কালের রেঁদার টানে সর্বশিল্প করে থর থর

জগলুল আসাদ

মাহমুদ, আপনার সাথে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি গেটের ছোট্ট মসজিদে নামাজ পড়েছিলাম প্রায় দুই দশক আগে । তখনই আপনি অসুস্থতায় ন্যুব্জ । ছোট্ট দেহটুকু নিয়ে আপনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন মাগরিবের সালাত আদায়ে।আপনাকে দূর থেকে দেখে পিছু নিয়েছিলাম ,নামাজে দাঁড়িয়েছিলাম আপনার পেছনের সারিতে। কথা হয়নি, সালাত শেষেও।শুধু তাকিয়ে দেখেছি ছোট্ট একটা দেহ হেঁটে চলে যাচ্ছে । বিমুঢ় হয়ে চেয়ে দেখেছি আপনার হেঁটে যাওয়া । ওটাই ছিল আপনাকে আমার প্রথম ও শেষ দেখা।

জগতের বহু বড় বড় কবি তাদের বিশ্বাসের ঘোষণা দিয়েছেন। এলিয়টের বিখ্যাত উক্তি প্রায় সকলেরই জানা: I am Catholic in religion, classicist in literature and royalist in politics.কাব্যে ধর্ম,পুরাণ,বিশ্বাস, আচার-প্রথা,ও প্রেম-বিরহ-যৌনতার উপস্থাপন কাব্যের সমান বয়সী।এলিয়ট তার “পোড়ো জমি”র নিরেট নৈরাশ্য উজিয়ে স্থিত হয়েছিলেন “ফোর কোয়ার্টেটস” এ। শেষ বয়সে বুদ্ধদেব বসু আশ্রয় নিয়েছিলেন মহাভারতের ছায়াতলে। জীবনানন্দ ঈশ্বর বিশ্বাসী না হলেও আস্থা রেখেছিলেন ইতিহাসের দৈবে । ইয়েটসও প্রকৃতি, ইতিহাসের শরণ শেষে ধ্রুপদী শিল্পের বৈভবে আর অতিন্দ্রীয় চর্চায় প্রাশান্তি যাচনা করেছিলেন । ব্রাউনিং এর কবিতায় কামনা-বাসনার জাগতিকতার সাথে চার্চীয় অনুশাসনের টানাপোড়েন দেখি । ব্রাউনিং অটল বিশ্বাসী ঈশ্বরে । টেনিসন টলোমলো। আর্নল্ড উদগ্রীব বিশ্বাসে নোংগর ফেলতে । ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতায় বার বার নানারূপে ফিরে আসে গডের প্রসংগ । রবি ঠাকুরের কাব্যশরীর থেকে উপনিষদীয় আত্মার স্ফুরণ ও উৎসারণ বাদ দিলে ঠাকুরের কী অবশিষ্ট থাকবে? আল মাহমুদও ঘোষণা দিয়েছিলেন তাঁর ঈমানের । কিন্তু,মাহমুদকে সইতে হয়েছে ন্যায্য-অন্যায্য অনেক যাতনা!

বিশ্বকবিতার ইতিহাসে আল মাহমুদীয় ভাব ও ভাষা অনন্য নয় । তার কথ্য ভাষার ব্যবহার ,প্রচল কথাকে অবিস্মরণীয় দক্ষতায় কবিতায় ব্যবহার ক’রে ফেলা , ইতিহাসের নির্বাচন,গীতল ভংগি,প্রেম ও কামের এমন উতলা আবেশ বিশ্বকবিতায় অলভ্য নয় । নানা কবির মাঝে তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।ভালো কবিতার এইসব বহু বহু বৈশিষ্ট্য আল -মাহমুদে ঘনীভুত চেহারা পেয়েছে । বহু বুক তোলপার করা পংক্তির রচয়িতা তিনি । তার সহজতার রাহসিকতা বার বার পঠনেও ফুরিয়ে যায়না।এখনো বলি তো:”গাঙের ঢেউয়ের মত বলো কন্যা কবুল কবুল”,বা “আমার মাথায় আজ চুড়ো করে বেধে দাও চুল/তুমি হও একতারা,আমি এক তরুণ বাউল”,অথবা “প্রবল ছোবলে তুমি যতটুকু ঢালো অন্ধকার,তারো চেয়ে নীল আমি অহরহো দংশনের ভয়ে” অথবা ” কবিতা তো মক্তবের মেয়ে ,চুলখোলা আয়শা আক্তার”। ‘আধুনিক’ কবিদের মধ্যে জীবনানন্দের পরে আল মাহমুদই সর্বাধিক স্মরণীয় পংক্তিমালা রচনা ক’রেছেন। কবিতাকে যদি ডব্লিউ. এইচ অডেন কথিত “মেমোরেবল স্পীচ” বলেন, তবে আল মাহমুদের অজস্র কবিতা অনেকেরই স্মরণে গ্রথিত আছে ! অনেকেই শঙখ ঘোষের “পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ” শিরোনানের গুচ্ছকবিতাকে “সোনালি কাবিন”-এর উপরে রাখতে চান, তা কেউ চাইতেই পারেন। তবে, এই বাংলার আলো-হাওয়া, জীবন-যাপন,বিশ্বাস-সংস্কার,ইতিহাসবোধ আর কামনার বহিপ্রকাশ আল মাহমুদে যত তীব্র সংরক্ততায় আমাদের হৃদয়ে সঞ্চারিত করেন, অতটা আর কার দ্বারা হয়?

দুঃখের বিষয় হলো, এ দেশে আল মাহমুদের ভক্ত আছে, তবে তার কাব্যের শক্তি ও প্রসঙ্গিকতা দেখিয়ে দেবার মতো বিশ্লেষণী শক্তিসম্পন্ন কাউকে দেখা গেলো না! তিনি “আদরের ধন” আর বার্ষিক উদযাপনের “বিষয়” হয়েই রইলেন । ধর্ম,ইতিহাস,বিশ্বাস,আত্মপরিচয় ইত্যাদি প্রসঙ্গকে কী করে কাব্যের ভেতরে অন্ত:সলিলা প্রবাহের মতো তিনি বইয়ে দিয়েছেন তা দেখিয়ে দেবার তাকদ দরকার। কেউ হয়তো এগিয়ে আসবেন।

কবিকে দ্বিধা নিয়ে দ্বিধায় থাকতে নেই,মাহমুদ জানে। কোলরিজ সেই কবে ইংগিত দিয়ে গেছেন,কবি তার এক বুকে ধারণ করেন শীত ও গ্রীষ্ম,শৈত্য ও উত্তাপ,সমকাল ও মহাকাল । এরূপ নানা বৈপরীত্য ও যুগ্মতাতেই তো গড়ে উঠে কবিতার ” Miracle of rare device”.কবিকে যে ধারণ করতেই হয় নানা স্ববিরোধিতা । কবিতাকে তো ধারণ করতেই হয় জীবনের শোণিত,জীবনের বল ও বিকার,পুজ ও পুষ্টি । কবিকে ব্যক্তিজীবন দিয়ে যে মাপে, সে কবিতায় অভিব্যক্ত জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্ত হারায় ! আল মাহমুদকে গালমন্দ বা বিরোধিতা করা আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের রাজনীতিকরণ এবং বিশ্লেষণী অসামর্থেরই এক জ্বলন্ত নজির। আমারা সামর্থবান ও সক্ষম হলে আল মাহমুদও তার ন্যায্য পাওয়না পাবেন । কারণ, ছোটদের বড় আসলে তেমন বড় নয়!

বাংলা সাহিত্যকে তিনি যা দেবার দিয়েছেন,এবার আল মাহমুদের পাওয়ার পালা। তাঁর জন্যে দোয়া ; তাঁর কবিতাকে প্রাসঙ্গিক করে তোলার গুরুত্বপূর্ণ কাজও রয়ে গেছে। কবির পরকালীন জীবন শান্তিময় হোক। তাঁর কবি সত্ত্বার কবুলিয়াত কামনা করি।

জাগলুল আসাদ:সম্পাদক,চিন্তাযান।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন