কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা।
।। পারভেজ আহসান।। পুবাকাশ
ফেব্রুয়ারি এলেই আমি প্রাত্যহিক কাজে একটি পরিবর্তন ঘটাই। দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে বইমেলায়, অন্য সময়ের চেয়ে অধিক পাঠ করি সৃজনশীল ও মননশীল সাহিত্য। ভাষা শহীদদের প্রতি হৃদয়ের গভীর থেকে ওঠে আসা শ্রদ্ধা এবং বাংলা ভাষার প্রতি হৃৎটান অনুভব করি বলেই এ-মাসের প্রতিটি মুহূর্ত কাটাই বাঙালিয়ানাই। ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭। শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জনপ্রিয় ওয়েবম্যাগ ‘চিন্তাসূত্রে’ নতুন প্রবন্ধ খুঁজছিলাম।
হঠাৎ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা কবি আল মাহমুদের লেখা ‘কাজী জহিরুল ইসলাম: বিশ্ববিচরণশীল কবি’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধের দিকে দৃষ্টি গেল। সাথে সাথে ভাবতে শুরু করলাম কে এই বিশ্ববিচরণশীল কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। এমন চমৎকার শিরোনামে জীবন সায়াহ্নে এসে কোন কবিকে নিয়ে লিখেছেন কবি আল মাহমুদ। সাথে সাথেই নিবিষ্ট চিত্তে প্রবন্ধটি পড়া শুরু করলাম। কিছু দূর এগোতেই দেখি কবি আল মাহমুদ কাজী জহিরুল ইসলামকে বাংলা ভাষার সবচেয়ে সমৃদ্ধ কবিত্ব শক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয়, একই লেখায় অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তিনি বললেন, ‘কাজী জহিরুল ইসলাম চির নির্বাসিত কবি ব্যক্তিত্ব। তাঁর দ্বারাই পৃথিবীর শ্রমবিনিময়ের ভাষা সঠিকভাবে অনুভব করে এর ভেতরকার মূল্যবান শব্দরাজি নিজের কবিতার অন্তরে সংযোজন করা সম্ভব’। কবি আল মাহমুদের এ লেখাটি পড়ে এ কবি সম্পর্কে আরো অধিক জানার কৌতুহল সৃষ্টি হল। গুগুলে সার্চ দিয়ে জানতে পারি কবিতার আঙিনায় কাজী জহিরুল ইসলামের পদচারণা শুরু ৮০’র দশক থেকে। যে দশক উচ্চারিত হলে ওঠে আসে নক্ষত্রের মতো একগুচ্ছ উজ্জ্বল নাম। তাঁদের মধ্যে খন্দকার আশরাফ হোসেন এবং রেজাউদ্দীন স্ট্যালিন উল্লেখযোগ্য। খন্দোকার আশরাফ হোসেনের কবিতায় আবেগ ও বুদ্ধির অপূর্ব সমন্বয়সাধন, পুরাণকে ভাঙা-গড়ার নিরীক্ষণ, সৌন্দর্য আশ্রিত প্রতীক , চিত্রকল্পের ব্যবহার ও রোমান্টিকতা পরিলক্ষিত হয় যা পাঠকের চিত্তে সৃষ্টি করে আনন্দের হিল্লোল । অন্যদিকে রেজাউদ্দীন স্ট্যালিনের কবিতায় বিজ্ঞান মনস্কতা, সময়পোযোগি মিথের ব্যবহার, রাজনীতি, সমকালীনতা, লোকজ ও নাগরিক জীবনের বহুবিদ দিকসমূহ শৈল্পিক সৌকর্যে পরিস্ফুট হয়েছে। তাদের সমকালীন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম কিভাবে জ্যোতির্ময় হয়েছেন বিস্তৃত কাব্য মণ্ডলে? এ প্রশ্নটি যে কোনো পাঠকের মনে উদয় হতে পারে। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলো বিশ্লেষণ করলেই তার অসাধারণ কাব্য প্রতিভা প্রতিভাত হয়ে উঠবে। প্রগাঢ় চিন্তন ক্ষমতা, গভীর জীবন দর্শন, প্রচলিত বিদেশি শব্দসমূহের সাবলীল ব্যবহার, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির সংস্কৃতি ও জীবনাচারের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্টসমূহকে কাব্য বিন্যাসের তন্তু হিসেবে ব্যবহার, প্রতীকাশ্রয়ে মুন্সিয়ানা কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। আমি আমার অনুসন্ধান থেকে এই বিষয়গুলো জানতে পেরেছি।
সময় ও জীবন একই সুতোয় গাঁথা। সময়ের রথে চড়ে জীবন চলে সম্মুখে। কবি জহির সময়ের বহুমাত্রিকতাকে তুলে ধরেছেন তার ‘অপেক্ষারা’ শীর্ষক কবিতায়:
আপেক্ষারা হরহর করে হেঁটে যায়, তিন পায়ে
সিলিং ফ্যানগুলো বাতাশের নিচে দোল খায়
ফ্লোর থেকে এক টুকরো আকাশ তুলে নেয় মিলিনিয়াম শিশু
ফুঁ দিয়ে ওড়ায় ছাদের দোতলায়
অপেক্ষারা চুপচাপ বসে থাকে টিভিস্ক্রিনে
সোফাগুলো নরম নিতম্বে ঝটপট বসে পড়ে
জানালারা এগিয়ে এসে কানকথা লাগায় দুটি বোরকার মাঝখানে
বোরকাদের ভেতরে চারটি গ্রেনেড গরম হতে থাকে
মাঝ রাতে কাঁদবে বলে –
অপেক্ষারা গরম কফির কাপ হয়ে ঢুকে যায় সাহেবের ঘরে
হ্যাটগুলো রোদ ঠেকাতে বসে পরে গোবরের স্তুপে
ব্যাঞ্চের আড়ালে আপেলের সাইজ মাপে ইহুদী যুবক, সাপারের আগে
ইতি উতি কী যেন খোঁজে এক এবনি কাঠের লাঠি
ফ্লোরে তখন প্লেনগুলো উড়তে থাকে ঘোষিত সিডিউল ভেঙে
অপেক্ষারা আর অপেক্ষা থাকেনা ।
এ কবিতায় কাঙ্ক্ষিত সময়কে ঘিরে মানুষের রঙিন স্বপ্নগুলো শব্দের ক্যানভাসে মূর্ত হয়েছে। অনেকেই অপেক্ষার প্রহর গোনে কেবলই ইন্দ্রিয় সুখের প্রত্যাশায়। এ পঙক্তি দুটো – ‘অপেক্ষারা গরম কফির কাপ হয়ে ঢুকে যায় সাহেবের ঘরে’ এবং ‘বেঞ্চের আড়ালে আপেলের সাইজ মাপে ইহুদী যুবক, সাপারের আগে’ ইন্দ্রিয় সুখেরই ইঙ্গিত বহন করে। আবার অনেকে প্রতীক্ষায় থাকে বেদনার স্বরূপ দেখবে বলে। ‘বোরকাদের ভেতরে চারটি গ্রেনেড গরম হতে থাকে/ মাঝ রাতে কাঁদবে বলে…’ এ-উক্তির মধ্য দিয়ে মৃত্যু ও ধ্বংসকে আলিঙ্গন করার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে প্রচ্ছন্নভাবে। প্রতীকের ব্যবহার কবির গভীর জীবনবোধ ও জীবন দৃষ্টির প্রখরতা ও গভীরতার পরিচায়ক। এ-কবিতায় প্রতীকাশ্রয়ী কবি চার দেয়ালে বন্দী নগর শিশুদের মুক্ত আকাশ দেখার স্বপ্ন ও আর্তি ফুঁটিয়ে তুলেছেন। কবিতার শেষ চরণে প্রতিবিম্বিত হয়েছে গভীর জীবন দর্শন। এ-কবিতাটি আশি’র দশকের অন্যান্য কবির কবিতা থেকে কাজী জহিরের চলার পথ যে আলাদা তা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়।
কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতায় নিসঙ্গতা, একাকিত্ব, নগর যন্ত্রণা, যাপিত জীবনে না বলা দুঃখগুলো ভিন্ন ঢঙে প্রকাশ পেয়েছে। তার কবিতায় কবি শহীদ কাদরীর কাব্য ও জীবন দর্শনের প্রভাব আছে মনে হলেও, যেহেতু দুজনই দীর্ঘ প্রবাসকাল কাটিয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে তার কবিতায় প্রতীকী শব্দ চয়ন ও মরমী ভাবনা তাকে স্বতন্ত্র কাব্যশক্তি হিসেবে আলোকময় করে তুলেছে। কবি শহীদ কাদরী নিজেও কাজী জহিরুল ইসলামকে বাংলা ভাষার একজন মেজর কবি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর ‘গাড়ি’ কবিতাটি পাঠক চিত্তকে আলোড়িত করেছে বলে আমার বিশ্বাস। যাপিত জীবনের শূন্যতাবোধ, মানসিক প্রশান্তির জন্যে তীব্র ব্যকুলতা এই কবিতার মূল উপজীব্য হিসেবে পরিস্ফুট হয়েছে। একই কবিতায় একই শব্দকে ভিন্ন অর্থের প্রতীক হিসেবে খুব কম কবিই ব্যবহার করেছেন, কিন্তু কাজী জহির তাঁর ‘গাড়ি’ কবিতায় গাড়ি শব্দটি দুটো ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন। গাড়ি শব্দটির মাধ্যমে চলমান জীবন এবং মানসিক প্রশান্তির আশ্রয় হিসেবে ইঙ্গিত করেছেন :
গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবছি গাড়ির কাছে যাব
কি যেন ফেলে এসেছি গাড়িতে
কি যেন পাই না খুঁজে সংসারের হার্ডডিস্কে
নারীদের ড্যাসবোর্ডে
খুঁজে পাইনা ওখানে, শৈশবের একটু ওপরে
বয়োসন্ধির বাড়িতে,
তাড়াতাড়ি ফেলে এসেছি কি যেন
গাড়ির সিটপকেটে, না হয় টুলবক্সে
না-কি ফার্স্ট-এইড বক্সের ভেতর, ডেটলগন্ধের নিচে?
না হয় পেছনে, ট্রাঙ্কের গুমঘরে –
গাড়ি চালাতে চালাতে তখন গাড়ির কাছে যাই
গাড়ি কই?
এইখানেই তো গাড়ি ছিল, এই কৈশোরতলায়
গাড়ি হারিয়ে ফিরে যাই
গাড়ি চলাতে চালাতে গাড়ির কথা ভাবি
এ-কবিতায় গাড়ি শব্দটির মধ্যে যেমন মরমি সুর বেজে ওঠে ঠিক তেমনি ড্যাসবোর্ড, হার্ডডিস্ক শব্দগুলোর ব্যবহার তার তথ্যপ্রযুক্তির সাথে নিবিড় সংশ্লিষ্টতা ও বিজ্ঞান মনস্কতার পরিচয় বহন করে।
ধ্রুপদী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত পাশ্চাত্য কাব্য প্রকরণ সনেট বাংলা সাহিত্যে সংযোজন করার পর দেবেন্দ্র নাথ সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মোহিতলাল মজুমদার, প্রমথ চৌধুরী, জীবনান্দ দাস, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হকসহ অনেক কবিই এ প্রকরণে কবিতা লিখেছেন। সকল কবিই আক্ষরবৃত্তের মাত্রা অনুসরণ করে সনেট লিখেছেন। ভাবের গাম্ভীর্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই সনেটে ধীর গতির ছন্দ অক্ষরবৃত্ত অনুসরণ করে ১৪ থেকে ১৮ কিংবা ২২ মাত্রা পর্যন্ত অক্ষর বিন্যাস করেছেন বেশ ক’জন কবি। কিন্তু কাজী জহিরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে সনেট রচনার প্রচলিত ধারা ভেঙে ভাবের গাম্ভীর্য বজায় রেখে স্বরবৃত্ত ছন্দে সনেট রচনা করেছেন। সম্প্রতি দৈনিক ইত্তেফাকের সাময়িকীতে প্রকাশিত তাঁর ৫টি স্বরবৃত্তের সনেট প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে তিনি একটি নোট দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে পেট্রারকান বা শেক্সপিয়েরিয়ান সনেট স্বরবৃত্তেই লেখা হয়েছিল। সেখান থেকে সনেটের ধারণা মাইকেল মধুসুধণ দত্ত বাংলা ভাষায় আনেন কিন্তু তিনি তা অক্ষরবৃত্তে বিন্যাস করেন। কবি তার রিক্সাশ্রমিক শীর্ষক সনেটে ৪ মাত্রার স্বরবৃত্তে পর্ববিন্যাস করে প্রতিটি পঙক্তিকে ১৪ মাত্রায় সীমিত রেখেছেন। প্রতি পঙক্তির শেষে একটি দুই মাত্রার অপূর্ণ পর্ব রেখেছেন।
রিক্সাশ্রমিক প্যাডেল মেরে স্বপ্ন বোনে আজও
প্রকাণ্ড এক পথের ওপর বিকেলটাকে দ্রুত
দেয় জুড়ে সে রাতের সঙ্গে সন্ধ্যা সুইয়ে সুতো
মধ্যরাতের এই শহরে সে যে বরকন্দাজও।
সিটের উপর উপন্যাসের গ্রন্থ খুলে রাখে
পরকিয়া, খুনসুটি-প্রেম, বৃষ্টিতে যায় ভিজে
কি করে পাঠ করবে এসব নিরক্ষর সে নিজে
গল্প যদি যায় ভিজে তাই গ্রন্থটিকে ঢাকে ।
রিক্সাশ্রমিক দিনের শেষে নিজের ঘরে ফেরে
সারাদিনের গল্পগুলো গামছাতে নেয় বেঁধে
বইয়ের ছেঁড়া একটি পাতা তারও আছে ঘরে
ক্লান্তি মুছে সেই পাতাটি দেখবে নেড়ে-চেড়ে
সেখানে প্রেম–সোহাগ ঠেলে অক্ষর ওঠে কেঁদে
উপন্যাসের এই পাতাটি নাজুক ও নড়বড়ে।
শুধু স্বরবৃত্ত ছন্দেই নয়, ধ্রুপদী আবেশ ছড়িয়ে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে অক্ষরবৃত্ত ছন্দেও সনেট রচনা করে তিনি মনন সৌকর্য ও শক্তিশালী কাব্য শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। বাংলা ভাষায় চতুর্দশপদী কবিতার পথিকৃত মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৪ মাত্রার অক্ষর বিন্যাস করে অষ্টক ও ষষ্টক পর্ব বিভাজনে ‘বঙ্গভাষা’, ‘কপোতাক্ষ নদ’ রচনা করেন। কিন্তু কাজী জহিরুল ইসলাম পর্ব নির্মাণে আধুনিক অক্ষরবৃত্তের স্বাধীনতা নিয়েছেন এবং অন্তানুপ্রাসের ক্ষেত্রেও স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন। তিনি কখ, খক, গঘ, গঘ, ঙচ, ঙচ, ছছ মেলবন্ধনে সনেট রচনা করেছেন । এ-মেলবন্ধনই প্রমাণ করে তিনি পেত্রাকীয় ও শেক্সপিয়েরীয় সনেটের সম্মিলনে একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন। কবি আল মাহমুদ তাঁর ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থে ‘সোনালী কাবিন’ শীর্ষক সনেটগুলো ১৮ মাত্রার অক্ষর বিন্যাসে রচনা করেছেন। কিন্তু কবিতায় ভাবের গাম্ভীর্যতায়, গীতলতায় ও প্রতীকী ব্যাঞ্জনায় কাজী জহিরের স্বাতন্ত্র্যবোধ প্রতিভাসিত হয়ে ওঠে। ‘বৈশাখের সনেট-১’ শীর্ষক কবিতাটি বিশ্লেষণ করলেই তার সনেট রচনার ক্ষেত্রে পরঙ্গমতা পরিমাপ করা সহজ হবে।
সুমেরু রাত্রির নিচে তাকে বলি না অবগুণ্ঠন
সৈকতে ঝিনুক ফোটা প্রহর আসুক না দেরীতে
আজ রাতে মগ্ন হতে চাই নীরবতার সঙ্গীতে
দিও না তুফান তছনছ করে কৃষ্ণচূড়া বন।
না না নড়বে না একটুও, জানি ভেতরে কী ঝড়
তুমি স্থির বসে থাকো মন্ত্রে বাঁধা অনড় প্রহরে
তোমাকে যে ভাঙে সে ঝড় কাঁপে আমার ভেতর
নামুক আঁধার আরো ঢেউ দেব নরম ডহরে।
বক্ষ-চৈত্র মাঠ খোঁজে নারীর অমৃত রসধারা
চতুর্দশী রাতের পূর্ণতা খুঁজে নিক তৃষ্ণ তিথি
কামনার সব রঙ দেয় যদি বাসর পাহারা
ঘোমটা সরিয়ে আমি খুলে দেব আলোস্ফীতি
কোথায় সানাই তবে, উলুধ্বনি, ঢোল, কই শাঁখ
আমার বাসরে বাজে রাঙা ভোর, নতুন বৈশাখ।
এ-কবিতায় বাসর রাতের মৌন আবহে নববধুর সাথে মিলিত হওয়ার যে ঝড় কবি মনে সৃষ্টি হয়েছে তা সৌকর্যময় ভাষায় ধ্রুপদী ভঙ্গিমায় ব্যক্ত হয়েছে। নারী-সুধারসে চৈত্রের দাবদাহে শুষ্ক মাঠের মতো তৃষ্ণার্ত কবি চিত্তকে সিক্ত করার অভিব্যক্তি আলোক রশ্মির ন্যায় বিচ্ছুরিত হয়েছে অসাধারণ এ-সনেটটিতে।
কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতায় আছে গভীর জীবন দর্শন ও প্রাতিস্বিক ভাবনা। অর্থালঙ্কারবিহীন কবিতা কালের আবর্তে হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা বোধ করেই তিনি আমেরিকান কবি রবার্ট ফ্রস্ট-এর মতো শ্বাশত জীবন ভাবনাকে তার কবিতায় চিত্রকল্প ও প্রতীকের মাধ্যমে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। তার ‘ওঁ থেকে উচ্চারিত’ শীর্ষক কবিতাগুচ্ছে প্রেম, দ্রোহ, দেহতত্ব, ও প্রাত্যহিকতা, বৈষয়িক ভাবনা মূর্ত হয়েছে শৈল্পিক আঙ্গিকে। কবি ভীষণ শৃংখলাবদ্ধ জীবন যাপনে বিশ্বাসী। তিনি মনে করেন সংসারত্যাগী ও বোহেমিয়ানরা প্রাণোচ্ছলতা উপলিব্ধ করতে পারেন না। তাদের জীবন মৃত বৃক্ষের মতো। এ-বোধ থেকেই তিনি সংসার জীবনে খুঁজে পেয়েছেন সবুজের ছোঁয়া।
মেঘের ওলান আস্তে ধীরে হচ্ছে ভারি।
শুকনো ডালে ঠাণ্ডা হাওয়া;
গাঢ় সবুজ মেহেদী পরে
বৃক্ষ হবে কি সংসারী।
‘ওঁ থেকে উচ্চারিত’ শীর্ষক কবিতাগুলো ছোটো হলেও রয়েছে ব্যাপক আত্মদর্শন। তিনি মনে করেন নিজেকে জানার মধ্য দিয়ে নিজের বিকাশ ঘটানো সম্ভব। আত্মপোলব্ধি ও চৈতন্যের উন্মেষের জন্যে তিনি নিজের ভেতরেই খোঁজেন মহীরূহ। অর্থাৎ আত্মজিজ্ঞাসাই বোধের বিকাশ ঘটায়।
কোথায় বোধিবৃক্ষ আছে, পৌঁছুনো কি খুব দুরূহ?
পর্বতে যাই, অরণ্যে যাই…
মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায়, নাভীর নিচে শেকড় গজায়…
বুকের ভেতর জেগে ওঠে
সুপ্রাচীন এক মহীরূহ
কেবল প্লেটোনিক ভালোবাসা বা আত্মিক ভালোবাসার মধ্য দিয়ে মানব-মানবীর জীবনে প্রেমের পূর্ণতা আসে না। ভালোবাসা কেবল মন ও শরীর সর্বস্ব নয়। দেহ ও মনের সমন্বয়ে ভালোবাসার বৃক্ষ বেড়ে ওঠে। তাই শেকড়ে রসের জন্যে, ফল ও বীজের জন্যে শরীরকে উপেক্ষা করা যায় না।
আমি যদি না ছুঁই তোকে
শুদ্ধ হবি কি করে?
কাণ্ড ফেটে বন্যা হবে
জল পাবি না শিকড়ে
ভালবাসা সম্পর্কে বিচিত্র অনুভূতি প্রকাশিত তার কবিতায়। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সৃষ্টি হয় প্রবল আকর্ষণ। ভালোবাসা অথবা প্রেমাচ্ছন্নতার কারণে কেউ নিন্দিত হয় না। প্রেমের ভেতরে থাকে ঈশ্বর। আর তাই পাহাড়ের প্রবল আকর্ষণে মেঘেরা স্পর্শ করে পহাড়শৃঙ্গ। বৃষ্টিস্নান হয় প্রকৃতির। বৃন্দাবনে রাধা ও অন্যান্য গোপীরা রাসলীলায় মত্ত হয় কৃষ্ণের সম্মোহনী শক্তিতে। এ-কথাগুলো হিরণ্ময় হয়েছে ‘ওঁ থেকে উচ্চারিত’ এই অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থে।
চোখের নদী এক চুমুকে…
দুখেরা সব শুকনো কাদা।
মেঘের কি ভয়
পাহাড় যদি হাতছানি দেয়,
বৃন্দাবনে রাধা’
এই যান্ত্রিক জীবনে মানুষ ভীষণ আত্মকেন্দ্রীক হয়ে পড়েছে। স্বার্থপরতার শেকড় প্রোথিত হয়েছে হৃদয়ের গভীরে। একাকিত্বের বৃত্তে তারা আজ বন্দি। মানুষের বাহ্যিক জাকজমক বেড়েছে। মানুষ নিজেদেরকে অনেক পাল্টেছে, কিন্তু তাদের আনন্দ বাড়ি নেই। ভালবাসা হারানোর দুঃখ শেষের পঙক্তির প্রতিটি শব্দে বেজে উঠেছে ।
আমরা দুজন এখন থাকি
একটি ভালো বাসাতেই
ঝড়ো হাওয়ায় কি সব যেন
গেলো উড়ে
নতুন ঘরে আগের ভালোবাসা নেই
কবি জহির ভালবাসার পূর্ণতার জন্যে শারীরিক ও আত্মিক প্রেমের অবিচ্ছেদ্যতার বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন। শুধুমাত্র শারীরিক প্রেম হৃদয়ের একাকিত্ব ও শূন্যতাকে দূর করতে পারে না। এ ধরনের প্রেম দিতে পারে ইন্দ্রিয় সুখ কিন্তু হৃদয়ে জাগাতে পারে না স্পন্দন। হৃদয়ের দূরত্বকে কমাতে পারে না। তাইতো কবি লিখেছেন-
যখন তুমি আমার পাশে থাকো
মায়ার রেখা আঁকো।
চোখের ওপর চোখ রেখেছ
ঠোঁটের ওপর ঠোঁটের ছোঁয়া
পরস্পরের কম্পিত হাত ছুটছে বেপরোয়া।
তবু তুমি অনেক দূরে, কিছুটা নির্বাকও।
কোনো কবিই সমকালকে এড়াতে পারেন না। সমকালীন ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে কবির হৃদয়ে পূঞ্জিভূত হয় আবেগ এবং এক পর্যায়ে সে আবেগের স্ফুরণ হয় অন্তসলীলার মতো কবিতার দেহে, অক্ষরের শৈল্পিক বিন্যাসে। সমাজে ঘটে যাওয়া পৈশাচিক ঘটনা, মানুষের বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা ও হিংস্রতা কবি চিত্তে এমন রেখা পাত করেছে যা কবি চেষ্টা করেও ভুলতে পারছেন না। শুধু বিবেকের দংশনে দংশিত হচ্ছেন।
শো রুম থেকে খুব বড়ো এক কাল কিনেছি আয়না।
শোবার ঘরের নীল দেয়ালে ঝুলছে এখন।
ওর ভেতরে যে লোক ছিল সে কেনো আর যায় না?
নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় সকল সীমাকে অতিক্রম করায় কবির ভেতরে সৃষ্টি হয়েছে প্রবল দুঃখবোধ। তিনি পেন্ডুলাম সন্ধ্যা দেখছেন তার চারপাশে। প্রতিদিন সূর্য উঠছে ঠিকই কিন্তু ভোর ফুটছে না। কোথাও স্নিগ্ধতা নেই, নেই নির্মলতা। এক অশুভ আঁধার গিলে খাচ্ছে রোদের ঝিলিক। তাই এ-দুঃসময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি লিখেন-
ঈশ্বরের ঘরে সারারাত ছিল এক চোরসূর্য উঠেছিল ঠিকই,সেদিন আসেনি ভোর
কবির উপলব্ধি হচ্ছে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই নিজের বিবেককে জাগ্রত করে অন্ধকার ছিঁড়ে কোমল রোদকে স্পর্শ করা সম্ভব ।
আগুন-গলা জলের নিচে পেতেছি এই অঙ্গ
অগ্নিস্নানে শুদ্ধ হবো
অন্ধকারে যাচ্ছে পুড়ে মধ্যরাতের বঙ্গ
‘ওঁ থেকে উচ্চারিত’ পাণ্ডুলিপির (প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থ) কবিতাগুচ্ছ পাঠ করলে ঐতিহ্য সম্পর্কে কবির সচেতনতা, প্রতীক ব্যবহারে নিজস্বতা, গভীর চিন্তার দুয়ার উন্মোচন করার সক্ষমতা এবং ছন্দ সচেতনতা প্রতিভাসিত হয়ে উঠে। এ-কবিতাগুলো কালের বিচারে উত্তীর্ণ হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
সময় সম্পর্কে কবি জহিরের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সময়কে দিন, মাস, বছরের বিভাজনে তিনি বিশ্বাসী নন। তিনি মনে করেন দীর্ঘকালের মধ্যে ক্ষণকাল ও ক্ষণকালের মধ্যে দীর্ঘকাল বিদ্যমান। কয়েক সেকেন্ড স্বপ্নের ভেতর দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে মানুষ। দীর্ঘদিনের কোমা থেকে জেগে ওঠার পর ব্যক্তিটির মনে হতে পারে সে কিছুক্ষণ আগে ঘুমোতে গিয়েছিল। তাঁর ‘আয়ুর ঘড়ি’ শীর্ষক কবিতায় ফুটে উঠেছে মহাকালিক ভাবনা।
এই যে মানুষ,
ব্যস্ত যারা
ছুটছে দ্রুত
কখন সকাল, সন্ধ্যা হলো
পাচ্ছে না টের
কয়দিনে তার হপ্তা, বছর,
কয়দিন তার মাসের হিসেব
কেউ কি জানে?
এই যে ধরো
একটি মানুষ কোমায় ছিল সাতাশ বছর
লোকটি যখন উঠলো জেগে
ক’দিন গেল?
কাজী জহিরুল ইসলামের কিছু কবিতায় ভিন্ন আঙ্গিকের প্রতীকের ব্যবহার পাঠককে ভাবার্থ উদঘাটনের পথ থেকে বিচ্যূত করতে পারে বলে আমার মনে হয়েছে। তাঁর ‘অপেক্ষারা’ শীর্ষক কবিতায় ‘তিন পা’ যেমন ভিন্নতা বা বহুমাত্রিকতাকে বুঝায়, একই সাথে অতিপ্রাকৃতের ইঙ্গিতও বহন করে। ‘গাড়ি’ শীর্ষক কবিতায় গাড়ি শব্দটি দুটো ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও জীবনান্দ দাশ ‘অন্ধকার’ শব্দটিকে কবিতায় বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন, তথাপিও এ ধরনের বহুল ব্যঞ্জনাবিশিষ্ট শব্দ পাঠককে বিভ্রান্তির জালে আটকে ফেলে। তিনি অনেক কবিতায় সাংস্কৃতিক ঔদার্যের প্রকাশ করতে গিয়ে বিদেশী শব্দকে সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কিছু শব্দ বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে কাব্যরস সৃষ্টি করতে সহায়ক নাও হতে পারে বলে আমার মনে হয়েছে। যেমন এবনি কাঠের উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলা ভাষাভাষী পাঠকেরা এ শব্দটির সাথে খুব পরিচিত বলে মনে হয় না।
কিন্তু এ কথা দৃঢ়তার সাথে বলা যেতে পারে কবি কাজী জহিরুল ইসলাম একটি নতুন কাব্যভাষা নির্মাণ বরেছেন। তার কবিতায় আছে বিশুদ্ধ ছন্দের ব্যবহার, প্রতীকের ব্যবহারে আছে অভিনবত্ব। কবিতায় তার প্রতিস্বিক ভাবনা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে দীর্ঘকাল ।