গুচ্ছকবিতা ।। সৈয়দ আহমদ শামীম ।। পুবাকাশ
কাফকার সংসার
(এই নিদারুণ অনিত্য পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে বড় কীর্তি হলো বিবাহ : ফ্রান্ৎস কাফকা)
সংসারী হবার জন্য কী করুণ আর্তনাদই না করেছিলেন কাফকা
এই প্রবল সভ্যতার দিনে একটি আরশোলা এসে তাকে বাঁচিয়ে গেল
তোমাদের দ্রুতির পরিধি দীর্ঘ শব যাত্রার মতো একদিন মৃত হলে
কাফকাকে ডেকে এনে বলো, ওঠো, তোমার বিবাহের দিন আজ।
এখানে
আমার অন্ধত্বের জন্য আমার চোখের অপলক দায়ী
গাঢ় ঘন বিপুল রঙের সুরে সে কর্ণকে ডেকেছিল
আমার বধির হবার জন্যে কর্ণকে রাজি করায়ে দিল
চোখের অতলে বসা দৃষ্টির ধ্যান যখন পূর্বাপর পৃথিবীপূর্ব সুহাসিনী জগতরূপ দেখে
সে তখন উৎসাহে কর্ণকে জাগিয়ে তোলে
আমি যদি অর্গল দিয়ে চোখের চাঞ্চল্য হতে
কর্ণকে আলগ রাখতাম
যদি তাকে নিঃসঙ্গ হাহাকারের গহনে ছড়িয়ে দিতাম
আমি তার বয়ে আনা প্রকৃত লালসার ভেতর লোলহীন পীরিতি পসার একাকার পেতাম
হায় আমার অপলক মৃত চোখ
পৃথিবীপাড়ের দৃশ্যপটে ভেসে
কর্ণকে সাথে লয়ে
তোমরা দুই অন্ধ বধির এসে আমার হাত ধরে আছ
বিস্মৃতি
বেহেশত জীবনের কথা আমার আবছা মনে নেই
পুনরপি একটা যথাযথ রূপ পরিগ্রহ পেলে
আমি কেবল মলিন মধুর মা’র স্মৃতিপথ রেখে
পিতাজিও ফিরে গেছে
যাবার আগে আগে তারেও ভালবেসে ফেলেছি
পুনরপি বেহেশতের যথাযথ রূপ পরিগ্রহ পেলে
সেই সল্টগোলা নৌ ঘাট
শহরে আসার স্মৃতি
অপসৃয় ইলশা গ্রামের রেখা
গৌরনদী প্রবাহিত প্রথম নারীর চোখ
ইত্যকার ধূসর সঞ্চয় ফেলে
আমি কি বেহেশতে যাব না
আমি এখন দুর্বহ প্রেমের ক্ষত
অক্ষত ফেলে রেখে বিদায় নিতে যাই
আত্মীয়তা
রোদ পড়ে যাওয়া দুপুরে উত্তর বঙ্গের এক ভিক্ষাজীবী
আমার হাত থেকে চাল নিলেন, ‘মায় কউ’…
মা তো মারা গেছেন
তার মূহুর্তে বুক খালি হয়ে গেল চোখ টান টান হয়ে
কেন তাকে এভাবে বললাম আর মিথ্যাই বা কিভাবে বলতে পারতাম
আমার মার এই অজানা আত্মীয়াকে আর কোনদিন
দেখতে পেলাম না
আমার কানে বাজে ‘মায় কউ’
তেমন শব্দে আমার প্রাণ কেঁদে বেঁকে যায়
ভিখারির হাতে হতে চোখের পানির মতো চাল ঝরে যায়
তেমন দুপুরে ভিক্ষুক এলে আমার কেমন লাগে
যেন উত্তর বঙ্গের সেই মহিলার আত্মা এলো চিৎকার করে কাঁদতে
মা তাকে ভিক্ষার সাথে আর কী দিয়েছিলেন?
দারস
তওহিদি ইমারত গুলোর অন্তরালে দারস আছে
আমি তা অলক্ষ্য করেছি
পাড়ার অল্প জানা ছেলেটি বিয়েথা করেওছে
দাড়িতে মোলায়েম মেহদির আভা
বাস ছেড়ে দিলে তারে আমি পাশেই আমন্ত্রণ করি
পূর্বতন চাকুরীতে অর্ধেক বেতনে আবারও গিয়েছে
যেহেতু বিশ্ববাজার সেহেতু মন্দাজনিত
গৃহছাড়া অনুজ ফিরেছে ঘরে রাজদণ্ড তামাদি বিবেচনা করে
রাজার শ্রান্তি এসেছে শুনি, আপনি জানেন!
জানি আমি, আদতে জেনেছি আমি গূঢ়ব্যাপ পলায়নপর ভাষ
কৃষ্ণ অন্দর যার রাজার খাহেশ তরে রূপক কবিতাপাচিল
আমারে পায় না খুঁজে রাজার সান্ত্রি কিবা জগতের ক্লেশ
ব্যবসায় অধিকতর বরকত নেই!
আলবৎ – ব্যবসায় ভাব লয়ে সকল আত্মমনীষা উজাড় করে তারে প্রায় তেজারতে হাঁটিয়ে দিয়েছি
তারপর কিছু নির্বাক সময় বাহিত হলে
মনে কিবা ভাব হল অচেনা অকুল
বাসে আমি বসে আছি যার পাশে তার মুখ বিষণ্ণ নয়, তুমি কোথায় নামবে-
লালখান বাজার
হুজুরের কাছে হাদিস পড়ি প্রতি জুমাবার
বামের সড়ক ধরে সে যখন হুজুরের ডেরার দিকে চলে গেল
পিঠে ব্যাগ
লাল টী শার্ট
বিপন্ন বাজার পথে নবীর সন্ধান
জননী
প্রতিটি বিস্ময়কর মানুষকে মা জন্ম দিয়েছেন
মানবজন্মের আগে ও পরে
যে রহস্য অপার কাল জননী প্রবাহিত হন
তুমি একবার তাকিয়ে দেখ
ব্যর্থ দৃষ্টির কোলে তুমি শুধু স্নেহের প্রস্রবণ পেয়েছ
হায় ব্যর্থ মানবহৃদয়, তুমি কেবলই তবু
বাসনাবিলাসে যেয়ে
জননীর সুধা কোনওদিন জীবনে পেলে না
গড়িয়ে যেতে যেতে
জগত উল্টে যেয়ে
কর্ণের দৃষ্টিরে আমি অক্ষি জুড়েছি
হায় আমার দিবাবসানের কাল শুরু
ক্রমাগত দিবাবসানের কালে গড়াগড়ি করে
আমার শয্যা হল শর
আর আমার দৃষ্টির শ্রুতিরে মূর্তির পেলবে পেলাম
দৃষ্টির দৃশ্য আর কর্ণের শ্রুতির উল্টা জলযানে
কী পরিহাস আমার, দুনিয়া কি খাদের কিনারে না
ও অট্টহাস, আমার অনিবার ফাঁস লয়ে
যারা অশ্রুজলে ভুবন ভাসালে
আর তাদের ছায়া কোথায় খুঁজিব
তারা ছায়ার ছায়া হয়ে আবডালে ঈষত্ সলাজ হয়ে
মৃদুপা’য় এসে হেসেছিল
না তারে শ্রুতির দৃশ্যে শুনেছি
আর না দৃষ্টির কর্ণে দেখেছি
ও আমার পরিহাস
কি আমার আত্মচক্রে সহজ বাতাসের স্মৃতি
ফিরিয়ে দেবে
টলস্টয় যান
আমার শিক্ষক পাশেনকা
তিনি জানতেন না কী শিখাচ্ছেন
কারণ তার কোনো স্মৃতিচারণা নেই
অনপনেয় দুঃখের ঋতুর ভেতর
তার ক্লান্তি ও বিষণ্ণতা নেই
তার রঙিন করে তোলা ভবিষ্যত নেই
তার সমমুহূর্তগুলো বেদনার আর্তি নেই
আমিই দেখেছি নিতান্ত প্রাণের তাগিদ
জীবনের প্রাণরক্ষার সাদামাটা হেতু
পাশেনকা একটা শীর্ণ চিমনির ঝাপসা ধোঁয়ার মতো
অনুল্লেখ প্রাণের তাগিদ
পাশেনকা স্থৈর্য’র পিঠে বসা
এক অনুপম আমার শিক্ষক
ফাদার সিয়ের্গি তাকে আমাকে দিয়েছিলেন
আনোয়ারা
এ সব মহামূল্যবান কথা নয় স্মৃতিকথা
ঊনিশ শ সাতাশি, ৮৮ সালে আমি কর্ণফুলী নদী পার হতাম
মোহনার দিক-একদিকে বিশাল সমুদ্রের শুরু
আরদিকে নদীর আবাহন-আনোয়ারা যেতাম
মোহছেন আউলিয়া বুজুর্গ ছিলেন সেখানে আমার ফুফুর বাড়ী
মাহফুজ,ভুট্টো,ঝিনুক আমার ফুফাতো ভাই বোনেরা কিন্তু
সেইসব দিন মরে গেছে হাজার বছরের স্মৃতিঘেরা দূরত্বের নৈকট্য নিয়ে
আমার ফুফু মারা গেছেন বছর দু’য়েক
নাকি শতাব্দীকাল হলো,কিছু বোঝা যায় না,আমার এ দশা হয় যে
সময় বুঝি না-আনোয়ারা রুস্তমহাট যেতাম
মোহছেন আউলিয়ার মাজারলগ্ন বিশাল পুকুর -বুজুর্গি মমতাঘেরা পরিবেশ
শত লোক স্নান করে
আমি যেতাম কর্ণফুলী নদী পার হয়ে পাহাড়ের মধ্যবর্তী পথ ধরে
চাপাতলী ফেলে-চাপাতলী আমার ফুফাতো বোনের শশুর বাড়ী
কখনো যেতাম পাহাড়ের গা ঘেঁষে নেমেছে ঢালু পথ
বাস্তবের সাথেই অবিশ্বাস্য মনে হতো এতই অপরূপ পাহাড় ঘেরা
ফুফাতো বোনের সংসার,পপি নাম ছিল আমার ভাগ্নীর
এখন মেয়ের বিয়ে দেবে আর সে সময় পাহাড়ের ছায়ায়
নিচে ছেলেদের সাথে মার্বেল খেলতো বলে
আমি যখন যেতাম কিছু শেয়াল দূর পাহাড়ের খাদে
নিরাপদ দূরত্বে থেকে দাঁড়িয়ে থাকতো
আর আর পথ হেঁটে গেলে তিয়াস পূর্ণ করার কলসী
আমি এই দীর্ঘ পটভূমি করে বলতে চাইছি জলভরা কলসের কথা!
কারা তোমরা হে স্নেহাতুর পথিক জননী!
একটি কি গ্রাম যখন পার হতে যাই কোনো গেরস্ত বাড়ীর
বাহির দরজা লগ্ন সড়কের ধারে নির্মিত মাটির দেয়ালের ভিতে
একটি মাটির কলসী ও নারকেল মালার গেলাস রক্ষিত
… যারা এখনো সজীব স্মৃতি ও ভাবের কোনো
বাস্তব সুরাহা পেরে ওঠে না, যেন একটি পানির সোরাহী মাত্র!
সে সময় পথিকের তৃষ্ণা মেটাবার জন্য যারা সড়কের উপর
মাটির মমতা মাখা দেয়ালের ভিত গড়ে কলসী রেখে দিত
সেই সব মানুষের বীজ নাকি মরে গেছে সব…
এখন কী হবে এই জলঘেরা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের
তৃষ্ণার্ত পথিক সব জলতেষ্টা লয়ে চলে যাবে তার বাড়ী ও গন্তব্যে
আমি যখন আনোয়ারা যেতাম তখনকার দিনের কথা
চোখ
আমি অনেক কবিতা লিখেছি
বৈষ্ণব বোধের ভেতর যৌনমনো’পর আগাধ ক্লান্তির শেষে
মনুষ্যতর লোলজিব যেথা বাসনার উলঙ্গ শুয়ে থাকা দেখে _
মা জানতেন
বলতেন যে, পুরুষের চোখের অগ্নি লাজলজ্জাহীন
বাড়ির বউ বোরকা ছাড়া এক কদম বাহির না যায়
তোমরা যখন নেকাব ছিঁড়ে ফেলছো হাতে
সংবিধান
মা থাকলে হাসতেন, বলতেন যে
একটা মা খেকো সভ্যতার ভেতর আমার নাতনি যেন
বোরকার অন্তরাল হতে থুথু ফেলে
সৈয়দ আহমদ শামীম : নব্বই দশকের কবি ও চিন্তক।
অবলীলাদের বাড়ির পর বহুদিন ধরে আপনার কবিতা পড়িনি। বেশ ভালো লাগলো