আমাদের ভিসি স্যার
ড. আবদুস সালাম আজাদী।। পুবাকাশ
এই বিশ্ববিদ্যালয় যাদের আঙুলের উপর ঘুরতো, তাদের আঙুল খুব শক্ত হলেও বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে আঙুলের চেয়ে বড় একটা মন লাগে, উদার একটা ব্রেইন লাগে, দিগন্তভেদী দৃষ্টি লাগে, জ্ঞানের জগতে সাঁতারু হতে হয় এই সত্যটা তাদের মধ্যে ছিলো কিনা জানতে আমার এখনো গবেষণা করতে হবে।
প্রফেসর মোহাম্মাদ আলি স্যার ইন্তেকাল করেছেন,ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিঊন। সংবাদটি শুনে মন খালি হয়ে গেলো। তিনি “আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে” ভিসি হিসেবে যোগদান করেছিলেন যে সময়ে, এই বিশ্ববিদ্যালয় সে সময় চকবাজারের ছোট্ট দুইটা বিল্ডিংএ চলতো। দেখতে তো বিশ্ববিদ্যালয় লাগতই না, ভেতরেও ছিলো একদম ছুপড়িখানার সেকন্ডারি স্কুলের মত। এই বিশ্ববিদ্যালয় যাদের আঙুলের উপর ঘুরতো, তাদের আঙুল খুব শক্ত হলেও বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে আঙুলের চেয়ে বড় একটা মন লাগে, উদার একটা ব্রেইন লাগে, দিগন্তভেদী দৃষ্টি লাগে, জ্ঞানের জগতে সাঁতারু হতে হয় এই সত্যটা তাদের মধ্যে ছিলো কিনা জানতে আমার এখনো গবেষণা করতে হবে।
এখানেও তিনি ভিসি হতে চেয়েছিলেন কি দেখে, তা রীতিমত ভাবনার বিষয় ছিলো আমার। তিনি কোন ভাবেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মানান সই ছিলেন না। না ছিলেন ইসলামিস্ট, যে তিনি ইসলামকে এখানে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখবেন। না ছিলেন অখ্যাত ও অপাংক্তেয় কেউ, যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া ভিসি পদ তাকে বড় করবে। কিন্তু তারপরেও তিনি এখানে এসেছিলেন ভিসি পদ নিয়ে। এসেছিলেন… সাহস দেখিয়ে। এটা ছিলো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রফেসর মোহাম্মাদ আলি সাহেবের সবচেয়ে বড় অবদান, তার বড় বিনয়, বড় চ্যালেঞ্জ, এবং অনেক বড় কুরবানি। তিনি আই আই ইউ সিকে বেশ উচ্চতায় নিয়ে আসেন, এবং এই ঋণটা শোধ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সারাজীবন লাগবে বলে আমি মনে করি।
তার সময়েই আমাকে সেখানে লেকচারার করা হয়। আমার ইন্টারভিউএ তিনি ৩টা প্রশ্ন করেছিলেন, যা আজো আমি মনে রেখেছি। তিনিই প্রথম প্রশ্ন করেছিলেন। বলেছিলেন “দাওয়াহ” বলতে কি বুঝায়? আজকের বাংলাদেশের মুসলিমদের কি বিষয়ে দাওয়াহ দেবেন? আমাকে ভেবে উত্তর দিতে হয়েছিলো।
দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিলো, আলকুরআন আল কারীম ইতিহাসে সর্বপ্রথম কোন ছাপাখানায় ছাপা হয়, এবং কোন সালে? এটার জবাব আমি দিতে পারিনি। শুধু বলেছিলাম, তুর্কিদের হাতে মনে হয়। তিনি মাথা নাড়িয়ে একটু শ্লেষ মিশিয়ে “না” বলেছিলেন।
তিনি শেষ প্রশ্ন করেছিলেন, পূরাণে মুহাম্মাদ বা আহমাদের (সা) “ভবিষ্যদ্বাণী” বলা হয়েছে, সে ব্যাপারে আপনার মত কি? আমি একটু ভেবে বলেছিলাম, স্যার, ঐটা আমার বিশ্বাস হয়না, কারণ আলাউদ্দীন হুসায়ন শাহের আমলে ঐ পুরাণটা জনমানসে আসে, ফলে তাকে “ভবিষ্য” বলতে আমার আপত্তি আছে। তিনি এবার স্মিত হাসি উপহার দেন। তাঁর আরেকটা বিষয় ভালো লেগেছিলো।
একজন প্রফেসর আমাকে “সুহুনিয়্যাহ” অর্থ জিজ্ঞাসা করলে আমি বলেছিলাম, ঐটা “সিহয়াওনিয়্যাহ” Zionism. এটা নিয়ে কথা লম্বা হচ্ছিলো দেখে তিনি হস্তক্ষেপ করে বলেছিলেন, ট্রান্সলিটারেশনে সুহুনিয়্যাহ বেমানান হয়, সিহওয়াওনিয়্যাহ বেশি মানানসই। পরে জানলাম তিনি ভাষাবিদ ছিলেন, এবং বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির অভিধান প্রণয়ন বোর্ডের তিনি সদস্য ছিলেন।
আমি এক পর্যায়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার যোগ্য মনে করতেছিলাম না। কাজেই সেখান থেকে বিদায় নেয়ার চেষ্টা করতেছিলাম। আল্লাহ তাআলারও রহমত, তিনি এক সপ্তাহের মধ্যেই একটা ব্যবস্থা করে দেন। ওখান থেকে বের হয়ে আসাটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছেনা দেখে আসার আগে এক সিনিয়র ভাই ও কিছু বন্ধুদের চাপে সেখান থেকে শিক্ষা ছুটি নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেই। আমার দরখাস্তে ভিসি স্যার সিগনেচার দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁর পি এস আব্দুর রহমান ভাই আমার ব্যাপারটা নিয়ে দেন দরবার করেন। পরে তিনি আমার সাথে কথা বলতে চান। আমি তাঁর সামনে বসার পর তিনি প্রথম যে কথাটা বললেন তা হলো, ইউকেতে তো আপনি পড়া লেখার জন্য যাচ্ছেন, তো অর্থ যোগান আসবে কিভাবে। আমি বললাম, ঐখানে এক হাইস্কুলে জব পেয়েছি, সেখান থেকেই অর্থ ইনশাআল্লাহ আসবে। তিনি একটা মিস্টিয়াস হাসি দিয়ে বললেন, তা হলে জবে যাচ্ছেন, পড়াটা সেকন্ডারী, তাই তো? আমি মাথা কাত করে “হাঁ” সূচক ইঙ্গিত দিলে তিনি বললেন, এত সত্যি কথা কেউ আমার সামনে বলেনা। এবং ধরেই নিচ্ছি আপনি আর ফিরে আসবেন না। আমি বললাম, আমি কোথাও থেকে বিদায় নিলে, কেন জানি, আল্লাহ সেখানে আর নেন না, স্যার। তবে আমি আমি তাক্বদীরে বিশ্বাসী। মিটিংটা খুব অম্ল মিশ্রিত ছিলো, তবে নিম-তিতা হবার আগেই আমি বলেছিলাম, “স্যার দরখাস্ত করেছি আমার বন্ধুরা করতে বলেছেন বলে। পারলে এপ্রুভ করবেন, না পারলে থাক ইনশাআল্লাহ”। আমি চলে এসেছিলাম স্যারের রুম থেকে। কয়েক বছর আগে এক ছাত্র ভিসি অফিসে নাকি আমার ফাইল খুলে আমার সেই দরখাস্ত দেখতে পায়। তা আমার কাছে স্ক্রীন শট নিয়ে পাঠায়। খুব শকড হয়েছিলাম তা পড়ে। বেশি খারাপ লেগেছিলো এটা দেখে যে, ছাত্রদের ভিসির অফিসে ঢুকে অনেক পুরনো একজন অখ্যাত শিক্ষকের ফাইল খুলতে পারার সহজলভ্যতা দেখে। পরে বুঝে নিয়েছি এটাই বাংলাদেশ। এখানে সব সম্ভব।
স্যার চলে গিয়েছেন। আই আই ইউসি থেকে তিনি কি পেয়েছেন জানিনা, তবে এই প্রতিষ্ঠান তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছে। এটা একটা মাদ্রাসা না, বিশ্ববিদ্যালয় তা তার মুখশ্রিতেই প্রকাশ পেতো। তার নামের শেষে “oxon” ও ছিলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আস্থার প্রতীক। তিনি মোট ৪টা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে অবদান রেখেছেন, এটাই তাঁর বড় হওয়ার দালিলিক প্রমান।
পৃথিবিতে তিনি অনেক সুনাম কুড়িয়েছেন, আখিরাতেও আল্লাহ তাআলা তাকে অনেক সন্মানিত স্থান দান করুন এই দুয়াই আমার এই মুহুর্তে। আল্লাহ তাআলা তার শোক সন্তপ্ত পরিবারকে এই শোক কাটিয়ে ওঠার তাওফীক দান করুন, আমীন।
ড. আবদুস সালাম আজাদী: বিশিষ্ট ইসলামী স্কলার। যুক্তরাজ্য প্রবাসী।