পাঁচটি কবিতা

শাকিল রিয়াজ

ভিলনিউস

ভিলনিউসে সন্ধ্যাগুলো মরা
তার উপরে মেঘ করেছে খুব
একটু পরে বৃষ্টি যদি নামে
একটু পরে রাস্তাটা নিশ্চুপ।

ইট বিছানো গলির মোহনায়
লাইট ফেলেছে মধ্যরাতের বার
ভুতের ভয়ে চমকে ওঠার মতো
রাতের হাতে নাচছে শনিবার।

চারদিকে খুব সটান নিরিবিলি
মুখোমুখি পরীটা উদ্দাম
নিঃসংকোচে বৃষ্টিরা তার হাতে
আমার আগেই দিচ্ছিল নীল খাম।

রাগ করে কেউ ফিরেছে রাত্রিতে
গৃহগুলো স্বপ্নভাঙা আজ
মেয়েটির চোখে একটু কাঙালপনা
টেনে টেনে আঁকছিল সেই সাজ।

ডিস্কোথেকের একঘেয়েমি নাচ
মুখ ভেংচিয়ে বাইরে ঝুঁকেছিল
নাকের নথে জ্বলছে অসভ্যতা
সভ্যতাকে খানিক ঝলসে দিলো।

পুরান দেয়াল গ্রাফিত্তিতে মোড়া
চক দিয়ে নীল কবুতরটা এঁকে
কানে কানে বলে দিলাম, পাখি
পালিয়েছি ঘৃণার শহর থেকে।

ভিলনিউসে সন্ধ্যাতারাগুলো
একে একে ঝাপসা হয়ে গেলে
ইট বাঁধানো পুরান সড়কটিতে
খুব ভীরু হয় একটি দুঃখী ছেলে।

তোমার কাছে কথা লুকাই ভ্রমে
তোমার কথাই ভীষণ মনে পরে
এই শহরে থার্মোমিটার পাবো?
ভিলনিউসের গা পোড়ে যে জ্বরে।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রেম

হেঁটেই এসেছি পথ এতোদূর দুঃসহ পা-ব্যথা
লুকিয়ে রেখেছি পায়ে, পাজামার লাল-শাদা পাড়ে
অবসন্ন গৃহদাহ চুপচাপ পিছে ফেলে এসে
তুমিও দেখবে, কিছু অপরূপ রোদ জমা ছিল
শহরের কাকডাকা মহল্লায় ঝাঁ ঝাঁ বারান্দায়
ছোটখাট ফ্রকগুলো শাড়ি হয়ে দুলছে যেখানে।

শহর কতটা দূর? ভোর হলো আমাদের এই
পদযাত্রার ব্যাকুল জিজ্ঞাসায়। শহর কি এলো?
কুয়াশার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় বিলবোর্ড আলো
পথের দুধারে খাড়া ছোট ছোট বিজ্ঞাপন বোর্ড
বড় থেকে বড়তর হতে থাকে। সেই মতে বুঝি
শহর এসেছে কাছে। শিরদাঁড়া চমকিত হয়
অনিশ্চিত ক্রন্দনের গুন গুন বিরহ সঙ্গীতে
শহর এসেছে প্রিয় এসে গেছি নগরের মোড়ে।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু প্রেম অসম্পূর্ণ ভালবাসাবাসি
পাড়াতে মহল্লাজুড়ে এলোমেলো করে রাখা ছিল
তার ঘ্রাণ নিতে আজ অন্ধকারে এসেছি শহরে
জেগে আছো প্রেমগুলো? তোমাদের কুড়াবো দুহাতে।

কম

ভালবাসা কিছু কম হোক প্রিয়া
বিশ্বাস হোক বেশি
চুলগুলো কম পরিপাটি হোক
চাহিদাটা এলোকেশী।

ফুলগুলো সব ফেলে দিয়ে আজ
হাতদুটো শুধু দাও
শাড়ির আঁচলে যে গ্রাম লিখেছো
সে পথেই শুধু যাও।

কম করে বলো প্রেমের গল্প
মিথ্যা কিছুটা কম
চায়ের টেবিলে দুটি কাপে হোক
যথারীতি সঙ্গম।

স্বপ্ন কিছুটা অগোছালো হোক
বালিশেরা হোক নীল
কপোলে চুমুর দাগ মুছে গিয়ে
উঁকি দিক দু’টি তিল।

জড়িয়ে ধরেছো, এতো জোরে কেনো?
একটু তো রাখো ফাঁক
দু’জনের ছোট মাঝামাঝিটায়
ভালবাসা দম পাক।

রাগ করে শেষে অভিমান নিয়ে
ঘুরে তুমি বসলেই
পুরুষেরা শুধু জানে গোলাপের
সামন পেছন নেই।

কাল তুমি অফিসে ফিরবে

পৃথিবীরা মরে যায় যার যার গৃহে
আমার অভিবাসে আমি একা বেঁচে থাকি
একাই বেঁচে থাকি এই মায়াহীন অনাত্মীয় সন্ধ্যায়
দিকভ্রষ্ট ট্রেনে মন খারাপ করে কোথাও
চলে যাবার মতো বেঁচে থাকি।
একটি প্রাণোচ্ছল অপেক্ষাকে পাশের চেয়ারে বসিয়ে রেখেছি
জন্মান্তরের আশায়। জীবন সহজ হোক নতুন অধ্যায়ে।

কাল তোমার ছুটি শেষ হবে নবোঢ়া
কাল তুমি অফিসে ফিরবে
কাল তুমি আমার ছায়াচ্ছন্ন চোখে তাকিয়ে
অনিদ্রার সাগর থেকে তুলতে চাইবে দু‘ফোটা তেষ্টা
তোমার ভ্রমণতপ্ত চিবুকের দিকে
একবারও তাকাবো না কাল।

আমি বারবারই একা বেঁচে থাকি
তোমাদের সুখসন্তপ্ত মৃত্যুবিলাসের শহরে
অহেতুক কিছু ব্যথা নিয়ে দুঃসহ বেঁচে থাকি।

কেন তুমি বেড়াতে যাও দূরে? ভূমধ্যসাগরে?
সান্তোরিনির শাদা পাথরে রোদ হয়ে পড়ে থাকা গ্রীষ্মকাল
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালে
তুমি কি জলপাই বনে গিয়ে কাপড় পাল্টিয়েছিলে?
তোমার শরীরে জলপাইয়ের গন্ধ লেগে আছে।
জলপাই তোমাকে কী করেছে?
বলো, কী করেছে?

কাল আমার চোখের দিকে তাকিয়ে
ভূমধ্যসাগরে তোমার স্নানের গল্প বলবে
আর জলপাইয়ের কথা বলতে গিয়ে
মুখ ভরে যাবে মনে পড়ার লালায়…

আরো দুই পঙক্তি হলে শেষ হতে পারতো এই কবিতা
অথচ আমার চোখ থমকে গেল
ভূমধ্যসাগরের মিহি গভীরতায়
আমার শ্বাস রুদ্ধ হলো জলপাইয়ের নিলাজ গন্ধে।

জর্জের শ্বাস

আমার বাঁ পকেট এখনো ফুলে আছে
আন্ধারমানিক নদের এক ফুঁ অপূর্ব বাতাসে
কবে একদিন এই তীক্ষ্ণ মিহি বাতাস
ঢুকে পড়েছিল পকেটে! তারপর
পকেটেরই পোষা হয়ে গেছে পুরোটা জীবন।

এইটুকু অতিরিক্ত বাতাস আমি জমিয়ে রেখেছিলাম জর্জ
শান দেয়া তীব্র শিসের মতো প্রস্তরভেদী
এক মুঠো বাতাস তোর শ্বাসে ফেলবো বলে
আমি জমিয়ে রেখেছিলাম এই কালো বুক পকেটে।
তোর শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল জেনে
আন্ধারমানিকেও থেমে গেছে ঢেউ।

জর্জ, তোর কণ্ঠ থেকে উপচে পরা আয়ু
যদি আবার ফুঁ দিয়ে ঢুকিয়ে দিতে পারতাম
তোর নিচু জীবনের দমে,
ঘটা করে দীর্ঘশ্বাস পালা দরিদ্র ফুসফুসে!
যদি পারতাম, মাটি থেকে তুলে আনতাম ব্রিথ।

তোর বন্ধ হয়ে যাওয়া চোখের পাতার বাইরে
পৃথিবীটা ধীরে ধীরে শাদা হয়ে যায়,
তোর বন্ধ হয়ে যাওয়া চোখের পাতার ভেতরে
এক অদৃশ্য জীবন আছড়ে পড়ে কালো হয়ে যায়
শাদা-কালোর এই ছানিপড়া ঘোলাটে পৃথিবীতে
তোর মৃত্যুটাই শুধু রঙিন হয়ে গেল।

এখন একজোড়া বোজা চোখ
আমাদের আত্মার দিকে ভীষণ তাকিয়ে আছে
এখন হৃদয়ের সর্বশেষ পালস থেকে
জন্ম নেয়া একটি রূপকথার ভাণ্ড
উপুড় হয়ে পড়েছে পিচঢালা কালো সড়কগুলোতে।

এই প্রবাহমান বাতাস সাক্ষী
স্বাক্ষী এই রৌদ্রোজ্জ্বল দিন
মিহি বিকেলে হাত উঁচু করা স্ট্যাচু অব লিবার্টি স্বাক্ষী—
এখানে একজনের শ্বাস-ভিক্ষা ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল।

এভাবেই নিতে না-পারা একটি শ্বাস
পুলিশের হাঁটু থেকে মোচড় খেয়ে খেয়ে
আমার দুহাতে এসে প্রাণভরে শ্বাস নিতে চায়।

আমি মোনাজাতের মত হাত তুলে
তোকে আগলে রাখবো জর্জ।

শাকিল রিয়াজ:নব্বই দশকের কবি ও সাংবাদিক

১টি মন্তব্য

  1. প্রিয় কবি শাকিল রিয়াজ এর সবগুলো কবিতা’ই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়লাম। এক কথায় অসাধারণ হয়েছে প্রত্যেকটি কবিতা।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন