গুচ্ছ কবিতা

মনসুর আজিজ

আত্মধ্যানের আসন

মনোজাগতিক বিন্যাসে দেখেছি নিজের অবয়ব
লৌকিক ও পারলৌকিক হিসাবনিকাশের পাঠ চুকিয়ে
আত্মজিজ্ঞাসার ধ্যানের আসনে সমাসীন হতেই
পাশে এসে দাঁড়ালো আমার আরেক আমি
না; নিজের প্রতিরূপ নয়Ñকিংবা প্রতিবিম্ব
আমার সামনে আমিই দণ্ডায়মান, আত্মপ্রত্যয়ী সুপুরুষ
অথচ ধ্যানের আসনে আমি যেন এক অপরাধী, সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি
প্রশ্নবানে জর্জরিত নালায়েক কমজোর বান্দা

অথচ ধ্যানে বসেছি প্রকৃতির সান্নিধ্য পাবো বলে
বন্ধু দাউদকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম পাখিদের ভাষা শিখবো বলে
থিওফ্রাসটসের কাছ থেকে শিখবো উদ্ভিদের সবুজ বিন্যাসের কাহিনি
আর জানবো ফুলের মোহিনি গন্ধের রহস্য কী করে তারা মোহিত করেছে
জগতের প্রেমিক-প্রেমিকাকে

জাবির ইবনে হাইয়ানের কাঁধে হাত রেখে জেনে নেবো রসায়নের ব্যবহার
ইরাটস থেনিস চিন্তার ভূগোল করে দিয়েছে এলোমেলো
হযরত খিজির সাগরের তলদেশ থেকে উঠে এসে এলায়িত বসে আছে ঝর্ণার পাশে
দার্শনিক এরিস্টটল রানী ইসাবেলার রূপে হয়েছে বিমোহিত
একটি নেংটি ইঁদুরকে থেমিস মনে করে তার পিছনে মত্ত শিকারির মতো ছুটে যাচ্ছে ডারউইন

আত্মজিজ্ঞাসার মানদণ্ড দণ্ডায়মান এক যুবক নিজের কাছেই দিচ্ছে তার হিসাব
বিভোর স্বপ্নের বিভায় নিজেই নিজের বিচারক

অলৌকিক তসতরি

হযরত শাহজালাল, আমি আপনার কাছে কিছু চাইতে আসিনি
আমার দৌলতের প্রয়োজন নেই এতটুকুু;
আমার স্ত্রীও চরের পলির মতোই উর্বর
আয়-রোজগার নিয়েও মাথা-ব্যথা নেই আর
একটু চেয়ে দেখুন নির্বোধ মেয়েরা আপনার পিতলের ডেকচিতে কিভাবে মাথা ঠুকছে
খুনি ফেরারি আপনার কবরে চুমু খায় মিনতিমাখা কণ্ঠে

টাকার চারাগাছ লকলক করে বেড়ে উঠছে এখানে
নির্বাচনে নেতাদের আনাগোনা বেশি, জেয়ারতে ভাগ্য ফেরে
আপনার কুদরতি হাত তাদের গলায় পরিয়ে দেয় বিজয়ের মালা
জাগতিক পুণ্যলাভের ফর্দ তারা আপনার খাদেমের হাতে ধরিয়ে দেয়
ব্যবসার উন্নতি থেকে সুন্দরী নারী লাভ এমনকি পরনারী ভোগের বাসনারও
পারমার্থিক মোক্ষলাভে ক্ষমতাবান লোকেরা আপনার কবরের পাশে বুকিং দিয়ে রাখে
লালশালুর নিচে খাদেমের অগাধ ধন-সম্পদ পুরাকীর্তির মতো ঢাকা পড়ে থাকে
মাশোহারা পায় বলে পুলিশও তা উল্টিয়ে দেখে না কখনো
হযরত! আপনার হৃদয় তো ছিলো প্রভুর প্রার্থনায় বিগলিত আর জীবন উৎসর্গীত ছিলো মানুষের কল্যাণে
অতলস্পর্শী রুহানি জ্ঞানের খনি ছিলো আপনার আত্মায়,
বচনে সুমিষ্ট পাখির গান, স্পর্শে ফুলের সৌরভ

হযরত! আপনার উদ্যানে আমি এক নতুন আগন্তুক
আপনার অলৌকিক তসতরি থেকে জ্ঞান ও হিকমার
সামান্য একটু ঢেলে দিন পথিকের হাতে
যেন আজলা ভরে পান করে প্রভুর প্রার্থনায় বিগলিত হতে পারে।

বাংলাদেশ…

বাংলাদেশ যেন হ্যান্ডকাপ পরা বৃদ্ধ কয়েদি
পায়ে তার দাগি আসামির বেড়ী
পুলিশের নির্যাতনের চিহ্ন উঁইডিবির মতো ছড়িয়েছে চারদিকে
র‌্যাবের রিমান্ডের দাগ লেগে আছে থকথকে শরীরে
পায়ের আঙুল থেকে চুঁইয়ে পড়ছে রক্ত
সেলাই করা কপালের ভাঁজে জমাট রক্তের দাগ
পুলিশের চার্জশিটে শোনা যায় মায়ের আর্তনাদ
বোনের বক্ষবিদীর্ণ চিৎকার
বিচারকের আসনে বসেছে ভয়াল আজদাহা
ছোবলে ছোবলে বিষাক্ত করে আসামীর শরীর
আদালত অঙ্গণ যেন মতিঝিল
টাকার মাতাল সুবাস ছড়ায় চারদিকে
ফেরারি চোখের ঘৃণা জমা রয় চোয়ালের ভাঁজে
মানবতা গান গায় বন্দি পাখির মতো

আর কতো রক্ত!
শৃঙ্খলিত মানুষের হাহাকার শোনা যাবে শিউলির সিগ্ধ সকালে
বিরহী নারীর বকুলের মালা শুকিয়েছে সেই কবে
পান্তার মাছি তাড়াতে তাড়াতে
শুকিয়েছে প্রতীক্ষিত মায়ের অশ্রু

খুলে দাও আমার হাতকড়া
পায়ের বেড়ীর বদলে এনে দাও লাঙল-কাস্তে
বিরান মাঠে ফলাবো এবার
সোনাঝরা ফসলের হাসি
অমিত স্বপ্নভরা আমার বাংলাদেশ…

কামের পলেস্তারা

চুড়ি বাজে মনে মাঝরাতে টুংটাং
সুর পেলে বাজে কামঘামে রিনঝিন
কোথায় লুকালো আনত নয়ন তার
ধুকপুক মন সেই সে স¦লাজ দিন।

এমন করে কি খুলেছি নিজেকে কভু
যেমন আঁধারে পুষ্পের কলি ফোটে
মাতাল রাতের উদাস মনের কোণে
সুরভি ছড়িয়ে তোলপাড় করে ছোটে।

ঝুরঝুর ঝরে কামের পলেস্তারা
কালোর গায়েও আলোর পরশ ঢালে
উন্মুল রাত পাড়ি দিয়ে তবে দেখি
ভোরের বাতাস লাগছে নায়ের পালে।

জীবন এমন অচেনা দ্বীপেই কাটে
অচেনা মানুষ হাত ধরে তবু হাঁটে।

রাতের পাতা হবো

শেয়ালের ডাক শুনে
ঘুমের আলিঙ্গন ছেড়ে উঠে বসলাম বিছানায়
বাতাসে পাতাদের কিচিরমিচির
শুকনো পাতার বয়েসি আর্তনাদ,
যুবতী পাতার শীৎকার ধ্বনি শুনে
আমারও মন চায় রাতজাগা পাতা হয়ে যাই
জোসনার আলো মেখে উঁকি দেবো জানালায়
মানুষের রমণে ঢেলে দেবো ক্লোরোফিল
নারীরা জন্ম দেবে সুপুষ্ট শিশু
তবে আর বৃক্ষ সংহারে মাতবে না তারা
নদীর শরীর ছুঁয়ে শুষে নেবো তার বিষ
গতিহীন পথহারা নদীর কণ্ঠে শোনা যাবে কুলুকুলু গান
সঙ্গম শেষে জানালায় দাঁড়াবে প্রশান্ত নরনারী
দেখবে পাতাদের শরীর বেয়ে নেমে আসা
নির্মল জোসনার প্রলেপ
ধীরে ধীরে নেমে গেছে নদীর জলে
শেষরাত্রির স্নিগ্ধতার মতো পবিত্র হবে মানুষ
কচিপাতার মতো নির্মল হবে অন্তর।

যোগ্য অযোগ্য

অযোগ্যরাই পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখে যোগ্যদের
বেকুফ কলাগাছ আছে বলে হস্তিদল দাপিয়ে বেড়ায় ভূখণ্ডে
মটরের দানায় শক্তি পায় তেজি ঘোড়া
নির্বোধ কেরানি নিখুঁত হিসাব করে বলে
জিডিপির কেশর ফুলে ওঠে
ঘাড় কাত করা মানবমহিষ বয়ে বেড়ায় ঘুষখোর মনিবের ফাইল
ছুটাবুয়া একদিন যদি ভুল করে গিন্নির মুখ ঘষে দিতো
পার্লারে সেজেগুজে হতো যদি মনিবের সহচারী
ড্রাইভার গেট খুলে মালিককে ফেলে দিতো খাদে
নাপিতের ক্ষুর যদি অন্তত গাল কেটে দিতো
তবে বলো; টিকে যেতো কারা?

কতোগুলো অযোগ্য শিকড় আছে বলে
বৃক্ষগুলো মর্দামি শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আজো
অস্পৃশ্য কেচো মাটিডিম প্রসব করে বলে
তরতাজা আনাজে ভরে ওঠে কৃষকের শূন্য ডালা
চালুনের ছিদ্র দিয়ে যদি একবার অযোগ্যরা বের হতে পারে
যোগ্যদের কতৃত্ব কোথায় লুকাবে সেদিন!

মেয়েটি

মেয়েটিকে একসময় ঘৃণা করতাম
আমার টানটান বিছানায় হিসু করলে
ঠাস করে চড় বসাতাম গালে
মাকে বলতামÑ এই মেয়েটিকে আমার ঘরে আনলে
বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো একদিন
মা হাসতেন মেয়েটির মায়ের দিকে চেয়ে।

মেয়েটি বেণী দুলিয়ে ইশকুলে যায়; আমি কলেজে
বাঁশঝাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতাম ওর ছন্দময় হাঁটা
বেণী দুটো কেউটের বাচ্চা, ফোঁস করে আমার দিকে চেয়ে
রাতে ভয় পেলে মনে হতো মেয়েটি যদি বিছানায় বসে মাথা টিপে দিতো…

অন্যপাড়ার বিদেশ-ফেরত ছেলেটি আসলো মেয়েটিকে নিতে
মেয়েটির মুখে গোধূলির আভা
আমার চোখে অস্তমিত সূর্য
মেয়েটির চোখে পূর্ণিমার চাঁদ
আমার মনে জোসনার স্রোত
তারপর জানালায় চেয়ে দেখিÑ
আলোর মিছিল হাঁটছে মেয়েটির পিছু পিছু
ছেলেটির মনে জ্বলছে মিটিমিটি তারা

দুমড়ানো বিছানার দিকে চাইলাম
ভেজা দাগ এখনো লেগে আছে তার গায়ে।

বন্দুক

দাদাজানের একটি দোনলা বন্দুক ছিলো পাখি শিকারের
ছোটবেলা বের হতাম দাদার সাথে
নানা-পদের পাখির মাংস শোভা পেতো বাটিতে
তৃপ্তির ছানাপোনা উল্লাসে ফেটে পড়তো দস্তরখানে
দাদার মৃত্যুর পর মিরাসি সম্পত্তি হিসেবে বন্দুকের মালিক হন বাবা
পাখির বদলে কৈশোরে দেখেছি বন্দুকের নলে লেগে আছে
অসহায় রায়তের রক্ত।

মা বন্দুককে ভীষণ ভয় পেতেন
বাবার হাতে বন্দুক দেখলে ভয়ার্ত পাখির মতো লুকাতেন ঘরের কোণে
একদিন বাবা হয়ে ওঠেন মত্ত শিকারি
মায়ের চিবুক স্পর্শ করে আছে বন্দুকের নল
বাবা হয়ে ওঠেন আমেরিকা, মা বিধ্বস্ত ইরাক
আমেরিকা কখনো পরাজিত হয় না
আমরা দুটি ভাইবোন জড়োসড়ো হয়ে নির্বাক কাঁদছি
ভয়ার্ত জিরাফ সিংহের সামনে যেমনটি থাকে।

বোনটি আমার বড় হয়েছে বেশ
সেই কৈশোরেই আমি হয়ে উঠি ওর অভিভাবক
পাশের বাড়ির সুদর্শন ছেলেটি ঘুরঘুর করে চারপাশে
বোন আমার চড়–ইছানা
একদিন বাগানে দেখলাম ওরা হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে
আমার মাথায় ওয়ারিশান সম্পত্তির মতোই নেচে উঠলো রক্ত
বন্দুকের নল ছেলেটির দিকে তাক করতেই
আদরের বোনটি পাখির ডানা বিস্তার করে দাঁড়ালো সামনে

আমি নির্বাক
বন্দুকটি ছুঁড়ে দিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরলাম বুকে
ছেলেটিকে ইশারায় ডাকলাম কাছে
তারপর;
আমি বাগানে একটি গাছের ডাল হয়ে গেলাম
আর ওরা দুটি পাখি।

স্পর্শের রেণু

কোমড়ের ভাঁজে ভাঁজে যদি দাও স্পর্শের রেণু
আমি তবে নীলফুলে ভরাবো প্রেমের মাচান
যদি দাও কাবিননামার সাৎক্ষরের মতো কাঁপাকাঁপা অনুভূতি
আমি তবে টানটান পাল খাটাবো উথাল নাওয়ের মাস্তুলে
উত্তাল নদীতে এঁকে দেবো ঢেউয়ের কারুকাজ
তুমি যদি হও শস্যের প্রশান্ত বিছানা
বীজ বুনে ভরে দেবো সমৃদ্ধির গোলাঘর
তোমার চারপাশে শুনতে পাবে নতুন শব্দের বাজনা
তোলপাড় করা মা মা ধ্বনিতে প্রতিধ্বনি নেচে উঠবে চারপাশে
দৃষ্টির ভাঁজে ভাঁজে দেখতে পাবে আনন্দের নাচানাচি।

যদি দাও একচিলতে চাঁদের স্নিগ্ধতা
আমি তবে জোছনার জোয়ার এনে দেবো তোমাকে

এই ধরো দুটি হাত, চেয়ে দেখো দুই চোখে
তারার আকাশ কতো ঝিকিমিকি জ্বলে।

নারী, সেতো একমুঠো মুগ্ধতার নাম
পলি ভরা বুক তার বহমান তটিনী
নতুন ক্ষেতে থোড়-ওঠা ধানের ডগা
কিষানের মাথার উপর পুঞ্জপুঞ্জ প্রশান্তির মেঘমালা।

মনসুর আজিজ : কবি ও সম্পাদক, আড্ডাপত্র।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন