আজাদ বুলবুল
কোথায় গেলো ধানের সুঘ্রাণ! সুপারি বাগানের গেছো গন্ধ, ঘাস বাদালির মিষ্টি সুবাস। পাট পঁচানোর সোঁদা গন্ধ এখন কই? চৈত মাসে কাদাজলমাখা প্যাকের গন্ধও নাকে আসে না। আমের বোলের ম ম ঘ্রাণ হারালো কোথায়! আমেরিকা ফেরত জলিল সাহেব কেবল ভাবেন। তিনি কী ঘ্রাণ শোঁকার শক্তি হারিয়েছেন? নাকি নাসারন্ধ্রে দেখা দিয়েছে অজানা জটিলতা। তা নাহলে কোথায় হারালো বিচিত্র ঘ্রাণের স্বদেশভূমি? নিজের কাছে জবাব খোঁজেন তিনি, কিন্তু আরো অনেক জিজ্ঞাসার উত্তরের মতো এটাও অমিমাংসিত থেকে যায়।
জলিল সাহেব এতোদিন নিজেকে দুর্ভাগা ভাবতেন। মনোবেদনার দীর্ঘশ্বাস লুকাতেন নানা গালগপ্পোর তুবড়ি ছুটিয়ে। প্রতিবেশীর জিজ্ঞাসার উত্তরে বলতেন– নিজের জন্মভুমি ফেলে বিদেশে থাকবো কেন? আমাদের কী দেশপ্রেম কম? ওখানে গেছিতো রোজগার করতে, করলাম বহুকাল। শেষকালে ঘুমাবো নিজের মাটিতে। যদিও আসল কথা এগুলো নয়। ঘটনা হলো ডলারের দেশ আমেরিকায় দুই যুগের অধিককাল নির্বিবাদে কাটিয়েও কাগজপত্র বানাতে পারেননি তিনি। আমেরিকান সিটিজেন হতে না পারার এই অক্ষমতা তাকে অহোরাত্রী কুঁকড়ে খায়। কতো লোক কত্তো সহজে ওয়ার্ক পারমিট গ্রীণকার্ড পেয়ে গেলো। ওপি, ডিবি কিনে, ইমিগ্র্যান্ট বিয়ের নাটক সাজিয়ে, ঘুস-উৎকোচ, উকিলি পরামর্শ মেনে কতো মানুষের ভাগ্যের দুয়ার খুলে গেলো। কিন্তু কপালে বিরূপ চিহ্ণ জলিল সাহেবের। নইলে সহস্র সুখের উৎসভুমি নিউইয়র্ক শহর ছেড়ে এখন নোয়াখালির পৈত্রিক বাড়িতে থাকবেন কেন তিনি। ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি জারি হবার পর বুঝলেন– সেদেশে থেকে কাগজপত্র বানাবার আশা করা আর ছাইয়ের স্তুপে হিসু করা একই কথা।
তবে জলিল সাহেবের মনোকষ্টের আগুনে ইদানিং জলঢালা পড়েছে। গত কয়েক দিনের ঘটনায় তিনি খুশি হবেন নাকি বেজার হবেন বুঝতে পারছেন না। ইটালির পর আমেরিকা যেখানে বাইশ বছর ধরে একনাগাড়ে ছিলেন সেটা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত দেশ। বন্ধ অফিস আদালত, দোকানপাট, স্কুল কলেজ। নগরবাসী সেল্প কোয়ারেন্টাইনে গৃহবন্দী।প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের হামলায় নিউইয়র্ক টাউন মৃতপুরী। আমেরিকা জুড়ে আক্রান্ত লক্ষাধীক মানুষ। দিশেহারা ট্রাম্প প্রশাসন করোনা প্রতিরোধে অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দুটো যুদ্ধ জাহাজকে হাসপাতাল বানিয়ে চিকিৎসা সেবার উদ্যোগ নিয়েছে। চটজলদি বানিয়েছে আইসিইউ বেড কিন্তু আশানুরূপ ফললাভ হচ্ছে না। বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, লাশের মিছিল। জলিল সাহেব ভোরসকাল থেকে টিভির চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরায় চোখ বুলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শেষ খবরটুকু জানার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকেন। অবাক বিষয় হচ্ছে আমেরিকার সিটিজেন হতে না পারার বেদনায় এখন আর তাড়িত হন না। বরং আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন– এমনিতর সান্ত্বনাবাক্য মনে মনে ভাবতে তৃপ্তি পান তিনি।
দেশে ফেরার পর গ্রামের মানুষের ভাষা, আচরণ, আইন মানার অবজ্ঞা দেখে মনে খুব কষ্ট হতো তার। আমেরিকার মানুষের তুলনায় তার প্রতিবেশীদের আচরণ এতো ফারাক! তবে সান্ত্বনা খুঁজতেন এই ভেবে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে দেখতে পাওয়া বিষয় বৈশিষ্ট্যের সাথে দারিদ্র্য পীড়িত দেশবাসীকে মেলানো অবান্তর।
করোনা নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে গ্রামে, গঞ্জে, শহরে, দেশজুড়ে। বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা, নানা বিশেষজ্ঞ অভিমত, স্বপ্নেপ্রাপ্ত ঔষধ ছড়িয়ে পড়ছে পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ওয়াজ নসিহতে বড় বড় মাওলানাগণ নিদানের নানা তত্ত্ব তুলে ধরছেন প্রামাণ্য দলিলের দোহাই দিয়ে। গুজবে প্রচারিত থানকুনি পাতা ও আদা চা তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে আপন মহিমায় করোনা বিনাশে অবদান রেখে চলেছে।
কয়েকদিন আগে এক বৈজ্ঞানিক জার্ণালের বরাত কেউ একজন লিখেছেন করোনাভাইরাস পঞ্চাশাধিকবার চরিত্র বদল করেছে। কেবল জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট নয় ঘ্রাণশোঁকার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়াও করোনার লক্ষণ। খবরটা শোনার পর থেকেই উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় দমে গেছেন জলিল সাহেব। অহরহ কুঁকড়ে থাকেন অজানা আতঙ্কে। ভয়ের শীতল স্রোত শিরদাঁড় বেয়ে নামতে থাকে নিসঙ্গ মূহুর্তে। গৃহবন্দীর নিরাপদ সময়কাল নিদারুণ অস্থিরতায় মুষড়ে তোলে। পেছনের জানালায় নাক ঠেকিয়ে চৈতালি বাতাসের গন্ধ শোঁকেন তিনি। কিন্তু খড়ের গাঁদার ছায়া মাড়িয়ে এঁদো পুকুরের ঘোলা জল জলিল সাহেবের নাকে কোনোরূপ গন্ধ লাগাতে পারে না। শিম, মাসকলাই ডাল, কাঁঠালের মুচি, ভাঁপ ওঠা ভাত, সবকিছুই যেন তার নাকে নিরাসক্ত গন্ধহীন।
তিনদিন ধরে এক নাগাড়ে গৃহবন্দী জলিল সাহেব। মনে তার করোনা ভয়। কিন্তু বুঝতে দেন না কাউকে। রাতে ঘুম হয় না। তন্দ্রা লাগতেই ভয়ের স্রোত গলায় আটকে যায়। দম বন্ধ হয়ে আসে। দড়ফড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসেন। কয়েক সেকেন্ড পরে খেয়াল হয় শ্বাস প্রশ্বাস ঠিকই আছে। এ সবই তার মনের ভুল। তীব্র ভীতিবোধ থেকে সৃষ্ট ফ্যান্টাসী।
তিন দিন জানালা খোলেননি, গোসল করেননি, দাড়ি কাটেননি তিনি। ঘুমও হয় নি ভালভাবে তার। দেশজুড়ে যেন অঘোষিত ধর্মঘট, কারফিউ। আজকাল সকাল হয় অনেক বেলা গড়িয়ে। দশটা নাগাদ তীব্র হুইসেল ও গাড়ি চলার গোঁ গোঁ আওয়াজ শুনে জলিল সাহেব বুঝতে পারেন সেনাবাহিনীর টহলদল রাস্তায় নেমেছে। তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছেড়ে জানালা ফাঁক করেন তিনি। টহলদল দেখার বাসনা কেন হলো, এটা আদৌ দেখার বিষয় কিনা কিংবা এই দেখাদেখির বিষয়টি বালখিল্য আচরণ কিনা এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বিষ্ময়ে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। তার নাকে গন্ধ লাগছে। পেট্রোলের মিষ্টি ঝাঁঝালো গন্ধ। কী আচানক কারবার। বালক বেলায় গ্রামে মটর সাইকেল বা জীপগাড়ি এলে এমনি ঘ্রাণ নাকে লাগতো। এইতো সেই গন্ধ! পোড়াপোড়া, কিন্তু বিদঘুটে নয়। জলিল সাহেব বুক ভরে বাতাস টেনে নেয়। আরে! এইতো গন্ধ। গন্ধ পাচ্ছেন তিনি। খড়ের গাদার ধোঁয়াটে গন্ধ, মজা পুকুরের পঁচা প্যাকের বিটকেলে গন্ধ। এক সপ্তাহের গৃহবন্দীকাল তার চারপাশের গাড়ির ধোঁয়া, ইটভাটার গর্জন, কীটনাশকের সুবাস সবকিছুই তাড়িয়ে নিয়ে গেছে। জলিল সাহেব এক ঝটকায় ঘরের দুয়ার মেলে প্রায় খুলে যাওয়া লুঙ্গি হাতের মুঠিতে ধরে দৌঁড়ুতে দৌঁড়ুতে চিৎকার করে বলতে থাকেন- এরে! আঁই হুদাহুদি ডরাইচি রে। আঁর করোনা অয় ন।
আজাদ বুলবুল: কথাশিল্পী ও গবেষক। উপ পরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম শাখা।