আরিফুল হাসান’র একগুচ্ছ কবিতা


পুবাকাশ


গতকাল রাতটা আমি কোথায় ছিলাম

একটা উলঙ্গ রাত আমাকে তাড়াতে তাড়াতে
নিয়ে গেলো পাহাড়ের পাদদেশে। 
দুর্গম পাহাড়ি পথে আমি ছুটছি, ছুটছে রাত।
হরিণেরা স্বপ্নের ভেতর চমকে চমকে উঠলে
দূরে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের দিকে মুখ তুলে 
একটি নিঃসঙ্গ হায়েনা তীব্রস্বরে ডেকে উঠে।
পাহাড়ের চূড়ায় তখন ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ ও আমি
উলঙ্গ রাত আর হায়েনার শিকার হতে থাকি।

অধরকুসুম

পাতার আড়াল দিয়ে একফোঁটা রোদ এসে
পড়লো তোমার ঠোঁটে
উপরের ঠোঁটের উপরে তিলটি স্পষ্ট হয়ে উঠলো
আমি ফুল ভেবে দূর থেকে শোভা দেখি
ছায়াময় রাস্তাটা স্থির হয়ে থেমে থাকে মহাকাল। 

বাতাস পড়ছে না। প্রকৃতির মতো ওই দুটো ঠোঁট
আটকে রাখছে রোদ, ছায়া, রাস্তা ও আমাকে।

মুছে যাক আয়ু

শহর থেকে নিভৃতির দূরত্বে আমার উপাসনালয় 
আমি সেখানে দেউলিয়া হই তার প্রেমে
সে আমাকে চেনে। আমি তার পরশ জানি না।

পবিত্র আত্মায় ধরা থাক অনেক জীবন
পাখি ও পাতাদের ক্রিমিনালিজম, মুছে যাক।

বায়ুবাহিত অগ্রহায়ণ 

হেমন্তের রোদে দাঁড়িয়ে একটা মাছ ধরার জাল
এর খুঁটিগুলি বিশীর্ণ বলাকার মতো ধূসর
একপাশে পড়ে আছে শ্যাওলাচ্ছন্ন মেছোডোল
শুকিয়ে যাওয়া খালটিতে শীতার্তের বিরহ।
জালটা কোথাও ছেড়া, কোথাও ফেটে আছে
তবু বায়ুবহনের অগ্রহায়ণে আটকে যাচ্ছে মানুষ।

ঘোরের ভেতর এক মুঠো শিশির

তুমি জল বললে, আমি বললাম বেহুঁশের ব্যাকরণ
ক্রান্তি ও ঘোরের ভেতর, এক মুঠো শিশির ঝরলে
তোমাকে মনে পড়ে ফেলে আসা বিস্মৃতির মতো।

এখন থেকে চন্দ্রযানে তুমি আর আমি, আমি ও তুমি
শতাব্দীর প্রাচীন ঝিরিটির মতো বলবো, ভালোবাসি।

ভয়ের পালক

পাখিঋণ। স্বপ্নে গাঁথি মৌসুমি পালক
সবুজ থেকে সজীবতা খুলে নিলে
কালের পাথরে চাপা পড়ে মন। হায় মন!

এমন অপেক্ষা যে, কাঁঠালি চাঁপার ঘ্রাণ
তোমাকে মশগুল করে রাখে
সেজদার প্রণত স্বভাবে।

তোমাকে শতেক জন্ম সামনে রেখে

কীভাবে ভাবলে, এমন চোরাপথে পাউটির দোকান হবো?
কুয়াশায় ভিজে আছে ঠোঁট। তুমি আমার এক পশলা চা।

যাক, তাহলে ভাব যাক বরিষণে, মুমূর্ষু রুগিদের পাশে
তুমি ঠিক এমনি দাঁড়াবে Ñযেরকম,
একটি সময়কে সামনে নিয়ে মৃত্যুর জন্য মানুষ যুদ্ধে দাঁড়ায়।

স্বপ্নতাড়িত শহর

স্বপ্নের শহরে পথিক এগিয়ে যায় নর্দমার দিকে
একটা পাথুরে লাবণ্য তাকে আকৃষ্ট করে
সুধীজনরা ভাবেন, এ নিছক পাগল
উটকো ঝামেলা
তাকে বাদ দেয়া হোক, করা হোক বনবাসী। 
পথিকের পথ জানে ভুলে যেতে স্বপ্নের শহর।

প্রশ্নচিহ্নের অধিকার

কে যায়?
এমন দিকশুণ্য পথে
অন্ধকারে
কে করে মরনকে অস্বীকার?
কার এমন বুকের পাটা?
কার ভেতরের ঘরের ঘাস মরে গেছে 
অথচ সে জীবন্ত সবুজ
কার অভ্যন্তরে পুড়ে গেছে
অথচ সে জলজ-কোমল?
এমন নাক্ষত্রিক রাতে
ভয়-ডর-শঙ্কাবিহীন
কে যায়
পথের সীমানা ছাড়িয়ে? 
সে কি দুর্দান্ত খুব
নাকি পরগাছা?
কি বলবে তোমরা তাকে,
সেকি আকাশের তারকা
নাকি অন্ধকারের সাথে মিতালি তার?
তুমি তাকে কী বলবে
যখন সে যায় 
তোমাকে অতিক্রম করে?

ছবিস্বপ্নের কোলাজ

একটা জলরঙের ছবি আটকে আছে চোখের ভেতরে
পথিক ফিরছে ঘরে, পথ তার কেঁদে কেঁদে খুন
একটা পাথরের প্রতিমা থমকে আছে বুকের গভীরে
গৃহী ছেড়েছে ঘর, ঘর তার হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে। 

গৃহী এবং পথিক, জল এবং পাথর একাকার হয়ে  এলে
চোখ ও বুকের ভেতর তখন জ্বলে উঠে পথ ও সংসার।

কাছে এসো সুন্দর

তোমাকে যদি না পেলাম 
অবারিত ঐশ্বর্যে আমার কাজ কী?
থাক তবে কাগজ কলম
আজ থেকে বিলাপই আমার ভাষা।

যদি দূরে থাকো, মেঘ হয়ে ছায়া দাও
তবে দুপুরের রোদে পুড়ে যাক
আমার কণ্ঠস্বর, আমার কবিতা 

কাছে এসো করুণা করে, হে সুন্দর
ক্ষমা করো অধীনের অপরাধ।

নাচো মনোহরা

আবারও আনন্দ, আবারও আনন্দ ধারা
বহো হে, হে জীবন, অমিয়র পথে দাও সাড়া
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, নাচো মনঃহারা…
এই বৈরিতা বিভেদের দেয়ালটা ঘুঁচাও
এই আঁধারের কালো রাত, আলো ভোর করে দাও
কেটে যাক দুঃস্বপ্নের যতসব খরা
নাচো মনোহরা….

জলভূগোলের দোর্দণ্ড

দুটো মৎস প্রকল্প পাশাপাশি। পাড়ের সীমানা নেই
শুধু এক জালের দেয়াল। 
তবু প্রকল্প দুটি কি হিংসুক! কি বিদ্বেষী
একটি আরেকটির জলের নিকট বার্তা পৌঁছুয়
কোরিয়ার সম্রাটের মতোই উদ্যত। 
জালের দেয়ালটিতে অসংখ্য খুঁটি গেঁড়ে রাখা আছে
সেখানে একঝাঁক পানকৌড়ি সীমানা মানে না।

মঙ্গল সুসমাচার

যখন তুমি আস্তাবলে ঢুকতে যাচ্ছো
তখন যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে আসা যায়
ততই মঙ্গল। 
তোমাকে আস্তাবলে ঢুকতে হয়
যেমন ঢুকতে হয় তোমাকে হাঁপড়ে।
তখন তুমি কী করবে যখন তুমি 
রাতের ভেতর প্রবেশ করছো ক্রমাগত? 
অন্ধকার থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে 
আসা যায়, ততই মঙ্গল। 

ফণার বীণা

তখন দুপুরের ছায়া
একটুকরো সবুজ ভিটেতে
তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে।
মিষ্টি রোদ ছিলো শীতের
আর পাতাগুলো ছিলো 
ঝরঝর। 
তোমার পায়ের নিচে 
একটি সাপ 
খেলা করতে করতে
ভুলে গেলো ফণার বীণা।


আরিফুল হাসান: তরুণ কবি। পেশা: প্রভাষক, বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য।  নিবাস: কুমিল্লা।  

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন