বানর রাজা চীনা পুরাণ (উপন্যাসিকা)
চীনের এক সুপার হিরোর গল্প (দ্যা জার্নি টু দ্যা ওয়েস্ট থেকে)
অ্যারন শেপার্ড অনুবাদ পান্থজন জাহাঙ্গীর
প্রিরিভিউ:
আপনি যদি সুপারম্যান বা স্পাইডারম্যানের কাহিনী দীর্ঘকাল ধরে থাকবে বলে মনে করেন তাহলে এই বানর সম্পর্কে একবার ভাবতে পারেন সে চীনের সুপার হিরো হিসেবে পাঁচশত বছর ধরে জনপ্রিয় হয়ে আছে। সে আশ্চর্যজনকভাবে শক্তিশালী, সে উড়তে পারে এবং তার এমন কিছু কৌশল জানা আছে যা অন্য সুপার হিরোরা কখনো শুনেইনি। আর সে সবসময় প্রস্তুত, শয়তান, ড্রাগন এবং কখনো দেবতা বা ঈশ্বরের সাথে যুদ্ধ করতে। এই বানর ষোড়শ শতাব্দীর দ্যা জার্নি টু দ্যা ওয়েস্ট নামক এক মহাকব্যিক কমিক ফ্যান্টাসির নায়ক। বানরের যে কাহিনীটি এখানে পুনর্কথিত হয়েছে তা হচ্ছে তার উৎপত্তি ও শুরুর দিককার ক্যারিয়ার-এবং একসময় সে আর উপর থেকে বের হয়ে আসতে পারেনা। অথচ সে অমরত্ব এবং জাদুশক্তি লাভ করার পর স্বর্গকে চ্যালেঞ্জ করে।
ধরণ:ফ্যান্টাসি
সংস্কৃতি:চায়না
থিম:ঔদ্ধত্য
বয়স:১০+
দ্বিতীয় পর্ব
প্রভুর সাথে সাক্ষাত
মন এবং হৃদয় পর্বতের ওপর, বানর রাজা পর্বতের পাশে একটি ডাবল দরজার সামনে দাঁড়ালো। এর পাশে ছিল প্রাচীন চরিত্রগুলো দিয়ে খোদাই করা একটি বিশাল পাথরের খন্ড। এটির নাম ছিল –
‘তিন তারকা খচিত স্বর্গীয় গুহা’
‘এটিই সেই জায়গা!ঠিক আছে এটিই কাঠুরিয়া আমাকে বলেছিল। আমি কেবল আশা করছি,এই মনুষ্য কাপড়ে আমাকে ভালো দেখাচ্ছে। সে হঠাৎ ভ্রমণ যাত্রার সময় যা পরিধান করে আসছিলো তার দিকে তাকালো। কালো জুতা,লাল আলখাল্লা এবং জুতোর হলুদ ফিতা। এরপরই দুটি দরজার মধ্যে একটি খুলে গেল। একজন যুবক ভ্রæকুঁচকে তার দিকে তাকালো। সে ভয়ে জোর দিয়ে বলল,
-আপনি সেই জন হতে পারেন না।
-কোন জন? বানর রাজা জিজ্ঞেস করলো।
-আমার প্রভু,মহান ধর্মীয় নেতা সুবুদ্ধি তার দৈনিক ধর্মীয় বাণী প্রদান করতে কেবল ডায়েসে উঠলেন। কিন্তু শুরু করার আগে তিনি আমাকে দরজাটি খুলতে বললেন। কারণ,কেউ এসেছিলেন, যে এই পথের পড়াশুনা করতে চায়।
-ওটিই আমি!বানর রাজা বললো।
-আপনি বলেননি! যুবক এই বলে হাসছে। আমার সাথে আসুন। তারা একটি পাথরের করিডরের নিচ দিয়ে হাঁটতে লাগল। তারপর একটি বড় চেম্বারে প্রবেশ করলেন। সেখানে ত্রিশ বা চল্লিশজন শিষ্য জাদির তৈরি একটি ডায়েসের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই প্লাটফর্মে আড়াআড়ি পা করে একজন লোক বসেছিলেন, যাকে স্বর্গের চেয়ে বয়স্ক দেখাচ্ছিল তবে শক্তিমান এবং স্বাস্থ্যবান। তার প্রবাহমান নিচের দাড়িগুলো তার পেছনের দিকে উড়ে যাচ্ছিল।
প্রভু! এই বলে বানর রাজা তার হাঁটুতে পড়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো এবং মেঝেতে মাথা দিয়ে আঘাত করতে করতে বললো,অনুগ্রহ করে এই বিনয় প্রার্থীকে আপনার শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করুন!
-এটাই কি বিনয়? মহান ধর্মগুরু বললেন। আমরা এটা দেখব। কিন্তু আমাকে বলো তোমার নাম কি?
-আমার কোন নাম নেই, প্রভু। আমার তো কোনো মাতা-পিতা নেই, যে আমার নাম দিবে। আমি একটি যাদুর পাথর থেকে জন্মগ্রহণ করেছি।
-খুবই অস্বাভাবিক,মহান ধর্মগুরু চিন্তামগ্ন হয়ে বললেন। ঠিক আছে,আমি কি তোমার নাম বানর দিতে পারি?
– প্রভু,কি উদ্ভাবনশীল ধারণা! এটি আমাকে সঠিকভাবে যোগ্য করে তুলবে!
-তাহলে বানর এটিই হবে তোমার নাম মহান ধর্মগুরু বললেন। আজ থেকে তুমি থাকবে এবং অন্যদের সাথে শিখবে-যতদিন না তুমি বিপদমুক্ত হবে!
তাই বানর এ পথের একজন ছাত্র হলো। প্রত্যেকদিন সে ধমীয় বই- পুস্তক পড়তে লাগলো। মতবাদগুলো আলোচনা করতে লাগলো এবং মহান ধর্মগুরুর ধর্মীয় বাণী শুনতে লাগল। বাকি সময় গুহা পরিস্কার করল,শাকসবজি এবং ফল বাগানে সাহায্য করতে লাগল। জ্বলানী সংগ্রহ করতে লাগল এবং ঝর্ণা থেকে পানি বহন করল। এভাবে দিন গেল,সপ্তাহ গেল,মাস গেল এবং বছর অতিবাহিত হল।
একদিন মহান ধর্মগুরু বাণী প্রদানের সময় বানর খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়ল যে, সে নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। সে হঠাৎ বন্ধ চোখ খুলল । চার পায়ে তারপর লাফাতে এবং ঘুরতে শুরু করে দিলো।
-ওটা বন্ধ কর! মহান ধর্মগুরু গর্জন করে উঠলেন। বানর তুমি এভাবে লাফিয়ে ছুটছ কেন?
-আমাকে ক্ষমা করুন প্রভু। বানর বললো। আমি আপনার বাণী শুনে এতোই খুশি ছিলাম যে আমি এটি না জেনেই নাচ শুরু করে দিয়েছিলাম।
-শুধু কি এটাই? চিন্তিত মনে বানরের দিকে তাকিয়ে মহান ধর্মগুরু বললেন। তুমি এখানে সাত বছর ধরে আছো,আমি বিশ্বাস করি। আমাকে বলো পথের কোন শাখাটি তুমি আমার কাছ থেকে শিখতে চাও?
-প্রভু, বানর বললেন,আপনি জানেন ,আমি কতোটা অজ্ঞ। ভালো যে কোন কিছু আপনি আমাকে শিক্ষা দিতে পারেন। আমি যদি তোমাকে বাহাত্তর টি পরিবর্তনের শিক্ষা দিতে চাই? যে গুলো শিখলে তুমি তোমার ইচ্ছা অনুযায়ী নিজেকে যে কোন কিছুতে রূপান্তর করতে পারবে।
-চমৎকার হবে,বানর বলল।
এরপর মহান ধর্মগুরু বানরের কানে ফিসফিস করে কি যেন বললেন। তিন মাস ধরে বানর বক্তিগতভাবে শিখিয়ে দেয়া কৌশলগুলো চর্চা করতে করলো। একদিন সে তার গৃহস্থলির কাজে বাগানের পেছন দিয়ে হাঁটছিলো। মহান ধর্মগুরু তার সামনে পড়লেন।
-বানর আমি তোমাকে যে ছোট ছোট কৌশলগুলো শিখিয়েছিলাম ওই গুলোর কি খবর?
-বেশ ভালো,প্রভু, বানর বলল। এখন আমি সেই বাহাত্তরটি পরিবতনের কৌশল ঠিকভাবেই সম্পন্ন করেছি প্রভু। কিন্তু আমাকে বলুন প্রভু, ওইগুলো কি আমাকে অমরত্ব দান করবে?
-সম্ভবত না! মহান ধর্মগুরু বললেন।
-তাহলে,আপনি অমাকে আরো বেশি শিক্ষা দিন।
-ঠিক বলেছো, মহান ধর্মগুরু বললেন। মেঘে ভেসে বেড়ানো বিদ্যার খবর কি? এটা শিখলে তুমি তোমার খেয়াল মতো দ্রæত যে কোন কিছুতে চড়ে ভ্রমণ করতে পারবে।
-দারুণ, বানর বলল।
মহান ধর্মগুরু ব্যখ্যা করলেন,যখন অমরণশীলরা অথবা বৌদ্ধ বা দেবতারা মহাদূরত্ব ভ্রমণ করতে চায়,তখন তারা এক পায়ের ওপর ভর করে যাদুর মেঘে চড়ে বেড়ায় এবং মেঘকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে আবার জোরে আঘাত করে। কিন্তু তুমি তো ভিন্নভাবে জন্মগ্রহণ করেছো। তাই এগুলোর পরিবর্তে তুমি সরাসরি আকাশে বাদুরের মতো ঝুলে উড়ে বেড়ানোর চেষ্টা করো।
এরপর মহান ধর্মগুরু বানরকে কিভাবে আকাশে বা স্থলে বা যাদুর মেঘে উড়তে হয়, আকাশে কিভাবে গতি বাড়িয়ে বা কমিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে অধিক সময় ভেসে থাকতে হয়, তার শিক্ষা দিলেন।
বানর চর্চা করতে করতে আরো তিনমাস অতিবাহিত করলো। শিঘ্রই সে প্রতিবার উড়াতে শতশত মাইল অতিক্রম করতে পারবে। তারপর একদিন মহান ধর্মগুরু তার বাণী প্রদানে বিরতি দিলেন এবং বানরকে আবার তার মঞ্চে ডাকলেন।
-বানর আমি তোমাকে যে সামান্য চাতুরিগুলো শিখিয়েছিলাম, ওগুলোর খবর কি?
-খুবই ভালো, প্রভু কিন্তু আমাকে বলুন, ওইগুলো কি আমাকে অমর করবে?
-আমার না বলা উচিত।
-তাহলে দয়া করে আমাকে আরো শিক্ষা দিন, প্রভু।
ধর্মগুরু তার মঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে বানরের খুব কাছে এসে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। তুমি লোভী জন্তু ! তুমি কি কখনো সন্তুষ্ট হবেনা? তোমার চাহিদা কি কখনো শেষ হবেনা?
তিনি তিনবার বানরের মাথায় জোরে আঘাত করলেন। তারপর তার হাত দিয়ে তার পিঠ স্পর্শ করলেন। এরপর জোর কদমে হেঁটে তার চেম্বারে চলে আসলেন। তারপর জোরে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
বোকা বানর! শিষ্যদের একজন বলল। তুমি প্রভুকে হতাশ করেছো
হুম অন্য একজন বলল, এবং কেউ জানেনা কখন তিনি আবার বের হবেন।
কিন্তু বানর তবু দাঁত দেখিয়ে সেখানে বসেছিল।
সেদিন গভীর রাতে বানর গুহার সামনের দরজা বাইরে শিষ্যদের ঘুমের জায়গা থেকে পীঠ দিয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন। সেখানে সে ছিদ্র দিয়ে মহান নেতার কক্ষের দরজা খোলা দেখতে পেলেন।
-এসো বানর, মহান নেতার কন্ঠস্বর শুনা গেল। বানর গড়াইয়া ভেতরে ঢুকলো। তিনি দেখলো মহান ধমীয় নেতা তার দোলনায় এক পায়ের উপর আরেক পা আড়াআড়িভাবে রেখে বসে আছেন।
মহান নেতা মুচকি হাসলেন, আমি দেখছি তুমি আমার গোপন ঈশারাগুলো রপ্ত করেছো।
-হ্যাঁ প্রভু, আমার মাথায় তিনবার আঘাত করার মানে বুঝেছিলাম, রাত্রির ত্রি প্রহরে এখানে আসতে হবে। এবং পেছনের হাত ধরার মানে বুঝেছিলাম যে পেছনের দরজা দিয়ে আসতে হবে। আপনি যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছিলেন ঠিক সেভাবে এসেছি।
-ঐভাবেই মহান নেতা বললেন। তোমার লক্ষ্যই হচ্ছে অমরত্ব লাভ শিক্ষা নেয়া। কাছে এসো আমার শিষ্য, এবং শুনো পরকালের গোপন রহস্য।
এভাবে মহান নেতা তার মূল্যবান প্রজ্ঞা প্রকাশ করলেন। কিন্ত তিনি যাই বললেন তা অবশ্যই এখানে লিখিত নেই। তিন বছর যাবত বানর গোপন কৌশল চর্চা করলেন। তার দেহ দৃঢ় এবং টেকসই হলো আর ক্ষমতাধর শক্তিতে পরিপূর্ণ হলো। তারপর একদিন সে অন্য শিষ্যদের সাথে গুহার বাইরে বসেছিল।
-বানর, শিষ্যদের একজন বলল। সেই বাহাত্তরটি পরিবর্তনের যুক্তিকতা আছে কি? তুমি কি বাস্তবেই নিজেকে অন্য কিছুতে পরিবর্তন করতে পারো।
-আমি অবশ্যই পারি। বানর গর্বের সাথে বলল।
-আমরা না দেখা পর্যন্ত তা বিশ্বাস করবো না অন্যজন বলল। তাহলে কেবল দেখো। বানর বলল। সে পরিবর্তন বলে ডাক দিল। দেখা গেল সেখানে বানরের পরিবর্তে একটি ইউনিকর্ণ দাঁড়িয়ে আছে।
-শাবাস! শাবাস! শিষ্যরা চিৎকার দিয়ে উঠলেন। বানর যখন পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসলেন তখন তারা তাকে করতালি দিল এবং কুর্নিশ করে সম্মান জানালো। তারপরেই মহান ধর্মগুরু সুবুদ্ধি হঠাৎ গুহা থেকে বের হয়ে পড়লেন।
-এতো চেচামেচি করছো কেন? তিনি চিৎকার দিয়ে উঠলেন। তোমরা কি জানো না এই পথের শিষ্যরা কখনো গোলমাল করেনা?
-আমরা দু:খিত, প্রভু। বানর বলল। আমি কেবল মাত্র আমার একটি পরিবর্তনের প্রদর্শনী দেখিয়েছিলাম। মহান ধর্মগুরু রেগে শাদা হয়ে গেলেন। বানর ছাড়া বাকি সবাই চলে যাও!
যখন সবাই চলে গেল, তখন মহান ধর্মগুরু তার শিষ্যেদের দিকে ঘুরে তাকালেন।এই হচ্ছে তোমার সেই ক্ষমতার ব্যবহার-যার তুমি প্রদর্শনী দেখালে? তুমি কি একবারও ভেবে দেখোনি যে অন্যরা তোমার প্রতি ঈর্ষান্বিত হবে? তারা বারবার অবশ্যই আসবে এবং তোমার গোপন রহস্যগুলো জানতে চাইবে। আর যদি তুমি তখন তাদের দাবি প্রত্যাখান করো তখন হয়তো তারা তোমার প্রতি প্রতিশোধ নিতে চাইবে।
প্রভু আমি দু:খিত।বানর বলল। আমি তা ভাবিনি।
ঠিক আছে, আমি তোমাকে শাস্তি দেবো না। মহান ধর্মগুরু বললেন। কিন্তু এখানে তুমি আর বেশিদিন নিরাপদ নও। তোমাকে এই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হবে।
প্রভু আমি কোথায় যাব? বানর শঙ্কিত হয়ে বলল।
এটাই তোমার কাজ। তোমাকে করতেই হবে। মহান ধর্মগুরু বললেন। কিন্তু তোমার এই পথে তুমি আরো যাদুর অস্ত্র রপ্ত করবে। যা তোমার আতœরক্ষার কাজে আসবে। প্রাচ্য সাগরের ড্রাগন রাজা হয়তো তোমার উপকারে আসবে।
কিন্তু প্রভু, জল টলমল চোখে বানর বলল, আপনার সকল দয়ার মূল্য না দিয়ে আমি কিভাবে যেতে পারি?
আমার কোন উপকার করতে হবে না, ধর্মগুরু বললেন। একবার যদি তুমি সেই দেশে যাও তাহলে সাংঘাতিক বিপদে পড়তে পারো। এর বাইরে শুধু আমার নাম স্মরণ করো। আর ভুল করেও কাউকে সাহস করে বলোনা যে তুমি আমার শিষ্য। প্রভু ওয়াদা দিলাম, বানর বলল, বিদায় প্রভু। তারপর সে আকাশে উড়াল দিল। এক খন্ড যাদুর মেঘ বসল। তারপর অনেক উপর দিয়ে উড়ে চলে গেলো
‘