১৫ আগস্ট : শোকের কবিতাগুচ্ছ


পিতৃহত্যার দায় ।। ফয়সল সৈয়দ

আমি এখনো আমার পিতার সামনে দাঁড়াতে পারি না,
অহেতুক আতংক সর্বত্র আমাকে গ্রাস করে ফেলে
থেতলে দেয় আমার
অতীত, বর্তমান, সমূহ ভাবনাগুলোকেও…
কত যশ, কত খ্যাতি
ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাতাসে-বাতাসে উড়ে।
পিতার চোখে হাসি, মুখে বন্দনার বাণী
তবু যেন কোথাও
বারে বারে অপ্রাপ্তির সুর
আমাকে দংশন করে,নাড়া দেয়, কুরে কুরে খায়।
আমি পিতার চোখে চোখ রাখতে পারিনা
এই বুঝি আমাকে সন্দেহ করছে,
কত্ত অসহায় আমি।

পিতাকে যত আপন করে জড়িয়ে ধরতে চাই
ততই তাঁর বুকের আর্তনাদটি কানে গাঢ় হয়ে বাজে।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে চেঁচিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করি-
হে আমার শ্রদ্ধাভাজন পিতা
তোমার কিসের এত শংকা?
তোমার কিসের এত ভয় ?
তোমার কিসের এত দ্বিধা ?
তুমি নিজেকে কেন আমার সামনে গুটিয়ে রাখ?

না। আমি বলতে পারিনি
আদৌ বলতে পারবো কিনা জানিনা।
কারণ।
কারণ,আমি তো আমার সন্তানকে দেখলে নড়ে চড়ে বসি।


১৫ আগস্ট ।। মাঈন উদ্দিন জাহেদ

ব্যাক্তি আমাকে ছোঁয় না, ছোঁয় না ইতিহাসের খেরোপাতা,
আমিতো অনন্তের মৌমাছি শব্দভুগ শতাব্দীর চারুভাষী-
চিরকাল অনেতিহাসের হালখাতা, ছুঁয়েছি তোমার চিবুক।

ইজেলে এঁটে, ফ্রেমে তুলির আঁচড় হয়ে বোধের বাড়ি-
তুমিও তাড়াতাড়ি ঘোমটা আঁটো আমার আড়াআড়ি;
জীবন-বারান্দায় আর হয় না দেখা তোমার আমার।
বৈষ্যবুদ্ধিরা হাঁটে, হাটে-বাটে-ঘাটে-মাঠে পকেটে,
এমন দো দিল, বেচইন মন তাবৎ এই বঙ্গ-সমাজে ?

তোমার আমার গাথার মুখচ্ছবি হয় না আঁকা মৃত্তিকায় ;
বিরহ কাহিনীগাথার শেষ সংলাপও হয় নাতো শেষ;
আগস্ট মানে অনিশেষ দুঃখ- করুণ এই বাংলাদেশ ।


ফিরে এসো, আমাদের অস্তিত্বে।। আরিফ চৌধুরী

এক শতাব্দীর পথ পেরিয়ে এসে
আমাদের অস্তিত্বের জাগ্রত অহংকারে
তোমার অস্তিত্ব খুঁজি নিয়ত
তোমার স্মৃতির চেতনায় এ বাংলার মানুষ আজও
জেগে উঠে অস্তিত্বের চেতনায়
তোমার স্বপ্নের এ দেশে
নদী নিরবধি বয়ে চলে আপন স্বত্বায়।

একদিন তোমার আহবানে জেগেছিলো মানুষ, মানবতা
প্রত্যয়ের মিলিত শপথে
এ মাটির স্নিগ্ধ সুষমায়,
রক্তে লেখা মানচিত্র উঁচিয়ে মানুষ
মানুষ জেগেছিলো নির্ভিক অহংকারে।

আজও পিতা তোমার স্মৃতি
পরম বিশ্বাসে আজও জাগিয়ে রাখে
মানুষ দুচোখের অস্তিত্বে,
আবার মানচিত্র জুড়ে জাগ্রত উচ্চারণে তোমার পরিচয়
এক উদার জমিনে তোমার স্মৃতি
ভেসে বেড়ায় স্বাধীন দেশে,
আবার বুঝি নতুন করে
জেগে উঠে মানুষ,
বুঝি নতুন করে
আবার ফিরে ফিরে আসা,
জন্ম জন্মান্তরে,
নতুন এক প্রবাহমান মহাজীবনে
তোমার অস্তিত্ব আমাদের মনের গহীনে
দীপ্ত থেকে দীপ্তি ছড়ায়।

আজ ফিরে এসো তুমি
সিগ্ধ জীবনের টানে
আমাদের প্রাণের অস্তিত্বে,
এ স্বাধীন স্বদেশ তোমাকে ডাকে
মুক্ত জীবনের টানে, নিবিড় ভালোবাসায়।


লালবৃষ্টি।। রিজোয়ান মাহমুদ

উঠোনে জলের শব্দ মাটিরা বিভোর কাঁদে
সিঁড়িতে রক্তের নুন যে আমারে বাঁধে।
ইতিহাস শুয়ে চলে ভোরের আজানে
প্রকৃতিও চুপচাপ শীর্ণ পেরেশানে।
শ্রাবণ ধারায় ভিজে গেলে দীর্ণ জামা
আমি মূক ও বধির বলিনি, সেখানে থামা।
সেদিন কি নিভেছিল সূর্য, বত্রিশ নম্বরে
শোকপাখি উড়েছিল বিপন্ন অম্বরে।
লালবৃষ্টি জলে আজো জ্বেলেছি চেরাগ
হাওয়া মাতম করে তবু শিখেছি বেহাগ।
তিনি তো দেবতারূপী পাঁজরের ঈভ
কবরের মাটি বলে মুজিব! মুজিব!


শোকগাথা।। মূল : অ্যাডোনিস।।অনুবাদ: মুজিব রাহমান

আমার বাবা এক আশু আগামী
যিনি প্রবাহের টানে ফিরেছেন আমাদের দিকে,
সূর্য এবং মেঘমালা উঠছে আমাদের বাড়ির উপর।

তাঁকে আমি ভালোবাসি,
এক দুরূহ দুর্জ্ঞেয় রহস্য,
ময়লাচ্ছন্ন কপাল
তার ক্ষয়িষ্ণু হাড় আর কাদাসহ
আমি তাঁকে ভালোবাসি।

২.

নৈঃশব্দ্য হাঁসফাস করলো ঘরের উপর,
চাপা কান্না হলো ঊর্ধ্বগামী
এবং যখন আমার বাবা ঢলে পড়লেন
মৃত্যুর কোলে
একটা মাঠ শুকিয়ে গেলো,
হঠাৎ পালিয়ে বাঁচলো একটা চড়ুই।

(অ্যাডোনিস: আরব বিশ্বের কণ্ঠস্বর । একাধারে অনুবাদক, তাত্ত্বিক, সাহিত্যের অধ্যাপক এ কবি বহুকালব্যাপী সাহিত্যে নোবেল প্রতিদ্বন্দ্বী। অনূদিত হয়েছেন বিভিন্ন ভাষায়। ‘ছাই-ভস্ম আর গোলাপের মধ্যবর্তী সময়’- শীর্ষক কাব্য-খ্যাত এই কবি বিবিধ সংস্কৃতির মধ্যে এক সেতুবন্ধন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। যদিও আরব, গ্রিক পুনর্জন্মের দেবতা অ্যাডোনিস নাম ধারণ করেছিলেন তাঁর কলমি নাম – সাহিত্যিক ছদ্মনাম হিসেবে। তাঁর জন্ম পশ্চিম সিরিয়ায় ১৯৩০ সালের পয়ল জানুয়ারি।)

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন