মাঈন উদ্দিন জাহেদ

বিশিষ্ট গবেষক ড. মাহবুবুল হক- এ রচনা সংগ্রহের শুরুতেই তুলে ধরেছেন রশীদ আল ফারুকীর পরিচিতি ও কর্ম তৎপরতা। তিনি লিখেছেন: ‘বিশিষ্ট গবেষক যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক রশীদ আল ফারুকী স্মরণীয় হয়ে আছেন বহুমুখী কর্মতৎপরতার জন্য। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি সাহিত্য সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-পরিমণ্ডলে সক্রিয় কর্মী ও সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। হয়েছেন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীর ভূমিকায়।

রশীদ আল ফারুকীর পিতৃদত্ত নাম খায়ের উল বসর ৷ তার জন্ম ১৯৪ ০ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার (তৎকালীন থানা) গোপ্তাখালী সালে। পিতামহ মাওলানা আবদুস সাত্তার ছিলেন সীতাকুণ্ড এলাকার বিখ্যাত আলেম। আর পিতা মোহাম্মদ নুরুল আবসার ছিলেন আরবি ও ফারসি সাহিত্যের অধ্যাপক। ছোটবেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার হাতেখড়ি হলেও মাধ্যমিক শিক্ষা নিতে হয় মাদ্রাসায়। মাদ্রাসার ছাত্র থাকাকালেই তিনি প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৫৫ সালে যুব লীগে যোগ দেন। পরের বছর আওয়ামী লীগে। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ছেড়ে যোগ দেন মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে।I ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি হলে তাকে কিছুকাল সীতাকুণ্ডে গৃহবন্দি থাকতে হয়। এই সময় তিনি ইংরেজি শিক্ষার দিকে বিশেষভাবে ঝুঁকে পড়েন।

১৯৫৬ সালে ফাজিল পাস করলেও পরে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন (১৯৬০)। এরপর চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আই এ (১৯৬২), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিএ. সম্মান (১৯৬৫) এবং এম এ. (১৯৬৬) পাশ করেন। চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র থাকা কালে অাইয়ুব-বিরোধী শিক্ষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে গ্রেফতার হন ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা কালে তিনি সামরিক শাসনবিরোধী ভূমিকার জন্য আবারও গ্রেফতার হন।

১৯৬৭ সালে রাউজান কলেজে শিক্ষকতার মাধ্যমে রশীদ আল ফারুকীর কর্মজীবন শুরু। ১৯৭০ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৭৫ সালে সহকারী অধ্যাপক পদে ও ১৯৮৫ সালে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৯৮৬ সালে। ১৯৭৮ সালে তিনি ভারত সরকারের গবেষণা বৃত্তি নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা শুরু করেন। সেখান থেকে পিএইচ ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৮১ সালে। ১৯৮৩ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদ চট্টগ্রাম শাখার সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে সাহসিকতার সঙ্গে তার নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৭ সালে তিনি বিশ্ব মৈত্রী ও সংহতি পরিষদের চট্টগ্রাম শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন। কর্মপাগল এই মানুষটি এই সময় অধ্যাপনা, লেখালেখি ও সাংগঠনিক নানা কাজে এতই বিভাের হয়ে পড়েন যে তার শরীর শেষে বিদ্রোহ করে৷ তার কিডনির কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায় ৷ ঢাকায় পিজি হাসপাতালে চিকিংসারত অবস্থায় ১৯৮৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

রশীদ আল ফারুকী শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে সমাজের প্রগতিশীল রূপান্তরে আস্থাবান ছিলেনI তাঁর চিন্তা ও কর্মে এর সম্যক প্রতিফলন লক্ষ করা যায় ৷ সমাজের প্রগতিশীল রূপান্তরের লক্ষে এক সময় তিনি সক্রিয় রাজনীতি করেছেন। পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা, পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশনার দিকেও সক্রিয়ভাবে ঝুঁকে পড়েছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তীর উদ্যোগে ১৯৬৪ সালে ‘নবদিগন্ত’ নামে একটি দ্বিমাসিক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তখন তিনি পিতৃদত্ত খায়ের উল বসর নামেই সুপরিচিত। প্রথমে ‘নবদিগন্ত’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে ছোট ভাই আখতার উন নবীর নাম ব্যবহৃত হলেও পরে খায়ের উল বসর নিজ নামে এটি সম্পাদনা করেন। প্রকাশনার প্রতি প্রবল ঝোঁক থেকে তিনি একটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। রাউজান কলেজে শিক্ষকতা কালে ১৯৬৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘বিবিধ মুদ্রায়ণ’ নামে একটি ছাপাখানা। এই ছাপাখানা থেকে ওই বছরই তিনি প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন মাসিক সাহিত্য সংকলন ‘বিবিধ’। পত্রিকাটির সম্পাদকও ছিলেন তিনি। পরে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তার ভাই আখতার ঊন নবী। ‘বিবিধ’ মাসিক পত্রিকা হলেও ১৯৬৭ সালে এর কয়েকটি মাত্র সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। ‘বিবিধ’ মানসম্মত সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে চট্টগ্রামের বিদগ্ধ পাঠক মহলে সমাদৃত হয়েছিল I সাহিত্য সংকলন ও পত্রিকা সম্পাদনায় তীর উৎসাহ কলকাতায় পি-এইচ. ডি গবেষণাকালেও লক্ষ করা যায়। সে সময়ে তিনি কলকাতা থেকে ‘আগুনঝরা ফাগুন’ নামে একটি একুশের সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৮৫ সালে রশীদ আল ফারুকী ‘নবজাতক’ নামে সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধপত্র প্রকাশ শুরু করেন। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর এর একটি করে সংখ্যা প্ৰকাশ্যি হয়েছে। তার অকাল মৃত্যুতে ‘নবজাতক’ পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায় ‘।
রশীদ আল ফারুকীর চারটি প্রবন্ধ গ্রন্থ গ্রন্থিত হয়েছে এ সংকলনে।

১. রুচি ও প্রগতি
২. মুসলিম মানস : সংঘাত ও প্রতিক্রিয়া
৩. বাংলা উপন্যাসে মুসলমান লেখকদের অবদান
৪.বাংলার জাগরণ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

সম্প্রতি (জুন-২০১৮) ড. মাহবুবুল হক এর সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হওয়া রশীদ আল ফারুকী রচনা সংগ্রহ একটি চমৎকার উদ্যোগ হিসেবে চিহ্নিত হবে। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো হলো : ‘রুচি ও প্ৰগতি’, ‘বাংলা সাহিত্যে চরিত্র-চিত্রণ’, ‘উর্দু সাহিত্যের রূপরেখা”, ‘শরৎ সাহিত্য জিজ্ঞাসা”, ‘মুসলিম মানস : সংঘাত ও প্রতিক্রিয়া’, ‘আধুনিক সাহিত্যের রূপরেখা”, ‘প্রসঙ্গ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য” ইত্যাদি।

প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ রুচি ও প্রগতিতে তাঁকে চেনা যায় সমড়াজমনস্ক ও
প্রগতিবাদী প্রাবন্ধিক হিসেবে ৷ উনিশ ও বিশ শতকের বাঙালি মুসলিম মানসের দ্বন্দ্বের প্রকৃতি অনুসন্ধানের ফসল তাঁর গ্রন্থ ‘মুসলিম মানস: সংঘাত ও প্রতিক্রিয়া” ৷ ‘বাংলা উপন্যাসে মুসলমান লেখকদের অবদান’ গ্রন্থে তিনি বের করেছেন পঁচাত্তর জন বাঙালি মুসলমান ঔপন্যাসিকের প্রায় দেড়শো উপন্যাসের হদিস।
ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি প্রসঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি ব্যক্তিত্ববােধের জাগরণ, শিল্পীর স্বাধীনতা, গণমানুষের মানস জাগরণ, বাংলাদেশের অভ্যুদয় ইত্যাদি বিষয়ে মননঋদ্ধ আলোচনা করেছেন ‘বাঙলার জাগরণ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে ৷ এসব আলোচনায় অকুণ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে তাঁর প্রগতিশীল মানবমুখী অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার ৷ রচনা সমগ্রটি সচেতন পাঠকের রুচির যোগান দেবে, এ প্রত্যাশা।

মূল্য:পাঁচশত টাকা। রশীদ আল ফারুকী রচনাসংগ্রহ।
সম্পাদনা:ড.মাহবুবুল হক।প্রকাশনা: বাংলা একাডেমি,ঢাকা।

মাঈন উদ্দিন জাহেদ:কবি ও প্রাবন্ধিক।সম্পাদক:পুবাকাশ।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন