মীর্জা গালিবের কবর ও দিল্লীর কড়চা ।। নাসির উদ্দিন আহমদ

১. শারাবী...

দিল্লীর আশে-পাশেই লোকটির বাড়ি। বয়স পঁয়ত্রিশ—দেখলে মনে হয় আরো পনেরো বছর বেশীই হবে। সাত বছর যাবৎ ডায়াবেটিস—অনিয়ন্ত্রিত। শরাব পান করতে করতে অগ্ন্যাশয়ের ধ্বংস ডেকে এনেছে। অগ্ন্যাশয়ের মাঝে এখন অজস্র ক্ষুদে পাথরের ঘরবাড়ি। আমরা বলি ক্রনিক।

ক্যালসিফিক প্যানক্রিয়াটাইটিস। অ্যালকোহল সেবনের অজস্র খারাপ পরিণতির একটি হলো এই রোগ। আর অগ্ন্যাশয় ধ্বংস হলে তো ইনসুলিন পয়দা হবে না। ফলস্বরূপ ডায়াবেটিস—যা ঔষধ সেবন করে নিয়ন্ত্রন করা যাবে না কখনো। প্রয়োজন হবে ইনসুলিন ইন্জেকশন।

তাকে বললাম—আভি শরাব পিয়ো? লোকটি বললো—জ্বি হ্যা। ধূমপান করো? বললো—না, তবে গাঁজা টানি।
লোকটি এক কাঠি সরেস। তাকে বললাম—যাও, এখনি সুগার পরীক্ষা করে এসো। লোকটি যখন চেয়ার থেকে উঠতে যাচ্ছে তখন মনে হলো তার ভারসাম্য ঠিক নেই। লোকটিকে যখন দেখছিলাম তখন সুন্দরী এক মহিলা খুব নজর দিয়ে দেখছিলো আমাকে। লোকটি যাওয়ার পর মহিলাটি এলো। কোলে এক ফুটফুটে শিশু। বললাম—বাতাও, কিয়া দিকখিত?

মহিলাটি বললো— রোগী তার স্বামী। এখনো শরাব পান করে। গাঁজা টানে হরদম। আর মিষ্টি খাওয়ার প্রতি তার বেজায় লোভ। আমি যেন তাকে এসব বারণ করি। এই রমণীর গভীর দু:খবোধ আমার হৃদয় স্পর্শ করলো।
লোকটির সুগার রিপোর্ট তাৎক্ষণিক হাতে এলো—৪৫৫ মি. গ্রা/ ডি. এল—যার মানে ডায়াবেটিস একেবারেই নিয়ন্ত্রনের বাইরে।

তাকে বললাম—তোমার তো ইনসুলিন ছাড়া উপায় নেই। সে বললো—স্যার ওষুধ দ্বিগুন করে দাও। আমি বললাম ট্যাবলেটে তো কাজ হবে না। আর শরাব, গাঁজা এসব বন্ধ না করলে ইনসুলিন তো চার বার লাগাতে হবে। এবার সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। খুব উত্তেজিত। স্ত্রীর দিকে আঙ্গুল তুলে বলতে থাকলো—স্যার ও যদি টর্চার বন্ধ না করে তবে আমি এসব ছাড়তে পারব না। সুন্দরী মহিলাটিকে কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তবে লোকটিকে বললাম—দেখো শরীর তো তোমারই পঁচবে এসব ছাই-পাশ খেলে। তোমার স্ত্রীর তো কিচ্ছু হবে না তাতে। ওরা চলে গেলো। তবে তুলে ধরে গেলো এ সমাজচিত্র।

পুনশ্চ: আজ যত পুরুষ রোগী দেখেছি তাদের শতকরা আশি জনই ছিলো মদ্যপ।
১৮.১২.১৯/ দিল্লী।

২. লড়াকু রোগীর জন্য ক্রেস্ট…

মায়ের কোলে থাকা অবস্থায়ই অনেকের সাথে গাঁট বেঁধেছে ডায়াবেটিস। কারো শৈশবে, কারো কৈশোরে আর কারো বা যৌবনের শুরুতে রক্তে দানা বেঁধেছে এই রোগ। বেশীরভাগই টাইপ-১ ডায়াবেটিস—আজীবন যাদের নির্ভর করতে হবে ইনসুলিনের ওপর। এই সব রোগীদের নিয়ে ছিলো আজ ক্যাম্প—All India Institute of Medical Sciences এর পূর্ব চত্বরে।

দিল্লীর তাপমাত্রা নেমে গেছে কোথাও চার ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে। এই শৈত্য প্রবাহের কারনে যত আশা করেছিলেন উদ্যাক্তাগণ তত রোগী অবশ্য হয়নি। তবে এক ক্যাম্পে ৩৯৩ জন টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীর উপস্থিতি নেহায়েত কম নয়।

বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। শুরুতেই কার্ড নিয়ে চলে যেতে হবে ভিতরে। অসংখ্য কাউন্টার। এক এক জায়গায় একেক আয়োজন। ওজোন, উচ্চতা, কোমড়ের মাপ, রক্তচাপ নির্ণয় করে চলে যেতে হচ্ছে রক্ত আর পেশাবের নমুনা দিতে।

চক্ষু পরীক্ষার জন্য বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ এসেছেন। বাইরে ওষুধ দেয়া হচ্ছে রেটিনা ভালোভাবে পরীক্ষার জন্য।
ভিতরে চলছে রেটিনা দেখার কাজ। আমরা করছি স্নায়ুবিক পরীক্ষা। সবগুলো অনুভূতি পরখ করে লিখে দিচ্ছি।

রক্তের রিপোর্ট চলে আসছে। তৈরী হচ্ছে ফাইল। পেশাবের নমুনা থেকে এলবুমিন ক্রিয়েটিন অনুপাত নির্ণয় হচ্ছে সেকেন্ডের মাঝে স্ট্রিপ থেকে। লিপিবদ্ধ হচ্ছে তথ্য-উপাত্ত। একদিনেই পাওয়া যাবে গবেষণার নানাবিধ কাঁচামাল। এক কথায় দারুণ।

রোগীরা খালিপেটে এসেছে রক্ত দিবে বলে। সবার জন্য তাই নাশতার আয়োজন ছিলো—ছিলো দুপুরের খাবারও।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ধারাবাহিক শিক্ষা প্রদান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোগীদের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানদানের জন্য স্টল খোলা ছিলো। ইনসুলিন প্রয়োগ পদ্ধতি, গ্লুকোজ কমে গেলে করণীয় বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে ক্যাম্পে। ইনসুলিন লাগানোর জন্য পুরুষ নারীদের জন্য আলাদা দুটো কক্ষ। বিনামূল্যে রোগীদের দেয়া হচ্ছে ইনসুলিন।

ডায়েটিশিয়ান রয়েছেন বেশ কয়েকজন। তারা নিয়েছেন এক কর্ণার। সেখানে খাদ্য-পুষ্টির জ্ঞান প্রদানের জন্য ছিলো নান্দনিক আয়োজন।

শেষের আয়োজন ছিলো সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সমস্ত কর্মযজ্ঞ শেষে রোগী ও আগত অভিবাবকগণ দুপুরের খাবার নিয়ে বসে গেছেন বিশাল এক অডিটোরিয়ামে।
ছোট্ট এক অনুষ্ঠান। রোগীদের বেশীর ভাগই শিশু কিশোর। তাদের জন্য তিনটি গ্রুপে ছিলো চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। বিজয়ীদের পুরষ্কৃত করা হলো এখানে। পঁচিশ বছর যাবৎ যারা রোগটির সাথে লড়ে যাচ্ছেন তাদের দেয়া হলো ক্রেস্ট। এবার ক্রেস্ট পেলেন নয় জন রোগী। কয়েক বছর ধরেই এই ধারা চলছে। দুয়েক সপ্তাহ আগে আউটডোরে আমিও দেখেছিলাম এমন এক রোগী—যার বয়স চুয়াল্লিশ, রোগের বয়স এক চল্লিশ। তিন বছর বয়স থেকে সে এই রোগ বয়ে চলছে। রোগীটির সাথে ক্যাম্পে আজও দেখা হলো।

এসব আয়োজন শেষ করে আমরা ডাক্তার, নার্স, সকল স্টাফ চলে এলাম AIIMS এর কনভার্জেন্ট বিল্ডিং এর নিচতলায়। বিশাল ডাইনিং রুম। ভেজ-খাদ্যের নান্দনিক সমাহার। দারুণ সব স্বাদের খাবার খেয়ে, দারুণ এক অভিজ্ঞতার ঝুলি কাঁধে নিয়ে চরম শৈত্যের ভিতর হেঁটে হেঁটে চলে এলাম নিজের ডেরায়।
২৮.১২.১৯/ দিল্লী।

৩.ঠান্ডা ঠান্ডা দিল্লী…

বাংলাদেশ থেকে গত পরশু(২৬ ডিসেম্বর’১৯) আমার দয়িতা উদ্বেগাকূল হয়ে জানতে চাইলো—আমি জমে গেছি নাকি? আমি পাল্টা শুধালাম কেন? উনি জানালেন বাংলাদেশের টেলিভিশনের খবরে জানিয়েছে দিল্লীর তাপমাত্রা ২.৪—গত কয়েক বছরের মাঝে নাকি এত নিচে নামেনি দিল্লীর তাপমাত্রা। আর খবর দেখেই ভাইবারে কল। আমার এক বন্ধু বললো—একটা ঠান্ডা মানুষ দিল্লীতে গেলো তাই বলে দিল্লীই এত ঠান্ডা হয়ে যাবে! আমি নিরুত্তর।

তবে কদিন আগেই তো মানালিতে গিয়ে বরফের ভিতর দিয়ে হেঁটে এলাম এজন্য দিল্লীর ঠান্ডা নস্যি মনে হচ্ছে। যদিও ঘরের বাইরে বেরুলে রাস্তায় মানুষের আগুন পোহানোর দৃশ্য দেখে আমিও খানিক আক্রান্ত হয় শৈত্যে।

কাল ভরা দুপুরে বাইরে বেরিয়ে গলির মুখে দেখি কয়েক যুবক। জ্যাকেট পরিহিত যুবকদের কানটুপি ছিলো উলের—কারো গলায় মাফলার পেঁচানো। আগুন জ্বালিয়ে উত্তাপ নিচ্ছে হাতে-পায়ে। দৃশ্যখানা আমার হাড়ের ভিতর কনকনে এক শৈত্য অনুভব ছড়িয়ে দিলো। হাতে কানটুপি নিয়ে ভাগ্যিস বেরিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় পরে নিলাম রঙিন উলের টুপি। কিছুক্ষণ পরে আপনাতেই কান আটকে দিলাম। মনে হচ্ছিলো মুখটাও আটকে দিই উলের বসনে।

গেলাম হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মাজারে। মাগরিবের আযান দিয়েছে সবে মাত্র। মাজারে প্রবেশের গলিতেই বিশাল এক মসজিদ। অযু করতে গিয়ে মনে হলো হাতে মুখে পায়ে যেন বরফ মেখে নিচ্ছি। মেঝেতে খালি পায়ে দু-মিনিট হাঁটতেই মনে হলো পা বুঝি অবশ হয়ে যাচ্ছে। নামাজান্তে বাইরে এসে দেখি চায়ের দোকানের সামনে বিশাল কিউ। ঠান্ডার জুলুম থেকে পরিত্রাণের জন্য উষ্ণ চা-কফির কাছে সঁপে দিচ্ছে নিজেদের। আমিও সেই দলে শামিল হলাম।

আজকের সকাল ছিলো ভয়ানক। কুয়াশা মাখা দিল্লী। দেড়শ মিটার সামনের কিছুই দৃশ্যমান নয়। গাড়িগুলো কুয়াশা-বাতি জ্বালিয়ে ধীরে হাঁটছে। আমিও হাঁটছি। দুহাত দুপকেটে—মাথায় উলের আবরণ। কদিন আগেও যাদের দেখতাম ছোট্ট টপ আর তারচেয়ে ছোট হাফপ্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াতো তাদেরকেও শৈত্যতা এসে পরাস্থ করেছে। গা পুরোটা ঢেকে গলায় পেঁচিয়েছে মাফলার।শীত এসে তাদের জন্য কিছুটা গা ঢাকার অভ্যাস করিয়ে নিচ্ছে!

আজ প্রথম একটি জিনিস জানলাম। আবহাওয়ার নোটিশ দেখাচ্ছে বিকেলে দিল্লীর তাপমাত্রা আট কিন্ত অনুভবে পাঁচ। ব্যাখ্যায় বলছে ফগ। ফগের কারণে আসল তাপমাত্রা যা থাকবে অনুভব হবে তার চেয়ে দু-তিন ডিগ্রী কম। তার মানে আজ সাত-সকালে ঘন কুয়াশার চাদর পরে যখন হেঁটে অফিসে যাচ্ছিলাম তখন অনুভব ছিলো তিন ডিগ্রী সেলসিয়াসের মতো।

মেট্রো থেকে নেমে ইচ্ছে করেই শীত উদযাপনের জন্য ইউসুফ সরাই মার্কেটের ভিতর দিয়ে হেঁটে এলাম। দুশ মিটার গলিতে নিদেনপক্ষে দশটি জায়গায় মালসা ভরা আগুন। যুবক বৃদ্ধ মিলেমিশে আগুনের কাছ থেকে ধার নিচ্ছে উত্তাপ। এত শীত! ভড়কে গেলাম। তাড়াতাড়ি ঘরে এসে চালু করলাম রুম হিটার আর বললাম আয় শীত আয়।
৩০.১২.১৯/ দিল্লী।

৪. বিদায় ২০১৯…

২০১৯ সালের শেষ দিনটি চিরতরে ডুব দিলো ইতিহাসের গহবরে। কাল নূতন বছরের সোনালী সূর্যোদয়। এভাবেই দিন যায় দিন আসে। বছর ফুরায় নূতন বছর হাসে। আমরা ক্রমে এগুতে থাকি ভবিষ্যতের পথে। একদিন এভাবে হঠাৎ করেই আমাদের জীবন পাড়ি দিবে না-ফেরার দেশে।

বছরের আজকের শেষ দিনের মতো যদি কেউ জানতে পারত আজ তার জীবনেরও শেষদিন—যদি জানতে পারত কাল শুরু হবে না-ফেরার দেশের প্রথম দিন! তবে কেমন হতো বিষয়টি। মনে হয় সব আনন্দ থেমে যেত, পৃথিবীর স্বজনেরা তাকে ঘিরে রাখতো—বেঁধে রাখতে চাইতো যে কোন বিনিময়ে।

সময়ের মতো জীবনকেও আটকানো যাবে না। সেজন্য বছর চলে যাওয়ার এই সময়গুলোতে মন হু হু করে ওঠে। মনে জাগে চলে যাওয়ার ভাবনা। পাতাগুলো ঝরে যায়। নূতন পাতা হাসে। একটি বছরে কত জীবন চলে যায়—কত নব-জীবন হাসে।

তবু এতসব বিষন্ন ভাবনার অন্তরালে মুখ বাড়িয়ে বলতে সাধ জাগে—মঙ্গলময় হোক সবার আগামী। বিশ্বাসে-কর্মে
জ্বলে উঠুক প্রতিটি নূতন ভোরে জীবনের দীপ্র প্রদীপ। সবাই সুস্থ থাকুন, রঙিন থাকুন, দীপ্তিময় থাকুন ঈসায়ী ২০২০ সালে।
শুভেচ্ছা রইলো অফুরাণ নূতন বছরের..
৩১.১২.১৯/ দিল্লী।

৫. ওয়াল্ড বুক ফেয়ার-২০২০

কাল রাতে ভারতীয় এক ডাক্তার বন্ধু জানালো দিল্লীতে—“World book fair 2020”—শুরু হয়েছে। তুমি যেতে পারো। রাতেই সিদ্ধান্ত নিলাম দিনে-দুপুরেই হাজিরা দেব মেলায়। মেলা হচ্ছে প্রগতি ময়দানে। এই ময়দান দিল্লীর সবচেয়ে বড় মিলন মেলা—দেড়শত একর জায়গা জুড়ে এর কলেবর। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা সহ প্রায় সারা বছর সত্তরটিরও বেশী বিভিন্ন মেলা আর সম্মেলন বসে এই স্থানে। প্রতি বছর ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষ এই স্থানে আগমন করে বিভিন্ন মেলায়।

মেট্রোতে চেপে প্রগতি ময়দান স্টেশনে নামলেই ১০ নম্বর গেট দিয়ে বের হয়ে খানিকটা হেঁটে এলে মেলার প্রবেশ দ্বার। এগারোটায় মেলা শুরু। বেলা সাড়ে বারোটায় আমার আগমন। দেখি তোরণে বিশাল ভিড়। মানুষের ঢল। বিশ রুপী দর্শনীর বিনিময়ে প্রবেশ। রাজপথের মতো প্রশস্ত পিচঢালা রাস্তা। দুধারে শিমুল, বট গাছের সারি। পাশেই উড়াল পথ দিয়ে ধেয়ে যাচ্ছে রেল। মানুষের ঢল আছে কিন্ত ধাক্কা-ধাক্কি নেই।

বেশ খানিকটা পথ চলার পর রাস্তা বামে বেঁকে গেছে। তারও কিছু পথ পরেই দুপাশে বিশাল দুই হল-ঘর। এর ভিতরেই শত শত বইঘর—স্টল। প্রথমেই আশ্চর্য হওয়ার পালা। স্টল জুড়েই বড় বড় বই—ইংরেজী ফিকশন, উপন্যাস। এক জোড়া বই মোটে একশত রুপী। সামনে এগুতে তো আরো তাজ্জব হওয়ার পালা। তিনটি বই একশত রূপী। শিশুতোষ বই তিনটি একশত রুপী। মানুষ হুমড়ি খেয়ে বই কিনছে। এ যেন অন্য রকম দিল্লীর রূপ। অনেক বই শতকরা ৫০ ভাগ কমিশন। হিন্দী, ইংলিশ, উর্দু বই এর সমাহার। আছে কিছু বাংলা বই এর স্টল। সমস্ত মেঝে জুড়েই মুড়ানো গালিচা। স্টলগুলো সাজানো গোছানো। কিছু কিছু স্টল ভিড়ে ঠাঁসা—কিছু স্টল ফাঁকা।
মহাত্মা গান্ধীর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এবারেই বই মেলার মূল প্রতিপাদ্য—গান্ধী : লেখকদের লেখক।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানী, চীন, সৌদী আরব, ইরান, নেপাল সহ বিশ্বের কুড়িটি দেশ তাদের স্টল সাজিয়েছে। বাংলাদেশ অবশ্য এখানে নেই। ঘুরে ঘুরে দেখছি আর এর তেরশত নন্দিত সজ্জিত স্টলের বাহারী রূপ দেখে মুগ্ধ হচ্ছি। বই কিনছি আর মনে মনে ভাবছি—ওজোন কত হলো। কেননা বই তো বিমানে চেপে নিতে হবে। এমনিতেই লাগেজের ওজোন ত্রিশ কেজি ছুঁই ছুঁই করছে। বই কেমনে নেব? কিনতে কিনতে যখন মনে হলো ওজোন পাঁচ কেজির বেশী হয়ে যাচ্ছে তখন ক্ষান্ত হলাম। কিন্ত মন চাইছিলো আরো বই কিনি। দিল্লী আমার ঘর হলে মণ খানিক বই কিনে ফেলতাম নিশ্চিত। ঘুরতে ঘুরতে কোন ফাঁকে যে চারটা বেজে গেছে টেরই পাইনি। দুপুরে খাইনি—পেটে জানান দিলো সে খবর। ভিতরেই অবশ্য ফুড কোর্ট রয়েছে অনেক। খেয়ে নিলাম ছুলে-ভুটুরি।

বিকেল গড়াতেই মানুষের ঢল যেন আরো বেড়েই চললো। তিন দিনের বিরতি শেষে ঠান্ডা আজ মনে হয় আবার দাপিয়ে পড়বে। সূর্য মেঘে আর কুয়াশায় ঢেকে গেছে। বিশ্ব পুস্তক মেলার জ্ঞানের আলোয় তবু যেন মনে হলো দীপ্তিময় হয়ে আছে আজ এই প্রগতি ময়দান।
৫.১.২০২০
প্রগতি ময়দানের মেলা থেকে।

৬. দুধের সর কিংবা নমস্তে…

এই বিশাল দিল্লী শহরের পথে ঘাটে চলতে ফিরতে কাকতালীয়ভাবে দেখা সাক্ষাত ঘটছে রোগীদের সাথে—রোগীর স্বজনদের সাথে। তাদের ভক্তি গদগদ চেহারা-সুরত আর আচরণ বেশ ভালোই লাগছে। দুয়েকটি ছোট্ট ঘটনা না বলে কী উপায় আছে!
ইউসুফ সরাই মার্কেটের ওপর দিয়ে হাঁটি প্রায়ই। এখানে টঙের চা বেশ টানে আমাকে। জাফরের বিরিয়ানীও খেয়েছি কয়েকদিন। তবে একটি জিনিসের স্বাদ নেওয়ার জন্য মনটা পেরেশানীর মাঝেই ছিলো। বিশাল এক লোহার কড়াই। তত গভীর নয়। এর মাঝে মণখানিক দুধ। নিচে সার্বক্ষণিক আগুন। দুধের ঘন সর জমে গেছে। দুধের সরের প্রতি বিড়ালের মতো খানিক লোভ যে আমারও আছে। ছোট বেলায় লুকিয়ে লুকিয়ে সর খাওয়ার এক-আধটু অভ্যাস তো ছিলোই। সকালে ওটসের সাথে দুধ আমার দিল্লী জিন্দেগীর জবরদস্ত নাস্তা। সাথে একটু মধু ঢেলে দিই। ব্যস।
তবুও এই লোহার কড়াই-এর সর-পড়া দুধের কাছে জিহবা নত হয়ে গেল। দাও তো দেখি। দোকানওয়ালা চিনি মিশালো। এক ঘটিতে গরম দুধ নিয়ে আরেক ঘটিতে বিশেষ কায়দায় বার কয়েক ঢালা-ঢালি করে গ্লাসে পরিবেশন করলো। তবে হ্যা—ঐ ঘন সর উঠালো বড় চামচে করে আর গ্লাসের ওপর ছড়িয়ে দিলো জব্বর করে। আহ। কী স্বাদ যে হবে!

দুধে চুমুক দেওয়ার জন্য গ্লাস যেই ঠোঁট ছোঁয়ালাম অমনি পাশ থেকে এক রমনী নমস্তে নমস্তে করে কাঁচুমাচু হয়ে পাশে দাঁড়ালো। কি আর করা।ঠোঁটের কাছ থেকে গ্লাসটা সরিয়ে নিলাম। তার ভাষায় বললো—চিনতে পারছেন। সত্যিকারার্থে আমি চেনা আর না-চেনার দ্বন্দ্বে তখন। সাথে তার স্বামী। বললো স্যার AIIMS -এ আপনার কাছে দেখিয়েছিলাম। উনার ডায়াবেটিস। তখন আমার স্মরণে এলো। হ্যাঁ জ্বি, হ্যাঁ জ্বি করে কিছু আলাপ সারলাম। উনারা সরওয়ালা দুধ পান করতে এসেছে। রোগী আর ডাক্তার তবে যে এক দোকানীর দুধ খায় রে! মণ খানিক দুধ এক দিনে কি করে শেষ হয় আমার সন্দেহ ছিলো। কিন্ত দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দুধ পান করতে করতে সে ধারণা পাল্টে গেলো। কারণ দেখলাম আমি থাকতে থাকতেই দোকানীর দশ গ্লাস দুধ বিক্রী হয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি দুধ গিলে বিব্রতকর অবস্থায় রোগীর কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

মেট্রোতে চেপে কোথাও যাচ্ছিলাম। ভিড়ের ভিতর এক শশ্রুমন্ডিত সন্জয় দত্ত মার্কা সুঠাম যুবক আমার কাছে এসে বললো—আপনি কি AIIMS-এর? আমি ইতিবাচক জবাব দেয়ার পর সে ভক্তি গদগদ ভাবে জানালো আমি নাকি এন্ডোক্রাইন ওপিডি-তে তার বাবাকে দেখেছি। তার বাবা এখন ভালো আছে। সে কৃতজ্ঞতা জানালো। এমন অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে আমার ডাক্তার জনম মনে হলো সার্থক হয়ে গেছে।

ওয়ার্ডে আমার কোন দায়িত্বপূর্ণ রোগী ছিলো না। চারজন সিনিয়র রেসিডেন্টের ভাগেই ছিলো বিশ জন। যার কারণে আমি সব রোগীদের কাছেই যেতাম। আর এই সুযোগে সব রোগীদের সাথে গড়ে উঠতো আমার সম্পর্ক। রোগীর স্বজন কিংবা কখনো রোগীরা আমার কাছে চলে আসতো তাদের রোগের বিস্তারিত জানার জন্য। যদিও হিন্দী ভাষায় আমার অদক্ষতা তাদের জ্ঞাত ছিলো। তবু ভাঙা হিন্দী আর ইংরেজীর সাথে দেহ-ভাষা মিলিয়ে তাদের সাথে মিলে গিয়ে বেশী আপন হয়ে গিয়েছিলাম। ফলো-আপে আসা কিছু এমন রোগী আছে যারা ওপিডিতে আমাকেই দেখাতে চাইতো। সেদিন এমন এক রোগী এলো। যার কুশিং ডিজিজের কারণে মস্তিষ্কের অপারেশন হয়েছে মাস দুয়েক আগে। ফলো-আপে আমাকেই দেখাবে। কিন্ত যে রুমে আমার দায়িত্ব সেখানে বসে আমি কোনভাবেই দেখতে পারি না। শেষমেষ সে বাধ্য হয়ে অন্য ডাক্তারকে দেখালো।কিন্ত প্রেসক্রিপশন নিয়ে ফের আমার কাছেই এলো—ডাক্তার ঠিক লিখেছে কিনা তা যাচাই করার জন্য। হায়রে ভরসা! রোগীদের ভরসার কেন্দ্রবিন্দু হওয়া কিন্ত রীতিমত চিকিৎসকদের জন্য বিশাল প্রাপ্তি। AIIMS-এ আমার এই প্রাপ্তি যোগ হলো।

সিনিয়র রেসিডেন্টদের সাথে কাজ করে অনেক কিছু শিখেছি। তাদের সাথে গড়ে উঠেছে হৃদ্যতা। এসব চিকিৎসকদের ছেড়ে যেতে হবে ভাবলেই মন বিষণ্ন হয়ে ওঠে। তারা বললো—আমরা তোমাকে মিস করব। আমি বললাম আমিও। কানে কানে বলি—যারা মিস করবেন তাদের মাঝে লেডি ডাক্তারও কিন্ত আছেন।
১১.১.২০২০/ দিল্লী।

৭. কবি শুয়ে আছেন…

একজন কবি শুয়ে আছেন চিরনিদ্রায়। যদিও তাঁর কবিতা জেগে আছে বিগত দুই শতাব্দী কাল । আরো বেঁচে থাকবে বহু সহস্র বছর বিশেষত তাঁর গজল আর দিওয়ানগুলো। তাঁর কবর দর্শন আর তাঁকে সালাম জানানোর সাধ ছিলো দীর্ঘ দিনের। এর আগেও একদিন এসেছিলাম। কিন্ত সন্ধ্যে ছ’টার কাঁটা ছুঁয়ে যাওয়ার পূর্বেই দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো সেদিন। হতাশাকে সঙ্গী করে ফিরেছিলাম নিজ ডেরায়। তাই আবার এলাম তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে। কবরের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম—আস সালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর। তিনি গভীর নিদ্রায় মগ্ন।কোন সাড়া শব্দ নেই। কোন শুরা সাকী কিচ্ছু নেই পাশে। তিনি অমর কবি—তিনি মীর্জা গালিব। তাঁর কবরের পাশে শুয়ে আছেন তাঁরই সহধর্মিনী — উমরাও বেগম। আর এর পাশেই তাঁর শ্বশুর। পরপর তিনটি কবর—শ্বেত পাথরে আচ্ছাদিত। তবে অন্য দুই কবর থেকে তাঁকে আলাদা করা হয়েছে—একটা ছোট্ট শ্বেত পাথরের ঘর আছে তার উপর। এক প্রান্ত খোলা। কোন কোন ভক্ত সেখানে রেখে গেছে ফুল। কবরের উপর বিছানো একটি পুরনো কাপড়। পড়ন্ত বিকেলে দিল্লীর এই হাড় কাঁপুনে শীতে শ্বেত পাথর বরফের মতো হিম হয়ে আছে আর তার ভিতর শায়িত কবি।

পৃথিবীর অন্যতম সেরা কবি—মীর্জা আসাদুল্লাহ বেগ খাঁন।গালিব তাঁর আসল নাম নয়—ছদ্ম নাম আর এই ছদ্ম নামেই বিশ্ব তাঁকে চিনে। উর্দু আর ফার্সী ভাষায় রচিত তাঁর গজল আর দিওয়ান আধ্যাত্মিকতা, নান্দনিকতা আর দার্শনিকতায় ভরপুর। শিল্প আর সৌন্দর্যের দ্যুতি তাঁর কাব্যকে দিয়েছে অমরত্বের সন্ধান। জন্ম ১৭৯৭ সালে আগ্রায়। তবে জীবনের প্রায় পুরোটা সময় কাটিয়েছেন দিল্লীতে। ১৮৬৯ সালে মৃত্যুর পর দিল্লীতেই তাঁকে সমাহিত করা হয়—হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজার সংলগ্ন এই সমাধিতে। তিনি ছিলেন তৎকালীন দিল্লীর সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি। তাঁর পূর্ব পুরুষের নিবাস কিন্ত ভারতে নয়। তাঁর প্রপিতামহ আহমেদ শাহ আবদালীর শাসনকালে উজবেকস্থান থেকে উদ্বাস্ত হিসেবে এসেছিলেন ভারতবর্ষে।

নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায় প্রবেশের আগেই গলির ভিতর তাঁর সমাধি। এখানে পথের সাথে লাগোয়া ইমারত—গালিব একাডেমী। সিঁড়িতে কুরশি পেতে বসে আছেন এক অশিতীপর বৃদ্ধ। শুভ্র-পক্ক কেশদাম, শশ্রুমন্ডিত—গালিব গালিব চেহারা। তাঁর সাথে দাঁড়িয়ে আলাপ করছে শীর্ণদেহী বৃদ্ধ। জিজ্ঞেস করলাম—গালিবের কবরখানা কোথায়? দাঁড়িয়ে থাকা মুরুব্বী খুব আগ্রহ দেখিয়ে বললো—চলো আমি নিয়ে যাই। আমি বললাম—তা আর দরকার নেই—শুধু পথ দেখালেই চলবে। কিন্ত উনি নাছোর বান্দা—আমাকে সাথে করে নিবেই। অগত্যা তার সাথেই পথ চললাম। এক মিনিট হাঁটলেই মূল ফটক। পাকা কাঠের বিশাল ফটক। সামনে বাজার—বলা যায় পুরো রাস্তা জুড়েই নানা সওদা নিয়ে বসে গেছে ফুটপাথের দোকানীরা।স্যান্ডেল-জুতো, কম্বল-জ্যাকেট, নানান কাপড় চোপড়ের পসরা।

দরজা গলে ভিতরে ঢুকতেই এক পাথর বিছানো চত্বর। সেখানে এই পড়ন্ত বিকেলে ক্রিকেট খেলছে এলাকার ছেলে-পুলে। এখানেই ছিলো উরস মহল। খাজা নিজামুদ্দিন আওলিয়ার উরস চত্বর। পাশেই এক পরিত্যক্ত কূপ—বট গাছের নিচে। সেটা পেরুলেই চৌষট খাম্বা। ভিতরে সারি সারি কবর—মর্মর পাথরে মুড়ানো। মোগল খানদানদের। ভিতরে পুরুষ বাইরে নারী—সবাই শেষ বিছানায় শুয়ে আছে। চৌষট খাম্বা মানে চৌষট্টি স্তম্ভ। যার উপরে দাঁড় করানো হয়েছে পঁচিশটি গম্বুজ। এই স্তম্ভগুলো শ্বেত পাথরের। একটি স্তম্ভের ওজোন একহাজার কেজি। পাথরের জানালায় জালির কারুকাজ। ওপরে বাহারী মর্মর পাথরের গম্বুজ। মোগল খানদানদের এই সমাধি সংলগ্ন আরেকটি চত্বর। সঙ্গী লোকটিকে আমার মোবাইল দিয়ে বললাম—একটি ছবি তুলে দিন। ক্যামেরা অন করে দৃশ্য দেখিয়ে বললাম—এখানে আলতো চাপ দিলেই ছবি উঠবে। মোবাইল ধরা দেখেই বুঝলাম উনি কোনদিন ছবি তুলেননি—নিজের দিকে তাক করে রেখেছেন স্ক্রিন। তাকে শুধরে দিলাম।এবার তিনি শক্ত করে দুহাত দিয়ে মোবাইল ধরে ক্যামেরার মুখ আটকে ছবি তুলতে গেলেন। আমি বললাম—ঠিক আছে বাবা, ছবি তুলতে হবে না। কয়েকটি ছেলে-পুলে আড্ডা দিচ্ছিলো কবরের পাশে। তাদের একজন ছবি তুললো। বৃদ্ধ ভদ্রলোক চিনিয়ে দিলো কবরগুলো।

মোগল খানদানদের কবরের পূর্ব পাশেই আলাদা আরেক চত্বর। সেখানেই মীর্জা গালিব। দু-এক জন বিদেশী পর্যটক এসেছেন—ঘুরে ফিরে দেখছেন গালিবের সমাধী।আমিও ঘুরে ফিরে দেখলাম। তাঁর কবরের দেয়ালে উর্দু ভাষায় লিখা বিখ্যাত শের। তিনি দিল্লীতে প্রথম দিকে ছিলেন চাঁদনী চক এলাকার একটি বাড়িতে। চাঁদনী চক তো বিশাল বাজার। ঢাকার চাঁদনী চকের চেয়ে ঢের বড়। আজ কোন অস্তিত্ব নেই সেই বাড়ির। বৃদ্ধ লোকটিকে ধন্যবাদ জানালাম কবরগুলো চিনিয়ে দেয়ার জন্য। তার চেহারা দেখে বেশ বুঝে গেলাম—শুকনো ধন্যবাদে কাজ হবে না। হাতে ধরিয়ে দিলাম কড়কড়ে একটা রুপীর নোট। এবার বৃদ্ধ লোকটির মুখে নিষ্পাপ হাসির দ্যুতি ফুটে উঠলো। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দেখে নিলাম চৌষট্ট খাম্বা ঘুরে ঘুরে। ছেলেদের ক্রিকেট খেলা দেখলাম—ফাস্ট বোলিং-এর স্টাইল দেখে মনে হলো এখানকার গলি থেকেই বেরিয়ে আসবে ভবিষ্যতের ইরফান পাঠান।

সমাধীর বাইরে গলির সাথেই সেই বিশাল এক ইমারত—গালিব একাডেমী। রয়েছে গালিবের বই। রয়েছে মিউজিয়াম। ইংরেজী অনুবাদ খুঁজলাম। ভালো কিছু পেলাম না। সব উর্দু আর ফারসী কিতাব। তবে একথা ঠিক কোন কবিকে বুঝতে হলে আর কবিতার রস আস্বাদন করতে গেলে সেই ভাষায় তাঁকে পড়তে হবে। কবিতার অনুবাদ যত ভালোই হোক সেখানে মূল কবিকে খুঁজে পাওয়া যায় না কিছুতেই।

একটি ইংরেজী অনুবাদের ছোট এক পু্স্তিকা অবশ্য জুটলো। মনে হলো সমুদ্র থেকে এক ফোঁটা জল হাতে তুলে নিলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিলো। পাশেই বিশাল মসজিদ—নিজামুদ্দীন আউলিয়ার মাজারের গলিতে। মাগরিবের আযানের সুর আর ধ্বনীতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো আধ্যাত্মিকতা।গালিবের কবরেও ধ্বনীত হলো সেই সুর।

নামাজ পরে আবার এলাম। তবে কবরগাহে নয়। গলিতে টিক্কা, কাবাব, গ্রীল আর তন্দুরীর সমাহার। গরম গরম ঝলসানো সেই সব লোভনীয় খাবার আমাকে ডাকছিলো। গালিবের মতো শুরা-সাকীর ভক্ত না হলেও এসব হরেক কাবাবের কাছে কুপোকাত হয়ে নিজেকে আবিষ্কার করলাম এক রেস্টুরেন্টে। উদোর পূর্তি শেষে বিল এলো মাত্র আশি রূপী। এক প্লেট কাবাব—দুটো তন্দুরী—একটি থাম্বস আপ। কি সস্তা! কি সস্তা!
৮.১.২০২০/ দিল্লী।

৮.রাজধানী এক্সপ্রেসে চড়িয়া যাত্রীরা হাঁটিয়া চলিলো…

কোলকাতা যাওয়ার ইচ্ছে কিংবা পরিকল্পনা ছিলো না মোটেও। তবু কি থেকে কি হয়ে গেলো। কপালে থাকলে আটকাবে কে? কোলকাতা আসতে হলো—ঘুরে বেড়াতে হলো। স্ত্রী কন্যা কে বিদায় জানাতে হলো কোলকাতা থেকেই। যদিও দিল্লী থেকে ঢাকা ফ্লাইট ছিলো তাদের জন্য নির্ধারিত। ফ্লাইটের ভয় আর আতঙ্ক এত বেশী পেয়ে বসলো আমার পরিবারকে যে বাধ্য হলাম মোম্বাই যাওয়ার পরিকল্পনা রদ করতে। আসা যাওয়ার টিকেট নিশ্চিত থাকার পরেও গচ্চা দিয়ে টিকেট ফেরত দিলাম মোম্বাই-এর। আর দিল্লী-ঢাকার বিমান যাত্রাও এজন্য বাদ দিয়ে চলে আসতে হলো ট্রেনে চেপে কোলকাতা। কোলকাতা থেকে তো নিজস্ব বাস সার্ভিস আছেই—গোল্ডেন লাইন। সেখান থেকে সড়ক পথে ফরিদপুরে পৌঁছতে কোন কষ্টই হবে না। কিন্ত দু-ঘন্টার ফুরুৎ বিমান যাত্রা এভয়েড করতে গিয়ে পুরো দুদিন প্রায় পথে থাকতে হলো। আর এখন পথে পথে তো আতঙ্ক। প্রতিবাদ চলছে যেখানে-সেখানে নূতন নাগরিকত্ব আইনের জন্য—আগুন জ্বলছে বিক্ষোভের সারা ভূ-ভারতের মাটিতে। শৈত্যের দাপট তো আছেই। দিল্লী থেকে কোলকাতার পথ জুড়েই ডিসেম্বরের শেষ সময়ে মরার ঠান্ডা।তবুও আসতে হলো আর এই সুবাদে দেখা হলো কোলকাতার। দুদিনের ছুটি আর সাথে রবিবারের সাপ্তাহিক বন্ধের দিন আর বড় দিনের ছুটি এভাবেই পথে পথে কেটে গেলো।

সিকি শতাব্দী আগে কোলকাতা থেকে দিল্লী ট্রেনে চেপে এসেছিলাম। ছাত্রাবস্থায়। গরীবি হালতের সেই ট্রেনের আটত্রিশ ঘন্টার যাত্রা এখনো মধুময় স্মৃতির অংশ। ছিলাম নিরানব্বই জন ছাত্র-ছাত্রী। সাথে ছিলেন শিক্ষক-পরিবার। অনেক লম্বা ছিলো সেই সফর। শীতের রাত—টগবগে যৌবন।স্টেশনে স্টেশনে দল বেঁধে নেমে পড়া—খুঁটির চা-পান। বন্ধু-বান্ধব। আড্ডা। হৈ-হুল্লোড়।মনে হয় এই তো সেদিন। তখন কোলকাতা দুবার গিয়েছি এক বছরের ব্যবধানে। যদিও বদলে গেছে অনেক কিছু তবুও এবার পরিকল্পনায় কোলকাতা ছিলো না মোটেও।

এবার দামী ট্রেন—রাজধানী এক্সপ্রেস। এসি-১। বিমানটিকিটের মতোই দামী—হাজার পাঁচেকের মতো জনপ্রতি। ভ্রমণের কাঙ্খিত সময়কাল ১৬ ঘন্টা। তবে একদিনেই টিকেটের টিকি মিলবে কিনা—এক সন্দেহের ভিতর রইলাম। দিল্লীর এক পরিচিত নিকটজন তার উপর দায়িত্ব দেয়া হলো টিকেট করার। তিনি জানালেন—২১ তারিখে(ডিসেম্বর)অপেক্ষমান তালিকায় আছেন আর নইতো ২২ তারিখ যেতে হবে। বিকেল ৪ টা ২৫ মিনিটে ট্রেন ছেড়ে যাবে তবে যাত্রা নিশ্চিত হচ্ছে কিনা জানা যাবে বেলা দুটোর সময়। সুতরাং আমাদের একেবারে রেডি হয়ে থাকতে হবে যাতে নিশ্চিত হওয়ার সংবাদ জানা মাত্রই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে পারি। ঘর থেকে স্টেশনে ট্যাক্সিতে সময় লাগবে প্রায় ঘন্টা খানেক। তাছাড়া অচেনা বিশাল স্টেশনের যজ্ঞ আয়োজনে প্লাটফর্মে এত লাগেজ নিয়ে নড়াচড়া করার জন্য হাতে পর্যাপ্ত সময় রেখে যাত্রা করতে হবে। প্যারায় পড়ে গেলাম যাত্রার আগেই। ভাগ্যিস পঙ্কজ দা বেলা একটার সময় জানিয়ে দিলো—যাত্রা নিশ্চিত।

বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম বেলা আড়াইটায়। দিল্লী রেল স্টেশনের কাছে এসে যেন আটকে গেলাম বিশাল জ্যামে। মনের ভিতর তাড়াহুড়া। লাগেজ নামিয়ে কেমনে যাব। পঙ্কজ দা জানালেন আমাদের প্লাটফর্ম নম্বর তেরো। অনেক খানিক আগেই ট্যাক্সি থেকে নেমে যেতে হলো।
দুটো হ্যান্ড লাগেজ, দুটো মাঝারী লাগেজ আর তেরো কেজি ওজোনের আরেকটি মাঝারী ব্যাগ। গাড়ি থামতেই লাল পোশাকের কূলি সব ঘিরে ধরলো। ওদের সাহায্য ছাড়া তো উপায়ও নেই।
আমি বললাম—কিতনা?
: পনেরশত রুপি।
কি বলে! প্লাটফর্মে পৌঁছে দিতে পনেরো শত রুপী—যেখানে বাসা থেকে স্টেশনে আসার ভাড়া দুশ পঁচাশি। সেখানে তিন-চারশত মিটার পথের জন্য এত্ত ভাড়া।
বললাম না বাপু, তিনশত টাকা বড় জোর পাবে। তিনজনে টানলে একশত টাকা করে।
আমি লাগেজের চাকা চালু করলাম। স্ত্রী কন্যাকে বললাম তোমরা একটি করে টানো—আমি বাকীগুলো।
কূলি দেখলো সবই তো হারাচ্ছে। শেষমেষ চারশত রুপিতে সম্মত হলো। আমরাও পৌঁছে গেলাম প্লাটফর্মের নির্ধারিত জায়গাটিতে।
যেখানেই কূলি সেখানে দামদর ঠিক না করে উঠলে কিন্ত ঝামেলায় পড়বেন সেজন্য ভ্রমণের সময় এটা মাথায় রাখবেন।
এসে তো দেখি বিশাল বিপাক! ট্রেন প্রায় তিন ঘন্টা লেট। অ্যাপস দেখিনি—সময়সূচী তো সেখানে মিলতোই। যাহোক এখন তো বোকারামের মতো তিন ঘন্টারও বেশী সময় স্টেশনেই কাটাতে হবে। স্টেশনের খোলামেলা জায়গায় দিল্লীর শৈত্য যেন জাঁকিয়ে নামছে। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে দুই ডিজিট ছেড়ে এক ডিজিটে নেমে যেতে থাকলো তাপমাত্রা। তার মাঝে বসে অপেক্ষায় আছি রাজধানী এক্সপ্রেসের।
রাজধানী এক্সপ্রেস স্টেশনে তাশরিফ আনলেন সন্ধ্যা সাতটায়। লোকজন উঠতে থাকলো ট্রেনে। এতক্ষণ শৈত্যে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা তেরো নম্বর প্লাটফর্মে হঠাৎ যেন হুলস্থূল লেগে গেলো। আমাদের এসি কেবিন। চারজনের জন্য এক রুম। শুয়ে বসে ঘুমিয়ে যাওয়া যাবে। বিছানা-চাদর-কম্বল-বালিশ সবই আছে সাজানো-গোছালো। ট্রেনে উঠে অন্তত শৈত্যের আক্রমণ থেকে যেন রক্ষা পেলাম।
মিনিট পাঁচেকের মাঝে কোট পরা এক ভদ্রলোক এলেন। নিজেকে ট্রেনের ম্যানেজার পরিচয় দিয়ে আমাদের স্বাগত জানালেন আর হাতে তুলে দিলেন এক প্যাকেট কাজু বাদাম ও এক বোতল মিনারেল ওয়াটার, জুসের প্যাকেট। কয়েক মিনিটের মাঝে দুলে দুলে চলতে শুরু করলো রাজধানী এক্সপ্রেস।

আমাদের রুমের চতুর্থ আসনটি ছিলো আরেক ভদ্রলোকের। পশ্চিমবঙ্গে তার বাড়ি, বাঙালী। উচ্চশিক্ষিত প্রৌঢ় এই ভদ্রলোক নিজেকে খুব গর্বের সাথে নাস্তিক পরিচয় দিলেন। তার সাথে আলাপচারিতা অল্প সময়ের মাঝে খুব জমে উঠলো। প্রাজ্ঞ এই বাঙালীর কাছ থেকে জানতে পারলাম ভূ-ভারতের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক চরিত্র। তিনিই জানালেন যতটুকু দেরী হয়েছে পথে তা কাভার করে যথাসময়ে সকাল সাড়ে দশটার মাঝে ট্রেন শিয়ালদহ পৌঁছে যাবে। ১৩০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে তিন ঘন্টা কাভার দেয়া মোটেও ব্যাপার না। সেজন্য আশায় বুক বাঁধলাম। তবে রাতে পথের কিছুই দেখতে পাব না এই ভেবে মনে একটু কষ্টও এসে দানা বাঁধলো। ট্রেনে যেতে যেতে পথের দৃশ্য দেখার যে আনন্দ তা আর উপভোগ করা হবে না। তবে ঘন্টা তিন-চারেকের মাঝে বুঝতে আর বাকী রইলো না আমরা মোটেও পৌঁছতে পারব না এমনকি পরের দিন বেলা দুটোর মাঝেও।

ট্রেন চলছে তবে এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো নয়—চলছে যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। আস্তে ধীরে দু-চার কিলোমিটার চলে আবার দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ঘন-কুয়াশায় ঢেকে আছে যেন ভূ-ভারত। দৃষ্টি সীমা জুড়েই কুয়াশা। পথ না দেখে পথ চলা যে বিশাল বিপত্তির কারণ হতে পারে সে কারণে এই ভাবে ধীরে ধীরে হেঁটে চলা। মনে হচ্ছিলো রাজধানী এক্সপ্রেসে “চড়িয়া সব যাত্রী যেন হাঁটিয়া চলিতেছে।” এই কুয়াশার কারণেই সব ট্রেন শিডিউল বিপর্যয়ে পড়েছে। আমাদের বিলম্বের হেতুও ছিলো কুয়াশা। যখন চলছে তখনো অন্ধকারে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আধা ঘন্টার মাঝেই নাস্তা এলো। চা এলো। রাতের খাবারের মেনু নিয়ে গেলো। নয়টার মাঝে রাতের খাবার খেলাম। খাবার খাওয়ার পর টান টান হয়ে শুয়ে পড়ার পালা। বাইরে তেমন কিছুই দৃষ্টির সীমানায় নেই। ভাঁজ করা বিছানার চাদর, বালিশের কভার, কম্বল ধুয়ে ইস্ত্রি করা—ময়লার কোন বালাই নেই। প্রতিদিনের জন্য আলাদা সেট প্রস্তত করে ট্রেনের জন্য সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করা হয়। এগুলো ধৌত করার জন্য হাওড়ায় আছে বিশাল এক কেন্দ্র। ভদ্র লোক জানালো সেটি নাকি দেখার মতো এক জায়গা।

রাত সাড়ে এগারোটার দিকে শুয়ে পড়লাম—বাসে ট্রেনে যাত্রা পথে আমার ঘুম আসে না মোটেও। তবু নাক কান ঢেকে শুয়ে আছি। গভীর রাতে কোন এক সময় আমরা কান ঢাকা অবস্থায় কানপুরে পৌঁছলাম। এটি আমাদের যাত্রা পথের প্রথম স্টেশন। তেমন কিছুই দেখা গেলো না কানপুরের—তবে তখনই কানে আসলো আমাদের কোলকাতা পৌঁছতে সন্ধ্যা হতে পারে। আমার মনে তখন আনন্দ—কেননা সারাটিদিন জানালায় চোখ মেলে দেখতে পাব খোলামেলা ভারত।

সাত সকালেই আরেকটি স্টেশনে থামলো ট্রেন। এলাহাবাদ স্টেশন। স্টেশন জুড়েই দেহাতিদের ভীড়। এটি ঐতিহাসিক নগরী। জওহর লাল নেহরুর পৈত্রিক ভিটে এখানেই। স্টেশনের পরেই বস্তি। ঘিন্জি ঘর। নোংরা পরিবেশ। স্টেশনে স্টেশনে গ্রাম্য মহিলা—কৃষাণী। কাজের অপেক্ষায় বসে আছে। ওরা বলে দেহাতি। কেউ এসে কিনে নিয়ে যাবে এদের—এদের শ্রম দিয়ে উৎপন্ন হবে সোনার ফসল। পরনে রঙিন মোটা সূতার শাড়ি আর চাদরে ঢেকে শীত আটকানোর কোশেশ চলছে তাদের।

স্টেশন শেষ না হতেই শুরু হলো বিস্তীর্ণ মাঠের পর মাঠ। হলুদ সরিষা, রবি শস্য বিভিন্ন কলাই ক্ষেত। অড়হর, ভেন্না, সব্জীর ক্ষেত। সবুজ বৃক্ষের আয়োজন। কোথাও কুয়াশা হালকা—কোথাও জাঁকালো। রেল লাইনের দুপাশে মাঝে মধ্যেই নালার মতো রুগ্ন জলাশয়। বকের সারি। বসে আছে ধ্যান মগ্ন। উড়ছে সকালের পাখি। মাইলের পর মাইল বাড়িঘর নেই—ক্ষেত আর ক্ষেত।
উন্মুক্ত টয়লেট। মাঠে দিগম্বর মানুষ—অবলীলায় মল ত্যাগ করছে। উত্তর প্রদেশের গ্রাম্য জীবনের নৈমিত্তিক চিত্র। এক দুই নয়—সাত-সকালে মাঠে মাঠে অসংখ্য মানুষের নিজ দেহের জৈব সার প্রয়োগের এই খোলামেলা দৃশ্য। চল্লিশ পঞ্চাশ বছর পূর্বে আমাদের দেশে এতটা না হলেও দু-একটি এমন দৃশ্য চোখে পড়তো। এখন কি চোখে পড়ে? মনে হয় না। ভারতের অনেক রাজ্যের মানুষ এখনো খোলা আকাশের নিচের উন্মুক্ত মাঠ ব্যবহার করছে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। বিশাল প্রকৃতির সাথে তাদের এই সখ্যতা সত্যিই বিষ্ময় জাগানিয়া ব্যাপার!

মোগল সরাই। নাম বদলের হিড়িকের মাঝে মোগল সরাই এখন দীন দয়াল উপাধ্যায়। আরো অনেক নাম বদলে যাচ্ছে ভারতে। বদলে গেছে ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়াম। নয়া নাম অরুন জেটলী স্টেডিয়াম। এখানেই উত্তর প্রদেশ শেষ—শুরু হবে বিহার। ভারতের এক অনুন্নত প্রদেশের নাম বিহার। পঁচিশ বছর আগে ট্রেন যখন রাতের বেলায় বিহারে ঢুকলো। হুড়মুড় করে দরোজা ঠেলে মানুষ আমাদের বগীতে ঢুকে পড়তে থাকলো। আমাদের এক কামড়ায় ত্রিশ জনের মতো ছাত্রী।এক বন্ধু আর আমি ছিলাম এই রুমের দায়িত্বে। গেটে মানুষ আটকে দিলাম। শীতের রাত। কনকনে ঠান্ডা বাতাস বইছে। গরীব মানুষ লাকড়ির বোঝা মাথায় নিয়ে উঠতে চাইছে আমাদের রিজার্ভ করা বগীতে। অনেক কষ্টে সেদিন আটকে দিয়েছিলাম মারমুখী মানুষদের। এখন সেই বিহারে। তবে রাতে নয় দিনের আলোয়। আর সেই লোকাল ট্রেন তো নয়—একেবারে এক্সপ্রেস ট্রেন।

খাবার আসছে দফায় দফায়। প্রথমেই বোতল ভর্তি মিনারেল পানি। এলেন ম্যানেজার গোছের একজন। অভ্যর্থনা জানালেন—হাতে তুলে দিলেন টিস্যু পেপার আর একটি জুসের প্যাকেট। এলো চা-বিস্কুট, কাজু বাদাম। এরপর ডিনারের পর্ব। শুরুতেই এলো স্যুপ। মেন্যুতে আছে রুটি, জিরা-ভাত। ভেজ আর নন ভেজে পার্থক্য তো আছেই। আমরা তিনজন। দুটো নন-ভেজ আর একটা ভেজ নিলাম। মিশ্র সব্জি, মুরগীর ঝোল আর ডাল। ভেজের তালিকায় মুরগীর মাংসের বদলে দুটো ডিমের কারি। সকাল না হতেই ফের চা বিস্কুট। এর পরেই এলো নাস্তা। পাউরুটি বাটার ডিম মামলেট। আছে ভেজিটেবল কাটলেট, পটেটো চিপস, মটর ভাজা, সাগর কলা। আবার চা। ট্রেন দেরী বলে চটজলদি দুপুরের খাবারের আয়োজন। ওয়েটার জিজ্ঞেস করে গেলো—খিচুড়ি সব্জী হলে চলবে কিনা? না কি ডাল সব্জী ভাত দেবে? আমরা জানালাম খিচুড়ি সব্জী—সাথে এক ডিম মামলেট। যথাসময়ে এসে গেলো দুপুরের খাবার। সার্ভিস বলা যায় ক্লাশ-ওয়ান।

৯. দিল্লী টু পাটুরিয়া…

এক ঘন্টারও বেশী সময় ধরে আটকে আছি ফেরী ঘাটে। হয়তো আরো আটকে থাকতে হবে দীর্ঘ সময়। এটাকে পাবলিক বলে থাকে জ্যাম। পাটুরিয়া ঘাট। আমাদের বেদনা প্রসবের ঘাট। বসে কবিতা লিখা আর গায়ে পায়ে রক্তে বিরক্তি মাখা ছাড়া কি বা করার আছে! তাই বেশরমের মতো কবিতা লিখলাম….

ফেরি ঘাটে আটকে যায় পৃথিবী
যত চাকা ছিলো সব ভুলে যায় প্রদক্ষিণ
বুধ শুক্র বৃহস্পতি নেপচুন
আমাদের সব রোদ ডুবে যায় অন্ধকারে
আমরা পাড়ি দিতে পারি না কোন নদী
শেকল পরিয়ে রাখে
মহাজাগতিক কোন চৌম্বকে টেনে ধরে
আমাদের হাত পা অবশ আঙ্গুল
বাচ্চারা কেঁদে ওঠে
আমাদের চোখ অসহায়—চাকা অসহায়
হাম্বি তম্বি অসহায় সব ক্রোধ অসহায়
শুধু ধূলো বালুর মতো আমরাও ডুবে থাকি
পথে পথে

আমাদের রমনীদের কিডনী ফুলে ওঠে
আটকে যায় কোলন মূত্র-নল
আমাদের গৌরব ফেরী ঘাটে ইয়া নাফছি ইয়া নাফছি বলতে বলতে
বিচারের আদালতে চোখ বুঁজে জপতে থাকে তসবীহ
আমরা এক ঘাটে বসে জোহর আছর মাগরিবের আযান
শুনতে থাকি পরম আহলাদে

আমরা অ্যানালগের কাঁটায় গেঁথে রাখি
সিদ্ধ হতে থাকা হাড্ডি মাংস শিরা
তারপর
আমরা পাঁপড় ভাজা খাই
গরম সয়াবিন তেল মুছে ফেলি প্যান্টে শার্টে
আমরা আমড়ায় লবণ ছিটাই
কফ থুতু গিলে বসে থাকি বড় জোর দুই-চার ঘন্টা
আমাদের সময়গুলো একে বারে ঘাটের পানির মতো
কম দামী হয়ে ওঠে
মায়েরা তরকারী রেঁধে বসে থাকেন
চাকা নড়ে না—ফেরী ঘাটে আটকে থাকে
আমাদের জ্বলে ওঠা সূর্যতাপ সমস্ত অহং
বিরক্তগুলো পাহাড়া দিতে থাকে আমাদের ক্ষোভ!
২১.১.২০২০/ পাটুরিয়া ফেরী ঘাট।

নাসির উদ্দিন আহম্মদ:
কবি ও প্রাবন্ধিক। প্রকাশিত গ্রন্থ পাঁচটি। ১.জল-জলোচ্ছ্বাস-কাব্য(১৯৯৫),২.নিমেষেরকিঙ্কিণী-কাব্য(২০১৭),৩.তবু আমি কেউ নই-(২০১৮)কাব্য,৪.জলছবির হাট-কাব্য(২০১৮),৫.সুস্থতার চাবিকাঠি-ফিচার(২০১৮)। স্ত্রী:শামীমা করিম,কন্যা: নাওশীন নাওয়ার কে নিয়ে যাপিত জীবন। পেশা:চিকিৎসক। সামরিক বাহিনীর চিকিৎসা কোরে কর্মরত।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন