অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীর প্রতি শ্রদ্ধা 


মেজবাহ উদ্দিন।। পুবাকাশ


অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ডিগ্রিধারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী ছিলেন একাই একশ, তিনিই বিভাগের প্রাণপুরুষ। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা, কঠোর নিরপেক্ষতা, রাজপুত্রসুলভ চেহারা, ভাবগম্ভীর চালচলন, পরিচ্ছন্ন রুচিশীল স্বভাব, ও মার্জিত চালচলন ছিল সকলের জন্য অনুকরণীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় ভাইস চ্যান্সেলর আবুল ফজল তাঁর পরামর্শের উপর নির্ভর করতেন। প্রায় সকল কমিটিতে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের অধ্যয়নকাল একটি সোনালী যুগ ছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথে এত মেধাবী ও বিখ্যাত শিক্ষকদের সমাবেশ কী করে সম্ভব হয়েছিল তা ভাবতে অবাক লাগে। বাংলা বিভাগে অধ্যাপক ডক্টর আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক ডক্টর আবু হেনা মোস্তফা কামাল; অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস; ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপক ডক্টর আবদুল করিম, অধ্যাপক ডক্টর আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন; পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক ডক্টর এখলাসউদ্দিন; গণিত বিভাগে অধ্যাপক ডক্টর জামাল নজরুল ইসলাম; রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অধ্যাপক ডক্টর আর আই চৌধুরী প্রমুখ। অধিকাংশের পড়াশোনা গবেষণা বিদেশে। আরো অনেকে ছিলেন, তবে সবার নাম বললে পাঠকের ধৈর্য থাকবে না।

ইংরেজি বিভাগে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী একজন শিক্ষক‌ও ছিলেন না। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ডিগ্রিধারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী ছিলেন একাই একশ, তিনিই বিভাগের প্রাণপুরুষ। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা, কঠোর নিরপেক্ষতা, রাজপুত্রসুলভ চেহারা, ভাবগম্ভীর চালচলন, পরিচ্ছন্ন রুচিশীল স্বভাব, ও মার্জিত চালচলন ছিল সকলের জন্য অনুকরণীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় ভাইস চ্যান্সেলর আবুল ফজল তাঁর পরামর্শের উপর নির্ভর করতেন। প্রায় সকল কমিটিতে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন।

কিন্তু অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীর প্রশাসনিক দক্ষতা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। তাঁর মূল্যায়ন করাও এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। আসলে তাঁর প্রকৃত মূল্যায়ন কখনো হবেনা। এর অন্যতম কারণ হলো অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী একে প্রচারবিমুখ মানুষ ছিলেন, আর প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের ব্যস্ততার জন্য হোক বা অনীহার জন্য হোক, তিনি সৃষ্টিশীল লেখার কাজে তাঁর মেধাকে ব্যবহার করেন নি।

একটা উদাহরণ দেই। কবি কাজী নজরুল ইসলাম আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কবি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী এর কঠোর সমালোচনা করে বলতেন, বাংলা বিভাগে তাঁর বন্ধুদের আধুনিক সাহিত্যের ধারণায় বেশ ঘাটতি আছে। বাংলা বিভাগে যেখানে অধ্যাপক ডঃ আনিসুজ্জামান, ডঃ মুনিরুজ্জামান, ডঃ আবু হেনা মোস্তফা কামালের মত খ্যাতনামা শিক্ষক আছেন সেখানে ইংরেজি বিভাগ থেকে এ রকম সমালোচনা দুঃসাহসিক বৈকি। তবে সাহিত্যে আধুনিকতার উপাদান ব্যাখ্যা করে তিনি তাঁর যুক্তি যেভাবে তুলে ধরতেন তাতে তাঁর যুক্তিকে খণ্ডন করার কোন উপায় ছিল না। তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী, কে কী মনে করল সেটা নিয়ে তিনি মোটেই ভাবতেন না।

তিনি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বেশি জানতেন না বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বেশি জানতেন তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। তিনি বাংলায় কথা বলার সময় ভুলেও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতেন না, ইংরেজি বলার সময় বাংলা শব্দ ব্যবহার করতেন না। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ফরমে স্বাক্ষর দিয়ে ফরমটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, “দপ্তরে গিয়ে ছাপ মেরে নাও”। প্রথমে আমার মাথায় ঢুকেনি। সেটা তিনি টের পেয়ে বললেন, স্বাক্ষরের নীচে তাঁর নামের সিলমোহর লাগবে।

তাঁর উভয় ভাষাজ্ঞানের গভীরতার ধারণা পেয়েছিলেন ইংরেজি বিভাগে তাঁর অনুজ ও ক্যামব্রিজের ডিগ্রিধারী অধ্যাপক হারুনুর রশিদ। তাই বাংলা একাডেমির মহা-পরিচালক হয়ে বাংলা-ইংরেজি অভিধান রচনার জন্য তিনি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীর শরণাপন্ন হন। অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীর সম্পাদনায় রচিত এই অভিধানে বিদেশি বাংলা শব্দ বিশেষতঃ আরবি ফার্সি শব্দের যে বিশাল সম্ভার তা অন্য কোন অভিধানে দূর্লভ। অন্য কাউকে দিয়ে এটা সম্ভব হতো না।

তেমনি, সকলের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে বলছি, ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর চেয়ে জ্ঞানী ও সাহিত্যিকসুলভ মনোমুগ্ধকর ভাষায় অনর্গল বক্তা তাঁর সমসাময়িক আর কেউ ছিলেন বলে আমার মনে হয় না। অনেকে নানাভাবে জনপ্রিয় ছিলেন, কিন্তু অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী জনপ্রিয়তা অর্জন করার পথে কখনোই পা বাড়াননি। নিভৃতচারী হয়েই থাকতে তিনি বেশি পছন্দ করতেন। রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকতে পছন্দ করতেন, তিনি কখনো বুদ্ধিজীবী সাজতে চেষ্টা করেন নি। সেজন্য বাইরে তিনি ততটা সুপরিচিতি নন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিমণ্ডলে তিনি সুপরিচিত, তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং তিনটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ইউজিসি এর সদস্য‌ ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। আজীবন জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়া প্রদীপ ৮৮ বছর বয়সে নিভে গেল!

প্রসঙ্গত বলে রাখি, অধ্যাপক ডঃ জামাল নজরুল ইসলাম ও অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী দুজনেই আমার নিজ এলাকা ফটিকছড়ির কৃতি সন্তান। প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ডাঃ নুরুল ইসলাম ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীর ভগ্নিপতি।

মহান আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাতবাসী করুন!


মেজবাহ উদ্দিন : প্রাক্তন যুগ্ম সচিব। চেয়ারম্যান, শৃংখলা কমিটি, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন