বাংলা সাহিত্যে মুহাররম ও কারবালা
আমিন আল আসাদ
[মত প্রকাশের অধিকার যেমন সবার আছে তেমনি মত বর্জনের অধিকারও আছে। তাই লেখার শুরুতেই পরমত সহিষ্ণুতা কামনা করছি]
‘মুহররম তরবারীর উপর রক্তের বিজয়ের মাস’। দশই মুহররম তথা কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে এক ট্রাজেডি। এ এক হ্রদয় বিদারক ও শোকাবহ ঘটনা। কেবল শোকাবহ ঘটনাই নয়, বরং এর শোক থেকে উত্থিত শক্তি ভষ্মিভ’ত করে দেয় সকল প্রকার জালিমের লৌহ লকার। কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনায় শোককাতর হয়না এমন মুসলমান নেই বললেই চলে। দল-মত,দেশ-ভাষা,বর্ণ,গোত্র,মাজহাব,তরীকা,শ্রেনী,পেশা নির্বিশেষে সকল ঈমানদার মুসলমান-যাদের হৃদয়ে বিন্দু মাত্রও আল্লাহর রাসুল (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা রয়েছে-তারা কারবালা প্রান্তরে ঘৃণিত ইয়াজিদ বাহিনীর কাপুরুষোচিত হামলায় নবীর (সা.) নাতি বেহেশতের যুবকদের সরদার ইমাম হোসাইন (আ) এবং তাঁর নিরস্ত্র নিষ্পাপ ৭২ জন সঙ্গী সাথী সহ নির্মমভাবে শাহাদাত বরণের করুণ ঘটনায় বেদনাহত হন। শুধুমাত্র মুসলমানেরাই নয় জাতিধর্ম নির্বিশেষে বিবেকবান অমুসলিম পন্ডিতেরাও লিখেছেন অমূল্য সব শোকবানী। এদের মধ্যে রয়েছেন ভারতবর্ষের প্রখ্যাত নেতা মহাত্মা গান্ধী, ইংরেজ দার্শনিক ও লেখক টমাস কার্লাইল, ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স, এডওয়ার্ড ব্রাউন, টমাস মাসরিক, ইতিহাসবিদ পি কে হিট্রি, ডবলিউ ডবলিউ হান্টার, ফ্রেডরিক জেমস, দার্শনিক নিকলসন, জার্মান প্রাচ্যবিদ মরবিন, জার্মনির বিখ্যাত কবি গ্যাটে, খৃষ্টান পুরোহিত অ্যান্টন বারা প্রমূখ।
কারবালার মর্মান্তিক ঘটনায় তারা মর্মাহত হন। কেবল মাত্র ইমাম হোসাইন (আ)-এর কালজয়ী বিপ্লবের প্রতিপক্ষ তদানিন্তন ধীকৃত বর্বও ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া, ইবনে যিয়াদ ও সীমার প্রমূখ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের স্বৈরশাসক গোষ্টী ও মুনাফেক আব্বাসিয়দের স্বৈর-শাসকবগ এবং তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের বর্তমান প্রজন্মরা ব্যাতিত। সেজন্যেই কবি শোকগাথায় গেয়ে ওঠেছেন
‘অমর শহীদ ইমাম হোসেন জন্মেছিলেন মদীনায়/ তাহার শোকে জগত কাঁদে, কাঁদেনা জালিমেরাই’
মানবজাতির জন্যে সর্বশ্রেষ্ট ঐশী গ্রন্থ মহাগ্রন্থ আল-কোরানে পৃথিবীর ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য বড় বড় ঘটনাকে আল্লাহপাক উদাহরণ হিসেবে পেশ করেছেন মানবজাতির শিক্ষার জন্যে ও তাদেরকে ইতিহাস সচেতন করার জন্যে। কোরান নাজিলের পর ওহির দরোজা বন্ধ হয়ে গেছে। ইসলামের প্রধান দুই মাজহাব আহালে বাইতের মাজহাব বা শিয়া মাজহাব এবং আহালে সুন্নাতের মাজহাব বা সুন্নি মাজহাব-এর বড় বড় পণ্ডিত ও তফসিরকারদের কেউ কেউ একথা বলেছেন যে যদি কোরান নাজিলের পর আর কোন ঐশি গ্রন্থ নাজিল হতো তবে কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনাটি এতোই তাৎপর্যপূর্ণ যে সেটি সেই ঐশি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিলো। কাজেই আশুরার চেতনা ও আন্দোলন মানবতার ইতিহাসে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়।
সাহিত্যে কারবালার প্রভাব-
ইমাম হোসাইন শুধু একটি নাম নয়। একটি ইতিহাস, একটি চেতনার নাম যা সত্য মিথ্যার পার্থক্য নিরূপনকারী। কালজয়ী বীর ইমাম হোসাইন ন্যায় ও ইনসাফের পক্ষে অন্যায় জুলুম নির্যাতন ও সেচ্ছাচারিতার বিপক্ষে অকুতভয়ে দাড়িয়ে থাকা এক মহানায়ক। সত্যান্বেষীদের মন মগজে জুড়ে থাকা কালোত্তীর্ণ এক অমর ব্যাক্তিত্ব। কারবালার শোকাবহ ঘটনা নিয়ে আশুরা আন্দোলনের তাৎপর্য নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় বই পুস্তক লেখা হয়েছে। তবে উর্দূ ফারসী ভাষায়ই এর চর্চা হয়েছে ব্যাপক। হিন্দি ভাষায়ও তা চর্চা হয়েছে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলায়ও কম নয়। বরং অনেক।
বাংলা ভাষায় আশুরার শোকাবহ শোকাবহ ঘটনা, মুর্হারমের চেতনা, ইমাম হোসাইন (আ)-এর সংগ্রামের দর্শণ নিয়ে একদিকে যেমন রচিত হয়েছে তাত্তি¡ক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, সেই সাথে কারবালার শোকাবহ ঘটনা ও আশুরা আন্দোলনের আবেগঘন বিষয়ে রচিত হয়েছে মর্সিয়া সাহিত্যের বিশাল ভান্ডার। এসবের মধ্যে রয়েছে কবিতা, ছড়া, গান, জারি, মর্সিয়া, এপিক, কথিকা, নাটিকা, উপাখ্যান, পুঁথিসাহিত্য ইত্যাদি। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী সাহিত্য হিসেবে পরিগণিত হয়ে হয়ে আছে মর্সিয়া সাহিত্য। বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের জীবনের সাথে কারবালার কাহিনী ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। তাই বাংলা সাহিত্যে কারবালার চেতনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
মর্সিয়া সাহিত্যের বিকাশ ও কিছুকথা-
উপমহাদেশে মর্সিয়া সাহিত্যের বিকাশ ঘটে মোঘল আমল থেকেই। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় নবাব আলীবর্দী খান ও তদীয় দৌহিত্র নবাব সিরাজউদ্যেলার সময়ে মুর্শিদাবাদে যে কবিদের সমাগম হয়েছিলো তাদের অনেকেই ছিলেন শিয়া অথবা নবীবংশের প্রতি মহব্বত সম্পন্ন সুন্নি। যাদেরকে বলা হয় আহালে বাইত পন্থী সুন্নি। তারা তরিকতপন্থীও বটে। তাদেরি প্রভাবে বাংলা মূলুকে মর্সিয়া সাহিত্যের অনুপ্রবেশ ঘটে। এবং সেটা পুঁথি সাহিত্যকে প্রভাবিত করে। ফার্সী উর্দু ভাষার ধর্মীয় বোধ থেকেই বহু বাঙ্গালী মুসলিম কবি মর্সিয়া ও পুঁথি রচনা করেন। তাদের মধ্যে রাধারমণ নামে একজন হিন্দু কবিও রয়েছেন।
কারবালা ও মুহররমের ঘটনা নিয়ে মধ্যযুগে ও পরবর্তীকালে যে সব পুঁথি ও বই লেখা হয়েছে সেগুলোর নাম জঙ্গনামা, মকতুল হুসায়েন, শহীদ-ই-কারবালা, সংগ্রাম হুসেন, এমাম এ্যনের কিচ্ছা, শাহাদাত নামা, হানিফার লড়াই,বড় জঙ্গনামা, গুলজার-ই-শাহাদাত, দাস্তানে শহীদ ইকরামালী, জঙ্গে কারবালা ইত্যাদি। পল্লী বাংলার মানুষ কারবালার ঘটনা নিয়ে মুহররম, মাসে যে বিষাদময় গীতিকা গেয়ে থাকে তার নাম জারিগান। জারিগান মূলতঃ আশুরার শোকগাথাকে নিয়েই রচিত হয়েছে। তাই বলা যায় জারিগান মুহররমের বেদনাগাথার এক বিশেষ রূপ।
মধ্যযুগের কবিদের থেকে শুরু করে পরবর্তীতে আবুল মা-আলী, মুহাম্মদ হামিদ আলী, কায়কোবাদ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মীর রহমত আলী, কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ পর্যন্ত আশুরা বা কারবালা কেন্দ্রিক কাব্যচর্চা এক বিশেষ রূপ প্রাপ্ত হয়। কারবালা ট্রাজেডি নিয়ে বাংলা ভাষায় কে সর্বপ্রথম লিখেছেন তার সঠিক পরিচয় না পাওয়া গেলেও একথা বলা যায় আহমদ নগরের কবি আফরাফ প্রথমবারের মতো মর্সিয়া লিখেছিলেন। শায়খ ফয়জুল্লাহ কারবালা সমন্ধে ‘জয়গুনে চৌতিশা’ নামে একটি কবিতা রচনা করেন যা এ সম্পর্কিত প্রথম বাংলা কবিতা বলে গন্য করা হয়। বাহরাম খান নামে এক কবি লিখেন ‘মাকতাল হোসেন’ । আরো লিখেন মুহাম্মদ খান নামে আরেক কবি। কারবালা নিয়ে আরো যে সব কবিতা রচিত হয় সেগুলো হলো কবি হায়াত মামুদের ‘কাশেমের রড়াই’ কবি হামিদের ‘সংগ্রাম হুসায়েন’, ফকির গরীবুল্লাহর ‘জঙ্গনামা’ কবি রাধারমণ-এর ‘এমাম এনার কিচ্ছা’, কবি মোহাম্মদ হামিদুল্লাহর ‘গুলজার-ই-শাহাদাত, কবি মুহাম্মদ হামিদ আলীর জয়নাল উদ্ধার ও ‘কাশেম বধ’, কবি মতিউর রহমান খান-এর ‘এজিদ বধ’ (যা অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত), কবি কায়কোবাদের ‘মহররম শহীদ’ (যা তিন খন্ডে সমাপ্ত), কবি আবদুল বারীর ‘কারবালা’ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ‘মহাশিখা’, কবি আবদুল মুনায়েমের ‘পঞ্চশহীদ’ , কবি মোহাম্মদ ইসমাইলেরর ‘শহীদের খুন’ কবি আবদুল হাকিমের ‘মরুসেনা’ মীর রহমাত আলীর ‘মহররম কাব্য’ ইত্যাদি।
কারবালা কেন্দ্রিক কিছু কবিতার উদ্বৃতিঃ
কারবালা কেন্দ্রিক মর্মস্পর্শী কবিতার কিছু লাইন এখানে উল্লেখযোগ্য। ফকির গরীবুল্লাহর জঙ্গনামার দু-একটি লাইন এমন-
‘হোসেন বলেন বিবি কান্দিওনা আর
আমা বাদে ভালো হবে তোমা সবাকার
গহর বানু বলে কি যে হবে আর
না রাখিলে মোর বংশ এজিদে কুফ্ফার
আপনি চলিলা ফের করিতে লড়াই
কুফরে সুপিয়া যাও কি হবে ভালাই
এমাম বলেন বিবি না কান্দিও আর
রদ না হইবে কভু কলম আল্লার
ঘিরিয়া রাখিল কুফার পানি বন্ধ করে
পানি পানি করে যত সব গেলো মরে
তোমরা মরিছ সবে পানির লাগিয়া
মেরাও জিও পানি বিনে যায় নেকালিয়া
আজ কাল-ই পানি বিনে মরিব নিশ্চয়
লড়িয়া মরিলে নাম রবে দুনিয়ায়’
কবি কায়কোবাদ লিখেন-
‘এই কি কারবালা সেই! এই সেই স্থান!
এই সেই মহামরু হেরিলে যাহারে
অশ্রু ঝরে দু’নয়নে কেঁদে ওঠে প্রাণ
যত কথা মনে পড়ে শিরায় শিরায়
প্রচণ্ড অনল শ্রোত হয় প্রবাহিত
প্রাণের নিভৃত কক্ষে হৃদয় কন্দরে
কি যে এক শোক স্মৃতি হয় উচ্চসিত
এই কি কারবালা সেই এই কি শ্মশান
যাহার বালুকা রাশি সিন্দুরের মতো-
হয়েছিলো সুরঞ্জিত হোসেন-শোণিতে’
কবি শাহাদাত হোসেন লিখেন,
‘এই সেই মহররম সেদিনের সেই গম
ভুলেছো কি মুসলিম? দ্বীন তব ইসলাম’
তিনি আরো লিখেন-
‘রুদ্র দুপুর চলে আফতাব শিরে গলে
ছুটে জ্বালা চৌদিকে ইঙ্গিত মৃত্যুর
কোনখানে নাহি চিন পানি এক বিন্দুর
মরু বালু ঝলকায়
উন্মনা ছুটে চলে বাতাসের হল্কায়
নাই পানি, নাই ছায়া জ্বল জ্বল মরুকায়া
কারবালা প্রান্তর ঝাঁ ঝা করে চৌদিক
শান্তির রেখা নাই শান্তনা মৌখিক
হাহাকার ! হাহাকার!!
আজ বুঝি দুনিয়ায় জাগিয়াছে মহামার
লাও পানি জান যায় ছাতি কাপে পাঞ্জায়
কাতরায় পানি বিনে আজি তারা শাহারায়
কলিজার টুকরা সে সন্তান একপাশে
জবে করা কবুতর ছটফটি মার হায়
ফাটে শোকে মার প্রাণ দাও পানি ছেলে যায়
দিল বুকে জনকের
ফিরো এলো কোলে শিশু বুকে তীর জহরের…
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী লিখেন-
‘দুরাত্মা শিমর পাপী সহসা যাইয়া
বসিলেক বক্ষে চাপি নয়ন উন্মীলি
হেরিলা রাজর্ষিবর নির্ম্মম মুরতি
শিমর বসেছে বক্ষে শিরচ্ছেদ তরে
কাতরে কহিলা বীর ওরে রে শিমর
আজী পূণ্য জুম্মাবার মধ্যাহ্ণ নামাজ
পরিবার অবসর দে রে কিছুক্ষণ’
পাপিষ্ট শিমার যখন ইমাম (আ)-এর শির কর্তণ করলো তখন কি প্রিবেশ সৃষ্টি হলো মুহুর্তে ধরায় সেটা বর্ণনা দিচ্ছেন কবি এভাবে—
‘খণ্ডিত হইলো শির! কাপিল ধরনী
গহসা জলদ জালে লুকালো তপন
আঁধার হইলো বিশ্ব বিভু সিংহাসন
কাপিলেক থর থর নিদারুণ শোকে
প্রকৃতি ছাড়িল শ্বাস, উড়ি রাজোরাশি
আধাঁরিল দশ দিশি গগণ মন্ডলে
গ্রহ সহ উল্কা জ্বলিয়া উঠিল
রহিল প্রবল বেগে উজানে ফোরাত
বিপ্লবিয়া বেলাভুমি কল্লোলে সমূদ্র
গর্জিল ভীষণ স্বাসে বিষম বিষাদে’
মুহররম ও কারবালা সংক্রান্ত কাব্য রচনায় আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। কবি আবদুল হাই শিকদার সম্পাদিত, নজরুল ইনিস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত ‘নজরুল কাব্যে আশুরা ও মুহাররম’ শীর্ষক গ্রন্থে নজরুলের মর্সীয়া গুলো একত্রে সংকলিত হয়েছে।
জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের ‘মহররম’ কবিতাটি জাতীয় জাগরণের কবিতা রূপে পঠিত হয়ে থাকে। যা নজরুলের বিদ্রোহী কাব্য গ্রন্থে স্থান পেয়েছে।
‘নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া
আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া
কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে
সেকাঁদনে আসু আনে সীমারের ছোড়াতে
রুদ্র-মাতম উঠে দুনিয়া দামেশকে
জয়নালে পড়ালো এ খুনিয়ারা বেশ কে?
তবে শোন ঐ শোন বাজে কোথা দামামা
শমসের হাতে নাও বাঁধো শিরে আমামা
বেজেছে নাকাড়া হাকে নকীবের তূর্য্য
হুশিয়ার ইসলাম ডুবে তব সূর্য’
উক্ত মোহররম কবিতায় আরো দুটি লাইন আছে তাৎপর্যপূর্ণ-
‘ফিরে এলো আবার ঐ মহররম মাহিনা
ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা’
প্রশ্ন জাগতে পারে যে নজরুল কি তাহলে আহলে বাইতের শোকে কিংবা আহালে বাইতের মহববতে কোন মর্সিয়া কোন শোকানুষ্ঠান বা ক্রন্দন চাহেন না? তিনি কি ইমাম হোসেনের (আ) শাহাদাতের শোকে বেদনাকাতর নন? অথচ আহালে বাইতের রেওয়ায়েতে একটি হাদিস আছে যে ‘আমাদের প্রিয় অনুসারীরা আমাদের জন্যে কাঁদবে’। পৃথিবীতে কত লোক মারা গিয়েছে এবং মারা যায়। তাদেরকে তো মানুষ একসময় ভূলেই যায়। একদিন দুদিন তাদের জন্যে কাঁদে। হয়তো কালে ভদ্রে বা বছরে একদিন স্মরণ সভা হয়। কিন্তু আহালে বাইতের শোকে কারবালার শহীদানদের শোকে যুগ ধরে মানুষের অশ্রæ ঝড়ছে। শোকার্তের কান্নার ভেতর দিয়ে শহীদে কারবালা বেঁচে আছেন। নজরুল কি এ বিষয়ে অবগত নন?
না বন্ধু না। কোন কোন কবিতার কোন কোন বাক্য বা শব্দাবলী জ্ঞাত অর্থের চেয়ে বা বাহ্যিক অর্থের চেয়েও অতিরিক্তি অর্থ প্রকাশ করে। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের শিল্পরূপকার বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ তাই বলেন ,‘কবিতার শব্দমালা জ্ঞাত অর্থের চেয়েও অধিক বা অতিরিক্ত অর্থ প্রকাশ করে। তাই নজরুলের কবিতার উক্ত দুটি লাইনের বাহ্যিক অর্থের চেয়ে অন্তর্নিহিত অর্থেও দিকে বেশী মনোযোগ দেয়া দরকার। নজরুল উক্ত দুটি লাইনের মাধ্যমে চাচ্ছেন শোককে শক্তিতে পরিণত করতে। তবেই জাতির আজাদি আসবে। নজরুলের মহররম কবিতাটির কাল হচ্ছে পরাধীন বাংলার সময়কাল। যখন বৃটিশ ইংরেজ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে জাতি নানাভাবে মুক্তির সংগ্রামে লিপ্ত। মুহররম কবিতাটির মাধ্যমে নজরুল বাংলার মুসলমানদেরকে জাগাতে চেয়েছেন শোককে শক্তিতে পরিণত করে। যেমনিভাবে শোককে শক্তিতে পরিণত করে সারা বিশ্বের যাবতীয় বিরোধী শক্তির সম্মিলিত ষড়যন্ত্র, রুদ্রচক্ষু ও বিরোধিতার পরও নবীবংশের রক্তজাত ও বংশজাত নেতৃত্বের নিপুণতায় আত্মশক্তিতে সটান দন্ডায়মান বর্তমান ইরান। নজরুলও তাঁর জাতির জন্যে তেমনটিই চেয়েছিলেন। নজরুলকে জাতীয়ভাবে আমরা এখনো আজো চিনতে পারিনি কিন্তু ইরানের সংস্কৃতি মন্ত্রী ঠিকই চিনেছেন। সেকারণেই ২০০৪ সালে ইরানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নজরুল সম্মেলনে সেই সময়ের ইরানের সংস্কৃতি মন্ত্রী বলেই ফেলেছেন, নজরুল আসলে ইরানেরি সম্পদ। কোন এক প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়া হয়তো নজরুলকে আমাদের মাঝ থেকে উড়িয়ে নিয়ে বাংলার কাদামাটিতে ফেলে দিয়েছে’।
আসলে নজরুল তাঁর উক্ত লাইন দুটো দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন কেবল শোক নয়া। আশুরা আন্দোলনের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে সত্য ন্যায়ের বিজয় ঘটাতে হবে। যে নজরুল লিখেছেন,‘ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা’’ সেই নজরুল-ই আবার লিখেছেন পাঁচ পাঁচটি মর্মস্পর্শী মর্সিয়া।
‘মোহররমের চাঁদ এলো ঐ কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়
ওয়া হোসেনা ওয়া হোসেনা তারি মাতম শোনা যায়’
তিনি লিখেছেন,– ‘এলো শোকের সেই মোহররম
কারবালা স্মৃতি বুকে লয়ে
আজি বেতাব বিশ্ব মুসলিম
সেই শোকে রয়ে রয়ে’
আরো লিখেছেন,
‘ ফোরাতের পানিতে নেমে ফাতেমা দুলাল কাঁদে
অঝোর নয়নে রে
দুহাতে তুলিয়া পানি ফেলিয়া দিলেন অমনি
পড়িল কি মনে রে
অসীম বেদনায় কাঁদে মদিনাবাসী
নিভিয়া গেল চাঁদের মুখের হাসি
কান্দে তরুলতা বনের পাখি
কোথায় হোসেন ডাকি ডাকি
পড়ছে ঝরে তারার রাশি’
আরেকটি কবিতার লাইন এরকম-
‘হায় হোসেন হায় হোসেন বলি
কাঁদে গিরিদরী মরু বনস্থলী
কাঁদে পশু ও পাখি তরুলতার সনে
তারি মর্সিয়া গাহে
বিশ্ব যাবে মুছে। মুছিবেনা আসু
চিরকাল কাদিবে কালের নয়নে’
এটাতো আহালে বাইতের বর্নিত রেওয়ায়েতেরই মর্মার্থ। আমাদের অনুসারীরা যুগ যুগ ধরে আমাদের জন্যে কাঁদবে।
কাজীআনজরুল ইসলাম আরো লিখেন-
, ওগো মা ফাতেমা
ছুটে আয়—- ছুটে আয়—-
তোর দুলালের বুকে হানে ছুরি
দ্বীনের শেষ বাতি বুঝি নিভিয়া যায় গো
বুঝি আঁধার হলো মদিনাপুরি’
‘মহররম’ নামে নজরুলের আরো একটি কবি আছে। সেখানে তিনি লিখেছেন-
‘ওরে বাংলার মুসলিম তোরা কাঁদ
এসেছে এজিদী বিদ্বেষ পূনঃ মোহরমের চাদ
এক ধর্ম এক জাতি তবু ক্ষুধিত সর্বনেশে
তখতের লোভে এসেছে এজিদ কমবখতের বেশে
এসেছে সীমার এসছে কুফার বিশ্বাসঘাতকতা
ত্যাগের ধর্মে এনেছে লোভের প্রবল নির্মমতা
মুসলিমে মুসলিমে আনিয়াছে বিদ্বেষের বিষাদ
কাঁদে আসমান জমিন কাঁদিছে মহররমের চাঁদ
একদিকে মাতা ফাতেমার বীর দুলাল হোসেনী সেনা
আরদিকে যত তখত বিলাসী লোভি এজিদের কেনা
মাঝে বহিতেছে শান্তিপ্রবাহ পূর্ণ ফোরাত নদী
শান্তিবারিতে তৃষাতুর মোরা ওরা থাকে তাহা রোধি
একদিকে নবী পরিবার ওরা কেবলি শান্তিব্রতী
আর একদিকে স্বার্থান্বেষী হিংসুক ক্রোধমতি
এই দুনিয়ার মৃত্তিকা ছিলো তখত যে খলিফার
ভেঙে দিয়েছিলো স্বর্ণসিংহানের যে অধিকার
মদগর্ব্বী ও ভোগী বর্বর ও এজিদী ধর্ম্মী যত
যুগে যুগে সেই সাম্য ধর্মে করিতে চেয়েছে হত
এই ধূর্ত ও ভোগীরাই তলোয়ারে বেঁধে কোরআন
আলীর সেনারে করেছে সদাই বিব্রত পেরেশান
এই এজিদের সেনাদল শয়তানের প্ররোচনায়
হাসান হোসেনে গালি দিতে যেতো মক্কা ও মদিনায়
এরাই আতœ প্রতিষ্ঠা লোভে মসজিদে মসজিদে
বক্তৃতা দিয়ে জাগাত ঈর্ষা হায় স্বজাতির হৃদে
ঐক্য যে ইসলামের লক্ষ্য এরা তাহা দেয় ভেঙে
ফোরাত নদীর কুল যুগে যুগে রক্তে উঠেছে রেঙে-
এই ভোগীদের জুলুমে। ইহারা এজীদী মুসলমান
এরা ইসলামী সাম্যবাদের কবিয়াছে খান খান
এক বিন্দুও প্রেম অমৃত নাই ইহাদের বুকে
শিশু আজগরে তীর হেনে হাসে পিশাচের মত সুখে
সার্বজনিন ভ্রাতৃত্ব ইসলামের সাম্যবাদ
যুগে যুগে এই অসুর সেনারা কবিয়াছে বরবাদ’
কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফ লিখেছেন,
‘না আমি বিদ্রোহী নই
যুদ্ধ করতে আসিনি আমি
দেখনা আমার কোন সৈন নেই, দূর্গ নেই, অস্ত্রাগার নেই
আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী-পূত্র-কন্যা
আছে ভাই বেরাদও ও কয়েগজন একনিষ্ট অনুগামী বন্ধু
আমি কারবালা পর্যন্ত এগিয়ে এসেছি একটি দায়িত্ববোধের শুভ তাড়নায়
আমার মাতামহ আল্লার রাসুল (সা), শেষনবী
তিনি প্রাচীন যুগের নবুয়তের শেষ ব্যাক্তি
তাঁর পড়ে আর কোন নবী আসবেনা
তিনি আধুনিক যুগে আল্লাহ প্রেরিত নকীব
আামি কারবালায় যিহাদের পতকা উড্ডীণ করে গেলাম
শাহাদাতের এ ঐতিহ্য আমাদের থেকেই ছড়িয়ে পড়বে
অনাগত যুগ যুগান্ত ধরে সব দেশে
মনে রেখো আমি যুদ্ধ করতে আসিনি
আমার কোন সৈন নেই, দূর্গ নেই, অস্ত্রাগার নেই
আমি প্রতিবাদ করতে এসেছি এবং শাহাদাতের ঝান্ডা
উচু করে রেখে গোলাম’।
রেনেসার কবি ফররুখ আহমদ লিখেছেন-
‘ফোরাতের তীরে তীরে কাঁদে আজো সংখ্যাতিত প্রাণ
উদভ্রান্ত ঘূর্ণিও মতো শান্তি চায় মাতমে কান্নায়
যেখানে মৃত্যুর মুখে তৃষ্ঞাতপ্ত মরুর হাওয়ায়
জিগরের খুন দিলো কারবালার বীর শহীদান
স্মৃতির পাথর পটে সে কাহিনী রয়েছে অগনণ
উজ্জ্বল রক্তের বঙে, মোছেনি তা মরু শাহারায়’
এভাবে আশুরা ও মুহররামের প্রেক্ষাপটে অনেকেই লিখেছেন। এখনো তা চলমান আছে। বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে। বিশ শতকের পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি ও নব্বই দশকের কবিরা অনেকেই আশুরা ও মুহররম নিয়ে কবিতা ও গান লিখেছেন। মর্সিয়া লিখেছেন ও লিখছেন। অথবা আশুরা, মোহররম, ইমাম হোসাইন, ফোরাত, কারবালা প্রান্তর, কে হোসাইন-কে ইয়াজিদ, ঘৃণিত সীমার, ইত্যাদি মুর্হারম সম্পর্কীত শব্দাবলীকে উপমা উৎপ্রেক্ষাতে হলেও বিভিন্ন কবিতার বিভিন্ন লাইনে প্রস্গং টেনে এনেছেন। কারবালা সংক্রান্ত স্বতন্ত্র কবিতার রচনা অথবা উপমা উৎপ্রেক্ষায় মুহাররম কেন্দ্রিক শব্দাবলীকে টেনে আনা এই সব কবিদের তালিকায় রয়েছেন, কবি সৈয়দ আলী আহসান, কবি আল মাহমুদ, কবি শামসুর রাহমান, কবি আবদুস সাত্তার, কবি আল মুজাহিদী, কবি আসাদ চৌধুরী, কবি শাহাদাত হোসাইন, কবি মাওলানা রুহুল আমিন খান, কবি ফজল শাহাবুদ্দিন, কবি মোহাম্মদ নূরুল হুদা, কবি আ স ম বাবর আলী, কবি মসউদ উশ শহীদ, কবি জহুরুশ শহীদ, কবি আবু নসরত রহমত উল্লাহ, ব্যঙ্গ কবি ফারুক মাহমুদ, কবি মতিউর রহমান মল্লিক, কবি আবদুল হাই শিকদার, কবি গোলাম মোহাম্মদ, কবি আসাদ বিন হাফিজ, কবি হোসেন মাহমুদ, কবি মেহসিন হোসাইন, কবি সৈয়দ মুসা রেজা, কবি অধ্যাপক সিরাজুল হক, কবি সোলায়মান আহসান, কবি মুকুল চৌধুরী, কবি আবদুল মুকিত চৌধুরী, কবি মহিউদ্দিন আকবর, কবি আতিক হেলাল, কবি মানসুর মুজাম্মিল প্রমূখ। আমার একটি ছড়া-কবিতা আছে মুহাররমম নিয়ে-
‘আকাশে ওই ওঠলো দেখো মোহররমের চাঁদ
ইমাম হোসেনের শোকেতে কাঁদরে তোরা কাঁদ
এই চাদেরি দশ তারিখে ফোরাত নদীর তীরে
কারবালা মাঠ লাল হয়েছে রক্তেরি আবিরে
এজিদ সীমার পাষন্ডরা ছূড়লো যখন তীর
সেই তীরেতে জীবন দিলেন আল্লাহ প্রেমিক বীর
ইমাম এবং তাঁর সাথীরা জীবন দিলেন হেসে
সত্য পথে লড়াই করে দ্বীনকে ভালবেসে
এজিদ সীমার পাষন্ডরা আজো লেগেই আছে
বীর মুজাহিদ ইমাম হোসেনের সাথীদের পাছে
ইমাম হোসেনের সাথীরা আজো বিশ্বমাঝে
করছে লড়াই ঢালছে লহু সকাল দুপুর সাঁঝে’।।
চলমান সময়েও চোখে পড়ে মুহররমের কবিতা। সকল প্রতিবন্ধকতা, অপপ্রচার, এবং নিরুৎসাহিত করণের জন্যে ভ্রান্ত ফতোয়াবাজীর পরও মানুষের হৃদয় থেকে কারবালাকে মুছে দিতে পারেনি এজিদের পক্ষশক্তি ও মানসপূত্ররা। আজো মর্সিয়াা রচনা করে চলেছেন অনেক কবি। এদের মধ্যে রয়েছেন মোহাম্মদ আতিয়ার রহমান, ইরফানুল হক, শাহনেওয়াজ তাবীব, নাজীম হোসাইন এবং নুরুল মনির প্রমূখ।
মর্সীয়া সাহিত্য ও বিষাদ সিন্ধু প্রসঙ্গ-
বাংলা মর্সীয়া সাহিত্যে বিষাদ সিন্ধুর একটা বিশাল প্রভাব আছে। এর সাহিত্য মান অতুলনীয় সন্দেহ নেই। বাংলা ভাষায় গদ্যের এপিক হিসেবে তা তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু এতে ভয়ানাক ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ আছে। বিষাদ সিন্ধুর বেশ কিছু পাঠ প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে। বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে বিষাদ সিন্ধুর পাঠ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। যারা কারবালার ইতিহাসের প্রতিপক্ষ, যারা আশুরা আন্দোলনের বিরোধী শক্তি, কারবালায় নবী পরিবারের উপর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের যুদ্ধাপরাধী যারা সেদিন ৭২ জন সঙ্গী সাথীর উপর অসম এক যুদ্ধের নামে বর্বর হামলা করেছিলো, ইমাম হোসাইন (আ) কে নিরস্ত্র অবস্থায় পানি বন্ধী করেছিলো, নবী পরিবারের সম্মাণিত নারী পুরুষ ও শিশুদের প্রতি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিলো। তাদের বর্তমান প্রজন্মের ভাবশিষ্যরা মুয়াবিয়া পূত্র ইয়াজিদকে যারা নির্দোষ প্রমাণ করে তার পক্ষে সাফাই গায় ‘বিষাদ সিন্ধু’ কে তারা এই মর্মে অভিযুক্ত করেন যে ‘বিষাদ সিন্ধু’ ইয়াজিদকে যেভাবে কুলশিত ও কলঙ্কিত করেছে ‘মাবিয়া পূত্র ইয়াজিদ নাকি ততটা খারাপ ছিলোনা। (নাউজুবিল্লাহ)। যত দোষ নাকি সব ইবনে যিয়াদের। বিষাদ সিন্ধু বাড়িয়ে লিখেছে ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া সম্পর্কে।
ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার সমর্থকরা মুসলমানদেরকে একটা ব্যাপারে খুব সতর্ক করে দেয় যে ইয়াজিদ সাহাবী পূত্র। ইয়াজিদকে গালমন্দ করলে সাহাবীর উপর সেটা বর্তায়। আর সাহাবীদের সমালোচনা করা পাপ। এমনকি তারা মাওলানা আবুল আ’লার ‘খেলাফত ও রাজতন্ত্র’ বইটিকেও এই মর্মে প্রশ্নবিদ্ধ করে সে বইয়ে কারবালা ও তৎপূর্ব ঘটনা এবং মুয়াবিয়া কর্তৃক ইয়াজিদের মনোনয়ন দান সম্পর্কে যে সব সমালোচনা করা হয়েছে এতে সাহাবীদেরকে সমালোচনা করা হয়েছে যা অত্যন্ত গর্হিত। মাওলানা’র প্রতি অভিযোগ করা হয় তিনি শিয়াদের লেখা ইতিহাস গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তাদেরকে পাল্টা প্রশ্ন করা যায় সাহাবীদের জীবনে ঘটে যাওয়া সত্য ইতিহাস যা অতীব সত্য ঘটনা সেই সব সত্য উচ্চারণ করা যদি সাহাবীদের বদনাম হিসেবে চিহ্ণিত করা হয় যাকে পাপ বা গর্হীত বলে মুসলমানদেরকে ভয় দেখানো হচ্ছে তাহলে সাহাবী মুয়াবিয়া স্বয়ং যখন অন্য সাহাবীর হাত কাটে, সাহাবী পূত্রকে গাধার চামড়ায় মুড়িয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে এবং মুয়াবিয়া ও তদীয় পুত্র ইয়াজিদের সমর্থক সাহাবীরা নিজেরা সাহাবী হয়ে অন্য সাহাবীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে। সাহাবীদেরকে গালমন্দ করে নবীপরিবার ও তাদের সমর্থক সাহাবীদের বিরুদ্ধে মসজিদে মসজিদে তাহলে সেটা কি পাপ বা গর্হীত নয়?
যা হোক ইয়াজিদপন্থীারা মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’র যে সমালোচনা করে সেটা হচ্ছে বিষাদ সিন্ধুর একমুখী পাঠ প্রতিক্রিয়া।
আবার অপরদিকে যারা আশুরা আন্দোলনের পক্ষশক্তি যারা ইমাম হোসাইন (আ) ও নবীর আহালে বাইতের ভক্ত তারাও বিষাদ সিন্ধুকে এইমর্মে আভিযুক্ত করে যে সেখানে আগাগোড়াই কারবালার প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। কারণ বিষাদ সিন্ধুতে কারবালার অত্যাচারের ঘটনা, শিশু আজগরের শহীদ হওয়া, ইমাম হোসাইন (আ)-এর শাহাদাত-এর শোকাবহ পরিবেশ এবং ইতিহাসের কিছু পরিচিত নাম বাদে আগাগোড়াই একটি কল্পিত উপন্যাস লেখা হয়েছে। এবং এখানে কিছু কল্পিত ঘটনা ও কল্পিত চরিত্র যোগ করা হয়েছে যা ইমাম হোসাইন (আ) এর জীবনে বা কারবালার ইতিহাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
এই দুই প্রকার পাঠপ্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতে বিষাদ সিন্ধু আমরা ভালো ভাবে অধ্যায়ণ করলে যতদুর ধারণা করা যায় মীর মোশারাফ হোসেন এখানে যে কাজটি করেছেন তার কিছুটা করেছেন স্বজ্ঞানে আর কিছুটা করেছেন অজ্ঞানে। স্বজ্ঞানে করেছেন মানে মীর মোশারফ হোসেন নিজেই স্বীকার করেছেন যে ‘বিষাদ সিন্ধু’’ নামে কোন ধর্মগ্রন্থ বা ইতিহাসের বই রচনা করেন নি। তিনি লিখেছেন একটি কল্পিত উপন্যাস যেখানে তিনি কেবল শহীদে কারবালার শোকাবহ ঘটনার কারবালার মর্মস্পর্শী ও হৃদয়বিদারক শোকাবহ ঘটনার শোকানুভুতিটুকুই গ্রহণ করেছেন। বাকিটা লিখেছেন কল্পনার মিশ্রণে।
আর তিনি কিছুটা করেছেন অজ্ঞানে এজন্যে বলি যে বিষাদ সিন্ধু’র রচনাকাল ১৮৮৫ সালে কারবালার প্রকৃত ইতিহাস ও নবীবংশের সঠিক কাহিনী কতজনইবা জানতো। মীর মশাররফ হোসেনইবা কতটুকু জানতেন? কেননা ১২০০ বছার যাবৎ নবীবংশের বিরোধী মতের শাষণ চলেছে বিশ্বে। তারা চালিয়েছে নানা অপপ্রচার। মানুষের মুখে মুখে শ্রুত কারবালার ইতিহাস ও বিকৃত হয়েছে নানাভাবে। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব না হলে আমরাও কি জানতে পারতাম আহালে বাইত বা নবীবংশের আসল ইতিহাস? হাজার বছর ধরে চেপে থাকা আহালে বাইতের ইসলামী জীবনদর্শণ বিরোধী মতের শাসকবর্গের তদানিন্তন মিডিয়া ও মুখপাত্রর স্বজ্ঞানে অজ্ঞানে মিথ্যাচার করে এসেছে। মিম্বরে ও ওয়াজের মঞ্চে শুনিয়েছে মিথ্যা ইতিহাস ও দিয়েছে মিথ্যা অপবাদ আহালে বাইতের অনুসারী শিয়া এবং আহালে বাইতের মহববতকারী প্রকৃত সুন্নিদের বিরুদ্ধে। তারা বলেছে আহালে বাইতের মাজহাবের অনুসারীরা শেষ নবী (সা) মানে না। তারা হযরত আলীকে নবী মানে। তারা নাকি বলে ওহীতো আলীর প্রতিই এসেছিলো জীবরাইল ভুল করে ওহী রাসুল (স)-এর কাছে নিয়ে এসেছিলো। তারা বলেছিলো আহালে বাইতের মাজহাবের অনুসারীরা ৬০ পাড়া বা ৯০ পাড়া কোরান মানে। এই হলো মিথ্যাচার ও বানোয়াট কথাবার্তার ধরণ। আমরা ছোটবেলাই এও শুনেছি যে আজকে যারা হায় হোসেন ! হায় হোসেন !! করে বুক চাপড়ায় তারই নাকি ইমাম হোসেন (আ) কে খুন করেছে। আজকে শোকে বেদনায় হায় হোসেন ! হায় হোসেন !! করে।
এভাবে তারা আমাদেরকে শুনিয়েছে মনগড়া ও বানোয়াট ইতিহাস। আর আহালে বাইতের মাজহাবের বিরুদ্ধে করেছে মিথ্যাচার। ফলে আমরাও বুঝতাম না কারা নবীবংশের সঠিক উত্তসূরী উত্তরপুরুষ। কারা তাঁদের সমর্থক ও বংশধর। কে শিয়া আর কে প্রকৃত সুন্নি। আর কে সুন্নির বেশধারী পঞ্চমবাহিনী ইয়ািজদ ইবনে মুয়াবিয়ার অনুসারী ? কারা খারিজী সম্প্রাদায়ের বর্তমান প্রজন্ম। কাজেই মীর মোশারফ হোসেন এসব নাও জানতে পারেন বৈকি। আহলে বাইতের প্রকৃত মর্যাদা সম্পর্কে তদানিন্তন সময়ে তিনি ওয়াকেফহাল নাও থাকতে পারেন।
এ প্রসঙ্গে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস আর ইতিহাস কখনো এক নয়। এটা মনে রেখেই ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়তে হবে। আবার একজন মুসলিম লেখককেও এটা বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন ধর্মীয় পবিত্র মানবদের পবিত্র জীবন আর পৌরণিক কাহিনী এক নয়।
পৃথিবীর বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক উপন্যাস ও পৌরাণিক কাহিনীর দিকে যদি আমরা তাকাই তবে দেখতে পাই হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় আদর্শের সাথে কল্পনা মিশিয়ে রচিত হয়েছে রামায়ণ মহাভারত মহাকাব্য। প্রাচীন গ্রীক জাতির ইতিহাসের সাথে কল্পনা মিশিয়ে রচিত হয়েছে হোমারের ইলিয়ড ও অডিসি। ইরানের রাজরাজরাদের ইতিহাসের সাথে কল্পনা মিশিয়ে রচিত হয়েছে মহাকবি ফেরদৌসীর শাহানামা মহাকাব্য। পলাশী ট্রাজেডি ও নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে রচিত সচিন সেনের ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে ‘আলেয়া’ ও ‘গোলাম হোসেন’ নামে দুটি কল্পিত চরিত্র আছে। এ দিক দিয়ে সিকান্দার আবু জাফরের ‘সিরাজউদ্দৌলা’ ইতিহাসের দিক দিয়ে নির্ভেজাল। ভগওয়ান এস গিদওয়ানী রচিত ‘দি সৌর্ড অব টিপু সুলতান’ বইয়ে পন্ডিত ‘পূর্ণাইয়া’ নামে একটি কল্পিত চরিত্র আছে। এরূপ ঘটনা ঘটেছে ‘আকবর দি গ্রেট’ নাটকেও। এসব হচ্ছে রাজ রাজরাদের ইতিহাস। কিন্তু ধমীয় পবিত্র ব্যাক্তি আর রাজ-রাজরাদের ইতিহাস এক নয় একথা মনে রাখা প্রয়োজন অন্তত প্রতিটি লেখককে। এসব ক্ষেত্রে তার বাড়াবাড়ি করার অধিকার নেই। ধর্মীয় পবিত্র ব্যাক্তিত্ব নবী রাসুল (স.) ইমামগনের জীবনিতিহাসের সাথে এ ধরণের কাল্পনিক কাহিনী ও কল্পিত চরিত্র আমরা কামনা করিনা। একজন বিশ্বাসী মুসলিম হিসেবে আমি কি পাড়ি আমাদের প্রিয় নবী (স)-এর জীবনিহাসের সাথে কাল্পনিক ঘটনা জুড়ে দিতে? কিংবা অস্কার পুরস্কারের যোগ্যতাসম্পন্ন ‘মহানবী মুহাম্মদ (স)’ সিনেমার পরিচালক মজিদ মাজিদী কি ইচ্ছে করলেই পারবেন তাঁর চলচিত্রে রাসুলের (স) নামে বানোয়াট কোন কথাবার্তা ও কাহিনী চালিয়ে দিতে? ধমীয় পবিত্র ব্যাক্তিত্বদের সাথে মানুষের ঈমান, আকিদা, আকিদা বিশ্বাস ও আবেগ জড়িত থাকে।
মীর মশাররফ হোসেন তাঁর যুগের এজনন শ্রেষ্ট লেখক এতে সন্দেহ নাই। আমাদের এ যুগেওতো শ্রেষ্ট লেখক আছেন। আজকে নুতন কোন বিষাদ সিন্ধু লিখা হলে নিশ্চয়ই তিনি তা করবেন না যা মীর মোশারফ হোসেনে করেছেন। কারণ আজকে ইসলাম ও মুসলিম মনোভাবাপন্ন বিশেষ করে আহালে বাইত ভক্ত কোন লেখকের দ্বারা এমন কর্ম হবে না। কারণ তিনি প্রকৃত ইতিহাস জানেন।
বিষাদ সিন্ধু বিষয়ে আমাদের করণীয়-
বিষাদ সিন্ধুর বিষয়ে আমাদের করণীয় হলো বিষাদ সিন্ধুকে বিষাদ সিন্ধু হিসেবেই পাঠ করবো। বাংলা সাহিত্যে গদ্যের এপিক বা গদ্য মহাকাব্য হিসেবে সে দৃষ্টিতেই একে দেখবো ধর্মের ইতিহাস বা ধর্মগ্রন্থ হিসেবে নয়। বাংলা মর্সিয়া সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করতে হলে বিষাদ সিন্ধুকেও লাগবে। এর পাঠ অন্তত আমার ঈমানের ক্ষতি করবেনা কারণ আমি প্রকৃত ইতিহাস জানি। ক্ষতি হবে যারা প্রকৃত ইতিহাস জানেনা। সে কারণে সবাইকে প্রকৃত ইতিহাস জানিয়ে দিতে হবে। বিষাদ সিন্ধু একসময় ঘরে ঘরে পঠিত হতো। এখন এর আর তেমন জনপ্রিয়তা নাই। মানুষ এখন অনেক সচেতন। তবে যারা জানেনা তাদেরকে বিষাদ সিন্ধু বিষয়ে স্বজাগ করে দিতে হবে যে এটি কারবালার প্রকৃত ইতিহাস নয়। এটি ধর্মগ্রন্থ নয়। কোন কোন মহল বিষাদ সিন্ধুকে বাজেয়াপ্ত করারও প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি বিষাদ সিন্ধুকে আপাতত বাজেয়াপ্ত করারও দরকার নাই আবার একে ধর্মীয় গ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করারও দরকার নাই। এটি আমাদের সংগ্রহ শালায় পড়ে থাকুক অন্যান্য বইয়ের পাশে। কেননা দেঢ়শত বছর পর একে বাজেয়াপ্ত করার আওয়াজ তুললে নুতন বিতর্ক তৈরী হবে যা মঙ্গলজনক নয়। তা না করে করে ‘বিষাদ সিন্ধুর’ র বিকল্প কোন বই রচনা করা যায় কিনা আর যা হবে সঠিক ইতিহাস নির্ভর যা ছড়িয়ে দিতে হবে সারা বাংলায়। সেটি হবে কাজের কাজ । আর কারবালার ইতিহাস চর্চাকে বাড়িয়ে দিতে হবে। কারবালার খল চরিত্রগুলো চিহ্ণিত করতে হবে। তাদের তদানিন্ত দোষর আশুরার যুদ্ধাপরাধীদের তখনকার সমর্থক ও বর্তমান সমর্থকদের মুখোশ জনগণের সামনে উম্মোচন করে দিতে হবে।
এও উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করছি যে ১৮৮৫ সালে যখন বিষাদ সিন্ধু রচিত হয় তখন বাঙালিনমুসলমানদের কোন আধুনিক সাহিত্য ছিলো না। তখন বিষাদ সিন্ধু ও আনোয়ারা নামে দুটি উপন্যাস বাঙালি মুসলমানদের ঘরে ঘরে থাকতো। আর থাকতো মকসুদুল মোমেনিন ও কাসাসূল আম্বিয়া। একথা সত্যযে বিষাদ সিন্ধু সাধারণ মুসলিম নরনারীকে কাঁদাতে পেরেছে। যারা কেঁদেছে তাদের আবেগ সত্য। বিশ্বাস ও হৃদয় সত্য। তাদের অশ্রুকণাগুলো পবিত্র। তবে সমস্যা হয়েছে কি। এক প্রবাসী ব্যাক্তি দেশে ফিরে এসে শুনে যে তার প্রিয় দাদী ইন্তেকাল করেছেন। সে তাই কবরস্থানে গিয়ে দাদীর জন্যে কাঁদে। দাদির জন্যে তিনি তার অন্তরের আবেগে কাঁদেন সেটা ঠিক আছে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে যে কবরটির পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদেন দূভাগ্যজনকভাবে সে কবরটি তাঁর দাদীর নয়। অন্য কারো। বিষাদ সিন্ধুর বেলায়ও তাই হয়েছে। বিষাদ সিন্ধুর জনপ্রিয়তা ও এবং মীর মশাররফ হোসেনের মতো ব্যাক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আল্লার কাছে ক্ষমা চাই আল্লাহ যেন মীর মশাররফ হোসেনকে ক্ষমা করে দেন।
কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার পর সেদিন নবী পরিবারের সদস্যদের উপর যে অত্যাচার করা হয়েছিলো এবং যে অত্যাচার ও নির্মূলাভিজান চালানো হয়েছিলো নবীবংশের অনুসারীদের উপর। পরবর্তি দেঢ়শত বছরের উমাইয়া ও আব্বাসিয় জালিম শাসকদের আমলে তা আজও বিদ্যমান। উমাইয়া ও আব্বসিয় জালিম শাষকদের হাতে পরবর্তীতে শিয়া ও সুন্নী উভয় মাজহাবের বড় বড় পন্ডিতগণ নিহত হয়েছিলেন। শহীদ হয়েছিলেন নবী বংশের পরবর্তী ইমামগণ। শিয়াদের এগারোজন ইমাম হযরত আলী (আ) থেকে ইমাম আসকারী (আ) পর্যন্ত (যারা ছিলেন শিয়া ও প্রকৃত সুন্নি উভয় মাজহাবের লোকদের কাছেই শ্রদ্ধাভাজনীয়) ইযাজিদী ধারার খুনিদের দ্বারাই শহীদ হন । আহালে বাইতের বিপুল সংখ্যক অনুসারী উমাইয়া ও আব্বাসিয়দের কারাগারে শহীদ হন অথবা নির্যাতনের ভয়ে দেশান্তরী হন। এইসব ইয়াজিদি ওমাইয়াদের বর্তমান প্রজন্ম কিন্তু পৃথিবীতে বিদ্যমান। আজ বিশ্বে কারা বোমাবাজি করছে। কারা শিরোচ্ছেদ করছে। কারা নিজেদেরকে সুন্নি পরিচয় দিয়ে আসল সুন্নি ও শিয়াদেরকে হত্যা করছে? ধ্বংশ করছে মানব সভ্যাতার ও ইতিহাসের মূল্যবাণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। ইসলামের ইতিহাসের এই পঞ্চম বাহিনী তথা অভিন্ন শত্রু হাজার বছর যাবৎ প্রচার ও ফতোয়াবাজি এমনভাবেই করেছে যে তারা কারবালার ইতিহাস চর্চাকে রহিত করে দিতে সক্ষম হয়েছে। আজ আমাদের দেশে মহররম মাসে কারবালা নিয়ে ওয়াজের মঞ্চ হয়না যা ছোটবেলাও দেখতাম। সম্প্রতি তারা নানা পুস্তক পুস্তিকায় এই মর্মে ফতোয়াবাজি করছে যে কারবালার ঘটনা নিয়ে কবিতা, প্রবন্ধ, মর্সিয়া, লেখা যাবেনা। কারবালার ইতিহাস চর্চা করা যাবেনা। তা নাকি বেদাত। অথচ এই কারবালাই ইসলামকে জিন্দা করেছে। ইসলামকে রক্ষা করেছে। চিনতে সহযোগিতা করেছে কে ইয়াজিদ আর কে হোসাইন। ইসলামের ইতিহাসে হুদাইবিয়ার সন্ধি যেমন ‘ফাতহুম মুবীন’ বা সুস্পষ্ট বিজয়। ঠিক তদ্রুপ কারবালার আত্মদানও ইসলামের বিজয়। উর্দু কবি শওকত আলী জওহর তাই লিখেন—
‘ক্বাতলে হোসাইন আসল যে মরর্গে ইয়াজিদ হায়
ইসলাম জিন্দা হোতা হায় হার কারবালাকে বাদ’
অর্থাৎ হোসাইনের মৃত্যু আসলে ইয়াজিদেরই মৃত্যু। ইসলাম কারবালার পর পুনুজ্জীবিত হয়েছে।
অথচ এই ফতোয়াবাজির কারণ কি? একদা এই উপমহাদেশের হিংসুটে পুরোহিতরা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ফতোয়া উচ্চারণ করেছিলো। ‘‘অষ্টাদশ পূরানাণী রামস্য চরিতানেচ, ভাষায়ং মানবাশ্রুতা রৌরবং নরকং ব্রজেত’’ অর্থাৎ যে মানবরচিত বাংলা ভাষায় অষ্টাদশ পুরাণ ও রামচর্চা করবে সে রৌরব নামক নরকে জ্বলবে। ঠিক একইভাবে কতিপয় ইয়াজিদপন্থী মোল্লা মৌলবী পুস্তক পুস্তিকা লিখছে কারবালার ইতিহাস চর্চার বিরুদ্ধে। কেননা প্রকৃত ইতিহাস চর্চা করলে তাদের আদর্শের পূর্বপুরুষদের থলের বেড়াল বেড়িয়ে যাবে। কেননা মুহররম যে তরবারীর উপর রক্তের বিজয়ের মাস। আমরা আমাদের জাতীয় জীবনে বায়ান্নের একুশের চেতনার কথা বলি। বলে থাকি ‘‘একুশ মানে মাথা নত না করা’ একুশের চেতনা স্বাধীনতার চেতনায় পর্যবসিত হয়েছিলো। আশুরার চেতনাও তদ্রুপ। আশুরার চেতনা থেকেই সত্য বিজয় লাভ করে। অত্যাচারী পরাভূত হয়। নিন্দিত হয় ধীকৃত হয়। আশুরার ইতিহাস চর্চার মাধ্যমেই এর খলচরিত্রগুলো চিহ্নিত হয়। বেড়িয়ে আসে তদানিন্তন কারবালা যুদ্ধাপরাধীদের চেহারা ও তাদের এ সময়ের সমর্থকেদের চেহারা। কাজেই এর বিরুদ্ধেতো ইয়াজিদ সমর্থকরা ফতোয়াবাজি করবেই। পলাশী যেমন আমাদেরকে চিনতে সহযোগিতা করে কে সিরাজউদ্দৌলা কে মীরজাফর। আশুরাও আমাদেরকে চিনতে সহযোগিতা করে কে ইমাম হোসাইন আর কে ইয়াজিদ। আশুরা আমাদেরকে শেখায় গাঁয়ের জোরে বিজয় লাভ করলেই প্রকৃত বিজয় হয়না। মানুষকে হত্যা করা যায় কিন্তুু তাঁর আত্মাকে কেনা যায়না। কবি বলেন, ‘জেতা শুধু জেতা নয় হারা নয় হারা/সময়যে বলে দেয় বিজয়ী সে কারা’’ কারবালায় ইমাম হোসাইন স্বপরিবারে শহীদ হয়েও বিজয়ী। আর ইয়াজীদের বিশাল বাহিনী গায়ের জোরে জিতলেও তারা অত্যাচারী জালিম।
কাতলে হোসাইন আসলযে মর্গে ইয়াজিদ হায়
ইসলাম জিন্দা হোতা হায় হার কারবালাকে বাদ’
একথা বড়ই দূঃখজনক যে আজ এই মর্মেও ফতোয়া উচ্চারিত হচ্ছে যে নবী পরিবারের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ আমরা যে গোলাম রসুল, গোলাম হোসেন, গোলাম আলী, আবদুর রসুল, আবুল হোসেন, আবদুল আলী, কানিজ ফাতেমা, কানিজ-ই বাতুল ইত্যাদি নাম রাখি তা নাকি রাখা যাবেনা। এগুলো নাকি শির্ক। (নাউজুবিল্লাহ)। তারা হৃদয়ের ভাষাকে শিরক বলছে। এই গোলাম কি আল্লার বান্দা অর্থে গোলাম? এই গোলাম কি ইবাদতকারী গোলাম? নাকি সেবক হিসেবে গোলাম? নাকি ভালবাসার নিদর্শন হিসেবে গোলাম? রাসুল (সা)-এর গোলাম ছিলো যে সাহাবী ওসামা (রা) তিনি কি আল্লার বান্দা অর্থে গোলাম ছিলেন? আবদুল্লাহ ইবনে ওমরকে যখন হযরত হাসান বললেন তোমার আব্বা তো আমার নানার (রাসুল (সা)-এর) গোলামের গোলাম ছিলো। এই কথা হযরত ওমর-এর কানে গেলে তিনি বললেন হাসানকে একটা কাগজে একথা লিখে দিতে বলো। একথা হাসান (আ) লিখে দিলে হযরত ওমর বললেন আমার মৃত্যুর পর এই লেখাটা আমার কাফনের ভেতর দিয়ে দিও। এটা আমার মুক্তির সার্টিফিকেট। এ ঘটনাকি জানা নেই এই সব ফতোয়াবাজ মোল্লা মৌলবীদের? এই সমস্ত ফতোয়াবাজ মোল্লা মৌলবীদের হাতে কয়জন লোক ইসলাম গ্রহণ করেছে। হযরত খাজা মাইনুদ্দিন চিশতি আজমিরি (র)-এর হাতে এক কোটি ভারতীয় ইসলাম গ্রহণ করেছিলো। তিনি বলেছিলেন-
‘শাহ আস্ত হোসাইন। বাদশা আস্ত হোসাইন।
দ্বীন আস্ত হোসাইন। দ্বীন পানাহ আস্ত হোসাইন
সার দাদ, ওয়া না দাদ দাস্ত দার দাস্ত ইয়াজিদ
হাক্কাকে বেনয়ে লা-ইলাহা আস্ত হোসাইন
মান বে গোলামে গোলামান হোসাইন’
অর্থাৎ হোসাইন হচ্ছে শাহ, হোসাইন হচ্ছে বাদশা, হোসাইন দ্বীন, হোসাইন দ্বীনের মুক্তিদাতা, শির দিয়েছেন কিন্ত ইয়াজিদের হাতে হাত মিলান নাই। হোসাইন হচ্ছে হক ও হকের মুক্তিদাতা, হোসাইন লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর ভিত্তি। আমি হোসাইনের গোলামদেরও গোলাম’
এই যে খাজা মইনুদ্দিন চিশতি (র) বললেন আমি হোসইনের গোলামদেরও গোলাম তাহলে তিনি কি শিরক করেছেন।
কারবালা এখনো ঘটে যাচ্ছে পৃথিবীতে। নবীবাংশের খ্যাতনামা ইমাম ও ফিকাহবিদ ইমাম জাফর সাদেক (আ) যিনি শিয়াদেরতো বটেই সুন্নিদের অনেক বড় বড় পণ্ডিতের ছিলেন সরাসরি ওস্তাদ তিনি হাজার বছর আগেই বলেছিলেন ‘হররোজ আশুরা হর জমিন কারবালা। ‘প্রতিটি দিনই আশুরা আর প্রতিটি দিনই কারবালা’ । ক্রমবর্ধমান অত্যাচারের প্রেক্ষিতেই তিনি তা বলেছিলেন। তাঁর কথা এই শতাব্দিতেও তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাভাষাভাষি লেখক সাহিত্যিকদের উচিৎ কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার শোকগাথার সাথে আশুরার আন্দোলনের প্রকৃত তাৎপর্যকে উপলব্ধী করে যুগান্তকারী সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করা। যা বর্তমান সময় ও আগামী দিনের সত্য মিথ্যার দ্বন্দ্ব সত্যকে বিজয়ী করার চেতনা সৃষ্টিকারী মাইল ফলক হিসেবে কাজ করবে। আশার কথা আমাদের দেশে ‘একুশের কবিতা’ ‘বিজয়ের কবিতা’ ‘স্বাধীনতার কবিতা’ ‘বৈশাখের পদাবলী’ ‘বৃষ্টির কবিতা’ ‘শীতের কবিতা’ র পাশাপাশি যুক্ত হয়ে সীরতের কবিতা বা মিলাদুন্নবী (সা)-এর কবিতাও চর্চা হচ্ছে পঠিত হচ্ছে। হচ্ছে নানা অনুষ্ঠানমালা। ঈদের কবিতাউৎসবও হচ্ছে বেশ কয়েকবছার যাবৎ। ইসলামের ইতিহাসের প্রাণপ্রদীপ নিহিত যে মহান ও শোকাবহ ঘটনার মধ্যে সেই আশুরা, কারবালা, মুহররমের কবিতার চর্চাও বাড়ানো প্রয়োজন।
আমিন আল আসাদ : কবি ও সাংবাদিক।
আমিন আল আসাদ অত্যন্ত যত্ন সহকারে বাংলা সাহিত্যে মুহররম ও কারবালাকে ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন। যথাযথ রেফারেন্স ব্যবহার লেখাকে মানসম্পন্ন করে তুলেছে। এ লেখা পাঠে পাঠক মাত্রই ঋদ্ধ হতে পারবে। লেখকের প্রতি শুভকামনা রইল।