হাসনাহেনার ঘ্রাণ।। সাবিনা পারভীন লীনা।। পুবাকাশ
খোলা বারান্দায় একটা হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ারে অনেক সময় থেকে বসে আছি, কতো সময় বসে আছি ঠিক বলতে পারবো না। গভীর ঘুমের মধ্যে হাসনাহেনার ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে আমি বারান্দায় এসে বসি। মনে হয় কেউ যেন আমাকে টেনে এনে বারান্দার চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে। ঘ্রাণটা আসে আমি যেখানে বসে আছি তার পাশে আকাশী, মেহগনি, রেইনট্রির যে ঘন বাগান সে দিক থেকে।
গাড়ির মৃদু ঝাঁকুনিতে তন্দ্রা কেটে গেলে সামিনাও অদৃশ্য হয়ে যায়। ঠাণ্ডা বাতাসের জন্য গ্লাস নামিয়ে দিই। গাছপালা পিছনে ফেলে গাড়ি ছুটে চলছে, হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে। তখন মিল্টনের কথা মনে পড়ল- ‘আপনার প্রেমটা গভীর স্যার।’
এখন মনে হচ্ছে হাসনাহেনার ঘ্রাণটা আবার পাওয়া গেলে মন্দ হতো না।
ফুলের সুবাস, জোছনা এসব উপভোগ কিংবা সময় ব্যয় করার অবসর বা ইচ্ছা কোনটাই আমার নেই। আমি একটা খরখরে টাইপের মানুষ, আশৈশব ইট-পাথরের ঢাকা শহরের বাসিন্দা; সারাদিন চলে যায় সংসারের রসদ জোগাড় করতে। তবে যৌবনের শুরুতে ছাতিম আমার মধ্যে যে ঘোরের সৃষ্টি করেছিল সেটা এখনো মনে পড়ে। কলেজ লাইফে একবার এক বন্ধুর সঙ্গে তাদের গ্রামের বাড়ি গেলাম, রাতে সিগারেট খাওয়ার জন্য মাঠের দিকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নেশাধরা একটা ঘ্রাণ আমার মগজে ঢুকে যায়। কয়েকদিন কেটে যায় ছাতিমের গন্ধের ঘোরে, বাড়িতে ফিরে এলেও সেই ঘোর কাটতে চায় না। বেশ কয়েক বছর শহরের বাইরে কোথাও গেলে জিজ্ঞাসা করি আশপাশে কোন ছাতিম গাছ আছে কি না? লোকজন এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন আমি একটা ভিন গ্রহের মানুষ। রমনা পার্ক তন্নতন্ন করে খুঁজেছি কিন্তু কোন ছাতিম গাছের অস্তিত্ব পাইনি। অবশেষে এই ঢাকা শহরে ছাতিম গাছের আশা ছেড়েই দিয়েছি। একদিন শিল্পকলা থেকে হেঁটে হেঁটে খিলগাঁ আসছি সন্ধ্যা গড়িয়ে যাওয়ার অনেক পরে। ছুটির দিন হওয়ায় রাস্তাঘাট ফাঁকা ফাঁকা। রাজমণির দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে তার একটু আগে সেগুনবাগিচা হিসাবরক্ষণ অফিসের ওয়াল ঘেঁষে ডাস্টবিনের স্তূপ পার হওয়ার সময় হঠাৎ ঝাঁঝালো একটা গন্ধ মাথায় ঢুকে যায়। গলা উঁচিয়ে দেখি ডাস্টবিনের ঠিক উপরে একটা ছাতিম গাছ ঝুঁকে আছে, গাছ ভর্তি ফুল। লম্বা করে নিশ্বাস নিতে গিয়ে দেখি ময়লার কটু গন্ধ এসে ঢুকছে মগজে। তারপরও লম্বা লম্বা করে নিশ্বাস নিতে থাকি; একবার ছতিমের গন্ধ একবার ময়লার গন্ধ…।
হাসনাহেনা নিয়ে আগ্রহের কোন অভিজ্ঞতা আমার নেই, তবে আমার আম্মার হাসনাহেনা বড়ো প্রিয় ছিল। কিন্তু এখানে এমন নির্জন রাতে হাসনাহেনার গন্ধটা আমার ভালো লাগছে। একইভাবে জোছনা নিয়েও উচ্ছ্বাস প্রকাশের মতো কোন ঘটনা আমার জীবনে ঘটেনি। তবু এখানে জোছনা ভালো লাগছে।
জোছনা নিয়ে একটু বলি, আমার চেনাজানা সবার পছন্দ জোছনা, কোনো কোনো মাসের পূর্ণিমায় তীব্র জোছনা হয় সেটা আমার এক বন্ধু আশিকের মুখস্থ। সে বিখ্যাত জোছনাপ্রেমী। জোছনা নিয়ে কোন লেখকের কি লেখা আছে তা তার ঠোঁটস্থ। বারী সিদ্দিকীর একটা গান আছে ‘বন্ধু তুমি আমার ভাদ্র মাসের পূর্ণিমারই চাঁদ..’। ভাদ্র মাসে নদ-নদী, খাল-বিল, পানিতে কানায়-কানায় ভর্তি থাকে, পানিতে চাঁদের আলো পড়ে এক মোহনীয় পরিবেশ তৈরি হয়। এখানে এসে আমার মনে হচ্ছে পাহাড়ের জোছনাও কম মোহনীয় নয়। কোন কোন জোছনাপ্রেমীর কম আলোয় মন ভরে না, তীব্র আলো চাই তাদের। আমার এমন তীব্র আলো ভালো লাগে না। চাঁদের আলোয় যদি হারানো সুঁই খুঁজে পাওয়া যায় তা হলে সূয্যের আলোর সঙ্গে এর তফাৎ থাকলো কোথায়? কোন তীব্রতাই ভালো না। আমার কাছে জোছনার মায়াবি দিকটাই আসল, বারবার হালকা মেঘের আড়ালে চাঁদ লুকিয়ে যাচ্ছে; তার সঙ্গে যদি হালকা বৃষ্টি নেমে আসে তাহলে তো কথাই নেই। মনে হবে আকাশ থেকে সমুদ্রের ফেনার মতো জোছনা ধুয়ে ধুয়ে নিচে নেমে আসছে- এমন আলো আঁধারী খেলাই আমার ভীষণ পছন্দ। এখন এপ্রিলের মাঝামাঝি, আকাশে যে চাঁদ তাতে তীব্র আলোই হওয়ার কথা কিন্তু হঠাৎ করেই কয়েকদিন থেকে আকাশে হালকা মেঘ, রাতে হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বৃষ্টিস্নাত জোছনা, হালকা বাতাস, নিস্তব্ধ রাত এমন প্রায় অলৌকিক পরিবেশে হাসনাহেনা আমাকে অন্যরকম ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়, ফজরের আজানের পর ঘোর কেটে গেলে আবার গিয়ে শুয়ে পড়ি। দূর গ্রামের দিক থেকে আসা বয়স্ক লোকের ভরাট গলার আযান শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়ি বলতে পারি না। কতোদিন সুবেহ সাদিকের শান্ত বাতাস বেয়ে আসা খালি গলার আযানের মধুর সুর শুনি না। ‘কে শুনালো মোরে আজানের সুমধুর সুর কবির এই অনুভূতি আমরা যারা ঢাকায় থাকি তাদের কোন দিনই হবে না।
এভাবে দুই রাত গেল, আজ তৃতীয় এবং শেষ রাত। সকাল হলে এই পাহাড়ি এলাকা ছেড়ে ঢাকায় ফিরে যাবো। আমি একটা বেসরকারী অফিসের মাঝারি গোঁছের একজন কর্মকর্তা সকাল থেকে রাত অবধি মাথা গুঁজে কাজ করি, মাসের বিশ তারিখ যেতে না যেতে টানাটানি। জোছনা দেখার মতো বিলাসিতার সময় কোথায়? এই পাহাড়ী এলাকায় এমন একটা নির্জন বাড়িতে একাকী রাত্রীযাপন আমাদের মতো শহরের কোলাহলে থাকা মানুষের জন্য লোভনীয়। তাই সুযোগটা হাতছাড়া করিনি। আমার শ্বশুর মিয়া আব্দুল আজিজ একজন উচ্চপদস্থ ব্যাংকার, রিটায়ার্ড করার পরপর পেনশনের সব টাকা ব্যয় করে এই দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় লেবুর বাগান করেছেন। ছেলে-মেয়ে আর আমার শাশুড়ির আপত্তি উপেক্ষা করে তিনি পনের দিন এখানে থাকতেন, মাসের বাকী পনের দিন ঢাকার বাসায় থাকতেন। তিনি এখন শয্যাশায়ী, সেদিন আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন,‘ বাবা খায়রুল, তুমি কি আমার লেবু বাগানটার খোঁজ-খবর নিয়ে আসতে পারবে? জানি তোমার কষ্ট হবে, তবু আমি চাই তুমি আমার কাজটা করে দেবে।’ আমার শ্বশুরের এই আবেদন আমি অগ্রাহ্য করতে পারিনি।
বাসাটা বেশ সুন্দর, পাহাড়ের সঙ্গে মিলিয়ে তিনতলা বিল্ডিং, নিচতলা দ্বিতীয় তলা এক এনজিও প্রতিষ্ঠানের অফিস, পাহাড়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঋণ দিয়ে স্বাবলম্বী করা তাদের কাজ। গত কয়েকদিনে যে পরিমাণ দারিদ্র মানুষের ভিড় এখানে দেখেছি তাতে দরিদ্র বৃদ্ধি এদের কাজ কি না বুঝতে পারছি না। তিন তলার ফ্ল্যাটটা আমার শ্বশুরের আস্তানা। বাড়ির পিছনে সামান্য জায়গাজুড়ে নানা ধরনের ফুলের বাগান, একপাশে ঘন বন, অন্যপাশ দিয়ে সরু রাস্তা চলে গেছে গ্রামের দিকে, দূরে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এনজিও-কর্মী ঋণ গ্রহীতা দরিদ্র-নারী-পুরুষের উপস্থিতিতে জমজমাট থাকলেও সন্ধ্যার পর নেমে আসে নিস্তব্ধতা; পুরো বাড়িতে প্রাণী বলতে আমার শ্বশুর আর তার কেয়ারটেকার মিল্টন। তাও দশটা পর্যন্ত, দশটার পর মিল্টন চলে যায় দুই কিলোমিটার দূরে তার গ্রামে- মা আর স্ত্রীর কাছে। থাকেন শুধু একাকি সৌখিন লেবু চাষী, মিয়া আব্দুল আজিজ।
মিল্টনকে বলে রাতে রাখা যেত; কিন্তু চাপাচাপি করতে মন চাইলো না। থাকিনা একাকি কয়েকটা রাত মাত্র। একাকীত্ব ও নির্জনতাও যে কখনো কখনো মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ দাওয়াই হতে পারে সেটা এখানে না এলে বুঝতে পারতাম না।
নিয়ম করে দশটার পর কারেন্ট চলে যায়, তার পরপর শুরু হয় শেয়ালের ডাক, প্রথমে একটা দুইটা, পরে দলবেধে শেয়াল ডাকতে থাকে। পরে মনে হলো সবগুলো শেয়াল এক জায়গা থেকে ডাকে না, দুইদল দুই জায়গা থেকে ডাকে। একদল অন্য দলের প্রতিপক্ষ। দ্বিতীয় দিন বিকেলে কৌতূহল মিটাতে সরু রাস্তা দিয়ে গ্রামের দিকে হাঁটতে গিয়ে এর সত্যতা মিলল। শেয়ালগুলো আসলে দুই গ্রুপে বিভক্ত. একদল থাকে মেহগনি বাগানে, অন্যদল থাকে সেগুন বনের দিকে। গ্রামের দিকে হাঁটতে হাঁটতে কিছু দূর গিয়ে দেখি একটা সরু রাস্তা ডান দিকে চলে গেছে । এই রাস্তায় কিছু দূর অগ্রসর হলে দেখি রাস্তাটা ক্রমে পাহাড়ের দিকে চলে গেছে, সেখানে সেগুনের বন। মাস্তুলের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সেগুনের সারি। সেগুন বনের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া সরু রাস্তা দিয়ে বেশি দূর অগ্রসর হতে সাহস হলো না, তাই ফিরে এসে মূল রাস্তা ধরে সামনের দিকে এগুতে লাগলাম। কিছু দূর গিয়ে হাতের বাম পাশে ছোটখাটো একটা আকাশমনী গাছের বন দেখতে পেলাম। এখন বুঝতে পারলাম রাতে ডেকে উঠা শেয়ালদের একদল আকাশী বন থেকে অন্য দল সেগুনের বন থেকে পালা করে ডেকে উঠে। ভাবলাম এদিক থেকে যেহেতু আজানের শব্দ ভেসে আসে মসজিদ, ঘর বাড়ি নিশ্চয় পাওয়া যাবে। তাই অগ্রসর হতে লাগলাম। কলাবাগানের মাঝ দিয়ে একটা মোড় পার হতেই ছোট ছোট কয়েকটা বাড়ি চোখে পড়ে, বাড়ি বলতে কয়েকটা মাটির ঘর; সবগুলো বাড়ির উঠান থেকে ধোঁয়া উড়ছে। সন্ধ্যা নামার আগেই মহিলারা উঠানে রান্নার কাজ শেষ করে নিচ্ছে। কেরসিন জ্বালিয়ে রাতে রান্নার মতো বিলাসিতার সুযোগ কোথায় তাদের? বাড়িগুলো দেখতে দেখতে আরো কিছুটা অগ্রসর হতেই দেখি হাতের বাম দিকে ছোট একটা মাটির মসজিদ, সামনে সামান্য ফাঁকা জায়গা। একজন হুজুর মেসওয়াক করতে করতে পায়চারি করছেন ধীর পায়ে, উদোম গায়ের কয়েকটা ছেলে ধুলোয় লুটোপুটি খাচ্ছে। মসজিদের মাথায় উঁচু বাঁশের সাথে মাইকের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না। তার মানে এই মসজিদ থেকেই মুয়াজ্জিন খালি গলায় আজান দেন, সেই আজানের সুর ভোরের শান্ত বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। মসজিদ পার হয়ে আর একটু অগ্রসর হতেই দেখি পাকা বিল্ডিং, মানে প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন। ভবনের সামনে বিশাল মাঠ, সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠের মাঝ দিয়ে চিকন সুতোর মতো পায়ে হাঁটা পথ। মাঠের ওপারে ঘন মেহগনি গাছের বনের মাঝ দিয়ে পথটা চলে গেছে, সেই বন রঙিন করে পশ্চিম আকাশে সূর্য বিদায় নিচ্ছে। সাদা লুঙ্গির ওপর সাদা পাঞ্জাবি পরা এক বৃদ্ধ এক কিশোরী হাত ধরে চলে গেল এই পথ দিয়ে। পড়ন্ত বেলায় বৃদ্ধ ও কিশোরীর চলে যাওয়া দেখলাম মুগ্ধ হয়ে, আমি কোন দিন চেনা জানা রাস্তা ছাড়া হাঁটিনি, আজ মনে হচ্ছে অজানা এই পথ ধরে এগিয়ে যাই, মনে হলো অজানা পথে হাঁটারও অদ্ভূত সুখ আছে, আমাকে কি সেই সুখ টানছে? গাছপালা, ঘাস, আমার জামাকাপড়, শরীর সব লাল হয়ে উঠেছে। এই লালের মধ্যে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে মনের অজান্তেই থেমে গেলাম। পরে মনে মনে ভাবলাম পথ পেলে এগিয়ে যাওয়া আমার মতো নানা পিছুটানে ক্ষয়ে যাওয়া লোকের কাজ নয়, তাই দ্রুত উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করলাম।
এইসব ভাবতে ভাবতে শরীরে হালকা শীত অনুভূত হচ্ছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ওয়্যারড্রব থেকে শ্বশুর মশায়ের সাদা চাদরটা গায়ে জড়িয়ে বারান্দায় এসে আকাশের দিকে তাকাতেই দেখি মেঘের আনাগোনা বেড়েছে, দেখতে দেখতে চাঁদকে একবারে ঢেকে ফেলেছে। আগের চেয়ে বাতাসের গতি বেড়েছে, সঙ্গে শীতলতাও। একটু ভয় ভয়ও লাগছে। হঠাৎ করেই বাগানের দিক থেকে হাসনাহেনার গন্ধ এসে নাকে লাগল, আমি নড়েচড়ে বসি। কিছুক্ষণের মধ্যে হাসনাহেনার নেশা ধরানো গন্ধ আমার মগজে ঢুকে যায়, আমি মনের অজান্তে তিন তলা থেকে নেমে পিছনের পকেট গেট দিয়ে বাগানে চলে আসি, তার পর গন্ধ শুকে শুকে বাগানের গণ্ডি পেরিয়ে ঘন বনের মধ্যে হাঁটতে থাকি। উচুঁ উচুঁ গাছের পাতার ছাওনির ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঝরা পাতার উপর।
ঘ্রাণের উৎসের পিছনে উদভ্রান্তের মতো ছুটতে ছুটতে এক সময় নাম না জানা একটা গাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকি। হঠাৎ ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়,গাছের পাতার ডাল বেয়ে পানি নেমে আসছে। জোছনায় বৃষ্টি বা বৃষ্টিস্নাত জোছনা, পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ, দূরে-বহুদূরে কুপির মৃদু আলো, সে এক অলৌকিক দৃশ্য! আমার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে, মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে আমার চেতনা লুপ্ত হয়ে যাবে।
ওইখান থেকে কিভাবে রুমে এলাম আমার মনে নেই, সকালে চোখ মেলে দেখি ঘড়িতে সাড়ে নয়টা বাজে। শ্বশুরের লেবু বাগানের তথ্য নেয়া শেষ। এবার ঢাকায় ফেরার পালা। দশটা না বাজতেই গাড়ি এসে যাবে। তড়িঘড়ি নাস্তা সেরে তৈরি হয়ে নিলাম। যথাসময়ে গাড়ি এসে গেল, ব্যাগপত্র গাড়িতে তোলা হয়েছে। সামনের রুমে মিল্টন অপেক্ষা করছে। মিল্টন শান্ত ধীর প্রকৃতির মানুষ। পেন্সিলের রেখার মতো গোঁফ থেবড়ানো নাকের নিচে। গত তিন রাতের ঘটনার বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইবো ভাবছি। কিন্তু কিভাবে কথাটা শুরু করবো বুঝে উঠতে পারছি না। এসময় মিল্টনই এগিয়ে এলো। ‘স্যার আপনার চোখ লাল কেন ? রাতে ঘুম হয়নি?’
‘তোমাকে একটা কথা বলবো মিল্টন, আচ্ছা তোমাদের বাগানে কি হাসনাহেনা গাছ আছে? না, মানে গত তিন রাত আমি হাসনাহেনার গন্ধ পেয়েছি।’
মিল্টনকে একটু চিন্তিত মনে হলো।
তার উত্তরের অপেক্ষায় আছি। মিল্টনের কপালের ভাঁজ আমার উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দিল। মনে মনে ভাবলাম কথাটা জিজ্ঞাসা না করলেই পারতাম। আমার মনেরই বিকার হয়তো।
‘হাসনাহেনার গন্ধটা কি মাঝ রাতে পেয়েছেন? বাগানের দিক থেকে এসেছে?’
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
‘আপনি কি গন্ধ ধরে ধরে বাগানের দিকে গিয়েছেন?’
আমি আবারও মাথা নাড়লাম।
‘না স্যার, বাগানে হাসনাহেনার কোন গাছ নেই। এমনকি কোন ফুলের গাছও নেই।’
‘তুমি কি বলছ এসব! আমি হাসনাহেনার ঘ্রাণ পেলাম…’
ভয়ে আমার মুখ শুকিয়ে গেছে। কোন কথা বের হচ্ছে না। শরীরে চিকন ঘাম হচ্ছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। টলতে টলতে কোন মতে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। আর কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকলে হয়তো পড়ে যাবো। গাড়ির দরজা খুলে রেখেছি ফ্রেশ বাতাসের জন্য। মিল্টন এতোক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল, চোখ তুলে আমার দিকে তাকানোর ইচ্ছা যেন তার নেই।
কয়েক কদম এগিয়ে এসে একটু ঝুঁকে পড়ে মিল্টন নিচু গলায় যদিও তার সব কথাই নিচু গলায় বলে, ‘একটা কথা বলবো স্যার, কিছু মনে করবেন না তো?’
আমি ইশারায় অনুমতি দিলাম।
‘যারা সদ্য প্রেমে পড়েছে তারা এখানে জোছনা রাতে হাসনাহেনার গন্ধ পায়, আপনি প্রেমে পড়েছেন, যেহেতু রাতে বাগানে চলে গেছেন সুবাসের টানে আপনার প্রেম অনেক গভীর স্যার’ এই বলে মিল্টন একটা হাসি দিল। এই হাসির মানে হলো সে অনেক গুঢ় একটা রহস্য উদঘাটন করেছে এই মাত্র, জটিল রহস্য উদঘাটনের সুখ তার চোখে মুখে। আমার মনে হচ্ছে গাড়ি থেকে নেমে মিল্টনের গালে কষে একটা থাপ্পড় মেরে আসি। নিজেকে সংযত করে মনে মনে ভাবলাম মিল্টনের মাথায় ছিট্ আছে, কারো কারো মাথার ছিট্ শুরুতে বুঝা যায় না।
গাড়ি আস্তে আস্তে চলতে লাগলো। মিল্টনের উডভট কথা, বিগত তিন রাতের ঘটনা এসব ভাবতে ভাবতে একবার মনে হলো, আমার মাথায় গণ্ডগোল দেখা যায়নি তো। ক্লান্তিতে তন্দ্রার মতো এসে যায়। হঠাৎ চোখের সামনে সামিনার মুখটা ভেসে উঠে, ধীর পায়ে সে এসে আমার কাঁধে হাত রাখে। তার ঘাড় অবধি ছোট চুল, কপালে বড় টিপ, গলায় মেটালের গয়না, লম্বা হাতাওয়ালা সবুজ ব্লাউজের সঙ্গে লাল শাড়ী, চোখে চশমা, ঠোঁটে হালকা বাদামী রঙের লিপস্টিক। আমি এভাবে তাকিয়ে আছি কেন তার দিকে নির্লজ্জের মতো? সামিনা আমার বউয়ের মামাতো বোন। গত তিন মাস থেকে আমাদের বাসায় আসা যাওয়া করছে, বউয়ের সঙ্গে কি একটা বিশেষ কাজে। আমার সঙ্গে তেমন একটা দেখা সাক্ষাত হয় না। দেখা হলে দুলাভাই দুলাভাই বলে মুখে ফেনা তুলে সেরকমও নয়।
গাড়ির মৃদু ঝাঁকুনিতে তন্দ্রা কেটে গেলে সামিনাও অদৃশ্য হয়ে যায়। ঠাণ্ডা বাতাসের জন্য গ্লাস নামিয়ে দিই। গাছপালা পিছনে ফেলে গাড়ি ছুটে চলছে, হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে। তখন মিল্টনের কথা মনে পড়ল- ‘আপনার প্রেমটা গভীর স্যার।’
এখন মনে হচ্ছে হাসনাহেনার ঘ্রাণটা আবার পাওয়া গেলে মন্দ হতো না।
সাবিনা পারভীন লীনা : কবি ও কথাশিল্পী।
খুব ভালো লাগলো
❤️
Keep it up……..