা। আপনারা পাঁচতলার ডানে একশত এক নম্বর এ যান। ওইটাই ওমর আলীর বাসা।’’
‘‘ওরা দরজা খুলছেনা,তাদের কোনো সাড়াশব্দও নেই। প্লিজ আপনার একটু আসা লাগবে।’’ বাড়ি
ওয়ালী তার কাছে রাখা অতিরিক্ত চাবির গোছার সদ্ব্যবহার করলেন। দরোজা খুলে পুলিশ দেখে
ডাইনিং রোমে একা দাঁড়িয়ে ওমর আলী । পরনে একটা শাদা শার্ট ও লুঙ্গি। বামহাতে একটা
পুটুলি। কপাল থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে। অন্যান্য রোমের দরোজাগুলো সব বন্ধ। পুলিশ দেখে ওমরআলী থরথর করে কাঁপছে। চেহারায় রাজ্যের অন্ধকার। কি চিন্তা করছে ওমর আলী? মৃত্যু বা কবর? যদি এর বিপরীত চিন্তা করে তাহলে তো তাকে গুজগাছ করতেই হয়। কোথায় যাবে ,কি কি লাগবে? তার একটা তো প্রস্তুতি নিতেই হয়। কিন্তু একরাশ হতাশা তার পা অচল করে দেয়।
তাকে যেন কেউ মহাযাত্রার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পিপি পরা পুলিশের লোকগুলো যেন যমদূত।
হাসপাতালগুলো যেন এক একটা শ্বশান। শ্বশান যেন তাকে চিৎকার করে ডাকছে,কালুঘাটের বাসের মতোই যাত্রির অপেক্ষায় খাটিয়া! অপনজন সবাই যেন দূরে সরে যাচ্ছে।‘‘আপনার সমস্যা কি?
আমাদের দেরি করালেন কেন? আপনি এখনও দাঁড়িয়ে আছেন? বের হন বলছি, তাড়াতাড়ি
গাড়িতে ওঠেন। এখন তো আমরা জামাই আদরে নিয়ে যাচ্ছি । কিছুদিন পরে দেখবেন মরে
ভাগাড়ে পড়ে থাকলেও সরানোর লোক।থাকবেনা।’

[পাঁচ]
ঘোর কাটলে ওমর আলি পা বাড়ায়। পুলিশের বকা শুনে এবার ভেতর থেকে সবাই বের হলো।
সবাই কাঁদছে। হয়তো মৃত্যুর আগাম বিদায় জানাচ্ছে ওমর আলীকে। যেদিন মরবে সেদিন আর কাঁদবে না কেউ। দেখতেও আসবেনা কোনো স্বজন। হয়তো শাদা কাফনও মোড়ানো হবে না গায়ে,জানাজা হবেনা, আসবে না কেউ, কেউ আসবে না। হয়তো এই দেখাই শেষ দেখা। শেষ যতই দেরী হয় ততই শোক প্রগাঢ় হয়, রঙিন হয়, বিরহ উতলে উঠে। কিন্তু পুলিশ তো আর যমদূত নয়। তারা ত্রাতা হিসেবে এসেছে। সুতরাং তাদের কর্তব্যে দেরি হওয়া বড়ই অমঙ্গল। নিচ থেকে আবার হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দিল ‘‘ তাড়াতাড়ি নেমে আসুন। দেরি করা কারোই জন্য ভাল হবে না, তাড়াতাড়ি নেমে পড়ুন।’’ অবশেষে কনস্টেবলদের সাথে নেমে পড়ল ওমর আলী। হাতে পুটুলিটি নিয়ে উপরের দিকে তার রহস্যময় দৃষ্টি। প্রত্যেক তলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিগুলো রহস্যের পর্দায় ছায়া ফেলে। তারাও পাথর চোখে দৃষ্টি ফেলে ওমর আলীর উপর কিন্তু এই দৃষ্টি কি
ভালোবাসার? না ঘৃণার? হয়তো তার কৌতুহল সেইসব দৃষ্টি রাখা থাকা জীবদের প্রতি।
এক সপ্তাহ পর আজ একই ট্রাজেডি। ভিন্নতা শুধু একটাই ঐ দিন ওমর আলীর জন্য চারজন শোক
করেছিল কিন্তু আজ কোনো শোক নেই, মাতম নেই। সবাই একসাথে যাচ্ছে। তাই আজ দেরি
হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তারপরও কেন এতো দেরি? অবশেষে ওসির ঝাঁঝালো কন্ঠের তারগুলোর কম্পন কর্কশ হয়ে উঠে,‘‘এতো দেরি হচ্ছে কেন?’’ তখন কনেস্টবল কাবিল ধীর পদক্ষেপে নিচে নেমে আসে। তার তালু বন্দি হয়ে আছে চরম উৎকন্ঠায় হতবিহবল বছর চারেক বয়সের একটা মেয়ে। সে বলল,
‘‘জি স্যার,বাসায় নন কোভিটও একজন আছে। কিন্তু তাকে রাখার কেউ নেই । এই জন্য দেরি
হচ্ছে স্যার ’’
‘‘মানে?’’
‘‘মানে,ওই পরিবারের একমাত্র শিশু রুবিনা ছাড়া নন কোভিড আর কেউ নেই।’’ পাশের ফ্লাটের
কোনো প্রতিবেশিও মেয়েটিকে রাখতে চাচ্ছে না স্যার। আমরা অনেক রিকোয়েস্ট করেছি স্যার।’’
‘‘হুম,এতো ভারি সমস্যা। আচ্ছা তোমরা এ চার জনকে এম্বুলেন্সে উঠাও। আমি দেখছি ব্যাপারটা।’’
ওসি হারুন রুবিনার হাত ধরে জমজম টাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে। ভালো মানুষের সন্ধান করা
পুলিশের কাজ নয়। তবুও তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উপরের দিকে দৃষ্টি রাখে। তার চোখ দুটো
টাওয়ারের উপরের তলার দিকে না আকাশের দিকে ঠিক বুঝা যাচ্ছেনা।

পান্থজন জাহাঙ্গীর : কথাশিল্পী।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন