আলো ।। মুহাম্মদ মিজানুর রহমান
সকাল থেকে মনটা ভালো নেই। আলোকে কয়েকবার ডাকলাম- এই আলো, এই আলো, একটু এদিকে এসো না। আলো আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। আমি কাছে গিয়ে বললাম, রাগ করছিস আলো। তোর অমন করে থাকাটা আমার কাছে ভারি কষ্টের। তবু সে কথার কোনো গুরুত্ব দিলো না। উলটো আমার দিকে তাকিয়ে এমন ভাব প্রকাশ করল, আমি যেন তার সমস্ত বিরক্তির একমাত্র কারণ। আমি বুঝতে পারছি না, সে কেন এমন করছে। তবু আমি আলোকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? এবার সে আগের মতোই নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে রইল। তবে একটুখানি আমার দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো, চোখ দুটোতে রক্তিম আভা ধারণ করেছে। আগুনে উত্তেজনা তার মস্তিষ্কে। চোখে-মুখে তারই প্রকাশ। এবার সে গাম্ভীর্য নিয়ে বলল, আমার জীবনে কী এমন আছে যা আমি তোমাকে বলব? আমি বললাম, কেন তুমি এমন করে বলছো ? বলার কি কিছুই নেই ? মেয়েসুলভ আচরণে আমার দিকে তাকিয়ে এমনভাবে মুখের ভঙ্গিমা দেখালো এবার সত্যি সত্যি আমার কাছে মনে হলো ও আমার কাছে অজানা-অচেনা কেউ।
আমি জানি, ও খুব ভালো মেয়ে। এ সংসারে পা রাখার পর জীবন হাঁপিয়ে উঠেছে ওর। আমাদের এ অভাবী সংসারে আমার তুলনায় আলোর অবদান কোনো অংশে কম নয়। তার হাতেই সংসারটা একটু একটু করে সাজিয়ে উঠতে শুরু করেছে। এ পরিবার, এ সংসার নিয়ে তার থেকে আর কেউ বেশি ভাবে না। ভোর হলে আমি বেরিয়ে পড়ি। আর সন্ধ্যায় ফিরে আসি। কিন্তু আলোর ভোর হয় রাতের কিছু অংশ বাকি থাকতেই। সংসারের যাবতীয় কাজ আলো একা নিজ হাতে করে। সকাল সকাল সব কাজ সেরে ফেলে। ফজরের আজান হলে আমাকেও ডেকে তোলে। কখনো কখনো আমিও তার কাজে সাহায্য করি। মাঝেমধ্যে আমি আর আলো দুজনে সব কাজ সেরে একসাথে ফজরের নামাজ পড়ি। ছেলেমেয়েরা এসব দেখে একটু-আধটু মুচকি হাসে। ওরা দেখেও যেন দেখে না। আর আমরা বুঝেও না-বোঝার ভান করি। এসব ব্যাপার নিয়ে কখনো সিরিয়াসলি ভাবি না। আমাদের ভাবনার জায়গাটা একটু আলাদা। আমাদের মূল্যবোধটা এরকম, ছেলেমেয়েরা আমাদের দেখে শিখবে। নিজের পারসোনাল লাইফটা ওরাও এভাবে ইনজয় করুক। অন্যায়ের পথে থাকার চেয়ে ভালোর প্রাকটিসটা আমাদের কাছে অনেক শ্রেয়। তাই বর্জনীয় বিষয়গুলো গ্রহণীয় ভাবতে মন কিছুতেই সায় দেয় না। আর সেটা পারিও না।
মাশরুবাকে নিয়ে ইদানীং সংসারে নানা অশান্তি হচ্ছে। তাকে এখানে রাখার বিষয়ে শুরুতেই আমার অমত ছিল। কিন্তু স্ত্রীর কাছে আমার কথা গুরুত্ব পায়নি। যেহেতু সে আলোর ছোট বোন। এ অমতের কথা গোপনে আমি আলোকে বললেও প্রকাশ্যে অন্য কাউকে বলতে পারি না।
মনে মনে সবসময় একথাই ভাবতাম, মাশরুবা ছোট নয়, তাছাড়া তার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। আলো আর মাশরুবা বয়সে মাত্র দুই বছরের ছোট-বড়। অজানা এক কারণে অল্প বয়সে আলোর সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়। লেখাপড়ার প্রতি মাশরুবার প্রচণ্ড ঝোঁক থাকার কারণে আমার শ্বশুর অনেক চেষ্টা করেও তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে পারেনি। তার কথা, এত অল্প বয়সে বিয়ের তকমা লাগিয়ে ঘুরতে চাই না। আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখি এরপর না-হয় বিয়ের কথা ভাববো। কারো বোঝা হয়ে বাঁচার মতো মানসিকতা আমার নেই।
আমার কাছে তার ভাবনাটা মোটেই অযৌক্তিক নয়। লেখাপড়ার মাঝে এরকম একটা তালগোলে পরিবেশে না জড়ানোই ভালো। মাশরুবাকে নিয়ে আমার শ্বশুর অনেক কথা বলেছে । এমনিতেই সে একটু রক্ষণশীল ঘরানার মানুষ। মেয়েদের বিয়ে-সাদীর ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট অগ্রগামী। তার মতে বিয়ের ব্যাপারটা অন্যরকম। বিয়েটাকে তিনি উত্তম চরিত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে দেখেন। তেমনি পড়াশোনার ব্যাপারেও তিনি আন্তরিক। আলোকে বিয়ে করার পর তিনি বারবার আমায় বলেছিলেন- বাবা, বিয়ের অজুহাতে মেয়ের পড়াশোনাটা বন্ধ করে দিও না। যে সমাজে অর্ধেক নারী, তাদের অন্ধকারে রেখে আলোর কথা ভাবা যায় না। আমার কাছে, বাবার চেয়ে একজন মায়ের শিক্ষিত হওয়া অনেক বেশি দরকারি। বিয়ের পরে আমি আলোকে অনেক বোঝালেও সে আমার কথা শোনেনি। বন্ধ করে দিলো পড়াশোনা। এ নিয়ে আমার শ্বশুর অনেক আফসোসও করেছে। আলোকে আর পূর্বের জায়গায় ফেরানো সম্ভব হয়নি। আমি নিজেও কম চেষ্টা করিনি। ফলাফল দাঁড়িয়েছে…।
তাই মাশরুবা যখন নিজের বিয়ের ব্যাপারে নিজেই বাধা হয়ে দাঁড়ালো তাকে আর জোরাজুরি করল না। কারণ আলো তার যে আশা ভঙ্গ করেছে মাশরুবা যেন সে কাজ করতে না পারে এ ব্যাপারে বাবা সচেতন হয়ে উঠলেন। তাই পড়াশোনার জন্যই মাশরুবার ঢাকায় আসা। আর এ সুবাদেই আমার বাসায়। আলো বারবার এ কথাই ভাবছিল, আমি থাকতে আমার ছোট বোন অন্য কোথাও থাকবে এটা আমার জন্য শোভনীয় নয়। তাহলে লোকে কী বলবে। আলো এমনিতেই একটু আত্মমর্যাদাশীল সম্পন্ন। সমাজ ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় নিয়ে কাজ করে। তাই আমি আলোর কথা ফেলতে পারলাম না। আর মাশরুবার বিষয়টি এড়িয়েও যেতে পারলাম না। আলোর সাথে একমত হয়ে পূর্বের কথা স্মরণ না করে আমিও বললাম, থাকুক না এখানে। ওতো আমার বোনের মতো। আলো দারুণ খুশি হলো আমার এ হ্যাঁ বলাতে। আলোর খুশি দেখে আমারও ভালো লাগছে। আমি তো চাই, ও সবসময় খুশি থাকুক। ওর একটুখানি হাসি আমার কাছে অনেক দামি।
দু’বোনের মিল দেখে আমারও মনে মনে দারুণ ঈর্ষা জাগে। নিজের বোনের কথা বারবার মনে পড়ছে। মাঝে মাঝে নিজেকে অপরাধী ভাবি। আলো তার বোনের প্রতি যে ভালোবাসাটুকু দেখাতে পারল, একজন ভাই হয়ে নিজের অসহায় বোনের প্রতি সে ভালোবাসা আমি দেখাতে পারলাম না। এ নিশ্চয়ই আমার ব্যর্থতা। ভাইবোনের ভালো-মন্দের খবর পর্যন্ত রাখতে পারি না। কেন পারি না? এর সদুত্তর খুঁজতে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু পাইনি। পেলেও সেটা সুখকর ছিল না আমার পরিবারের জন্য। বারবার ভয় হতো ওদের ঘর বাঁচাতে গিয়ে নিজের ঘরটাই-না ভেঙ্গে যায়, তার চেয়ে বরং যা আছে এ নিয়ে বেশ আছি। তাই নিজের কথা ভাবতে গিয়ে এখন ওদের কথা ভাবতে পারি না। বউয়ের যোগ্য স্বামী হওয়ার চেষ্টা করেছি। এখন তা-ই হয়ে গেছি। আমায় নিয়ে আলোর কোনো ভয় নেই। না-আছে সংশয়। এখন আমার ব্যাপারে আলোকে আর কিছু বলতে হয় না। আমি যে আলোর। মনেপ্রাণে সে এটাই জানে।
আমার এই এক মেরুকরণের খবর এখন আর কারও অজানা নয়। মা-বাবার সাথে কথা হয় বটে কিন্তু সে কথার গভীরতা মন থেকে আমাকে তুষ্ট করতে পারে না। বারবার লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে রাখতে হয়। এতেই আমি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। কখনো কখনো ভাবি, কী চেয়েছি আর কী পেয়েছি। এরপরেও সবকিছু ভেবে চুপ থাকতে হয়। এখন যে আর বলার কিছু নেই। সে সীমা অনেক আগেই অতিক্রম করে ফেলেছি।
মাশরুবার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ নেই আমার। সেই অনাগ্রহের জায়গাটাও আমি প্রকাশ করতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, আলোর মতো মেয়েরা এভাবে হতে পারে কখনো কোনো দিন ভেবেছি? তাহলে মাশরুবা আমার কে, তাকে নিয়ে এতো ভাবারই-বা কী আছে? আলোই তার জন্য যথেষ্ট।
আলোকে নিজের কষ্টটা বহুদিন বোঝাতে চেয়েছি। না সে কোনোদিন বুঝেছে, আর না-বুঝবে। সংসার জীবনে আমি কোনোদিনই চাইনি আমাদের পারিবারিক অশান্তির ছায়া আমাদের ছেলেমেয়েদের উপর পড়ুক। তাই নিজে হেরেও চুপ থেকেছি। ছেলেমেয়ের কথা ভেবেছি। মনে মনে এই সংকল্পও করে নিয়েছি প্রতিবাদ যখন করিনি আর কোনোদিন করব না। আপোস করেই বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিব। কারণ আমাকে তো অনেকটা পথ এভাবেই পাড়ি দিতে হবে। মায়ের চোখের জল, বাবার কান্না এর মূল্য তো আমাকে বড় দাম দিয়ে চুকাতে হবে। মনে মনে সেই দিনটার জন্যও প্রস্তুত।
মাশরুবাকে আমি ছোট বোনের মতো জানি। তার প্রতি আমার যে বিরুপ ধারণা ছিল তার অনেকটাই এখন নেই। আলো আমায় সে পথ থেকে সরিয়ে নিয়েছে। কাজের প্রতি মাশরুবার দৃঢ়তা সত্যিই আমায় মুগ্ধ করেছে। এখন তার ব্যাপারে উদ্যোমী হয়ে আমি নিজেও খবর রাখি। কেমন চলছে তার পড়াশোনা। কীভাবে কাটছে তার দিন। তার মাঝে রোমান্টিকতার কোনো অভাব নেই। তার গতিবিধি দেখে মাঝে মাঝে সংশয় জাগে। ছোটবেলা থেকেই আড়ালে-আবডালের বিষয়গুলো আমাকে ভাবিয়ে তুলত। নিজে কখনো এসবে না জড়ালেও এ মানুষগুলোকে চিনতে খুব একটা বেশি কষ্ট হতো না আমার। এজন্য ভাবিদের অনেক বকা শুনতে হয়েছে। কম বয়স থেকেই মুখে কথা খুব একটা বেশি আটকাতো না। মনে যা হতো হুটহাট করে তাই বলে ফেলতাম। বিয়ের পরেও এ অভ্যেসটা ছাড়তে পারিনি।
মাশরুবাকে নিয়ে বেশ আগে থেকেই আমার মনে সন্দেহ দানা বেঁধেছে। কিন্তু আলোর ভয়ে সে কথা প্রকাশ করতে পারিনি। একদিন মুখ ফসকে বলে ফেললাম, এই যে শ্যালিকা, গতিবিধি দেখে তো ভালো মনে হচ্ছে না। না-জানি কোন রোমান্টিকতায় জড়িয়ে পড়েছো। এটুকু বলাতে আলোর অগ্নিশর্মা মুখটা দেখে আমি ওখানেই থমকে গেলাম। ভাবলাম, যা বাঁধিয়েছি জানি না কদিনে এর সুরাহা হবে? এরপর থেকে আলো আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। যখন ডাকতে হয় ছেলেকে বলে, এই যা তোর বাবাকে ডাকগে। আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। কখনো কখনো মেয়েটা আমাকে ডেকে নেয়। এভাবে ইশারা-ইঙ্গিতে দিন কাটতে থাকে।
ইদানীং আমি লক্ষ করছি, আলো আমার ওদিনের কথা মনে রেখে মাশরুবার উপর নজর রাখছে। আমাকে সে ধরা দিতে চায় না। মাশরুবাকে নিয়ে যতই আমি দুষ্টুমি করি না কেন সে আমার বোন সমতুল্য। আমার মুখের ভাষা আর মনের কথার মাঝে অনেক তফাত সেটা আলো ভালো করেই জানে। মাশরুবার বিষয়টি আমার কাছে ভালো লাগছে না। না-পারি আমি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে। আর না-পারি সন্দেহ করতে। তারপরেও মনের মধ্যে একটা দাগতো লেগেইআছে। এ বয়সে ভুল করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। হয়তো সেটাই সে করছে। কিন্তু আমরা বুঝতেও পারছি না। আসলে সেই ভুলটা কী।
সকালে সে ক্যাম্পাসের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে। লাঞ্চটা ওখানেই সারে। সারাদিন বাসায় ফেরে না। সন্ধ্যার দিকে বাসায় আসে। আবার কখনো রাত হয়ে যায়। এভাবেই তার দিন কেটে যায়। আলো আজ নিজে থেকেই আমায় কাছে এসে বলল, মাশরুবার ব্যাপারটা আমার ভালো মনে হচ্ছে না। আমি বললাম, কী রকম মনে হচ্ছে তোমার? আলো বলল, দেখ, এটা ফাজলামো করার সময় নয়। আমার মনে হচ্ছে ও এমন কোনো পথে পা বাড়িয়েছে যে সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। তুমি ওর ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখ। আমি বললাম, ও তোমার বোন ওর কথা তোমার চেয়ে আর বেশি কে ভাবতে পারে? আমি বুঝতে পারলাম, আলো আমার এ কথাতে রাগ করেছে। তবুও তার রাগ ভাঙ্গাতে আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হলো না।
আলোকে আমি যাই বলি না কেন, কিন্তু মাশরুবার ব্যাপারটা ভাবিয়ে তুলল আমায়। আমি জানতে চেষ্টা করলাম আসলে ওর কী হয়েছে। চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না আমার। আমি যেটুকু আঁচ পেলাম তাতে আমার ধারণাই সত্যি হতে চলেছে। এই খবর যদি আমার শ্বশুর জানতে পারেন তাহলে লজ্জায় তার মাথা কাটা যাবে। আমি আলোকে পর্যন্ত বিষয়টা লুকিয়ে গেলাম। আমার ভয় হতে লাগল, ও যদি কিছু একটা করে বসে। এসবের তো ওই একটাই পরিণতি।
নিত্যদিনের মতো আমিও অফিসে চলে গেলাম। আলোকে যথাসম্ভব বোঝাতে চেষ্টা করলাম মাশরুবা ঠিক আছে। ওর কিছু হয়নি। আমরা যা আশংকা করছি তেমনটি হয়নি। হতেও পারে না। সারাদিনে বাসার আর কোনো খবর আমি রাখিনি। রাত আটটার দিকে বাসায় ফিরে এলাম। দরজায় হাত রাখতেই আলো ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো। চোখ দুটো ভেজা। আমি বললাম, কী হয়েছে? আলো আমার কথার কোনো উত্তর দিলো না। ভিতরে চলে গেল। আমিও আলোর পিছু নিলাম। এবার আমি আলোকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আলো, কী হয়েছে? ও বলল, মাশরুবা এখনো বাসায় ফেরেনি। আমি অবাক হলাম ! দীর্ঘ সাত বছরে এমন একটি দিন কখনো হয়নি যে দিন মাশরুবা বাসায় ফেরেনি। এই মুহূর্তে ঠিক আমি কী করব ভেবে পাচ্ছি না। আমি সবরকম চেষ্টা করলাম ওকে খোঁজার। ওর বন্ধুবান্ধর যাকে চিনি সবাইকে ওর ব্যাপারে বললাম। সবার একই কথা, মাশরুবা এমনটি করতে পারে না। ও কেন বাসায় ফিরছে না। এ নিয়ে আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম।
স্বামী হিসেবে আমি বউয়ের অনুগত হলেও আমার অন্য ভাইয়েরা আমার মতো নয়। তারা যে বউয়ের অমর্যাদা করে তা-ও না। আমার একটা ভাই এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিস্ট্রিতে মাস্টার্স করছে। তার সাথেও আমার কোনো যোগাযোগ নেই। রাগে হোক আর অভিমানে হোক সে-ও আমার খবর রাখে না।
এক সপ্তাহ হয়ে এলো মাশরুবার আর কোনো খবর নেই। ব্যাপারটা যে কীভাবে আড়াল করব ভেবে পাচ্ছি না। তাছাড়া চেপে রাখাটাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। পরে যখন জানাজানি হয়ে যাবে কী জবাব দেব আমি সবাইকে। কারণ, সে আমার অধীনেই ছিল। সবাই ভাববে, এটা আমার দায়িত্ব অবহেলায়ও হতে পারে। অষ্টম দিনও অতিবাহিত হতে চলেছে। এখনো আমার শ্বশুরকে বিষয়টি জানাইনি।
হঠাৎ করে আমার ফোনে মাশরুবার নম্বর থেকে একটা কল এলো। ফোনটা তুলে আমি মাশরুবাকে যাচ্ছেতাই বললাম। আমার মনে গাদা গাদা রাগ জমে ছিল তার জন্য। সে চুপ হয়ে আমার কথা শুনল। কোনো উত্তর দিলো না। ফোনে একটা সদ্যজাত শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি বললাম, তুমি কোথায় ?
ও বলল, ভাইয়া, তুমি আমাকে দেখবে? তাহলে বুবুকে নিয়ে সোজা ঢাকা মেডিকেলের গাইনি ওয়ার্ডে চলে এসো।
আমি বললাম, ওখানে!
তুমি এসো এরপর না হয় জানতে পারবে।
এখন এতকিছু জানার সময় নয়। আলোকে নিয়ে সোজা হাসপাতালে পৌঁছলাম। ওখানে গিয়ে দেখলাম, মাশরুবা একটি বেডে শোয়া। তাকে খুব দুর্বল মনে হচ্ছে। পাশে ফুটফুটে একটি পুত্রসন্তান। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ বাচ্চাটি কে? কী এর পরিচয়? মাশরুবা আমাকে বলল, ঐ লোকটাকে জিজ্ঞেস করো, ও কে?
আমি দেখতে পেলাম মাশরুবার থেকে কিছুটা দূরে আমাদের দিকে পিঠ করে একটা লোক বসা। আলো বলল- মাশরুবা, কে ওই ছেলেটি? ও আমার স্বামী। এই সন্তানের বাবা। আলো রেগেমেগে অস্থির হয়ে উঠল। আমি বললাম, আলো, তুমি এটা করতে পারো না। এটা হাসপাতাল। চারদিকে লোক ভর্তি।
আমি লোকটার কাছে গিয়ে আমার দিকে মুখ ঘুরালাম। ও বলে উঠল- দাদা, আমায় মাফ করে দাও। আমি এমনটি করতে চাইনি। আমি চড়াও হয়ে উঠলাম ওর উপর। মাশরুবা ওই অবস্থায়ও আমার দিকে ছুটে এলো। না ভাইয়া, না। ওর কোনো দোষ নেই। আলো তোমার এবং তোমার পবিরারের উপর যে অন্যায় করেছে কিছুটা হলেও আমি তা পুষিয়ে দিতে চেয়েছি। তাই নিজে জেনেশুনে এ পথে পা বাড়িয়েছি। আমি মাশরুবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। অদূরে তাকিয়ে দেখি, মা দাঁড়ানো। আমি মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়লাম।
লেখক : তরুণ গল্পকার ও প্রাবন্ধিক।