পাহাড়ী ভট্টাচার্য
আমাদের গৌরবময় অতীত রাজনীতি, সাহিত্য-সংষ্কৃতি-সাংবাদিকতা-র প্রোজ্জ্বল পূর্বপুরুষদের মধ্যে সবিশেষ উল্লেখ করার মত হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যে তিনি একজন। তাঁর জীবন ও কৃত্য, দেশের আজকের প্রজন্ম খুব বেশী অবগত নয় বলেই আমার ধারনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘৭০-এর দশকের সংঘটিত “সেভেন মার্ডার”-নামক হত্যাকান্ডটি নিয়ে তাঁর লেখা সম্পাদকীয়-র শিরোনাম ছিল “স্বভাবিক মৃত্যু-র গ্যারান্টি চাই”। তিনি সুলেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিক-নির্মল সেন। আমার সৌভাগ্য, আমি তাঁকে দেখেছি! প্রসঙ্গত, পিতৃপুরুষদের অনেকে, বিশেষত পিতামহ,কাকা-জ্যাঠা স্বদেশের জন্যই নিজেদের জীবন বিসর্জিত করেছেন। নির্মল সেন জীবনে ও রাজনীতিতে, তাঁদের অনেকের মত ছিলেন বলেই তাঁর প্রতি আমার ঔৎসুক্য ছিল প্রবল। সম্প্রতি, তাঁর জীবন- রাজনীতি বিশেষ করে মুক্তিযূদ্ধ-কালীন ঘটনাক্রম নিয়ে লেখা এ বইটি তাঁকে আরো কিছুটা জানার সুযোগ করে দিয়েছে।
নির্মল সেন অনিকেত ছদ্মনামেও লিখতেন। তিনি দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা,দৈনিক সংবাদ সহ অনেক পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁর প্রধান-তম পরিচয় একজন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক, বামপন্হী রাজনীতিক, তিনি কৃষক-শ্রমিক সমাজবাদী দলের প্রধান ছিলেন। তাঁর জন্ম হয় ৩০ আগষ্ট ১৯৩০ গোপালগঞ্জের-কোটালীপাড়ায়, মৃত্যু ৮ জানুয়ারী ২০১৩, ঢাকায়। নির্মল সেন-এর কয়েকটি গ্রন্হ হল “মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্র”, “মা জন্মভূমি”, “বার্লিন থেকে মস্কো”, ” লেনিন থেকে গর্ভাচভ “আমার জবানবন্ধি”। ” আমার জীবনে একাত্তরের যূদ্ধ”-এ নির্মল সেন জানাচ্ছেন একটি বিশেষ সময়কে ঘিরে তাঁর দিনলিপি। অবরুদ্ধ ঢাকা, প্রত্যন্ত পূর্ব বাংলা, ভারত বর্ষের দৈনন্দিন নানা চিত্র ছাড়াও ব্যক্তিক অনুসঙ্গ উঠে এসেছে বইটিতে।
আমাকে তীব্র মাত্রায় আবেগতাড়িত করেছে তাঁর বয়ান।
নির্মল সেন গল্পের অদলে শুনিয়েছেন ‘৭১-এর পূর্বাপর। বইটিতে পূর্ব পাকিস্তানের সমাজ-জীবন, সাম্প্রদায়িকতা, আইয়ুব বিরোধী ‘৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-র ৬-দফা, ‘৬৯-৭০ কালপর্বের অজস্র কথা আছে। আছে ‘৭১-এরও কথা। তাঁর আত্মগোপন, কষ্ট-সাধ্য ভারত যাত্রা, মুক্তিযূদ্ধ সংক্রান্ত যোগাযোগ, ভারতে রাজনৈতিক তৎপরতা-সবই আমরা পাই বইটিতে। পাশাপাশি, জন্মসূত্রে গোপালগঞ্জ -এর মানুষ নির্মল সেনের সাথে বঙ্গবন্ধু-র সম্পর্ক, স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবাদিক সমাজের স্বার্থ ও মুক্ত গণমাধ্যম
-এর জন্য বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে তাঁর নেতৃত্ব, ভূমিকাও তিনি অকপটে স্পষ্ট করেন সে সময়ের রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে।
মায়ের সাথে ছেলের দেখা হয়নি ২৩ বছর। ২৩ বছর পর সুয়োগ হয়েছে ভারতের আসানসোলে মা-সহ পরিবারের সবার সাথে দেখা করার। মুক্তিযূদ্ধ, সন্তানকে সে সুযোগ এনে দিলেও সন্তান দেশমাতৃকার কাজে এতটাই ব্যাপৃত হয়ে পড়েন যে মা-কে একবার গিয়ে চোখের দেখা দেখে আসা হল না। অবিশ্বাস্য হলেও এমনটাই নির্মল সেনের জীবনে ঘটেছিল। পরে অবশ্য একবার মায়ের কাছে যান দেশ স্বাধীন হবার পর।
‘৪৭-এ পরিবারেে সবাই বাংলাদেশ ছেড়েছিল, একমাত্র তিনিই যাননি। স্বদেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি অপরিমেয় ভালবাসা, দায়বদ্ধতা, লেখক-সাংবাদিক-রাজনীতিক এ চারণপুরুষটিকে জেলে,জেলের বাইরে রাজপথে অামৃত্যু বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে ব্যাপৃত রেখেছিল। অকৃতদার, সর্বস্ব ত্যাগী,দেশপাগল নির্মল সেন-এর জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই, পূর্ব-পাকিস্তানের জনগনের ওপর শোষন-বৈষম্যের বিপরীতে সংঘঠিত নানামাত্রিক অান্দোলন-কথা, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার ৪ দশক পরও অবাধ গণতন্ত্র ও সু-শাসন প্রতিষ্ঠার অনমনীয় অঙ্গীকার-প্রসুত ধারাবাহিক, অক্লান্ত সংগ্রাম, জীবন-যূদ্ধের বয়ান। সেসবেরই অাশ্চর্য ধারাভাষ্য, স্মৃতিচারণ-মূলক এ গ্রন্হ ” আমার জীবনে একাত্তরের যূদ্ধ” । ২০০৯ সালে মৃত্যুর ৪ বছর আগে, বইটি ঢাকা থেকে প্রকাশ করেন তাঁরই এককালের ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহযোদ্ধা এবং প্রকাশক হারুনর রশিদ। বইটি আমাকে মুগ্ধ করেছে। এটির পাঠ ও পুণপ্রচার প্রত্যাশিত। কমরেড নির্মল সেন ইতিহাস ও রাজনীতির এক বিরলপ্রজ পুরুষ। সহজে বিষ্মৃত হবার মত নন।
পাহাড়ী ভট্টাচার্য: কবি ও প্রাবন্ধিক।