রক্ত ।। বিশ্বজিৎ চৌধুরী
কাল সারাটা রাত আমি নিঘুর্ম কাটিয়েছি রজত। এখন টরেন্টো শহরের বিরল এক ঝলমলে সকালবেলায় আমার জানালাটার সামনে এসে বসেছি। রাস্তার ওপারে একটি সবুজ ছিমছাম পার্ক, সেখানে দুটি ছোট্ট শিশু হুটোপুটি খাচ্ছে তাদের মায়ের গা ঘেঁষে। কিন্তু এসব কিছুই যেন রেখাপাত করছে না আমার নিস্পৃহ চোখের পাতায়। আজ তোমার কথা বড় মনে পড়ছে রজত। মনে তো পড়ে, এই বিদেশ বিভুঁয়ে একটি নারীর যে কোনো নিঃসঙ্গ মুহূর্তে তার প্রিয় মানুষটির কথা মনে পড়বে না তা কী হয়। কিন্তু আজকের দিনটা অন্যরকম রজত। আজ আমার স্মৃতি-সত্তা জুড়ে শুধু তুমি, আর বন্যার জলের তোড়ের মতো ভেসে আসছে অজস্র স্মৃতি! আমি কী অনুতপ্ত? আমি কি ভুল কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম? এই প্রশ্ন অজস্রবারের মতো আরও একবার মনে আসে। এর উত্তর তো জানি না, শুধু জানি সুধীন দত্তের কবিতার পংক্তি দুটিই চরম সত্য আজ— ‘ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে? মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া।’
গতকাল সন্ধ্যায় টরেন্টো শহরের সবচেয়ে বড় মিলনায়তনটিতে একটি নাটক মঞ্চস্থ হলো। অল কমিউনিটি ক্লাব নামের একটি ক্লাব আছে এখানে। আমিও সদস্য হয়েছি তাতে। কী করি বলো, বেঁচে থাকার জন্য আশে পাশে কিছু মানুষ তো লাগে! তা যতই তাদের নানারকম আড়ম্বরের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারি আর না পারি, যতই রাতের পার্টির সাজ ও পোশাকটা যথার্থ হলো কী না এ নিয়ে আগের মতোই উদাসীন আমি, তবু একঝাঁক হুল্লোড়ে নর-নারীর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে রেখে সামাজিক জীব হিসেবে নিজের পরিচয়টা তো নবায়ন করতে হয়। তা ছাড়া ছেলেটা বড় হচ্ছে, কলেজের বাইরে তার সোসালাইজেশনের দিকটা লক্ষ্য রাখতেও উপদেশ-টুপদেশ দেন তার শিক্ষকেরা। তো, ক্লাবের মেম্বার হলাম, যেটুকু না হলে নয় সেরকম যোগাযোগটাও রক্ষা করে চলেছি। অনেকটা আছি আছি, নেই নেই এরকম আর কী! এই ক্লাব থেকে নানা রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় সারা বছর জুড়ে। কখনো ভারত থেকে শাহরুখ, সালমান, প্রিয়াংকা, শ্রেয়া ঘোষাল আসে তো, কখনো পাকিস্তানের রাহাত ফতেহ্ আলী খান। বাংলাদেশ থেকে শাকিলা-বিশ্বজিতের মতো শিল্পীদের পাশাপাশি টিভি চ্যানেলের ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতায় বিজয়ী শিল্পীরাও আসে মাঝে মাঝে। কখনো যাই সময় পেলে, কখনো যাই না। তবে সবসময় যে মশালা-বিনোদন নিয়ে ব্যস্ত থাকে এমনও নয়। মাঝে মাঝে বেশ কিছু ভালো উদ্যোগও নেয় অল কমিউনিটি ক্লাব। কয়েক বছর আগে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে এই ক্লাবটি ‘বাপুজি’ নামের একটি নাটক করেছিল মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে। এই ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে নাটকটি প্রবাসী ভারতীয়রা তো বটেই, আমরাও দারুণ উপভোগ করেছিলাম।
তখন থেকেই কানাডায় বসবাসরত বাঙালিরা, বিশেষ করে বাংলাদেশি বাঙালিরা দাবি জানিয়ে আসছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে এরকম একটি নাটক করা হোক। আমি অল কমিউনিটি ক্লাবের তেমন সক্রিয় সদস্য না, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নাটক হোক বা সেটা মেট্রো টরেন্টো কনভেনশন সেন্টারে মঞ্চস্থ হোক—এসব নিয়ে মোটেই সোচ্চার ছিলাম না আমি। কেন এসবের মধ্যে আমি নেই না সে তো তুমি জানো। তোমার চেয়ে কে আর বেশি করে চেনে আমাকে! কিন্তু ডা. শামীম নাছোরবান্দা। এরকম একটি মঞ্চে দেশ-বিদেশের দর্শকদের কাছে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরা যেমন দরকার, তেমনি প্রবাসী বাঙালিদের আগামী প্রজন্মও যেন সত্যিকারের ইতিহাসকে জানতে-বুঝতে পারে তার জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া দরকার—এসব কথা আমাকে দিনরাত বোঝাতে বোঝাতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছিল ডা. শামীম।
‘তুমি বুঝতে পারছ না প্রীতি, এই লোকটাকে না জানলে আমাদের শিশু-কিশোররা বাংলাদেশকে জানবে না।’
আমার হাসি পায় রজত, মা-র কাছে মাসীর গল্প বলতে আসে শামীম। যত আমি আন্দোলন-সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু—এই দুর্বহ শব্দগুলো ভুলতে চাই, ততই যেন শামীম আমাকে ইতিহাসের পাঠ শেখাতে আসে!
এখানে শামীমের কথাটা একটু বলি। সেই ১৯৯৫ সালে যখন কোলের ছেলেটাকে নিয়ে এদেশে এসে পৌঁছেছিলাম তখন এই ডা. শামীমই বলতে গেলে ছিল আমার ত্রাণকর্তা। আমার এক দূর-সম্পর্কে ভগ্নিপতি ঢাকা এয়ারপোর্টে তুলে দিতে এসে এই লোকটার ল্যান্ডফোনের নম্বর দিয়ে বলেছিলেন, ‘যে কোনো প্রয়োজনে সাহাঘ্য করার জন্য ওর চেয়ে ভালো মানুষ আর পাবে না।’
এই জীবনে কত লোকের কত আশ্বাসবাণী আর যোগাযোগ সূত্র যে পেয়েছি! বেশির ভাগই কাজে আসেনি। কিন্তু দূরসম্পর্কের ভগ্নিপতির এই আশ্বাসটা যে কত বড় সত্য হয়ে গেল আমার জীবনে! এখনো মনে পড়ে এয়ারপোর্টে নেমে ল্যান্ডফোনে উপযুর্পুরি চেষ্টা করেও শামীমকে না পেয়ে যখন দিশাহারা; অসহায় চেহারা নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি, তখন কোত্থেকে যেন ঠিক আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল ৩৫-৩৮ বছরের বাঙালি যুবক। শামীম। বলল, ‘আপনি জাহানারা মাহমুদ না?’
বিস্মিত দৃষ্টি তুলে বলেছি, ‘হ্যাঁ।’
‘চলুন, আমি শামীম।’
‘চলুন’ বলে আমার বাক্স-প্যাটরা টেনে নিয়ে গাড়িতে তুলল বটে, কিন্তু আমি যে কোথায় যাচ্ছি সেটাও যেন জানা নেই আমার। আসলে রজত আমার যাওয়ার তো কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা ছিল না। এক বান্ধবী মাত্র দুবছর আগে কানাডা এসেছিল স্বামীকে নিয়ে, আপাতত কিছুদিন চাইলে তার ওখানে থাকতে পারি এটুকু অশক্ত একটা আশ্বাসের ভিত্তিতে এসে পড়েছিলাম, ভেবেছিলাম পরে যা হবার হবে। কিন্তু বান্ধবী এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে আসা দূরে থাকুক, খোঁজই তো নিল না একবার।
গাড়িতে বসে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এখানে কী করেন আপনি?’
‘গাড়ি চালাই, ড্রাইভার।’ হাসিমুখে উত্তর দিয়েছিল শামীম।
ঠাট্টা করছে কি না বুঝতে পারিনি, ‘তবে যে শুনেছিলাম আপনি ডাক্তার।’
‘ঠিকই শুনেছিলেন, কিন্তু সেটা ছিল বাংলাদেশে থাকার সময়কার পেশা, এখন পেশা পাল্টে গেছে। দয়া করে কেন পাল্টাল সে কথা জিজ্ঞেস করবেন না।’
আমি আর কিছুই জিজ্ঞেস করিনি তখন।
স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে জানতে চেয়েছিল, ‘কোথায় যাবেন এখন?’
‘মিসিসাগা।’ খুব দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে আমার গন্তব্য জানালাম। হাত ব্যাগের ভেতর থেকে ঠিকানা লেখা টুকরো কাগজটাও বের করে দেখালাম তাঁকে।
বেশ লম্বা ড্রাইভ শেষে বান্ধবী অদিতির বাসায় পৌঁছেছিলাম প্রায় রাত আটটার দিকে। কানাডার প্রকৃতির একটা অদ্ভুত ব্যাপারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল প্রথম দিনই। রাত আটটা বটে, দিনের আলো তখনো নেভেনি, চারপাশে যাকে বলে গোধূলির আলো।
অদিতি আর তার স্বামী বিমলেন্দু কি আমাদের দেখে খুশি হয়েছিল? নাকি ঘাড়ে চেপে বসা ঝামেলা ভেবে বিরক্ত হয়েছিল? জানি না, অন্তত তাদের অভিব্যক্তি দেখে বোঝার উপায় ছিল না। কিন্তু শামীম বোধহয় কিছু একটা বুঝেছিল। মালপত্তর নামিয়ে দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় খুব কাছে ঘেঁষে চাপা গলায় বলেছিল এখানে থাকার কোনো অসুবিধা হলে তাকে ফোন করতে যেন সংকোচ বোধ না করি। কি আশ্চর্য! কী করে প্রথম দিনই একটি পরিবারে গিয়ে তাদের মনোভাব সম্পর্কে আঁচ করতে পারল শামীম!
অদিতি-বিমলের দুটি ছেলে-মেয়ে। তিনটি বেডরুম তাদের লাগেই। ডিনারের পর আমাদের মা-ছেলের জন্য তারা শোওয়ার ব্যবস্থা করেছিল বেসমেন্টের একটা কক্ষে।
কোনোদিন তো বলিনি রজত, সব সম্পর্ক চুকিয়ে এসেছিলাম, বলার মুখও ছিল না। তা ছাড়া এসব কথা তোমাকে জানালেইবা তখন কী আর করার ছিল তোমার। সেই দিনগুলো আমার কী দুর্বিসহ ছিল তুমিও হয়তো জানতে চাওনি। খোঁজও তো নাওনি।
সেই রাতে বেসমেন্টের সেই কামরাটাতে প্রচণ্ড হিমঠান্ডার মধ্যে মনে হচ্ছিল মা-ছেলে বুঝি রাত ফুরাবার আগেই মারা যাব। ছেলেটা আমাকে জড়িয়ে ধরে হিহি করে কাঁপছিল, তার দাঁত-কপাটি লেগে যাচ্ছিল, আর আমি আমার সমস্ত উত্তাপ দিয়ে নিজের সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখব সেই উপায় নেই, কারণ আমার শরীরটাও তো লাশের মতো ঠান্ডা!
মৃত্যুর চেয়ে বড় কিছু তো নেই। গভীর রাতে ঋজুকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম অদিতিদের বেডরুমের সামনে। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে বান্ধবী আর স্বামীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বললাম আমাদের দুরবস্থার কথা। ওর বেডরুমে ডেকে নিয়েছিল অদিতি। আমাদের তিনজনের জন্য খাট ছেড়ে দিয়ে বিমলেন্দু শুয়ে পড়েছিল সোফা-কাম-বেডে। সেই আমার প্রবাস জীবনের প্রথম রাত রজত।
পরদিনই ফোন করেলিাম শামীমকে। কেন জানি মনে হয়েছিল এই লোকটাকে বলা যেতে পারে। খুব দ্বিধা ও সংকোচ নিয়ে বলেছিলাম থাকার অসুবিধার কথাটা। এক ফুৎকারে আমার অস্বস্তির মেঘ উড়িয়ে দিয়ে শামীম বলেছিল, ‘ডেনফোর্থে আমার দু কামরার ফ্ল্যাট, বেশ বড়সড় একটা ডাইনিংও আছে। যদি আপনার অসুবিধা না হয়, মা-ছেলে আমার এখানে থাকতে পারেন অনায়াসে।’
আমি একটু আমতা আমতা করছিলাম, শামীম বলল, ‘কয়েকটা দিন থাকেন, তারপর চাকরি-বাকরি একটা হলে অন্য কোথাও ব্যবস্থা করে নেবেন।’
কাউকে না কাউকে তো বিশ্বাস করতেই হয় রজত। বানের জলে ভেসে যাওয়ার আগে গাছের ডালপালা হোক বা শেকড়-বাকর, কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে তো হয়। আমি শামীমকে আঁকড়ে ধরেছিলাম। আজ তোমাকে শামীমের কথা এত বলছি কেন? তোমার কাছে জবাবদিহির সম্পর্ক তো আমার বোধহয় আর নেই, তবু, তবু বলছি কেন? বলছি, কারণ এক ধরনের গ্লানি, এক ধরনের অপরাধবোধ আমাকে মাঝে মাঝেই প্রশ্নের মুখোমুখি করে দেয়। যতই এখন স্কার্ট-টপস আর শার্ট-ট্রাউজার পরে অফিস করতে যাই, যতই মুখে ফুটুস-ফাটুস ইংরেজি বা স্প্যানিশ দুটোই চালিয়ে নিতে পারি, তবু বাঙালি ঘরের মেয়েই তো। জীবনে যাকে ভালোবাসতে পারলাম না তার সঙ্গে লিভ ইন করে গেলাম বছরের পর বছর—এটা অহর্নিশ কাঁটার মতো বিঁধে আছে বুকে। এ কথা বুঝতে পারি শামীম ভালোবাসে আমাকে। যদি তার কথা সত্যি হয়ে থাকে, বাংলাদেশের ডাক্তার এদেশে এসে গাড়ির চালক হয়েছিল যে যুবক, তার ক্ষেত্রে নাকি ঘটেছিল ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট।’ এয়ারপোর্টে প্রথম দেখাতেই নাকি আমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। কী জানি সত্যি হলেও হতে পারে। তবে আমার দিক থেকে কৃতজ্ঞতা বোধ যতটা ছিল তার প্রতি, ভালোবাসাটা কখনো সে রকম গড়ে ওঠেনি। কেন এমন হয় বলো তো রজত? একটা লোক এত কিছু করল আমার জন্য। অথচ সেই লোকটাই যখন দু হাত বাড়িয়ে আছে কাঙালের মতো, তাকে দিতে পারলাম না উজার করে। বরং যা কিছু দিয়েছি, সেটা শুধুই কৃতজ্ঞতাবোধের তাড়নায়, আর কিছু নয়।
ভালো আমি তোমাকেই বেসেছিলাম রজত। সেই যে আশির দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জারুলতলায়, চাকসু ক্যাফেটেরিয়ার সামনে, শহীদ মিনারের পাদদেশে কামরুল হাসান রজত নামের এক তরুনের কণ্ঠে অনর্গল প্রবাহের মতো উচ্চারিত হতো প্রতিবাদের ভাষা, সেই ভাষা শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। চশমার কাচের আড়াল থেকে দীপ্ত, বাঙময় দুটি চোখ আমাকে যেন ঘুমের মধ্যেও জাগিয়ে রাখত।
লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট? না, ঠিক প্রথম দেখাতে প্রেম বলতে যা বোঝায় তা নয়, কিন্তু মুগ্ধতার শুরু প্রথম দিন থেকেই। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আমার পরিবারের তো বিষাদময় অতীত ছিল, তাই রাজনীতির প্রতিদিন আমার এক ধরনের বিতৃষ্ণা। পারতপক্ষে পলিটিক্যাল কোনো সভা-সমাবেশে যেতাম না। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েছিলাম একটি নবীন বরণ অনুষ্ঠানে। সেখানে কামরুল হাসানের, ভার্সিটির তরুণ-তরুণীদের প্রিয় রজত ভাইয়ের বক্তৃতা শোনা হলো প্রথম। এখনো মনে আছে বক্তৃতার শুরুতেই আবৃত্তি করেছিলে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতার পংক্তি—‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা/দুর্যোগে পথ হয় হোক দুর্বোধ্য/চিনে নেবে যৌবন বার্তা।’
কী সেই শানিত উচ্চারণ, দীপ্ত ভঙ্গি! সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতাটিকে সেদিন যেন নতুন করে উপলব্ধি করেছিলাম। আর একবার ১৫ আগস্ট, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের দিনটির স্মরণে শোক ও প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছিলে তোমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকসু ক্যাফেটেরিয়ার সামনে। তখন তো এই দিনটিতে প্রকাশ্যে অনুষ্ঠান আয়োজন করাও ছিল বড় কঠিন। চারুকলা বিভাগের ছাত্ররা বঙ্গবন্ধুর একটি প্রতিকৃতি তৈরি করেছিল অনেক বড়। সেটাকে একপাশে রেখে ছোট্ট একটি মঞ্চ। রজত, সেদিন তোমার বক্তৃতা শুনে অশ্রুসিক্ত হয়নি এমন কোনো দর্শক-শ্রোতা আমি দেখিনি। বক্তৃতা শেষ করেছিলে নির্মলেন্দু গুণের একটি কবিতা পাঠ করে— ‘মুজিব মানে আর কিছু না/মুজিব মানে মুক্তি/পিতার সাথে সন্তানের/ না লেখা প্রেম চুক্তি…।’
আমি মুখে ওড়না চাপা দিয়ে ফঁুপিয়ে উঠেছিলাম। সেদিনই তোমার সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয় হলো রজত। আমাদের ক্লাসমেট কেউ একজন বোধহয় পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল দুজনকে। মনে পড়ে, প্রথম দিকে তেমন করে তাকাওনি। আমার তো দশজনের ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার চেহারা নয় রজত, সেই কিশোরীবেলা থেকে কত স্তাবকের প্রশংসার আতিশঘ্যে ভেসে যেতে যেতে বড় হয়েছি। কিন্তু তুমি আমার দিকে আলাদা মনোযোগ দিয়ে তাকালে না পর্যন্ত। এই কারণেই কী তোমার প্রতি আকর্ষণ আমার আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল? জানি না।
তুমি আমাকে শুরুতে তেমন আমল দাওনি। কিন্তু আমার বাবার নাম শুনে চমকে উঠেছিলে! বলা যায়, তখন থেকেই আমার জন্য আলাদা করে জায়গা তৈরি হলো তোমার মধ্যে। তুমি আমাকে সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলে, ‘আবু মাহমুদ আপনার বাবা?’
‘জি।’
‘মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন আবু মাহমুদ, তিনি আপনার বাবা?’
‘জি, তিনিই।’
‘আচ্ছা, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর আপনার বাবারা কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন…।’
‘জি, প্রতিরোধ যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র দখল করতে চেয়েছিলেন। মৌলভী সৈয়দ, এস.এম ইউসুফ, মহিউদ্দিন চৌধুরী আর আমার আব্বারা মিলে খুনীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য নানারকম পরিকল্পনা করেছিলেন…, এসব আমার মায়ের কাছে শোনা।’
‘হ্যাঁ, এটাকেই তো তখনকার সরকার “চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা” নাম দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। মৌলভী সৈয়দ ধরা পড়েছিলেন আর্মির হাতে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করে মেরেই ফেলল লোকটাকে। আর আপনার আব্বা…।’
‘মৌলভীর সৈয়দের লাশটা তবু পাওয়া গিয়েছিল। আমার আব্বার লাশটাও পাওয়া যায়নি… আমি তখন অনেক ছোট, সাত-আট বছর হবে বয়স।’—বলে আমি মাথা নিচু করেছিলাম। আর ঠিক তখনই আমার পিঠে একটা হাত রেখেছিলে তুমি। আমার সমস্ত শরীর তরঙ্গায়িত হয়ে উঠেছিল রজত। রবীন্দ্রনাথের গানের মতো, ‘মোর বীনা উঠে কোন সুরে বাজি, কোন নবচঞ্চল ছন্দে…।’
পিঠে হাত রেখে গভীর বিশ্বাসে তুমি বলেছিলে, ‘আপনার বাবার মৃত্যু বৃথা যাবে না, এদেশে একদিন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবেই।’
কী আশ্চর্য, এখনো বুঝতে পারি না, সেদিনের সেই চরম প্রতিকূল দিনগুলোর মধ্যে কী করে তুমি এই প্রত্যয় জাগিয়ে রেখেছিলে মনে যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবেই!
রাজনীতির প্রতি আমি বিতৃষ্ণ হয়ে পড়েছিলাম সেই শিশু বয়সে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড আর নিজের পিতার অকালমৃত্যুর পর দুঃসহ দিনগুলোর স্মৃতি মনে করে। আমার আম্মু, আমার স্কুল শিক্ষিকা আম্মু কী লাঞ্চনা সয়ে আবু আহমদের একমাত্র মেয়েকে বড় করে তুলেছিলেন সে তো আমি দেখেছি, বুঝেছি। কিন্তু নিয়তির কী অনিবার্য সিদ্ধান্ত, আমি ভালোবাসলাম তোমাকেই!
দেশের সে কী দুর্দিন তখন। ঢাকায় প্রতিদিন স্বৈরাচার বিরোধী মিছিল বের হচ্ছে। মিছিলে গুলি হচ্ছে, ট্রাক তুলে দেওয়া হচ্ছে মিছিলে। ডাক্তার মিলন মারা গেছেন পুলিশের গুলিতে। ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’—খোলা বুকে-পিঠে এই স্লোগান লিখে পথে নেমেছিল নূর হোসেন নামের এক তরুণ। পুলিশের গুলি এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছিল সেই তরুণের বুক ও পিঠ। এসব খবর প্রতিদিন চট্টগ্রামে এসে পৌঁছায়। টগবগ করে ফুটছে ছাত্র-তরুণ জনতা! তুমি সারাদিন তখন পড়ে আছো পথে, মিছিলে-আন্দোলনে-সংগ্রামে। আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনে, বোটানিক্যাল গার্ডেন বা ঝরনার ধারে একান্তে প্রেম করার সুযোগ আমাদের হলো না কখনো। যেন মানুষটার সঙ্গে নয় তার পথের সঙ্গে মন বেঁধেছি আমি। সেই যে সলিল চৌধুরীর গানটা, ‘পথে এবার নামো সাথি, পথে হবে পথ চেনা…।’
নব্বই সালে স্বৈরাচারের পতন হলো। আমরা সত্যিকারের গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম। অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেল ওই একই বছর। তোমার একটা চাকরি হয়ে গেল এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনে একটি গলফ স্টিক তৈরি ও রপ্তানির কারখানায়। ভালো চাকরি। তুমিও ঘরে কিছুটা মনোযোগী হতে শুরু করেছ। পরের বছর নির্বাচন হলো। খুব আশা করেছিলাম আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে। কিন্ত সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়ে কী করে যেন বিএনপি ক্ষমতায় এলো সেবার। খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলে, কিন্তু তুমি বলতে, ‘গণতন্ত্র তো গণমানুষের ভাষা, মানুষ যাকে চায় তাকেই ক্ষমতায় বসাবে— কী করার আছে!’ —এই কথার মধ্যেও তোমার গভীর আক্ষেপের বিষয়টা টের পেতাম।
চাকরি-সংসার চলছে, খুব সক্রিয় না হলেও রাজনীতি ছাড়তে পারোনি তুমি! কিন্তু সত্যি করে যদি বলি তোমার ভালোবাসায়, উত্তাপে-আশ্রয়ে জীবনের সেরা সময়টা কাটছিল তখন আমার। ওই বছরই ছেলে হলো আমাদের। তুমি নাম রেখেছিলে ঋজু। বলেছিলে, ‘মেরুদন্ডটা চিরকাল শক্ত রেখে বড় হোক ছেলেটা, তাই নাম রাখলাম ঋজু।’
কিন্তু এরমধ্যে হঠাৎ কী হয়ে গেল রজত! সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেল আমাদের। এক ছুটির দিনে তোমাদের গ্রামের বাড়ি সাতকানিয়ায় এক রাজনৈতিক সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলে তুমি। সভায় জামাত-শিবিরের লোকজন আক্রমণ করেছিল। তোমাদের এক রাজনৈতিক সহকর্মী মারা গিয়েছিল সেদিন। তুমি কোনোমতে প্রাণে বেঁচে এসেছিলে। সেদিন তোমাকে বলেছিলাম, ‘রাজনীতি ছেড়ে দাও, পরিবেশটা কেমন যেন হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া সংসার-সন্তান চাকরি-বাকরি সামলে এখন এসব কী আর সম্ভব?’
আমার কথা তোমার যুক্তিপূর্ণ মনে হয়েছিল কিনা কে জানে, তুমি হ্যাঁ না কিছুই বলো নি। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাটা ঘটল তার দুদিন পর। মধ্যরাতে হঠাৎ পুলিশ এসে ঘিরে ফেলেছিল আমাদের ঘর। নিজের চোখে দেখলাম পুলিশ আমাদের শোবার ঘরের বালিশের নিচে একটা রিভলবার রেখে দিয়ে সেটা তোমার অস্ত্র বলে তুলে নিয়ে গেল তোমাকে।
অসুস্থ মা আর কোলের শিশুটি ছাড়া তখন আর কেউ ছিল না আমার। পরদিন সকালে আমি থানায় ছুটে গেছি। থানা বলছে, তারা এই নামে কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। আমি এসবি, ডিবি, পিআইবি—পুলিশের নানা সংস্থায় দিনের পর দিন ছুটে বেরিয়েছি। একটা জলজ্যান্ত মানুষকে কোথায় তুলে নিয়ে গেল তার কিছুই জানাতে পারল না কেউ। যেন পুলিশের গাড়ি নয়, ভিনগ্রহ থেকে কোনো যন্ত্রযান এসে নিয়ে গেল তোমাকে।
পঁচাত্তর সালে আমার বাবার লাশ পায়নি আমার মা। একইভাবে আমিও স্বামীকে হারালাম কিনা সেই চিন্তায় আমার নিঘুর্ম রাত্রি, পাগলের মতো আমার ছন্নছাড়া দিন! প্রায় আট দিন পর এক ভোরবেলায় একটি গাড়ি এসে নামিয়ে দিয়ে গেল তোমাকে। হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ, ক্রাচে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে ঘরে ঢুকলে তুমি।
সেদিন, ঠিক সেদিনই আমি ঠিক করেছিলাম এই দেশে আর থাকব না। শিশুবয়সে পিতৃহীন হয়ে যে দুর্বিষহ মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে আমি বড় হয়েছিলাম, আমার ছেলেটাকে সেই যন্ত্রণার ভার বইতে দেব না আমি।
কানাডা যাওয়ার পথ বাতলেছিল আমার দূরসম্পর্কের ভগ্নিপতি। কিন্তু তোমাকে কিছুতেই রাজি করতে পারলাম না। এত অনুনয়-বিনয়, কান্নাকাটি, ছেলের মাথায় হাত রেখে তার ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর অনুরোধ কিছুই বিবেচনায় নিলে না তুমি। কী আশ্চর্য! বাম পায়ে জোর পাও না, ক্রাচ বগলে নিয়ে চলতে হবে বাকিটা জীবন, তবু তোমাকে দেশ ছাড়তে রাজি করাতে পারলাম না রজত। কী জেদ, কী গোঁয়ার্তুমি তোমার! তুমি দেশে বসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দেখার অলীক স্বপ্ন দেখ, তুমি খুনী রাজাকারদের বিচার হবে বলে তখনও বিশ্বাস কর!
জীবনে সেই প্রথমবার ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। প্রয়োজনে তোমাকে ছেড়ে আমার ছেলেকে নিয়ে বিদেশে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। বিদেশ যাওয়া তো নয়, দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার। কিন্তু আমি অটল। তোমাকে ছেড়ে আসা আমার পক্ষে কতটা কঠিন ছিল সেটা তোমার চেয়ে আর বেশি কে জানে। কারণ তোমাকে ছাড়া অন্য কোনো জীবনের অস্তিত্ব যে আছে সে কথাই তো ভুলে গিয়েছিলাম আমি! সেদিন আমার সিদ্ধান্তে তুমি বাধা দাওনি রজত।
আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। আজও মাঝে মাঝে আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে, সত্যিই কি আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম রজত? আজও কি আমরা বিচ্ছিন্ন? জানি না। তবে সব ধরনের সামাজিক-জাগতিক যোগাযোগ তো ছিন্ন হয়ে গেল! তোমার খবর নেওয়ার চেষ্টা করিনি। তুমিও হয়তো করনি। এইভাবে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি, আবার কোথাও যেন অনন্তকালের অবিচ্ছিন্নতা রয়ে গেল আমাদের।
ছেলেটা বড় হতে হতে জানতে চাইতো তোমার কথা। আমি নানাভাবে গল্প বানিয়ে বলেছি আমাদের সম্পর্কছেদের কারণ হিসেবে। সত্যি কথাটা বলিনি, আবার তোমাকে কখনো ওর কাছে ছোটও করিনি। এখন তো সে রীতিমতো একুশ-বাইশের যুবক। ভেবেছিলাম একবার নিয়ে যাব বাংলাদেশে। নিজে সে একবার একাই যেতে চেয়েছিল মাদারল্যান্ডে। কিন্তু সত্যি কথাটা কী জানো, আমার মধ্যে দেশ নিয়ে এখনও এক ভীতি কাজ করে। তবে এখন, গতকালের নিঘুর্ম রাতটি কাটিয়ে ভাবছি, না কোনো ভয়-ভীতি, কোনো সতর্কতা, কিছুতেই কিছু হয় না। যা হবার তা-ই হবে। রক্ত বলি আর জিন বলি তাকে অস্বীকার করব তার সাধ্য কী। দু একমাসের মধ্যেই ছেলেটাকে, ঋজুকে একবার তোমার কাছে পাঠাব ভাবছি রজত।
এবার তোমাকে গতকাল সন্ধ্যায় মেট্রো টরেন্টো কনভেনশন সেন্টারে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনাটি বলি। অল কমিউনিটি ক্লাব বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটির স্মরণে ‘শেখ মুজিব: দ্য ট্র্যাজিক হিরো’ নাটকটি মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। মীর সালেক খানের লেখা নাটক, তাঁরই নির্দেশনা। বাইল্যাংগুয়াল নাটক, বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে সংলাপ বলবে চরিত্ররা। সালেক খানের মতে, তাতে প্রবাসী বাঙালি দর্শকদের পাশাপাশি অন্য ভাষাভাষী দর্শকেরাও নাটকটির মূল সুরটা ধরতে পারবে। তা ছাড়া এখানকার বাঙালি কিশোর-তরুণরা অনেকেই তো এখন বাংলাটা ঠিক বুঝতে পারে না, তারাও বুঝবে নাটকের বার্তাটি। মীর সালেক খান এক সময় ঢাকায় থিয়েটার করতেন, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু আর রাইসুল ইসলাম আসাদদের বন্ধু ছিলেন।
প্রথম ধাক্কাটা লেগেছিল, সালেক খান যখন আমার ছেলেটাকে বঙ্গবন্ধু চরিত্রের জন্য নির্বাচন করল তখন। তাঁকে বারবার বোঝালাম নাটক তো দূরের কথা, এই ছেলে আবৃত্তি-টাবৃত্তিও করেনি কখনো। বাংলা উচ্চারণেও সমস্যা আছে তার। সালেক খান নাছোড় বান্দা, বললেন, ‘আমাকে একবার সুযোগ দিন। এ ছেলের চেহারার সঙ্গে তরুণ মুজিবের চেহারায় কোথায় যেন মিল আছে। এটা একটা বড় প্লাস পয়েন্ট, বাকিটা আমি ম্যানেজ করে নেব।’
কী বলব, ছেলেরও দেখি বেশ উৎসাহ আছে। দীর্ঘদিন রিহার্সাল হলো নাটকের। এই রিহার্সেলের দিনগুলোতে ঋজু আমার কাছে বঙ্গবন্ধুর কথা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা, বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা বিষয়ে জানতে চাইত। ভেবে দেখ রজত, সেই রক্তাক্ত অধ্যায় থেকে, সেই ইতিহাস থেকে দূরে থাকব বলে ছেলেকে নিয়ে এত পথ পাড়ি দিয়ে এলাম। এখন সেই ছেলে আমার কাছে জানতে চায় সেই ইতিহাস আর রাজনীতি। আমি বিস্তারিত বলতাম না। দুএকটা ওপর ওপর কথা বলতাম শুধু।
তারপর সেই দিনটি এল। গতকাল ছিল ১৫ আগস্ট। এটা ২০১৬ সাল। মেট্রো টরেন্টো কনভেনশন সেন্টারের থিয়েটার হলে প্রায় হাজার দেড়েক আসনের একটিও খালি নেই। পর্দা খুললে আমি আমার ছেলেটাকে চিনতেই পারছিলাম না। ঠোঁটের ওপর একজোড়া নকল গোঁফ আর চুলটা ব্যাক ব্রাশ করে আঁচড়ে দিয়ে সালেক খান যেন সত্যিই তরুণ মুজিবকে নামিয়ে এনেছে মঞ্চে। আবার কিছুক্ষণ পর মেকাপ রুমে মুখে দু একটা রেখা টেনে দিয়ে, চুলের কিছু অংশে ধূসর আর সাদা করে দেওয়ার পর পরিণত বয়সের বঙ্গবন্ধুর মতোও লাগছিল ওকে। কী বলব নিজের মুখে, আমার লাজুক মুখচোরা ধরনের ছেলেটা এ রকম অভিনয় করতে পারবে, ভাবতেই পারিনি।
এক ঘণ্টা বিশ মিনিটের নাটকটি মোটামুটি উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল বাঙালি-অবাঙালি সব দর্শকদের কাছে। একটি রাষ্ট্রের মহান স্থপতির জাদুকরী নেতৃত্ব, তাঁর অনলবর্ষী ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর অনুপস্থতির মধ্যেও তাঁর বজ্রকণ্ঠের প্রেরণা— এসব পর্ব খুব সুন্দর করে এসেছে নাটকে। যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর বিজয়ীর বেশে প্রত্যাবর্তন এসব দর্শকদের কতটা আপ্লুত করেছে বারবার তাদের হর্ষধ্বনি ও করতালির মধ্যে তা বোঝা গেছে। নাটকটি ছিল বিয়োগান্তক। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িতে ফারুক, রশিদ, ডালিমের মতো একদল বুনো শুয়োর কেমন করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ভীতিসঞ্চারী আবহসঙ্গীত আর আলো-ছায়ার কারুকাজে তা চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছিলেন পরিচালক। শেষ দৃশ্যটা ছিল গুলিবিদ্ধ শেখ মুজিব লুটিয়ে তাঁর পড়ছেন বাড়ির সিঁড়ির ওপর। পুরো মঞ্চে তখন লাল আলো, রক্তের রঙ।
এটাই ছিল শেষ দৃশ্য। আমি নিজে দুএকবার রিহার্সেলে গেছি রজত। সালেক খান দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে শেখ মুজিব বুকে হাত দিয়ে লুটিয়ে পড়লে মঞ্চ লাল আলোয় রক্তাক্ত হয়ে উঠবে এবং ধীরে ধীরে পর্দা নামবে।
কিন্তু শেষ দৃশ্যে অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে গেল মেট্রো টরেন্টো কনভেনশন সেন্টারে! তখন ধীরে ধীরে পর্দা নামতে শুরু করেছে। আবেগাক্রান্ত বা অশ্রুসিক্ত দর্শকেরা উঠে দাঁড়িয়েছে হল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। ঠিক তখনই হঠাৎ দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠেছে শেখ মুজিব চরিত্রের অভিনেতা: ‘স্টপ! নট নাউ, ডোন্ট ড্র দ্য কার্টেন এট দ্য মোমেন্ট। এখনই পর্দা নামাবেন না। এই দৃশ্য এখানে শেষ হতে পারে না।’
পর্দা খুলে গেল আবার, দর্শকরা স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে পড়ল যে যার জায়গায়। আমার শেখ মুজিব, আমার লাজুক মুখচোরা ছেলেটা তখন দৃপ্তকণ্ঠে দীপ্ত ভঙ্গিমায় বলছে: ‘সুধীমণ্ডলী, প্লিজ ডোন্ট লিভ দ্য থিয়েটার হল নাউ। এই দৃশ্য এভাবে শেষ হতে পারে না। শেখ মুজিব ক্যান নট ডাই ইন দিস ওয়ে। শেখ মুজিব উইল লিভ অ্যাজ লং অ্যাজ বাংগালিজ ড্রিম, বাংলা ল্যাগোয়েজ সারভাইবস। বে অব বেঙ্গলের জলের কোলাহল যতদিন থাকবে, ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস যতদিন থাকবে, ততদিন বেঁচে থাকবেন শেখ মুজিব।’
মুহুর্মুহু করতালিতে মুখর তখন মিলনায়তন। টানা কয়েকমিনিট ধরে চলল বাংলার বর্ষনমুখর দিনের অবিরল বৃষ্টিধ্বনির মতো করতালির শব্দ।
দর্শক যেন ততক্ষণে অভিনেতার নির্দেশের কাছে সমর্পিত। ঋজু বলল—‘আই আর্জ ইউ অল টু সে ওয়ানস— বঙ্গবন্ধু মরে নাই।
সে এক অভাবিত ঘটনা! বাঙলা, ইংরেজি, স্প্যানিশ, হিন্দি, উর্দু তামিল—নানা ভাষাভাষী কয়েকশ দর্শক তখন শুদ্ধ-অশুদ্ধ উচ্চারণে প্রকম্পিত করে তুলল মিলনায়তন—‘বঙ্গবন্ধু মরে নাই।’
সবাই চলে যাবার পর আবেগে আমার দুহাত চেপে ধরেছিলেন সালেক খান, তার চোখে বিস্ময় ও মুগ্ধতা, ‘কী করল দেখলেন ছেলেটা! এই আগুন… এই আগুন সে কোথায় পেল?’
কোথায় পেল সে কথা আর বলা হয়নি সালেক খানকে।
বিশ্বাস করো রজত এই দৃশ্য দেখার পর এখন মরে গেলে আমার জীবনে আর কোনো অতৃপ্তি থাকবে না। সারা রাত নিঘুর্ম কাটিয়েছি আমি। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে মরেছিল আবু মাহমুদ। তাঁর লাশ পাইনি আমরা। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দেখে যাবে বলে এত অত্যাচারে লাঞ্চনা সয়েও দেশ ছাড়েনি, রাজনীতি ছাড়েনি কামরুল হাসান রজত। তাঁদের উত্তরসুরীকে আমি কী করে ইতিহাস থেকে দূরে রাখব! আমার ব্যর্থতা আজ এতকাল পর আমার আনন্দাশ্রু হয়ে উঠল। ঋজু আবু মাহমুদের নাতি, কামরুল হাসান রজতের ছেলে… সাহসের উত্তরাধিকারকে, রক্তের উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করবে কে! ঋজুর মা হিসেবে কিছুটা গৌরবের অধিকার আমারও কী আছে রজত?
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, কথাশিল্পী ও সাংবাদিক।