প্রফেসর আলী: অধ্যাপকীয় খান-ই-খানান
সরওয়ার মোরশেদ।। পুবাকাশ
আলী স্যারের সাথে জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের এক জায়গায় ভীষণ মিল – প্রচন্ড বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিমত্তার অধিকারী হয়েও তারা সেভাবে লেখালেখি করেননি। তবে প্রফেসর রাজ্জাক চরম সৌভাগ্যবান যে তিনি ছফার মতো একজন শিষ্য পেয়েছিলেন। ছফা তার ‘যদ্যপি আমার গুরু’র মাধ্যমে পুরান ঢাকার চির নতুন অধ্যাপককে অক্ষরে প্রায় অমরত্ব দান করেছেন। আলী স্যারের শিষ্যদের মধ্য হতে মোহীত উল আলম স্যার, সরওয়ার চৌধুরী স্যার, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী স্যার, জাহাঙ্গীর বিন সারওয়ার স্যার, মাইনুল হাসান চৌধুরী স্যার ও সুকান্ত ভট্টাচার্য স্যার উদ্যোগ নিলে আমরা আলী স্যারের জীবনী বা একটি Commemorative volume পেতে পারি।
এক.
বছর আটেক আগের কথা। বিভাগে এমএ পরীক্ষা কমিটির প্রশ্নপত্র সমীক্ষণের কাজ চলছে কাজী মোস্তাইন বিল্লাহ স্যারের রুমে। Henrik Ibsen এর উপর একটা প্রশ্নে ব্যবহৃত ‘indictment’ শব্দটাকে আমাদের এক শ্রদ্ধেয় সহকর্মী ‘ইন্ডিক্টমেন্ট’ উচ্চারণ করলে কমিটির সভাপতি QMB স্যার বললেন শব্দটির সঠিক উচ্চারণ হবে ‘ইনডাইটমেন্ট’। প্রিয় সহকর্মী জানালেন শব্দটির উচ্চারণ ‘ইন্ডিক্টমেন্ট’ও হয়। ছাত্র- শিক্ষক মধুর বাহাসের আবহ তৈরি হলে সভাপতি স্যার মডারেশন কর্ম সাময়িক বন্ধ রাখার ইঙ্গিত দিলেন। বিল্লাহ স্যার ড্রয়ার থেকে Cambridge Dictionary বের করে আমাদের দেখালেন শব্দটির সঠিক উচ্চারণ ‘ইন্ডাইটমেন্ট’। তারপর স্যার যে কথাটি বলেছিলেন সেটাই এই ক্ষুদ্রাবয়ব লেখার মূল প্রতিপাদ্য। স্যার আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ” এই শব্দের উচ্চারণ আমিও ভুল করতাম। এর সঠিক উচ্চারণ আমি প্রফেসর আলীর কাছে শিখেছি।” অধ্যাপক আলীর ছাত্র না হয়েও বিল্লাহ স্যারের মতো একজন পন্ডিত ব্যক্তি সেদিন আলী স্যারের প্রতি যে সসম্ভ্রম কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছেন, তা একাডেমিশিয়ান হিসেবে প্রফেসর আলীর শালপ্রাংশু ব্যক্তিত্ব আর অর্জনকেই নির্দেশ করে।
দুই.
আমি রব হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। একবার হলের কোন এক অনুষ্ঠানে আলী স্যারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ইংরেজি বিভাগের ছাত্র হিসেবে হল মিলনায়তনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম স্যারের বক্তব্য শোনার জন্য। কাঞ্চনকান্তি সুপুরুষ আলী স্যার যখন বক্তব্য শুরু করলেন, মুহূর্তে সমস্ত কর্কশ কোলাহল থেমে গেল। এর আগে স্যারের বাংলা বক্তব্য শুনেছি বলে মনে পড়ে না। শুঁটকিখেকোদের দেশের একজন ভূমিপুত্র এত সুমিষ্ট উচ্চারণে বাংলা বলতে পারেন, সেটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকেছিল। স্যারের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছিল, এতো বক্তৃতা নয়, যেনো কোন বহু-চর্চিত কন্ঠাধিকারী বাচিক শিল্পীর পরিশীলিত কাব্যিক উচ্চারণ! এই বক্তৃতা শোনার পর অনেকবার ভেবেছিলাম স্যারের সাথে গিয়ে পরিচিত হবো, দুদন্ড কথা কইবো। আমার বাবার পরিচয় দিবো। উল্লেখ্য, আমার বাবা ইন্টারমিডিয়েটে চট্টগ্রাম কলেজে আলী স্যারের সহপাঠী ছিলেন। চবি ইংরেজি বিভাগে ভর্তির পর পিতৃদেব আমাকে অনেকবার তাগাদা দিয়েছিলেন যাতে আমি আলী স্যারের সাথে পরিচিত হই। আজন্ম Escapist আমার পক্ষে সে কাজ হয়ে উঠেনি। হয়ে ওঠেনি প্রফেসর আলীর সাথে একান্তে কথা বলা। অবশ্য এহেন বাচিক শিল্পসুষমার অধিকারী এক Verbal artist এর সাথে আমি কী আর কথা বলতাম! রব হলে স্যারের দেয়া বক্তব্য স্মরণে এলেই আমার মনে পড়ে কনরাডের ‘Heart of Darkness’ এর রাশান Mr. Kurtz সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিল, সেটার ইতিবাচক দিকটি: You don’t talk with that man – You listen to him! এমনই এক কথার ঐন্দ্রজালিক ছিলেন আলী স্যার!
তিন.
আলী স্যারের প্রতি আমার ব্যক্তিগত মুগ্ধতা অন্য একটি কারণে। বাংলাদেশের মিডিয়াতে ঢাকাকেন্দ্রিক ইংরেজির অধ্যাপকদের বিশেষ করে সর্ব অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, কবীর চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীদের যে দেদীপ্যমান উপস্থিতি, সে তুলনায় এ ত্রয়ীর সমমানের বুদ্ধিজীবী প্রফেসর আলীর প্রভাব-প্রাবল্য রীতিমতো শোচনীয়! নব্বই এর দশকে গৃহীত বাংলা একাডেমির অভিধান প্রকল্প আলী স্যারের প্রান্তিক অবস্থান কিছুটা হলেও ঘুচিয়ে দিয়েছিল। আমরা সবাই জানি, বাংলা একাডেমির English to Bengali অভিধানের সম্পাদক ছিলেন প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। আর Bengali to English অভিধানের সম্পাদক ছিলেন প্রফেসর আলী। আমাদের আলী স্যার!
চার.
আলী স্যারের সাথে জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের এক জায়গায় ভীষণ মিল – প্রচন্ড বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিমত্তার অধিকারী হয়েও তারা সেভাবে লেখালেখি করেননি। তবে প্রফেসর রাজ্জাক চরম সৌভাগ্যবান যে তিনি ছফার মতো একজন শিষ্য পেয়েছিলেন। ছফা তার ‘যদ্যপি আমার গুরু’র মাধ্যমে পুরান ঢাকার চির নতুন অধ্যাপককে অক্ষরে প্রায় অমরত্ব দান করেছেন। আলী স্যারের শিষ্যদের মধ্য হতে মোহীত উল আলম স্যার, সরওয়ার চৌধুরী স্যার, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী স্যার, জাহাঙ্গীর বিন সারওয়ার স্যার, মাইনুল হাসান চৌধুরী স্যার ও সুকান্ত ভট্টাচার্য স্যার উদ্যোগ নিলে আমরা আলী স্যারের জীবনী বা একটি Commemorative volume পেতে পারি।
আমাদের বর্ণবাদী (সফেদ-পীত বর্ণের দল) শিক্ষক রাজনীতির আর বিভাজন-প্রবণ দলীয় অপরাজনীতর শিকার হয়েছেন প্রফেসর আলীর মত ব্যক্তিত্বও। অবলীলায় তিনি হতে পারতেন প্রফেসর ইমেরিটাস। আমার মনে হয়, আলী স্যার জাতীয় অধ্যাপক হওয়ার মত যোগ্য ব্যক্তি। উল্লেখ্য যে তার পরিবার থেকে একজন জাতীয় অধ্যাপক হয়েছেনও।জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ডাঃ নুরুল ইসলাম সম্পর্কে আলী স্যারের ভগ্নিপতি ছিলেন। আমার পরম সৌভাগ্য যে ডাঃ ইসলাম আর আমি একই এলাকার মানুষ ও একই বিদ্যালয়ের ছাত্র। পরিতাপের বিষয়, চবিতে আলী স্যারের সমসাময়িক দুজন অধ্যাপক প্রফেসর ইমেরিটাস ও দুজনের একজন জাতীয় অধ্যাপক হলেও প্রফেসর আলীর বরাতে কোনটাই জোটেনি।
পাঁচ.
সেকালের ইংরেজির অধ্যাপকদের প্রবাদপ্রতিম পোশাক পরিচ্ছদের পারিপাট্য আর আভিজাত্যের গল্প শুনেছিলাম চট্টগ্রাম কলেজের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান স্যারের মুখে। তিনি বিশেষ করে চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ আবু হেনা, প্রফেসর মোজাফফর ও প্রফেসর আবু সুফিয়ানের কথা বেশি বলতেন। জীবিত অধ্যাপকদের মধ্যে প্রফেসর খান আলী স্যারের sartorial elegance এর ঢের প্রশংসা করতেন। আলী স্যারের বসন এবং বচনের উচ্ছসিত প্রশংসা এই সেদিনও করছিলেন আমাদের বিভাগের বর্তমান সভাপতি ড: সুকান্ত স্যার।
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি সেভাবে না পেলেও অণুক্ষণ প্রশংসায় ভাসতে ভাসতেই আলী স্যার চলে গেলেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আওতার বাইরে। পাদপ্রদীপের ঔজ্জ্বল্যে সেভাবে সুস্নাত না হয়েও, পদ-পদবী-পদকভারে মৃত্তিকাচুম্বী না হয়েও শিষ্যদের এমন প্রবলভাবে আবিষ্ট করে রাখা আলী স্যারের মতো একজন মহান অধ্যাপকের পক্ষেই সম্ভব। মনে পড়ছে, বিগত English Alumni Reunion এ বিল্লাহ স্যারের বক্তব্যের একটি ছোট্ট কথা। QMB স্যার তার বক্তব্যে মঞ্চে উপস্থিত আলী স্যারকে ‘Professor of professors’ হিসেবে সম্বোধন করেছিলেন। সত্যিই রাজাদের রাজা যেমন রাজাধিরাজ, তেমনি আলী স্যার অধ্যাপকদের অধ্যাপক (অধ্যাপকাধিয়োধ্যাপক!)। তিনি শিক্ষকদের খান-ই -খানান।
সরওয়ার মোরশেদ: প্রফেসর , ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
As a student of English Department of I have little memories about Mohammed Ali Sir. Surely he had a very impressive calm and cool personality. He could earn respect through his teaching style and depth of knowledge. He has a special place in our hearts.