আহমেদ মনসুর
উপন্যাসের কী সংজ্ঞা হতে পারে; এ নিয়ে আলোচনা এন্তার। সময়ের সাথে আরও আলোচনা এগুতে পারে। সময়ের বাঁক পরিবর্তনের সাথে এর চরিত্র পাল্টাবে, আকার বা প্রকার পাল্টাবে, পাল্টাবে তার গঠনরীতিও। তবে এখানে এটুকু বলতে পারি- সমাজ বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে মানবজীবনের বড় একটা দিক বিস্তৃত পরিসরে আলোচিত হয় যেখানে, অনেকগুলো উপগল্পও মিলিত হতে পারে এসে মূল গল্পের মোহনায়, ভাবের পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে, আবার নাও ঘটতে পারে। ঘটলে সেটা মিলনের মধুর আবহেও হতে পারে, আবার হতে পারে দুঃখজাগানিয়া শোকের।
‘কবি ও রহস্যময়ী’ কোন ধারার উপন্যাস? বাংলা সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক বোদ্ধারা এর রুপ-রস-বৈশিষ্ট ঘেঁটেঘুঁটে বের করুক, এরপর সুচিন্তিত আর উচ্চমার্গীয় ব্যাখ্যা দাঁড় করাক। আপাতত পাঠানুভূতিটাই শুধু প্রকাশ করি এই পরিসরে।
ইতিহাসের অপ্রকাশিত, অথচ সাহিত্যানুরাগীদের কাছে তুমুল আগ্রহের একটি বিষয়কে আকর করে গল্পের ছলে আলোকপাত করার চিন্তা থেকেই যে এ উপন্যাসের জন্ম, পাঠ শেষে তা পরিষ্কার।
উপন্যাসটি দাঁড় করাতে লেখককে গলদঘর্ম হতে হয়েছে বুঝা যায়। বহু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়েছে। মেলাতে হয়েছে একটি সূত্রের সাথে অন্যটির। উপাত্তের উৎসগুলোর সন্ধান পেতেও হয়তো সময় আর শ্রম দুটোই ব্যয় করতে হয়েছে সমানে। কারণ এর চরিত্রগুলো লেখকের কলমের ডগায় সৃষ্টি হয়নি যে মনমতো নির্মাণ করবেন। বাংলা সাহিত্যাঙ্গনের চেনাজানা মুখ সব। বিখ্যাত এবং বহুল আলোচিতও বটে। যে প্লটের উপর কাহিনির বিস্তার তাও অলীক নয়, এখানেও লেখকের কলম পরাধীন। তাঁকে এগুতে হয়েছে সাবধানী চালে, আশ্রয় প্রার্থী হতে হয়েছে ইতিহাসগ্রন্থের কাছে। বলতে হয়- এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার ঝোলাটাও তাঁর একেবারে শূন্য।
এত সীমাবদ্ধতা স্বত্ত্বেও লেখক এগ্রন্থ রচনায় অসাধ্য সাধন করেছেন বলা যায়। কবি কাজী নজরুল ইসলামের বৈচিত্র্যময় প্রেমের ইতিবৃত্ত, তাও গেল শতাব্দীর গোড়ার কাহিনি। এনিয়ে প্রবন্ধ হতে পারে, হতে পারে অনুসন্ধানী দীর্ঘ আলোচনা। তা বলে উপন্যাস! তাও ১৯০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ পরিসরে ব্যাপৃত। এ সত্যিই খুব দুরুহ কাজ বটে। উপন্যাসিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী তা করেছেন। ইতিহাসের বাস্তব সত্যের সাথে শক্তিশালী কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়ে লেখক অনন্যসাধারণ এক ব্যঞ্জণ তুলে দিয়েছেন পাঠকের পাতে।
মোহন বাঁশির সুরের মতো পাঠককে টেনে নিয়ে যায় এক পৃষ্ঠা থেকে অপর পৃষ্ঠায়। ভাষা অত্যন্ত গতিময়। শব্দ নির্বাচনেও লেখক যথেষ্ট রুচিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। উপমা আর শৈলীতে এতটা অলঙ্কারসমৃদ্ধ পাঠকের মনে বিন্দুমাত্র বিরক্তির উদ্রেগ ঘটায় না। শব্দের পিটে শব্দ চাপিয়ে বাক্যগুলো অভিজ্ঞ চাষার মতো এমনভাবে বুনেছেন পাঠকের অন্যত্র দৃষ্টি ফেরানো কঠিন।
‘তক্তপোশেই যবুথবু হয়ে বসলেন কবি। কিছুটা তফাত রেখে বসল ফজিলতও। নিঃশব্দে কেটে গেল কয়েকটা মুহূর্ত। কবি নীরব, কিন্তু ভেতরে একটা অস্থিরতার তোলপাড় যে চলছে তাঁর মনে, দুহাত ব্যবধানের দূরত্বে বসেও তা বুঝতে পারে ফজিলত।’ পৃষ্ঠা- ৫১।
‘যে যক্ষ রাজকুমারীকে সাত সমুদ্দুর তের নদীর পারে পাষাণ-পুরীতে সোনার খাটে শুইয়ে রাখলে, তার অতি স্নেহকে কি দেবত্ব বলে ভুল করবে। হয় তাকে মেরে ফেল, কিংবা ছেড়ে দিয়ে বাঁচতে দাও। যাদুতে ঘুমিয়ে রইল বলেই রাজকুমারী হয়ত যক্ষকে অভিশাপ দিলে না, হয়ত বা দেবতাই মনে করলে!’ পৃষ্ঠা- ৯৫।
উপন্যাসের পরতে পরতে টান টান উত্তেজনা কিংবা নাটকীয় মোচড়গুলো সত্যিই লক্ষ করার মতো। পাঠককে শেষাবধি টেনে নিয়ে যাওয়ার অনন্য দক্ষতা এর রয়েছে। এ উপন্যাসে সফল উপন্যাসিক হিসেবে লেখক তাঁর জাত চিনিয়েছেন। সমসাময়িক অন্যান্য কথাসাহিত্যিকদের মতো ধোঁয়াশাচ্ছন্ন ভাষার আশ্রয় নিয়ে নিজের দুর্বলতা আড়াল করবার চেষ্টা তাঁর ছিলো না। বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর আর মানিকের উপন্যাসের মতো স্বচ্ছ, ঝরঝরে আর নির্মেদ গদ্যে আখ্যান বর্ণনায় মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।
অজানা তথ্য হাজির করে পাঠককে চমকে দেওয়া কিংবা জ্ঞান দান করা লেখকের উদ্দেশ্য ছিলো কিনা জানি না, তবে নিছক মনোরঞ্জনের নিমিত্তে যে এটি রচিত হয়নি তা পরিষ্কার। এখানে কিছুটা দর্শন, বড় একটি অংশ জুড়ে প্রেমের মোড়কে কবিমনের উন্মাদনা, কিছুটা পাগলামো আর বেশিরভাগটা জুড়ে সময়ের একটি বিশেষ চরিত্র অঙ্কনের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে। এসবকিছুকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে- সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশে একা একজন নারী কিভাবে সংগ্রাম করে নিজের মেধার পরিচয় তুলে ধরেছে, সেটাই।
গ্রামের এক স্কুল শিক্ষকের মেয়ে ফজিলাতুন্নেছা। আর দশজন গ্রাম্য মেয়ের মতো তারও ভাগ্য নির্ধারন করে রেখেছে তৎকালীন সমাজব্যবস্থা। সে তাল ও কেটে দিয়েছে আপন মহিমায়। মাঝখানে ওর জীবনালেখ্যের ডালে কোকিলের মতো ছন্নছাড়া এক পাখি; কবি নজরুল এসে সুর তোলেন প্রেমবীণায়। ফজিলাতুন্নেছা কিছুটা বর্তে যায় বৈকি, মুহূর্তে মোহভঙ্গ হয় আবার। সাবধানী মন তাকে সতর্ক করে। এ যাত্রায় ওর পিতৃতুল্য শিক্ষক নলিনীমোহনের অবদানও ব্যাপক। কবিবন্ধু কাজী মোতাহার হোসেন যেন দোদুল্যমান একটি সেতু।
পরিশেষে পরিণতির মধুর সানাই এখানে বাজে না। আবুল বাশারের ‘ফুলবউ’ এর মতো মধুর ট্র্যাজেডিতে রুপ নেয় কবি ও রহস্যময়ীর প্রেম। তবে থেকে যায় অনেক প্রশ্ন। সচেতন পাঠকচিত্তে সেসব প্রশ্নের দোলাচল থেকে যাবে আবাদুল আবাদ।
আলোচ্য উপন্যাসে যা পাওয়া যায়, আর যা পাওয়া যায় না:
১. পিছনে ফিরে তাকিয়ে কবি নজরুলের অমীমাংসিত প্রেমের একটি অধ্যায়ের চিত্র পাওয়া যায়। কবিচিত্তের ব্যাকুল উন্মাদনা, ভালোবাসার চিরকাঙাল, প্রেমপ্রার্থী, অথচ প্রত্যাখ্যাত অসহায় একজন প্রখ্যাত কবির আলোকিত জীবনের অন্ধকার দিকটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। চাঁদের কলঙ্কের যেমন।
২. তৎকালীন সমাজের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি। সমাজের উচ্চশ্রেণির অনেকেই চিন্তার দিক দিয়ে ততটা অগ্রসর হতে পারে না। অদৃশ্য কোন এক রশি টেনে রাখে যেন পিছনের দিকে। নারীর উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে কেউ কেউ ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এলেও অনেকে তা মানতে পারেন না। নারীমুক্তির কথা কাব্য-বাণীতে উল্লেখ করলেও স্বয়ং নজরুলও মনে করেন- নারী কেন গণিতের মতো কঠিন বিষয়ে পাঠ নিয়ে কঠোর হয়ে উঠবে? সে তো প্রেমময়ী।
৩. বাংলা নবজাগরণের যুগ। সবক্ষেত্রে বাঙালির বিকাশ ঘটার উন্মেষকাল। অথচ একা একজন নারী যখন এগুতো চায় আপন মহিমায়, তখন লিঙ্গবৈষম্য বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। পদে পদে আটকানোর চাল।
৪. সমস্ত বিপত্তি জোর পায়ে ঠেলে মনোবল আর মেধার উপর ভর করে চাইলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। তখন একজন নলিনীমোহন স্যার, একজন ‘সওগাত’ সম্পাদক নাসিরউদ্দিন উত্তাল তরঙ্গে সঙ্গী হয়ে পাশে এসে দাঁড়ায়।
৫. যত যাকিছু এগুনোর প্রত্যয় থাক, নজরুলের মতো দক্ষ প্রেমসাধকের প্রেমনিবেদনকে পায়ে ঠেলা কঠিন, কিছুটা প্রশ্রয় দিতে হয় অবচেতনে।
৬. কবির ভেতর পাগলামো না থাকলে সাহিত্য তার সঠিক জায়গা পায় না। উপন্যাসে উল্লেখিত নজরুলের একটি বক্তব্য অনেকটা এরকম- কবির স্থান হয় সাধারণের অনেক উপরে, নয় অনেক নিচে। হয়তো নিচেই হবে। মণিমুক্তোর সৌন্দর্য নাহয় সে তুলে ধরে কি করে।
৭. নজরুল সীমাহীন আবেগপ্রবণ একজন কবি। আবেগের জোয়ারে ভেসে যখন যা ইচ্ছে লিখেছেন, করেছেন। সাহিত্য সৃষ্টির বিরল এক ক্ষমতা নিয়ে জন্মালেও যুক্তিনির্ভর চিন্তা করার ক্ষমতা তাঁর ছিলো না কোন কালেই। সাহিত্যে আবেগ থাকবে, তবে আবেগের জোয়ারে ভেসে যেতে পারবে না। নজরুল সারাজীবন তাই করেছেন।
৮. সমাজ বাস্তবতার প্রকৃত রুপ, তথা ধর্মীয় প্রশ্চাৎপদতা আর নারীর অবমূল্যায়নের বিষয়টি বাদ দিলে সমাজের অপরাপর; তথা সে সময়ের সমাজ কাঠামো, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কথা, এতদবিষয়ে সাধারণ মানুষের চিন্তা কিংবা মনোভাবের কোন চিত্র আলোচ্য উপন্যাসে আমরা পাই না।
৯. শরৎচন্দ্রের আবেগধর্মী উপন্যাসের প্রচ্ছন্ন ছায়া এখানে স্পষ্ট। পাঠকের অনুভূতিতে ঘা দেওয়া, জাগ্রত করা গিয়েছে দারুণভাবে, কিন্তু পিছনে ফিরে তাকিয়েও পিছনের সমস্ত দেখা হয়ে ওঠেনি। একটা মাত্র শ্রেণির কথা ঘুরেফিরে আলেচিত হয়েছে। বাকি মানুষের কথা, বাকি বিষয়ের কথা সেভাবে ওঠে আসেনি।
১০. বর্তমান সমাজবাস্তবতার সাথে এ উপন্যাসের কোন যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। সফল অতীতচারীতা হয়েছে। সার্থক মধুর ট্রাজেডি হয়েছে। কিংবদন্তির আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এসময়ে এর প্রাসঙ্গিকতা কি? এসময়ের কবিরা কি নজরুলের মতো আচরণ করে? এসময়ের মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার পথে সংগ্রামটা কি ফজিলতের মতো?
রোমান্টিসিজমের ঘোর অকালে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যুগে প্রায় শতবর্ষ পিছনে ফিরে গিয়ে, বর্তমানের ছোঁয়া বাঁচিয়ে কিংবা যোগসূত্র স্থাপন না করে আখ্যানধর্মী প্রেমকাহিনি কালোত্তীর্ণ উপন্যাসগুলোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে কিনা সেটা ছেড়ে দিতে হয় কালের বিবেচনায়।
কাজী নজরুল ইসলামের প্রেমকাহিনি নিয়ে রচিত লেখকের উপন্যাস ‘নার্গিস’, ইতিমধ্যে পাঠকের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। নজরুলের বৈচিত্র্যময় প্রেমের আরেকটি অধ্যায়ের উপর নির্মিত উপন্যাস ‘কবি ও রহস্যময়ী’, গতিময় ভাষায় অঙ্কিত নিটোল গল্প, নিঃসন্দেহে পাঠককে মোহগ্রস্তের মতো একটানা পড়ে যেতে হবে। এরমধ্যে পাঠকের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে উপন্যাসটি।
[উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। প্রচ্ছদ করেছেন মাসুক হেলাল। মূল্য রাখা হয়েছে ৩৫০ টাকা। প্রকাশিত হয়েছে জানুয়ারি ২০২০ এ]
আহমেদ মনসুর : তরুণ কথাকার।