পাহাড়ী ভট্টাচার্য
“I am an atheist, and if an atheist and a Pope think the same things, there must be something true. There must be some human truth that is beyond religion.” – ওরিয়ানা ফ্যলাচি।
ওরিয়ানা ফ্যলাচি এক প্রবল, গতিময়, সক্রিয় ও তীব্র প্রানোচ্ছল নারী সত্তা। প্রতিকুল পরিবেশে, ঘটনার ঘনঘটায়, উত্তাপ-উত্তেজনার আবর্তে দাড়িয়ে, বাধা ও বহুমাত্রিক বিধি-নিষেধকে উপেক্ষা করে, রীতিমতোন যূদ্ধাবস্হার মধ্যেও ধারাভাাষ্য সহ প্রকৃত ঘটনাচিত্র ও সংবাদ/প্রতিবেদন সৃজন ও পরিবেশনের বিরল পটুত্ব ক্রিশ্চিয়ানা এম্যানপোওর্ সহ সিএনএন-বিবিসি-আল জাজিরা কিংবা ডয়েচে ভ্যালে-র অনেক জনপ্রিয় নারী সংবাদকর্মীদের মধ্যে ‘৯০-এর দশক থেকেই আমরা দেখছি। ফ্যলাচি, এবংবিধ দুঃসাহসিনীগনের,বলা চলে প্রতিভু, পূর্ব-প্রজন্মের একজন।
ওরিয়ানা ফ্যলাচি, নি:সন্দেহে, অামার প্রিয়তর নারী চরিত্রদের অন্যতমা। মত প্রকাশে দ্ব্যার্থহীন, নিরাবেগ, স্পষ্ঠতর-অকপট, অকাট্য, সুক্ষ রসবোধসম্পন্ন এবং অনিবার্যভাবেই, তীব্র মাত্রায় বাস্তবতাকে ধারণকারিণী এক বিরলপ্রজ, ব্যতিক্রমী, নিরলস সৃষ্টিশীল সত্ত্বা!
পোলিশ বংশোদ্ধুত, অধুনা ইতালী-র ফ্রোরেন্সে ১৯২৯-এ জন্ম নেয়া এই নারী সাংবাদিক, লেখক এবং রীতিমতোন “সেলিব্রেটি” জীবদ্দশায় তো বটেই, ২০০৬ সালে, তাঁর মৃত্যুর প্রায় দেড় দশক পরেও সমান আকর্ষনীয়া ও প্রাসঙ্গিক।
প্রসঙ্গত, ফ্যলাচি প্রতিনিধত্ব করেন এমন একটি দুরন্ত সময়কালকে যখন গোটা বিশ্ব, দৃশ্যত: বহুধা বিভক্ত। একদিকে মার্কিন অর্থনীতি ও আগ্রাসনের বাড়বাড়ন্ত, রাশিয়ার সাথে স্নায়ুযূদ্ধের বাতাবরণ, চীন-ভিয়েতনাম-কোরিয়া-জাপানের সাথে মার্কিনীদের কখনো বানিজ্যিক কখনো রাজনৈতিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট লড়াই, কখনো তীব্র প্রতিযোগিতা, ল্যাটিন আমেরিকার দেশে দেশে বিপ্লব-পর্ব, এশিয়া কিংবা আফ্রিকায় উপনিবেশের নিগড় ভেঙ্গে স্বাধীন রাষ্ট্রসত্ত্বার জন্মযোগ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রতিক্রিয়াশীল ও একদলীয় বংশানুক্রমিক স্বৈরতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের জেঁকে বসা, ইউরোপে অভিবাসী জনস্রোতের ঢেউ, ইতালী, গ্রীস, স্পেনে ফ্যাসিবাদের দাপট, কোথাও বা ধর্মাস্রয়ী জঙ্গিবাদের পদধ্বনি- বস্তুত এমনটিই ছিল ফ্যলাচি-র সময়কালের দৃশ্যপট ও বিশ্ব-বাস্তবতা।
ওরিয়ানা ফ্যলাচি ছুটে গেছেন পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। পেশাদারিত্বের ষোলকলা পূর্ণ করেই এসাইনমেন্ট সেরেছেন, সাক্ষাতকার নিয়েছেন, অক্লান্ত লিখেছেন নানা দেশ, সমাজ-ঘটনা বিষয়ে, তাবৎ বাঘা বাঘা সব রাষ্ট্রনায়ক ও সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতির সব নেতৃস্হানীয়দের নিয়ে, এমনকি রাজনীতির বাইরের জগতের নামজাদাদের কেউ কেউও হয়েছেন ফ্যলাচি-র আগ্রহের বিষয়বস্তুু। তালিকায় কে নেই? হেনরি কিসিন্জার, ইন্দিরা গাঁধী, ভুট্টো, মুজিব, খামেনী, গাদ্দাফী, রেজা শাহ পাহলভি, দেং শিয়াও পিং, জেনারল গিয়াপ, নগুয়েন ভ্যান থিউ, ইয়াসির অারাফাত, বাদশাহ হুসেন, লেস ওয়ালেসা, হলিউডের সেলিব্রেটিদের মধ্যে জিনা লোলোব্রিজিত, ইনগ্রিড বার্গম্যান, শ্যন কনোরি, শার্লি ম্যাকক্লেইন, আলফ্রেড হিচকক থেকে শুরু করে মহাকাশচারি চার্লস কনরাড, এমনকি পোপ অবধি। ১৯৭৭ সালে ওরিয়ানা ফ্যলাচি-র “ইন্টারভিউ উইথ হিস্ট্রি” প্রকাশিত হয়। বইটিতে ছড়িয়ে অাছে ফ্যলাচি-র অনবদ্য বর্ণন-ভঙ্গিমায় দারুণভাবে প্রভাবিত, কতিপয় প্রসঙ্গে বিব্রত ও প্রশ্নবানে জর্জরিত, রীতিমতো কুপোকাত-প্রায় সাক্ষাতকারদাতাদের সরল-অবিশ্বাস্য সব স্বীকারোক্তি ও ঘটনার নেপথ্যের অজস্র ঘটনার বর্ননা ও দৃশ্যকল্প, যা বস্তুত সমসাময়িক ইতিহাসেরই এক নির্বেদ পুণ:র্পাঠ! পাঠক মোহাবিষ্ট হন সত্যের এমনতর উন্মোচনে!
সাধারণ কর্মজীবি বাবা-মার সন্তান ওরিয়ানা ফ্যলাচি চিকিৎসাবিদ্যা ও রসায়নশাস্র অধ্যয়ন ছেড়ে একপর্যায়ে সাহিত্যের ছাত্রী হন এবং একাডেমিক পাঠ অসমাপ্ত রেখেই কাকা-র অনুপ্রেরণায় সাংবাদিকতায় যুক্ত হন।
সে সময়, ‘৬০-এর দশকে, যখন অনুসন্ধানী ও মাঠ-পর্যায়ের ঝুঁকিপূর্ণ সাংবাদিকতার বিষয়টি নারীরা এড়িয়ে চলতেন, তখন ফ্যলাচি এটিকে চ্যালেন্জ হিসেবে নেন।
শ্রম ও মেধার মেলবন্ধনে ফ্যলাচি-র রিপোর্টিং, ফিচার, ইন্টারভ্যু, মেমোয়ার, গদ্য ও সাহিত্যকর্ম ক্রমশ স্বদেশে ও বিদেশে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। ২১টি ভাষায় অদ্যাবধি তাঁর রচনা অনুদিত হয়েছে। ফ্যলাচি-র ” এ ম্যান”, ” দ্য রেজ এন্ড দ্য প্রাইড”, ” লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ণ”, ” নাথিং, এন্ড সো বি ইট”, ” দ্য ফোর্স অব রিজন”, ” ইফ দ্য সান ডায়জ” সবিশেষ উল্লেখযোগ্য কিছু রচনা।
একটি অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন ন্যায়সঙ্গত বিশ্ব- ব্যবস্হার প্রতি ফ্যলাচি-র পক্ষপাত, সমাজবিপ্লব ও গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা-র ধারায় তাঁর অাস্হাশীলতা, নারী ও শিশুদের সুরক্ষায় চিন্তাক্লিষ্টতা, যুদ্ধ ও সংঘাতহীন একটি পৃথিবীর জন্য অাকুলতার সাথে সাথে ইউরোপ সহ বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদ, ধর্মাস্রয়ী জঙ্গিবাদের উত্থানের অাশংকায় আকুল এক নারীসত্ত্বাকে আমরা তাঁর মধ্যে প্রত্যক্ষ করি।
কৈশোরে-তারুণ্যে, পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইতালীতে ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসক ফ্রাঙ্কো-র বিরোধিতা, সে সময়ের অাধিপত্যবাদ-বিরোধী গণ-প্রতিরক্ষার রাজনৈতিক নানা কার্যক্রমে যোগদান, মননে-চর্চায় একটি নির্মোহ আবেগ ও ক্রমশ বিশ্ববীক্ষণকে ধারণ, সত্য ও নীতির প্রশ্নে দৃঢ়, অবিচল, প্রত্যয়ী থাকবার চর্চাটি ফ্যলাচি অক্ষুন্ন রাখেন অামৃত্যু। তাই তাঁকে বলতে শুনি, ” I see power as an inhuman and hateful phenomenon. I have always looked on disobedience towards the oppresive as the only way to use the miracle of having been born.” যৌবনে বিপ্লব ও যূদ্ধক্ষেত্রে রিপোর্টিং কিংবা ইন্টারভ্যুর কাজের অভিজ্ঞতা, কখনো সামরিক একনায়ক কিংবা স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের হাতে নাজেহাল হবার কিংবা মেক্সিকোতে গুলিবর্ষন ও শারিরীক আক্রমনের শিকার হওয়ার মত ঘটনাদি তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারে নি। কার্যসূত্রে গ্রীক রাজনীতিক অালকজান্দ্রোস পানাগুলিস-এর সাথে ‘৭০-এর দশকে পরিচয়, প্রেম, ৩-বছরের লিভ টু গেদার, সম্পর্কের অবনতি, অপূর্ণ, অতৃপ্ত মাতৃত্ব ও অপরিণত গর্ভপাত, গ্রীক শাসকগোষ্টীর হাতে পানাগুলিস-এর রহস্যময় মৃত্যুর কথা ফ্যলাচি অনবদ্যভাবে তুলে এনেছেন তাঁর “এ ম্যান” উপন্যাসে। ২০০৬-এ ক্যান্সার আক্রান্ত ফ্যালাচি ৭৭ বছর বয়সে ইতালীর ফ্রোরেন্সে মৃত্যুবরণ করেন।
ওরিয়ানা ফ্যলাচিকে “রেসিজম” ও “ইসলামোফোবিয়া”-আক্রান্ত মনে করতেন তাঁর নিন্দুকেরা। তাঁকে নিয়ে, ২০১৭-য় নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ লিখেছেন ড্যুইট গার্নার, তাঁর জীবনী লিখেছেন ক্রিস্টিনা ডি স্টিফানো। ২০১৫ সালে ওরিয়ানা ফ্যলাচি-র জীবন-ভিত্তিক ইতালীয় চলচিত্র “লা ওরিয়ানা” মুক্তি পায়।
পাহাড়ী ভট্টাচার্য: কবি ও প্রাবন্ধিক।