আধুনিক আফগান কবিতা
ওবাইদুল্লাহ দরবেশ দুররানি
গৌতম ঘোষ দস্তিদার অনূদিত।। পুবাকাশ
[জন্ম ১৯৭১ সালে। কান্দাহারে। সাহিত্যদুনিয়ায় দরবেশ দুররানি নামেই খ্যাত। সােভিয়েত-আগ্রাসনের সময় সপরিবার পাকিস্তানে চলে যান। কোয়েট্টা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই ইংরেজি পড়ান। কবিতা লেখেন পশতুভাষায়, গদ্যরচনা ইংরেজিতে। কাব্যগ্রন্থ আটটি। প্রতিটিই পুরস্কারধন্য, জনপ্রিয়। বসবাস কোয়েট্টায়।]
ও আমার পুণ্যভূমির ঘাতক
ও আমার পুণ্যভূমির ঘাতক, তুমি যে বন্দুকটি কাঁধে নিয়ে চলেছ
তার না-আছে চোখ না-আছে পা—সে তােমার চোখদুটি কেড়েছে
আমার পদক্ষেপ মাপতে, আর দিনমান আমাকে অনুসরণ করার জন্য,
ব্যস্ত রেখেছে তােমার পা-দুটিকে, আর আমার বুকের ভিতরে একটি
গর্ত খোঁড়ার জন্য প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আমার মৃত্যুনাদ
শুনবে বলে সে সতর্ক রেখেছে তােমার কানদুটি।
ও আমার পুণ্যভূমির ঘাতক, যে বন্দুক তুমি কাঁধে
বয়ে চলেছ, সে কি জন্মখোঁড়া, কালা ও অন্ধ-
তাই সে তােমার পা, কান আর চোখে ভর করেছে?
এই ভারী বন্দুকটি সম্পর্কে তুমি কিছুই জানােনা
কিন্তু, আমি জানি, আমাদের এক উভশত্রু
অনেক দূরের দেশে বসে সব মতলব আঁটছে।
সে ছক করেছে আমাদের ভাইদের মেরে ফেলার,
বর্বরবাহিনী দিয়ে আমাদের দাঁতগুলি গুড়িয়ে দেওয়ার
সেই ষড়যন্ত্রী কিন্তু আছে একেবারে নিরাপদ দূরত্বে!
সে চায় আমাদের রক্ত মাটিতে মিশিয়ে দিতে,
তার রক্ত অনেক দামি, অপচয়ের কোনও প্রশ্নই নেই।
সে চায়, আমাদের প্রতিটি রাত কাটুক শীতের যুদ্ধক্ষেত্রে,
আর সে ঘরে বসে দিব্যি তাপ পােহাবে অগ্নিকুণ্ডের।
এইভাবে একটি-একটি করে ছক কষেছে আমাদের শত্রু
দুর্ভেদ্য-ঘরে নিজের দেহটি জামার মতাে ঝুলিয়ে রেখে
সে এসেছে আমাদের দেশে এই বন্দুকের ছদ্মরূপে।
ও আমার পুণ্যভূমির সেনা, যখন এই শয়তান, মেরুদণ্ডহীন শত্রু
বন্দুক সেজে এসেছে আমাদের দেশে, সে একা আসেনি
এসেছে অজস্র ও প্রচুর, এসেছে এ-দেশের জনসংখ্যা ছাপিয়ে।
প্রতিটি বন্দুক পারে অবিরাম সংযমহীন গুলি ছুড়তে—
কেবল কারও একটিমাত্র হাড় ভাঙতে নয়,
কেবল কারও ত্বকমাত্র পােড়াতে নয়,
কেবল কারও ধমনীগুলিই কুঁচকে দিতে নয়,
নয় কেবল কারও রক্তস্রোত বইয়ে দিতে
বুলেট কোথায় যাবে, কার দিকে যাবে, বন্দুকও জানে না!
বন্দুকের প্রকৃত প্রত্যঙ্গগুলি নিজগৃহে নিরাপদে আছে,
তার বদলে তারা ব্যবহার করছে আমাদের সব অঙ্গগুলি।
একটি বন্দুক আমাকে তােমার পায়ে লুটোতে বাধ্য করে,
অন্যটির চোখ থাকে আমার চোখের দিকে,
তৃতীয়টি থাকে আরেকজনের কাধে
যেমনভাবে তােমার কাধে রয়েছে তােমারটি।
বন্দুকরা নিজেদের সব প্রত্যঙ্গ ঘরে রেখে এসেছে,
সঙ্গে এনেছে কেবল নিজেদের মুখগুলি!
বন্দুক, তুমিও স্বাধীন নও, কেননা বন্দুকের মুখটি তার নিজস্ব
দাঁতবিহীন সেই মুখ কথা বলে বুলেটের ভাষায়।
কিন্তু, একটি বুলেট যখন কাউকে ঝাঝরা করে দেয়,
সে তখন তার দাঁতহীন মুখটি দেখতে পায় না।
সে কেবল দ্যাখে তােমার কাঁধ আর তােমার হাতদুটি।
সে তােমাকে শত্রু হিসাবে চেনে, বন্দুককে নয়।
আর সে তখনই তােমার থেকে চূড়ান্ত প্রতিশােধ পায়।
ও আমার পুণ্যভূমির ঘাতক, যেবন্দুকটি বইছ তােমার কাঁধে
কত রক্ত সে ছিটিয়েছে আমার দেশের মাটিতে,
তার কি কোনও সঠিক হিসাব আছে?
তুমি একাই এ-জন্য দায়ী, তুমিই তাে অকারণ-প্রতিশােধকামী,
কেননা, তারা তাে তারপর কাঁধে তুলে নিয়েছে অন্য বন্দুক
আর সেই বন্দুকের নলমুখ তােমাকেই নিশানা করেছে!
ওহ, তুমি তাে এখন মুকুটের জন্য লালায়িত,
একদিন এই বুলেট ছুঁড়ে দেবে তােমারও কলজে
মুকুট নয়, তুমি এখন কফিনের কিনারায় রয়েছ।
সাবধানে থেকো আর আর-একবার ভেবে দ্যাখাে,
যতক্ষণ শত্রুরা তােমাকে ছুড়ে না-ফেলে পরিত্যক্ত কবরখানায়
নিজেকে অন্ধকার-ভবিতব্য থেকে বাঁচাতে একবার
ভেবে দ্যাখাে, কে তােমার মৃত্যুপুঁটি সাজিয়েছে!
আমি তােমার ভাই, আমাদের উভয়শত্রু তােমার কাঁধে চেপে আছে,
সে জন্মখোঁড়া, কালা ও অন্ধ—সে আমার পদক্ষেপ মাপছে তােমার চোখে,
সে আমাকে তােমার পায়ে ছুড়ে ফেলছে, আমার বুকের ভিতর
একটি বিস্ফোরণ ঘটাবে সে, আমার মৃত্যুনাদ শুনবে তােমার কানে!
সে কেবল একটি দাঁতবিহীন মুখগহ্বর, সে কেবল বুলেটেই কথা বলে!