মতান্তরঃ পুনঃপাঠ
আহমদ ছফার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’
এবনে গোলাম সামাদ।। পুবাকাশ
[মনীষী আহমদ ছফা’র ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ দীর্ঘপ্রবন্ধটি প্রকাশের পর থেকে বৈদ্ধিক মহলে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে। খ্যাতিমান কবি-সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল, বৈশাখ ১৩৮৩ (এপ্রিল ১৯৭৬), অষ্টাদশ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যায় বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ড. এবনে গোলাম সামাদ ‘র একটি আলোচনা প্রকাশিত হলে সুধীসমাজের প্রবল দৃষ্টি কাড়ে। দীর্ঘ ৪৫ বছর পর পুবাকাশ পাঠকদের জন্য আলোচনাটি পুনঃপাঠের আয়োজন হলো]
সমকালে (ফাল্গুন ১৩৮২ সংখ্যায়) আহমদ ছফার একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এতে তিনি বাঙালি মুসলমানের মানসিকতা বিশ্লেষণ করে দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু প্রবন্ধটি পড়ে আমার মনে হয়েছে, তথ্য ও তত্ত্বের বেশ কিছু অসঙ্গতি আছে। তাই এই আলোচনায় অবতীর্ণ হচ্ছি। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি খোলা মন নিয়ে এ প্রসঙ্গে সমকালে আরো আলোচনা হবে। আমাদের সংশয় ঘুচবে।
আর্য ও অনার্য
ছফা সাহেবের মতে বাঙালি মুসলমানের একটি বিরাট অংশই নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে উদ্ভূত। এরা সকলেই ছিলেন অনার্য। তার মতে ‘যেহেতু নবদীক্ষিত মুসলমানদের বেশির ভাগই ছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দু, তাই আর্য সংস্কৃতিরও যে একটা বিশ্বদৃষ্টি এবং জীবন ও জগত সম্বন্ধে যে একটা প্রসারিত বোধ ছিল, বর্ণাশ্রম ধর্মের কড়াকড়ির দরুন ইসলাম কিংবা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষাগ্রহণের পূর্বে সে সম্বন্ধে তাঁদের মনে কোন ধারণা জন্মাতে পারেনি।’ ছফা সাহেবের এই উক্তির সঙ্গে নৃতাত্ত্বিক গবেষণালব্ধ ফলের বিন্দুমাত্র যোগাযোগ নেই।
এই উপমহাদেশে দৈহিক নৃতাত্ত্বিক গবেষণার সূত্রপাত হয় স্যার হার্বার্ট রিজলে নামক ব্রিটিশ নৃতাত্ত্বিকের চেষ্টায়। স্যার রিজলে ব্রিটিশ-ভারতের নানা প্রদেশ থেকে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের দৈহিক মাপ সংক্রান্ত যেসব তথ্য সংগ্রহ করেন আজও তা বিশেষভাবে আলোচ্য। বাঙালিদের দৈহিক মাপজোক সম্পর্কে সংগৃহীত রিজলের তথ্য এখনো খুবই মূল্যবান। রিজলের মাপ অনুসারে কোনো বাঙালিকেই আর্য বিভাগভুক্ত করা চলে না। তাই ছফা সাহেবের আর্যের যুক্তিটা বিশেষভাবেই অচল।
রিজলে যাদের ভারতীয় আর্য বলেছেন, তাদের নিদর্শন আমরা বিশেষভাবে পাই কাশ্মীরে, পাঞ্জাবে, রাজপুতনায় ও জাঠদের মধ্যে; বাঙালিদের মধ্যে নয়। ভারতীয় আর্যদের মাথার খুলির আকৃতি লম্বা, নাক সরু থেকে মধ্যমাকৃতি, গায়ের রঙ ফরসা, দেহের আকৃতি লম্বা এবং মুখে গোঁফ-দাড়ির প্রাচুর্য আছে, কিন্তু বাঙালিদের সঙ্গে এই বর্ণনা মেলে না। হিন্দু বাঙালি ও মুসলমান বাঙালির কেউই ভারতীয় আর্য দলে পড়ে না। জানতে ইচ্ছা হয়, ‘আর্য’ শব্দটি ছফা সাহেব তার প্রবন্ধে কী অর্থে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন?
রিজলে সাধারণভাবে বাঙালিদের স্থাপন করেছেন মোঙ্গল-দ্রাবিড় মানবধারায় (Racial type)। রিজলের মোঙ্গল-দ্রাবিড় তত্ত্ব এখন অনেক নৃতাত্ত্বিকই স্বীকার করেন না। কারণ রিজলে যাদের দ্রাবিড় বলে চিহ্নিত করেছিলেন, এখন প্রমাণিত হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে একাধিক মানবধারা। ‘দ্রাবিড়’ শব্দটিকে বিশেষভাবেই গ্রহণ করতে হয় ভাষা পরিবারবাচক হিসেবে। বাঙালি ঠিক কোনো একটি বিশেষ মানবধারায় পড়ে না। পর্ব বাংলার অনেক বাঙালির মধ্যে মঙ্গোলীয় প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু মোটের উপর বাঙালিকে কেউ মঙ্গোলীয় বিভাগভুক্তও বলতে পারে না। কারণ বাঙালির চোখের পাতায় মঙ্গোলীয়দের মতো ভাঁজ নেই, বাঙালিদের মুখে যথেষ্ট দাড়ি-গোঁফ থাকে।
বাঙালিদের রঙ কালো। কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে তথাকথিত আর্যদের কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। তাদের মাথার আকৃতি গোল (মধ্যমাকৃতি হবার দিকে প্রবণতা আছে), আর্যদের মতো লম্বা নয়। এমনকি বাঙালি উচ্চবর্ণের মানুষদেরও (ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য) আর্য বলে চিহ্নিত করা চলে না। বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের মধ্যেই গোলমাথা, সরু থেকে মধ্যমাকৃতি নাকওয়ালা মানষের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। বাঙালি আর্য নয়, আবার তথাকথিত অনার্যও নয়। তাই ছফা সাহেবের যুক্তি অচল।
ছফা সাহেবের বক্তব্যের সাথে মিল আছে বঙ্কিমচন্দ্রের। বঙ্কিমচন্দ্র তার ‘বাংলার উৎপত্তি’ নামক প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘বাঙালি সমাজের নিম্নস্তরেই বাঙালি অনার্য বা মিশ্রিত আর্য ও বাঙালি মুসলমান।’ কিন্তু নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই ধরনের কোনো মতকেই আর স্বীকৃতি দেয়া যায় না। বাঙালির পরিচয় দিতে গিয়ে ছফা সাহেব যেসব কথা বলেছেন তা থেকে মনে হয়, বাঙালির নৃতত্ত্ব সম্পর্কে তার ধারণা আধুনিক জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
অন্যদিক থেকে বলা যায়, বাঙালি অনার্য হলেও কোনো ক্ষতি নেই। আর্য মানেই উন্নত আর অনার্য মানেই হীন- এ ধরনের কোনো যুক্তি এখন আর দেয়া চলে না। কারণ বাংলাদেশে আর্যরা আসবার আগেই একটি উন্নত সভ্যতা ছিল, এ-কথা ভাববার মতো যথেষ্ট প্রমাণ এখন আমাদের হাতে এসেছে। বাঙালির প্রাক-ইতিহাস সম্বন্ধে বহু কিছু এখন নতুন করে লিখতে হচ্ছে, মাটি খুঁড়ে আবিষ্কৃত হওয়া নানা নতুন নিদর্শনের জন্য। বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে মাটি খুঁড়ে খুব প্রাচীনকালের নিদর্শন এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে খুব বেশি দূরে অবস্থিত নয় এরকম জায়গায়- পশ্চিমবঙ্গে- এমন অনেক নিদর্শন মাটি খুঁড়ে আবিষ্কৃত হয়েছে যার ফলে বাঙালির ইতিহাস নতুন করে লিখতে হচ্ছে।
বোঝা যাচ্ছে, আর্যদের চাইতে অনার্যরা কিছুমাত্র কম সভ্য ছিল না। বরং আর্যদের চাইতে অনার্যরা ছিল বহুদিক থেকেই অনেক উন্নত। ছফা সাহেব বলেছেন, বাঙালি মুসলমানের উদ্ভব আর্যদের থেকে হয় নি, হয়েছে নিম্নশ্রেণির হিন্দু থেকে। কিন্তু এখন মাটি খুঁড়ে আমরা যে অতীত ইতিহাসের পরিচয় পাচ্ছি তাতে আর্যবাদের কোনো গৌরবই থাকছে না। পশ্চিম বাংলায় অজয় নদীর দক্ষিণে পাণ্ডুরাজার ঢিবি নামক স্থানে ১৯৬২-৬৩ সালে ব্যাপক খননকার্য চালানো হয়। এর ফলে সেখানে তাম্র-প্রস্তর (মেসোলিথিক) যুগের বহু নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। তামার বড়শি, নানা আকৃতির ও বিভিন্ন প্রকার নকশাযুক্ত মাটির পাত্র ও অন্যান্য প্রাচীন সংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে।
মহিষাদল নামক আরেকটি স্থানে একটি মাটির পাত্রের মধ্যে কয়লায় পরিণত হওয়া ধান পাওয়া গিয়েছে। এসব ধান প্রমাণিত হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব ১৩০০ সালের কাছাকাছির। এসব নিদর্শন পরীক্ষা করে পণ্ডিতেরা সিদ্ধান্তে এসেছেন যে প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব দেড় হাজার বছর আগে সিন্ধুনদের উপত্যকায় যেমন তাম্র- প্রস্তর যুগের সভ্যতা ছিল, এসব অঞ্চলেও ছিল অনুরূপ সভ্যতাসম্পন্ন মানুষের বাস। এরা ধান চাষ করত, মাছ ধরত, নানাপ্রকার জীবজন্তু শিকার ও পালন করত।
আর্যতত্ত্ব নিয়ে তাই আজ আর বড়াই করবার কোনো যুক্তি নেই। প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারে ‘আর্যবাদ’ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু ছফা সাহেবের লেখা পড়ে মনে হলো তিনি এসব কথা জানেন না; অথবা জানলেও আলোচনার যোগ্য বলে স্বীকার করেন না। তার কাছে বাঙালি মুসলমানরা হীন। কারণ তাদের নেই আর্যদের মতো বিস্তারিত চিন্তাশক্তি, উদ্ভাবনী ক্ষমতা।
ইতিহাসের অজ্ঞতা
কেবল প্রাক-ইতিহাস নয়, ইতিহাসের কাল সম্পর্কেও মনে হয় ছফা সাহেবের জ্ঞান খুব বেশি নয়। ছফা সাহেব বোঝাতে চেয়েছেন, বাঙালি মুসলমান নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত সম্প্রদায়। আর তাই তাদের মনে সব সময় থেকেছে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রতি ভয় ও সম্ভ্রম। কিন্তু এ-দেশের মুসলিম যুগের ইতিহাস ভালোভাবে পাঠ করলে অন্য ধারণারই সৃষ্টি হয়। মধ্যযুগের ইতিহাসে দেখতে পাই, বাংলাদেশে মুসলমানরা হিন্দু ক্রীতদাস রাখতে পারতেন, কিন্তু হিন্দুরা কোনো মুসলিম ক্রীতদাস রাখার অধিকারী ছিলেন না।
`চৈতন্যভাগবত’ পাঠে অবগত হওয়া যায়, মুসলমানরা হিন্দুদের ছোট জাত বলে মনে করতেন। কোনো মুসলমান (হরিদাস) ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করলে ‘মুলকের পতি’ তাকে বলেছেন :
কত ভাগ্য দেখ তুমি হঞাছ যবন।
তবে কেন হিন্দুর আচারে দেহ মন।
আমরা হিন্দুরে দেখি নাহি খাই ভাত।
তাহা তুমি ছাড় হই মহাবংশ-জাত।
তাই এ-দেশের মুসলমানরা নিজেদের সব সময় হীন ভেবেছেন এ রকম কথা ধোপে টেকে না। বরং এর উল্টোটাই সত্য, তারা নিজেদের ভেবেছেন অন্যদের চাইতে অনেক উচ্চজাতি হিসেবে।
এই উপমহাদেশের মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখতে পাই, মুসলমানের সংখ্যা পশ্চিমে আর পূর্বেই বেশি। মধ্যভারতে মুসলমান সংখ্যায় কম। দক্ষিণ ভারতেও মুসলমানের সংখ্যা বেশি নয়। বাংলাদেশে কেন হিন্দু নিম্নবর্ণের লোক দলে দলে মুসলমান হতে গেল তা এক সমস্যা। জানি না ছফা সাহেব এ নিয়ে কোনোদিন মাথা ঘামিয়েছেন কি-না।
বাংলাদেশে মুসলমানদের সংখ্যাবৃদ্ধি সম্পর্কে একাধিক ঐতিহাসিক একাধিক মন্তব্য করেছেন। কারো কারো মতে :
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মোঙ্গলরাজ চেঙ্গিস খাঁ সমগ্র মধ্য এশিয়ার তুর্কী মুসলমানদের রাজ্য এবং বোখারা, সমরখন্দ প্রভৃতি ইসলামী সংস্কৃতির প্রধান প্রধান কেন্দ্রগুলি ধ্বংস করেন। ইহার ফলে এই অঞ্চল হইতে গৃহহীন পলাতকেরা দলে দলে ভারতে তুর্কী মুসলমান রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে। পরে তাহাদের অনেকে বাংলাদেশে বসতি স্থাপন করিল …।
(রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলার ইতিহাস : মধ্যযুগ, পৃ. ২৩৩)
কিন্তু ছফা সাহেব তার আলোচনায় এসব মুসলমানদের কথা আলোচনা করেন নি। কেবল বলতে চেয়েছেন, বাঙালি মুসলমান আসলে হিন্দু নিম্নবর্ণের থেকেই বিশেষভাবে উদ্ভূত। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, তুর্কীদের মাথার খুলিও গোলাকৃতি। সম্ভবত তুর্কীরা বাংলাদেশে গোলাকৃতি মাথাওয়ালা লোকের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটিয়েছে।
বাঙালি মুসলমান সমাজের যে চিত্র ছফা সাহেব দিয়েছেন, তা খুবই খণ্ডিত চিত্র। পুঁথিসাহিত্যের মধ্যে যে বাঙালি মুসলমান মনের পরিচয় পাই তাতে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় বিশেষ ধরনের ‘গ্রাম্যতা’ ও লেখকদের ইতিহাসজ্ঞানের অভাব। কিন্তু তা বলে মুসলমানদের মধ্যে কোনোদিন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ছিল না- এ-রকম ঢালাও সিদ্ধান্ত করতে যাওয়া উচিত নয়। বাঙালি মুসলমান বাঙলায় কথা বলত। সাধারণ কাজকর্ম সে করত বাঙলা ভাষার মাধ্যমে। কিন্তু তার সাংস্কৃতিক ভাষা ছিল প্রধানত ফারসি। এ ভাষার মাধ্যমেই সে উচ্চশিক্ষা লাভ করত। মুসলমান আমলে এদেশে অনেক মক্তব ও মাদরাসা ছিল। অনেক সুলতান এ-রকম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতেন। সুফি দরগাতেও শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল। মুসলমান সমাজে অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা সম্বন্ধে যথেষ্ট যত্ন নেয়া হতো।
(দ্রষ্টব্য, ঐ, পৃ. ২৩৮)
মধ্যযুগের বিখ্যাত মুসলমান কবি আলাওল একাধিক ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। বাঙলা, ফারসি, আরবি ও হিন্দি ভাষায় তার জ্ঞান ছিল। মুসলমানদের মধ্যে যারা শিক্ষিত হতেন তারা প্রায় সকলেই একাধিক ভাষায় জ্ঞান রাখতেন। তাদের শিক্ষা সে যুগের মাপকাঠিতে নিম্নমানের ছিল না। কিন্তু ছফা সাহেবের আলোচনা পড়লে মনে হয়, সব মুসলমানই ছিলেন ‘গ্রাম্য চাষা’, বড় জোর নিছক লোকসাহিত্যের সাধক।
ইতিহাস নয়, গল্পকথা
ছফা সাহেবে বাঙালি মুসলমান সম্বন্ধে এমন অনেক কথা বলেছেন যা নিছক বানানো বলে মনে হয়। ছফা সাহেবের মতে, ‘বাঙালি মুসলমানরা শুরু থেকেই তাদের আর্থিক ও সামাজিক দুর্দশার হাত থেকে আত্মরক্ষার তাগিদেই ক্রমাগত ধর্মমত পরিবর্তন করে আসছিল। … বাঙালি মুসলমানদের অধিকাংশই বাংলার আদিম কৃষিভিত্তিক কৌমসমাজের লোক। তাদের মানসিকতার মধ্যেও আদিম সমাজের চিরন্তন লক্ষণসমূহই প্রকট। বারবার ধর্ম পরিবর্তন করার পরও বাইরের দিক ছাড়া তাদের মানসিকতার মৌলবস্তুর মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসে নি।’ তার এই বক্তব্যের সঙ্গেও আমরা একমত হতে পারি না। কারণ, প্রথমত, ছফা সাহেব যে ধরনের আদিম কৌমসমাজের কথা বলেছেন এ-দেশে সুলতানি আমলের আগেই তার বিলুপ্তি ঘটেছিল। ভূমিব্যবস্থা ও কৃষিকৌশল- উভয়দিক থেকে বিচার করলেও বাংলাদেশের কৃষকদের আদিম কৌমসমাজের অন্তর্ভুক্ত করা চলে না।
অন্যদিক থেকে বলা যায়, ধর্ম জিনিসটা বাঙালি মুসলমানদের কাছে আগেও ঠিক বাইরের জিনিস ছিল না, তা ছিল তার মনের গভীরে বিশেষভাবে প্রোথিত। তাই দেখি ইংরেজ যখন এ-দেশের রাজা হলো, তখন মুসলমানরা হিন্দুদের মতো খ্রিষ্টানধর্ম গ্রহণে আগ্রহী হলেন না, তারা সাড়া দিলেন আরব থেকে আগত ওয়াহাবি ভাবধারায়, পরে যা গ্রহণ করল বিশেষ আঞ্চলিক রূপ, বাংলাদেশীয় রূপ।
বাঙালি মুসলমানের জাগরণ
ছফা সাহেব স্বীকার করেছেন, বাঙালি মুসলমান ঊনবিংশ শতকে দু’টি উল্লেখযোগ্য আন্দোলন করেছেন। একটি হলো ওয়াহাবি ও অপরটি হলো ফরায়েজি। কিন্তু তিনি আক্ষেপ করেছেন, এ দু’টি আন্দোলনের চরিত্র নিয়ে। তিনি এ দু’টি আন্দোলনকে মন খুলে প্রশংসা করতে পারেন নি। কারণ এ দু’টির মূলে ছিল ধর্মীয় প্রেরণা, কোনো আধুনিক সমাজ দর্শন নয়। কিন্তু প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, কেন এই অবজ্ঞা? ধর্মীয় অনুভূতি থাকলেই কি কোনো আন্দোলনের সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব ছোট হয়ে যায়? অন্য অনেক দেশেও ধর্মীয় চেতনা রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। কিন্তু আমরা এসব আন্দোলনকে অবজ্ঞার চোখে দেখি না। বাংলাদেশের বেলাতেই বা আমরা এর ব্যতিক্রম করতে যাব কেন?
প্রবলপ্রতাপ ক্রমওয়েল বিলাতের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন খ্রিষ্টান পিউরিটানিজমের প্রতিনিধি হিসেবে। কিন্তু তা বলে আমরা তার সমালোচনা করি না। বরং বলি, তিনি দিয়েছিলেন বিলাতের ইতিহাসকে বদলে, দিয়েছিলেন রাজতন্ত্রকে দুর্বল করে। ফলে ব্রিটেনে সৃষ্টি হতে পারে বর্তমান গণতন্ত্রের ভিত্তিভূমি। বিলাতের দু’টি গণআন্দোলনও- ‘ডিগারস’ ও ‘লেভেলারস’ ছিল বিশেষভাবে ধর্ম-চেতনা অনুপ্রাণিত। কিন্তু বিলাতের ইতিহাসে এখনো এদের কথা শ্রদ্ধাভরেই স্মরণ করা হয়। অথচ আমাদের দেশে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী মনে করেন, ধর্মীয় অনুপ্রেরণাযুক্ত সব আন্দোলনই প্রতিক্রিয়াশীল। আর তাই তা বিরূপ সমালোচনার যোগ্য। বিশেষ করে কোনো আন্দোলনের মূলে যদি কাজ করে থাকে ইসলাম ধর্মের অনুপ্রেরণা তবে তা কখনোই জনসাধারণের পক্ষে কল্যাণকর হতে পারে না।
কিন্তু খোঁজ নিলে দেখা যায়, ধর্ম নানা জাতির ইতিহাসেই পালন করেছে বিশেষ গুরুত্বপর্ণ ভূমিকা- যাকে বাদ দিয়ে ইতিহাস বোঝা যায় না। আধুনিক সমাজতাত্ত্বিকরা নানাভাবে ধর্মের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বিখ্যাত ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক এমিল দরকেইমের মতে ধর্মকে বাদ দিয়ে কোনো সমাজ-জীবনের ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। ধর্ম সমাজ-জীবনের বাস্তব ভিত্তি। বিখ্যাত জার্মান সমাজতাত্ত্বিক ম্যাকস বেবরের মতে, মানুষ ইতিহাস গড়তে চায় তার আপন মূল-চেতনার উপর ভিত্তি করে। আর মূল-চেতনার উৎস হিসেবে ইতিহাসে ধর্ম পালন করে প্রধান ভূমিকা। কিন্তু ছফা সাহেবের কাছে ধর্ম একটি বিচার্য বিষয়ই নয়। তার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে তাই তিনি খোলামনে গ্রহণ করতে অক্ষম।
ছফা সাহেবের মতে বাঙালি মুসলমান সমাজের জাগরণ এসেছিল হিন্দু সমাজের জাগরণের ফলে। কিন্তু এই জাগরণ হিন্দু সমাজের জাগরণের মতো সুগভীর ছিল না। তার এই বক্তব্যও বিশেষভাবে সমালোচনাসাপেক্ষ। কারণ প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে, জাগরণ বলতে কী বুঝব? মুসলমান ও হিন্দু সমাজের জাগরণের চেহারা কি ছিল একই প্রকারের? মুসলমান সমাজ ও হিন্দু সমাজের জাগরণের চেহারা কখনো ঠিক এক ছিল না।
ঊনবিংশ শতকে ইউরোপীয় ভাবধারার প্রভাবে হিন্দু সমাজে নানা সংস্কারবাদী আন্দোলন আরম্ভ হয়। রামমোহন চান সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে। বিদ্যাসাগর চান বিধবা বিবাহ চালু করতে। কিন্তু মুসলমান সমাজের এসব সমস্যা ছিল না। মুসলমান সমাজে জাগরণ পরিগ্রহ করে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ। মুসলমানরা বিদ্রোহ করেন বিদেশি শাসনের বিপক্ষে। তারা গ্রহণ করেন ওয়াহাবি মতবাদ। এ প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয় লিখেছেন :
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বাংলার মুসলমানদের দুইটি বিপ্লব জনসাধারণের মনে বিশেষ ভীতি ও উদ্বেগের সঞ্চার করিয়াছিল। আরবে আবদুল ওয়াহাব নামক এক ব্যক্তি (১৭০৩-১৭৮৭ খ্রি.) মুসলমান ধর্ম সংস্কারের জন্য এক আন্দোলন উপস্থিত করেন। তাহার সম্প্রদায় ‘ওয়াহাবি’ নামে প্রসিদ্ধ। ভারতেও ওয়াহাবি ধর্মমত প্রচারিত হইয়াছিল (১৮২০-১৮৭০ খ্রি.) এবং প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল খুব প্রসার লাভ করিয়ছিল।… সমস্ত উত্তর ভারতে এই আন্দোলন শক্তিশালী হইবার পূর্বেই বাংলাদেশে দুইজন মুসলমান ইহার অনুরূপ আন্দোলন আরম্ভ করেন। ধর্মসংস্কারের জন্য আরম্ভ হইলেও ক্রমে ইহা ইংরাজ ও জমিদারদিগের বিরুদ্ধে প্রজাদিগকে উত্তেজিত করে। …
(বাংলার ইতিহাস : আধুনিক যুগ, পৃ. ৫৬-৫৭)।
ফরায়েজি আন্দোলন সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মজুমদার মহাশয় লিখেছেন :
শরিয়ত উল্লার সম্প্রদায়ের নাম ছিল ফরাজি। ইহাদের অধিকাংশই ছিল জমিদার কর্তৃক উৎপীড়িত প্রজা এবং বাংলার শিল্প ধ্বংস হওয়ার ফলে বেকার শ্রমিক দল।
(ঐ, পৃ. ৫৮)
শরিয়ত উল্লার মৃত্যুর পর তার পুত্র মুহম্মদ মুহসিন (১৮১৯-১৮৬০ খ্রি.) ফরায়েজি আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করেন। তিনি তার ডাকনাম ‘দুদু মিয়া’ হিসেবে বিশেষ প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেন। দুদু মিয়া কার্যত পূর্ব বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের শাসকে পরিণত হন। তাকে দমন করতে ইংরেজদের বিশেষ বেগ পেতে হয়।
দুদু মিয়া সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মজুমদার মহাশয় লিখেছেন :
তিনি (দুদু মিয়া) ঘোষণা করেন যে জমি ভগবানের, সুতরাং জমিদারদের খাজনা আদায় করিবার কোন অধিকার নাই। বিংশ শতাব্দীর অসহযোগ আন্দোলনের অনেক পূর্বাভাস দুদু মিয়ার আন্দোলনে পাওয়া যায়। জমিদার ও নীলকরেরা তাঁহার এই সমুদয় প্রচারের ফলে ভীত ও সন্ত্রস্ত হইয়া তাঁহার নামে লুটপাট, অনধিকার প্রবেশ প্রভৃতি বহু অত্যাচারের জন্য বহুবার আদালতে অভিযোগ করে, কিন্তু তাঁহার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবার লোক না থাকায় তিনি প্রতিবারই খালাস পান।
(ঐ, পৃ. ৬০)।
উপরের কথাগুলি থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, কত গভীর ও ব্যাপক ছিল বাঙালি মুসলমানের জাগরণ। বাঙালি মুসলমান কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করতে চায় নি। আর চায় নি বলেই সম্ভব হয়েছে আজকের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। যারা উইলিয়াম হান্টার লিখিত বিখ্যাত বই ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ পড়েছেন, তারা জানেন কী রকম দুর্জয় সাহস নিয়ে বাংলাদেশ থেকে বাঙালি মুসলমান ওয়াহাবি ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে যেত দূর পাঞ্জাবে ও সীমান্ত প্রদেশের মতো অঞ্চলে যুদ্ধ করতে। কিন্তু ছফা সাহেবের লেখায় বাঙালি মুসলমানের ইতিহাসের এসব দিকের কোনো পরিচয় নেই।
ছফা সাহেবের মতে, বাঙালি মুসলমান কেবল সবকিছুতেই ‘গোঁজামিল দিয়েই সবচেয়ে বেশি আনন্দ পায় এবং গোঁজামিল দিতে পারাটাকেই রীতিমতো প্রতিভাবানের কর্ম বলে মনে করে। শিশুর মতো যা কিছু হাতের কাছে, চোখের সামনে আসে তাই নিয়ে সে সন্তুষ্ট, দূরদর্শিতা তার একেবারেই নেই। কেননা একমাত্র চিন্তাশীল মনই আগামীকাল কী ঘটবে সে বিষয়ে চিন্তা করতে জানে। বাঙালি মুসলমান বিমূর্তভাবে চিন্তা করতেই জানে না।’
ছফা সাহেব ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে মুসলিম জাগরণ দেখা দেয় সে সম্পর্কে কিছুই বলেন নি। অথচ এই জাগরণের কথা বাদ দিয়ে আজকের বাঙালি মুসলমানের মনোধারার ব্যাখ্যাই সম্ভব নয়- ভাবাই যায় না, বাংলাদেশ উদ্ভবের কথা।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ -গবেষক মুক্তিযুদ্ধের কলম সৈনিক প্রফেসর ড. এবনে গোলাম সামাদ এর সাথে নব্বই দশকের কোন এক সন্ধ্যায় পুবাকাশ সম্পাদক মাঈন উদ্দিন জাহেদ।
চমৎকার একটি পোর্টাল। অনেক কিছুর সমাহার এখানে রয়েছে। অসংখ্য ধন্যবাদ তাদের সকলকে যারা এর পেছনে এবং সামনে রয়েছেন।