সীরাতে মুহাম্মাদ সা. পাঠ ও চর্চার হদিস
।। মাঈন উদ্দিন জাহেদ।। পুবাকাশ
হদিস শব্দটি বুৎপত্তি হাদিস থেকে। আর হাদিস শব্দটি যে মহান ব্যাক্তির ভাস্য হিসেবে চিহ্নিত তিন হচ্ছেন মানবতার মহান বন্ধু মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সা:। যাঁর জন্ম ও তিরোধান মাস রবিউল আওয়াল । হেরা গুহায় আলোর পিদিম হাতে পাওয়ার আগ থেকে যিনি আরব সমাজে এক অনন্য চারিত্র সুধায় অনুসরণীয় ছিলেন। প্রত্যাদেশ পাওয়ায় হয়ে ওঠেন আরো বাঙময় আলোর পুরুষ। তিমির হনন করে আনেন নতুন ভোরের দিন। আইয়ামে জাহিলিয়াতের আরব জাজিরা হয়ে ওঠে বিশ্বশান্তি ও বিশ্বজয়ী এক বীরের জাতির সুমহান নেতা। তাঁকে জীবন চরিতে যেমন চর্চা হয়েছে, ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে তেমনি সৃজনশীল সাহিত্যেও চর্চা হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যে অসাধারণ সব কবিতা, না’ত, আলেখ্য, জীবনী, চলচ্চিত্র, চর্চা হয়েছে তাঁকে নিয়ে।
কিন্তু সারা বাংলাদেশে যখন এ মহান ব্যক্তিত্ব নিয়ে আজ মাতোয়ারা, তাঁর জন্মদিন ও আদর্শ নিয়ে উৎসব, আলোচনা মাহফিল চলছে তখন আমাদের পত্রিকার সাহিত্য পাতাগুলো দেখলে মনে হয় না তারা বাংলাদেশের মানুষ। পাতাগুলো জন বিচ্ছিন্ন মনগড়া বিষয় নিয়ে ফোকাস হয় কিন্তু এ মহান ব্যক্তিত্ব নিয়ে কোনো আলোচনা বা ফলিত সাহিত্য চর্চার সুযোগ নেই, এ জনবিচ্ছিন্নতা এক ধরনের ফ্যান্টাসি মগ্নতা ছাড়া কিছু না। সাহিত্য যত জনচারিত্র ঘনিষ্ঠ হবে ততই সমৃদ্ধ হবে, জনগ্রাহ্যতা পাবে।
আজ গতিময় প্রযুক্তিযুগের দিকদিশাহীন ভ্রান্তিমান সময়ে হযরত মুহাম্মাদ সা. এর জীবনাদর্শের আলোক দিশা নতুন ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হোক। তাঁর জীবন চরিত বা ফলিত সাহিত্য চর্চা হোক এ কালের প্রাত্যহিক প্রসঙ্গ। জেগে ওঠুক নতুন ভোরের আলোয়-
সীরাত চর্চা কেন ও কীভাবে?
সীরাত চর্চার গুরুত্ব কী এ প্রশ্নটা দিয়ে এই লেখাটা শুরু করতে পারি। কোরআন, হাদিস ও ফিকাহের চর্চার পাশাপাশি বিশেষভাবে কেন সিরাত চর্চার গুরুত্বারোপ করা হয়? এর অনেক কারণ আছে। তবে আমরা বিশেষভাবে দুইটি কারণের কথা বলতে পারি।
সামাজিক পরিসরে রাসুল্লাহ (সা.) ইসলাম কীভাবে প্রয়োগ করেছেন, এটা সীরাতেই জানা যাবে। নবী (সা.) কি কোনো বাধা ও বিপত্তি ছাড়াই ইসলাম কায়েম করেছেন? অবশ্যই না। কোনো কৌশল ও চেষ্টা ছাড়াই সব হয়ে গেছে? অবশ্যই না। ইসলাম আমাদের কাছে এখন পুঁথিবদ্ধ ও লিপিবদ্ধ বর্ণনায় রূপান্তরিত হয়েছে। যেখানে অনেক আদেশ ও নিষেধ আছে। উচিত ও অনুচিতের কথা আছে। হালাল ও হারামের কথা আছে। তবে সমাজ, রাজনীতি ও কৌশলের কথা নেই। যে জার্নি ও ক্লান্তির মধ্য দিয়ে ইসলাম কায়েম হয়েছে, তার কথা নেই। ফলে আমাদের মধ্যে ইসলাম নিয়ে অনেক ভুল ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে। কেউ বাস্তবতার কাছে নত হয়ে ইসলামের কাটছাঁট করছেন। কেউবা সবকিছুতেই কঠোরতার কথা বলে সমাজ ও সময় থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।
আপনি যদি সীরাত পাঠ করেন, তাহলে একজন মানুষ নবীকেও পাবেন। যিনি পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান। রাগ করে কথা না বলে থাকেন। স্ত্রীর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করেন। তাঁর স্বাদ-আহ্লাদ পূরণ করেন। উম্মতের চিন্তায় অস্থির হয়ে থাকেন। মৃত সন্তান কোলে নিয়ে কান্না করে উঠেন। আরও কত কী আছে সীরাতে। সে যাই হোক। সীরাত পাঠ মানে একইভাবে নবীজির সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবন পাঠ। তো এর অংশ হিসেবে কোন কোন বই পড়া যেতে পারে?
১. যারা প্রথম সীরাত পড়া শুরু করেছেন, তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো বই সীরাতে খাতামুল আম্বিয়া। নবী জীবনের মূল মূল ঘটনা এ বইয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। সংক্ষিপ্তভাবে। লেখেছেন তাকি উসমানির বাবা মুফতি শফি রাহিমাহুল্লাহু। বইটির উর্দু ও বাংলা সংস্করণ আছে।
২. সীরাত অবশ্যই বোঝার বিষয়। কেচ্ছা-কাহিনী নয়। নিছক ঐতিহাসিক ঘটনা নয়। সীরাত থেকে আমাদের উপকৃত না হওয়ার একটা বড় কারণ হচ্ছে, আমাদের বোঝাবুঝির তরিকাগত ভুল ও বোঝাবুঝির চর্চার অভাব। এ সমস্যা দূর করতে সবচেয়ে ভালো বই হচ্ছে, শায়েখ রামাদান আল বুতি রাহিমাহুল্লহুর ফিকহুস সীরাহ। বইটির আরবি ও ইংরেজি সংস্করণ আছে।
৩. ছোট আকারের মধ্যে সবচেয়ে সাজানো-গোছানো ও শুদ্ধ বর্ণনার প্রতি যত্নবান বই আর রাহিকুল মাখতুম। আধুনিক ভাষা, বর্ণনাশৈলী ও দৃষ্টিভঙ্গি। এ বইটা সবসময় হাতের কাছে রাখার মতো। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মুজাকারা, বন্ধুদের মধ্যে হালাকাহ বা রাতে ঘুমানোর আগে ১০ মিনিট করে করে চোখ-বোলানোর মতো বই। লিখেছেন ছফিউর রহমান মোবারকপুরী হাফিজাহুল্লাহু। বইটির আরবি, ইংরেজি, উর্দু, বাংলাসহ নানা ভাষিক সংস্করণ আছে। বাংলায় খাদিজা আখতার রেজায়ীর অনুবাদ বেশি জনপ্রিয়। তবে এ অনুবাদে একাডেমিক মান রক্ষা হয়নি। সবচেয়ে ভালো অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে তাওহিদ পাবলিকেশন্স থেকে।
৪. আর রহিকুল মাখতুমের প্রায় সমমানের বই হচ্ছে নবীয়ে রহমত। লিখেছেন আবুল হাসান আলী নদবি রাহিমাহুল্লাহু। তিনি গেল শতকের প্রভাবশালী আলেমদের মধ্যে একজন। তবে পার্থক্য হচ্ছে, তৎকালীন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিষয়ে বিস্তৃত বর্ণনা আছে বইটির শুরুতে। আছে লেখকের ব্যক্তিগত সীরাত পাঠের অভিজ্ঞতার গল্প। শামায়েল সংকলনের প্রতি গুরুত্ব আছে। আছে আবেগ ও রুহানিয়াত। এ বইটির সঙ্গে শামায়েলে তিরমিজি মিলিয়ে পড়তে পারেন। তাহলে ব্যাপক উপকার হবে। বইটির উর্দু, আরবি, বাংলা, ইংরেজিসহ নানা ভাষিক সংস্করণ আছে।
৫. গেল শতকের সবচেয়ে বিখ্যাত দুইটি সীরাত গ্রন্থ হচ্ছে শিবলি নুমানি ও সুলাইমান নাদাবি রাহিমাহুমাল্লাহুর সীরাতুন নবী ও আলী সাল্লাবি হাফিজাহুল্লাহুর আস সীরাতুন নাবাবিয়াহ। এ দুইটি বই সম্পর্কে কথা বলা খুব কঠিন। তার চেয়ে বরং বলা ভালো, এর মধ্যে সব আছে। প্রথম বইটির উর্দু, বাংলা, ইংরেজি সংস্করণ আছে। দ্বিতীয়টির আরবি ও ইংরেজি, বাংলা ।
৬. যারা ট্র্যাডিশনাল পাঠে অভ্যস্ত, ট্র্যাডিশনাল লেখাজোখার গুরুত্ব বুঝেন, তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো বই সীরাতে মুস্তাফা। লিখেছেন ইদ্রিস কান্ধলবি রাহিমাহুল্লহ। সঙ্গে সঙ্গে সীরাতে ইবনে হিশাম ও জাদুল মাআদ ইবনুল কাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ। প্রথম বই দুইটিতে সীরাত-সংশ্লিষ্ট সব ঘটনা আনার চেষ্টা করা হয়েছে। তৃতীয় বইটিতে সীরাতের বিষয়ভিত্তিক আলোচনা আছে। অসাধারণ একটা বই। এটি সবসময় শিথানের কাছে রেখে পড়ার মতো বই। এ বই তিনটির বাংলা অনুবাদ আছে।
৭. যারা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সীরাত পাঠ করতে চান, তারা মুনির গাদবানের আল মানহাজুল হারাকি পাঠ করতে পারেন। এ বইয়ে নবীজির জীবনের আন্দোলন তরিকা ও নীতির কথা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। সাইয়েদ কুতুব মরহুমের মাইলস্টোনের আলোকে লেখা হয়েছে।
একই সঙ্গে হামিদুল্লাহ খানের নবীজির রাজনৈতিক নথির সংকলন পাঠ আপনার সামনে নবীজির রাজনৈতিক কর্ম-তরিকা বোঝার ক্ষেত্রে ভালো সহায়ক হবে।
তেমনি নবীজির সরকার ব্যবস্থা বুঝতে সাহায্য করবে আবদুল হাই কাত্তানি রাহিমাহুল্লাহুর বিশাল বই আত তারাতিবুল ইদারিয়াহ।
৮. যারা দার্শনিকভাবে সীরাত পাঠ করতে চান, তাদের জন্য শিবলি নুমানির সীরাতুন নবীই সবচেয়ে ভালো। এর পাশাপাশি শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি রাহিমাহুল্লাহুর হুজ্জাতুলাহিল বালিগার দ্বিতীয় অংশ থেকে পড়তে পারেন। বাংলা অনুবাদ আছে।
আপনি যে রুচির মানুষই হন, নবীজির পবিত্র জীবন আপনাকে শারাবান তাহুরা বা আবে কাউসারের স্বাদ উপহার দেবে। তাই সীরাত পড়–ন জীবনভর-বছরজুড়ে এবং দৈনিক নিয়ম করে। যেখানে যে অবস্থায় থাকুন সীরাতুন্নাবীই আপনার সেরা পাথেয়। সেরা তৃপ্তি ও সেরা সুখ।
সাথে আরো পড়তে পারেন:
পয়গম্বর – জয়নুল আবেদিন রাহনুমা
সীরাতে ইবনে কাসির-ইমামুদ্দিন ইবনে কাসির
মহানবীর জীবন চরিত- ড.হোসাইন হায়কল
ফিকহুস সিরাত- ড.মুহাম্মাদ আল গাযালী
দ্য প্রফেট মুহাম্মাদ : বার্নাবি রজারসন
সীরাতুর রাসুল (ছা:)ড.মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মহনবী- সৈয়দ আলী আহসান
যাদুল মাআদ: আল্লামা ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম
সীরাহ মুহাম্মাদ সা.: জিম তামভীর
সীরাতুন নবী সা.: শাইখ ইবরাহিম আলি
আখলাকুন নবী সা. হাফেজ আবু শাইখ ইসপাহানী
মুহাম্মাদ সা. এ প্রফেট ফর আওয়ার টাইম : ক্যারেন আর্মস্ট্রং
যেমন ছিলেন তিনি- শাইখ মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিল
সীরাতুন নবী সা.(৪খণ্ড)শাইখ ইব্রাহিম আলি
সীরাহ মুহাম্মাদ সা. (২খণ্ড) ব্রেইনড্রপস প্রকাশনি
মানব সভ্যতার ইতিহাসে হযরত মোহাম্মাদ সা. এর অবদান: মাইকেল কুক
মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ সা:-নঈম সিদ্দিকী
ফুট স্টেপ অফ মুহাম্মাদ সা:- তারিক রামাদান
সীরাতে সরওয়ারে আলম- আবু আ’লা
শামায়েলে তিরমিজি-ইমাম তিরমিজি রাহ:
বিশ্বসাহিত্যে বিশ্বনবী – মুহাম্মদ নুরুল আমিন
মুহাম্মাদ সা. ব্যাক্তি ও নবী- সালেহ আহমদ শামী
মুহাম্মাদের নাম: মুস্তফা জামান আব্বাসী
তোমাকে ভালবাসী হে নবী: গুরুদত্ত সিংহ
দি প্রফেটস: সৈয়দ আলী আশরাফ।