মাটির আখ্যানকার।। মিলটন রহমান।। পুবাকাশ
‘প্রদোষে প্রাকৃতজন‘ বিশ্বসাহিত্যের তুলনাহীন সাহিত্য হিরকখন্ডগুলোর সাথে তুলনীয় হতে পারে। তারপরও আমি এই মাস্টারপিসকে স্টেফেন গ্রীনব্লাট কিংবা গ্রামসির কোন তত্ত্বের ছকে ফেলে মূল্যায়ন করতে চাই না। কেননা বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন‘ গভীরতম রেখা এঁকে দিয়েছে। যা কেবল এতদঞ্চলের ঐতিহাসিক সংজ্ঞাতেই বিচার্য হতে পারে। প্রদোষে প্রাকৃতজন এবং দু্ষ্কালের দিবানিশি এই দুই পর্বে রচিত উপন্যাসটির বিশ্বসাহিত্যের অবস্থান বিচার করতে হলেও ওইসব পাশ্চাত্য দার্শনিক কিংবা বিশ্লষকের উচিত হবে এই উপন্যাস নির্মাতা এবং এর মনস্তাত্বিক এলিমেন্টসগুলোর সাথে পরিচিত হওয়া। তা না হলে বিশ্বসাহিত্য সংযোগে উপন্যাসটি যে অদ্বিতীয় ভূমিটি দখল করবে তা চিনে নিতে তাদের কষ্ট হবে। তাই আমি মনে করি শওকত আলী‘র উপন্যাস বর্ণনার জন্য পাশ্চাত্যপান্ডিত্যর প্রয়োজন পড়ে না।
আপনি কোথায় বসে লিখছেন তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কি লিখছেন, কেনো লিখছেন তা নিশ্চয় সান্ধ্য কথা নয়। আপনাকে লিখতে হচ্ছে, কেনো লিখতে হচ্ছে? এ জিজ্ঞাসার কথা যখন অস্ট্রিয়ান বোহেমিয়ান কবি রাইনার মারিয়া রিলকে(৪ ডিসেম্বর ১৮৭৫-২৯ ডিসেম্বর ১৯২৬) বলেন, কেনো তোমাকে একটি বিষয় লিখতে বাধ্য করে তার কারণ জানতে হবে। দেখবে সে বিষয়টি তোমার মনের খুব গভীরে শেকড় বিস্তার করেছে। এমনকি কেউ যদি তোমাকে সে বিষয়ে লিখতে বাঁধা দেয়, তুমি আত্মাহুতি দিতেও কার্পণ্য করবে না।‘ কি প্রচন্ড ভাবাবেগ। যেখান থেকে মুক্তি নেই। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল ঔপন্যাসিক শওকত আলীর প্রতিটি উপন্যাস পাঠের পর আমার একথা মনে হয়েছে। তাঁর বিষয় নির্বাচন এবং তাকে আখ্যান আকারে উপস্থাপন একটি আন্দোলনই মনে হয় আমার। ২৫ জানুয়ারী তাঁর তৃতীয় প্রয়াণ দিবস। যে উপন্যাসগুলো রচনায় কেউ যদি তাঁকে বাঁধা দিতেন তাতেও তিনি দমে যেতেন না, এমন একটি উপন্যাস বিষয়ে সামান্য রেখাপাত করতে চাই।
‘রাঢ় বরেন্দ্র বঙ্গ সমতটবাসী প্রাকৃতজনের সংগ্রামী পূর্বপূরুষদের স্মরণে‘ আদিতেই উৎসর্গপত্রে ঔপন্যাসিক আমাদের ইতিহাসের ইঙ্গিত দেন এভাবে। বলেন ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন‘ এর ইতিহাস, প্রেক্ষাপট এবং সময়ের কথা। আটশ‘ বছরেরও আগে সেন রাজত্বের কথা। উপন্যাসের নামকরণ আগে থেকেই পাঠকের দৃষ্ঠিতে গেঁথে দেয় অন্ধকার সময় এবং সেই সময়ে বসবাসকারী অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের চেহারা। ফলে সুচনাতেই ঔপন্যাসিক শওকত আলী পাঠকের মগজে স্থাপন করেন একটি প্রশ্ন ‘সেই মানুষ কারা‘? পাঠকমাত্রই এই প্রশ্ন নিয়ে প্রবল আগ্রহে প্রবেশ করতে পারে বৃত্তান্তের গভীরে। সেন বংশীয় রাজত্বের কাল ধরে রচিত উপন্যাসটিতে পাঠক হিসেবে আমি প্রথম সময়ের গন্ধ পাই বাসুদেব কর্তৃক কুমারশিল্পী শ্যামাঙ্গের মূর্তি ভাঙার দৃশ্যে। বাসুদেব সেন রাজার সেনাপতি কিংবা অনুসারী ছিলেন কিনা সে প্রশ্ন এখানে বড় হয়ে ওঠেনি। দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে সেন রাজার শাসনামলকালে শিল্প-সাহিত্যের প্রতি উদাসীনতা। সেই বিরূপতা কিভাবে বিভিন্ন স্তরে বিস্তার করেছে তার প্রথম ধাক্কাটি এখানেই মূর্ত হয়ে উঠেছে। যখন বাসুদেব শ্যামাঙ্গকে বলে, যেসব মূর্তি তৈরী হচ্ছে তা তার বাবার অর্থে নয়, এর কড়ি সংযোগ করছে, ‘কায়স্থ কুলতিলক মহাসামন্ত সুধীমিত্র‘। এর পর শ্যামাঙ্গের মুখেই বিদৃত হয়েছে শিল্পীদের দাশ করে রাখার সেনবংশীয় প্রবণতা।
এই যন্ত্রণা বুকে নিয়েই উজুবট গ্রাম অতিক্রম করে যাত্রা শুরু হয় শ্যামাঙ্গের। ওই জনপদের প্রতিটি ভাজ থেকে শওকত আলী তুলে এনেছেন প্রান্তিক মানুষের দীর্ঘশ্বাস। তৎসম ও চলতি শব্দগাঁথায় রচিত গদ্যে তিনি যে ঘোর তৈরী করেছেন, তাতে মনে হয়েছে ওই শব্দরা সেই জনপদের কাহিনী বর্ণনার জন্যই তৈরী ছিলো। বরেন্দ্র কিংবা মগদে কিভাবে শোষিত মানুষেরা লক্ষণসেনের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে। কিভাবে যবন, বৌদ্ধ ভিক্ষু, ডোম কিংবা যোগিরা প্রতিবাদি হয়ে উঠেছে, তার বর্ণনা যেনো উপন্যাসের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের পাতায় গভীর রেখাপাত করেছে। সেই ইতিহাস শওকত আলী‘র মত আর কেউ বলতে পারে নি। উপন্যাসের চরিত্রগুলো সেন রাজত্বকালের ইতিহাসের কোথায় বর্ণিত না থাকলেও তাদের নবরূপে ঠাঁই দিয়েছেন তিনি। লীলাবতি, মায়াবতি, শ্যামাঙ্গ, বসন্তদাসদের ইতিহাসের নায়ক হিসেবে স্থাপন করেছেন শওকত আলী। সেনরাজত্বের অত্যাচার নীপিড়নের দৃশ্য উপস্থাপনে তিনি একজন দিব্যস্বাক্ষীর মতই কাহিনী বর্ণনায় উপগত হয়েছেন। ইতিহাস সচেতনতা এবং প্রখর উপস্থাপনা শওকত আলী‘কে সেই সময়ের মানুষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। মনে হয় তিনি সেই পুনর্ভবা,আত্রেয়ী, করতোয়া, নবগ্রামের মতো জনপদে হেঁটে হেঁটে কাহিনী বিদৃত করছেন। তিনি পিপ্পলীর হাটে কুসুম ডোমিনীর ওপর হরিসেনের অত্যাচারের দৃশ্য নির্মাণ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন সেনরাজত্বের বর্বরতার ধরণ। বয়ানে তিনি যখন বলেন, ‘…এবং তারপর সর্বসমক্ষে কুসুমকে নির্বস্ত্রা করে তার যোনিদেশে একটি উত্তপ্ত লৌহদন্ড প্রবেশ করিয়ে দেয়া হলো। মৃত্যুর পূর্বেকার চিৎকার…‘। বরেন্দ্র জনপদে সেন রাজার সৈন্যরা প্রজা নিরাপত্তার বদলে কিভাবে বিলাসব্যাসন ও পীড়নে ব্যস্ত। অন্যদিকে যবন সৈন্যদের প্রতিআক্রমণের দামামা। বৌদ্ধ বিক্ষুদের আত্মরক্ষা ও আক্রমণ। এসব ঘটনা পরম্পরা সেলাই সূঁতোর মতো সূত্র মেনে গেঁথে গেছেন তিনি। কোথাও ইতিহাসের এতটুকু ফাঁক নেই। যে ‘সেখশুভোদয়া‘ পাঠোত্তর শওকত আলী ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন‘ রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন, সেই চম্পুকাব্যের রচয়িতা হলায়ুদ মিশ্রের সন্ধানও পাওয়া যায় এ উপন্যাসে(যদিও হলায়ুধ মিশ্র‘কে নিয়ে বিতর্কের অবসান হয় নি। বলা হয় লক্ষণ সেনের সভাকবি আর সেখশুভোদয়ার রচয়িতা এক হলায়ুধ মিশ্র নয়)। আমরা ধরেই নিতে পারি লক্ষণ সেনের সভাকবি হলায়ুধ মিশ্রই এই উপন্যাসের একটি চরিত্র। এই কবির বয়ানেও লক্ষণীয় তিনি রাজার অবাধ্য হতে রাজি নন। অন্যকেও এ বিষয়ে সতর্ক করতে দেখা যায়। শান্তি ফিরিয়ে আনতে বন্ধু সোমজিৎ এর কথার বিরোধিতা করে তিনি রাজার ক্ষমতা জাহিরে ব্যসাত হয়ে ওঠেন। তবে সেই সাথে তার কন্ঠে বৌদ্ধ, যবনদের বিষয়েও ভীতি লক্ষ্য করা যায় শেষ প্রাতে। এসব দৃশ্য নির্মাণে শওকত আলী শিল্পোত্তীর্ণ মোনোৎকর্ষতার চিহ্ন রেখেছেন।
এতে করে ইতিহাস নির্ভার উপন্যাস হিসেবে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন‘ বিশ্বসাহিত্যের তুলনাহীন সাহিত্য হিরকখন্ডগুলোর সাথে তুলনীয় হতে পারে। তারপরও আমি এই মাস্টারপিসকে স্টেফেন গ্রীনব্লাট কিংবা গ্রামসির কোন তত্ত্বের ছকে ফেলে মূল্যায়ন করতে চাই না। কেননা বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন‘ গভীরতম রেখা এঁকে দিয়েছে। যা কেবল এতদঞ্চলের ঐতিহাসিক সংজ্ঞাতেই বিচার্য হতে পারে। প্রদোষে প্রাকৃতজন এবং দু্ষ্কালের দিবানিশি এই দুই পর্বে রচিত উপন্যাসটির বিশ্বসাহিত্যের অবস্থান বিচার করতে হলেও ওইসব পাশ্চাত্য দার্শনিক কিংবা বিশ্লষকের উচিত হবে এই উপন্যাস নির্মাতা এবং এর মনস্তাত্বিক এলিমেন্টসগুলোর সাথে পরিচিত হওয়া। তা না হলে বিশ্বসাহিত্য সংযোগে উপন্যাসটি যে অদ্বিতীয় ভূমিটি দখল করবে তা চিনে নিতে তাদের কষ্ট হবে। তাই আমি মনে করি শওকত আলী‘র উপন্যাস বর্ণনার জন্য পাশ্চাত্যপান্ডিত্যর প্রয়োজন পড়ে না। কেননা ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন‘ থেকে শুরু করে ‘নাঢ়াই‘ পর্যন্ত শওকত আলীর জার্নি জানিয়ে দেয় তাঁর শক্তি কোথায়। তিনি দীর্ঘ এই যাত্রায় তুলে এনছেন প্রান্তিক মানুষের কথা। তুলে এনেছেন নিপীড়িত মানুষের দলিত-মথিত হওয়ার দৃশ্য।
মিলটন রহমান : কবি ও গবেষক।