শোকাবহ মুহররম, মর্সিয়া ও কাজী নজরুল ইসলাম
।। ঝিনুক জোবাইদা
মুহররম এর দশ তারিখ। পৃথিবীর ইতিহাসে, এযাবৎ কালের সবচেয়ে শোকাবহ দিন। এদিনের সাথে আর কোনো শোকদিবসের সাথে তুলনা করা যায় না। মুসলমানদের ইতিহাস রক্ত রঞ্জিত হয়েছিল এইদিন, তা আর কখনো মুছে যায়নি। কতটা শোকাতুর এই দিন কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কাব্যসাহিত্যে পরিষ্কার ভাবে চিত্রময় করেছে।
মর্সিয়া শব্দের অর্থ শোক বা আহাজার, দুঃখ, শোককাব্য, বেদনামিশ্রিত কাব্য।
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের হৃদয়ে গভীরভাবে আঘাত করেছিল কারবালার বেদনাবিধুর, মর্মান্তিক ঘটনা। মোহররম তাঁর হৃদয়কে বেদনাদগ্ধ করেছে, করেছে অশ্রু সজল।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (স.) এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসেন, তাঁর কাছে মহানায়ক। মোহররমের শোককে তিনি শক্তিতে পরিণত করার আহ্বান জানিয়েছে।
মুহররম কাজী নজরুল ইসলামের কাছে স্বাধীনতার প্রতীক। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বস্ব বিসর্জন দেয়ার অবিস্মরণীয় মহাকাব্য।
কবি বলেন-
‘দ্রিম্ দ্রিম্ বাজে ঘন দুন্দুভি দামামা,
হাঁকে বীর, ‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামা।’
‘মোহররম’ কবিতা নজরুলের অমর সৃষ্টি যার কোনো দ্বিতীয় তুলনা হয় না। ইমাম হাসান, হোসেনের সাথে কবিতাটিতে অপরিসীম ব্যাপকতা নিয়ে এসেছেন হজরত আলী ও খাতুনে জান্নাত মা ফাতিমা রা: তাঁদের পরিবারের অন্যান্য সদস্য, প্রিয় অশ্ব দুল দুল।
কবিতার প্রারম্ভে শোককে চিত্রময় করেছেন এভাবে,
‘নীল সিয়া আসমান : লালে লাল দুনিয়া,
‘আম্মা! লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া!’
‘কাঁদে কোন ক্রন্দসি কারবালা ফোরাতে,
সে কাঁদনে আসু আনে সিমারেরও ছোরাতে!
প্রিয়জন হারানোর মর্ম বেদনা , এবং পানির জন্য হাহাকার বর্ণনা করেছেন এভাবে
“গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা,
‘আম্মাগো, পানি দাও, ফেটে গেল ছাতিমা’!
পুরো কবিতাজুড়েই গভীর বেদনায় জর্জরিত আর্তনাদ।
তার মধ্যেই কবি প্রতিজ্ঞা করেন-
‘ফিরে, এলো আজ সেই মোহররম মাহিনা,
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না!’
মুহররমকে নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের আরেকটি কবিতা আছে ‘মোহর্রম’ নামে। বানানে সামান্য পার্থক্য থাকলেও কারবালার নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, বিশ্বাসঘাতকতা, উপমা, রূপকের ব্যবহারে আরো তীব্রভাবে তুলে এনেছেন কবি এই কবিতায়। বাঙলার মুসলিমদের ডেকে বলছেন:
‘ওরে বাঙলার মুসলিম, তোরা কাঁদ,
এনেছে এজিদী বিদ্বেষ পূর্ণ মোহর্রমের চাঁদ!…
এসেছে ‘সীমার’ এসেছে ‘কুফা’র বিশ্বাসঘাতকতা,
ত্যাগের ধর্মে এসেছে লোভের প্রবল নির্মমতা!
এজিদের নিষ্ঠুরতার বিস্তৃত বিবরণ দিতে দিতে কবি মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রশ্ন রাখছেন-
‘আল্লা! এরাও মুসলিম, এরা রসূলের উম্মত,
কেন পায়নি বা প্রেম আর ক্ষমা শান্তি ও রহমত?’
আল্লার দরবারে নজরুলের প্রার্থনা
‘শান্তি, শান্তি, আল্লা শান্তি দাও!
সর্বদ্বন্দ্বাতীত তুমি, নাও তব প্রেম পথে নাও!’
প্রত্যক্ষ কবিতার পাশাপাশি কিছু কিছু কবিতায় ও গানে উদাহরণ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা এবং উদ্ধৃতি হিসেবে কবি ব্যবহার করেছেন মোহররম প্রসঙ্গে-
“তরুণের গান “কবিতায় কারবালা প্রসঙ্গ এসেছে এভাবে
“নব জীবনের ফোরাত কুলে তো কাঁদে কারবালা তৃষ্ণাতুর,
ঊর্ধ্বে শোষণ সূর্য, নিম্নে তপ্ত বালুকা। ব্যথা মরুর!”
নজরুল ইসলামের সঙ্গীতে ফুটে উঠেছে মোহররমের অন্তর ভেদী হাহাকার। চিরকাল মানুষের মনকে শোকে-দুঃখে জড়িয়ে রেখেছে।
ধর্মীয় গণ্ডী পার করে মর্মস্পর্শী সেই কাহিনী সবাইকে ছুঁয়ে যায়। তাই কবি লিখলেন-
‘মোহররমের চাঁদ এল ঐ কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়।
ওয়া হোসেনা, ওয়া হোসেনা তারই মাতম শোনা যায়।’
আরো লিখেছেন-
“এস শোকের সেই মোহর্রম কারবালা স্মৃতি লয়ে’
আমি বে-তাব বিশ্ব মুসলিম সেই শোকে রোজা রোয়ে!”
(এল শোকের সেই মোহর্রম)
ডাক দিলেম ‘ওগো মা ফাতেমা ছুটে আয়;
তোর দুলালের বুকে হানে ছুরি।
দিনের শেষ বাতি নিভিয়া যায় মাগো
বুঝি আঁধার হলো মদিনা পুরী।”
‘ফোরাতের পানিতে নেমে’ কি করছেন ফাতেমাতনয় সে চিত্র ও এঁকেছেন মানবদরদি নজরুল।
‘ফোরাতের পানিতে নেমে ফাতেমা দুলাল কাঁদে
অঝোর নয়নে রে।
দু’হাতে তুলিয়া পানি ফেলিয়া দিলেন অমনি
পড়িল কি মনে রে!’
ইমাম হোসেনের একে একে মনে পড়ে
‘দুধের ছাওয়াল’ আসগরের কথা, শাদির নওশা শহীদ কাসেমের কথা, ফোরাতের পানিতে সকিনার হাতের মেহেদি মোছার কথা, বীর আব্বাসের কথা যার দুই বাহুই শহীদ হয়েছিল কারবালার যুদ্ধে।
এ ছাড়া বহিছে সাহারায় শোকের ‘লু’ হাওয়া’ ‘মরুর ফুল ঝরিল অবেলাতে’ ‘হাতে হাত দিয়ে আগে চল’
‘পুবাল হাওয়া পশ্চিমে যাও’ ‘আমি যদি আরব হতাম’
‘খাতুনে-জান্নাত ফাতেমা জননী’, ‘ওরে ও মদিনা’ ইত্যাদি কবিতা ও গানে মোহররম প্রসঙ্গ এসেছে নানা অনুষঙ্গে।
তবে গদ্যে কাজী নজরুল ইসলাম মর্সিয়া নিয়ে যা লিখেছেন তাও গুরুত্বপূর্ণ। ১৯২২ সালের ২৯ আগস্ট ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় এই মর্মে যে ‘ধূমকেতুর’ ‘মোহররম সংখ্যা’ বের হবে। এর আগে কোনো পত্রিকার মোহররম সংখ্যা বের হয়েছে বলে জানা যায় না। কাজী নজরুল ইসলাম এ ব্যাপারে চিরকালের অগ্রগামী । সেই পত্রিকা সংখ্যায় নজরুল লিখেছেন, তার গদ্য রচনা ‘মোহররম কথা ও মোহররম’।
‘মোহররম’ ঠাঁই পেয়েছে রুদ্রমঙ্গল কাব্যে।
“ফিরে এসেছে আজ সেই মোহররম সেই নিখিল মুসলিমের ক্রন্দন কাতরানির দিন। কিন্তু সত্য করে আজ কে কাঁদছে বলতে আর হে মুসলিম? আজ তোমার চোখে অশ্রু নেই। আজ ক্রন্দন স্মৃতি তোমার উৎসবে পরিণত। তোমার অশ্রু আজ ভণ্ডামি, ক্রন্দন আজ কৃত্রিম, কর্কশ চিৎকার। ”
হায় হাসান, হায় হোসেন’ বলে মিথ্যা বীভৎস চিৎকার করে আর মা ফাতেমার পুত্র শোকাতুর আত্মাকে পীড়িত করে তুল না।…
আল্লার পানে তাকাও, রাসূলের দিকে চেয়ে দেখ, মা ফাতেমা, হজরত আলীর মাতম শোন, কাসেমের সখিনার অতৃপ্তির আকুল কাঁদন শোন, কবি শিশু আসগরের তীর বিঁধা কাঁচা কলিজার খুন খারাবির কথা স্মরণ কর, আর তোমার কর্তব্য নির্ধারণ কর, হে মুসলিম।’
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর মননে অবিস্মরণীয় ব্যঞ্জনা নিয়ে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছে মোহররমের শোকানল।
ঝিনুক জোবাইদা : কবি ও কথাকার।