মধ্যরাতের অ্যাম্বুলেন্স ।। কাজী জহিরুল ইসলাম ।। পুবাকাশ
নতুন বছর শুরু হয় একটি দুঃসংবাদ দিয়ে। আমরা করোনায় আক্রান্ত। ১৪ জানুয়ারি সকালে সব স্বাভাবিক লাগছিল। বুঝি সব ঠিক হয়ে গেছে,আবার আমরা আগের মতো বিকেলে পার্কে হাঁটতে যাবো, নানান দেশের খাবার রান্না করবো, লিখব। ১৯ তারিখ রাতে আমার স্ত্রী মুক্তির প্রেশার বেড়ে যায়। কয়েক ঘন্টার মধ্যে তা বাড়তে বাড়তে আকাশে ছোঁয়। ৯১১-এ ফোন করি। কুড়ি মিনিটের মধ্যেই ওরা চলে আসে। মুখে স্প্রে করে,প্রেশারের অষুধ দেয় কিন্তু কিছুতেই নামছে না। বরং আরও বেড়ে যাচ্ছে। লাল অ্যাম্বুলেন্সটি ওকে মধ্যরাতে নিয়ে গেল…
মুক্তি ফিরে এসেছে। এখনও প্রেশার পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি তবে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। অ্যাম্বুলেন্সটি চলে যাবার পর আমি ক্রমাগত লিখতে থাকি আমার হৃদয়ের অনুভূতি। সেই অনুভূতিগুলোই এই কবিতাগুচ্ছ।
১.
রাত এখন আড়াইটা,
লাল রঙের একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে দরোজায় দাঁড়িয়েছে।
লোকালয়ে আলো ও শব্দের ভীতি ছড়িয়ে তোমাকে নিয়ে গেল।
ওরা নাকি তোমার নরোম হৃদয়টাকে
যন্ত্রের নিচে রেখে খুঁজে দেখবে ওখানে কেন এতো
উথাল-পাতাল ঢেউ।
কিন্তু হায় ওরা তো জানে না
হৃদয়টা তুমি বাড়িতে রেখে গেছ?
২.
ফোন ধরছো না কেন?
উৎকন্ঠায় ঘামছি আমি। প্রেশার কী নামেনি এখনও?
অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে আসা দুজন দশাসই প্যারামেডিক
তোমার হাতে ক্রমাগত সুঁই ফুটিয়েও শিরা খুঁজে পাচ্ছে না।
আমি তোমার কবোষ্ণ ডান বাহু ধরে বসে আছি।
তুমি চুপ করে আছো,
মুখে যন্ত্রণার কোনো অভিব্যক্তি নেই।
আমি জানি যন্ত্রণা লুকোবার কী অসাধারণ ক্ষমতা তোমার।
ক্রমাগত সুঁই ফোটানোর যন্ত্রণা
কিছুতেই আমাকে দেখতে দেবে না।
সুইয়ের যন্ত্রণা নেবে, নেবে না আমার কান্না, এতোটাই নিষ্ঠুর তুমি।
৩.
সেলফোনের নীলাভ বাতি জ্বলে ওঠে।
আমি বাথরুমে যাচ্ছিলাম,
শিকারি চিলের মতো এসে ছোঁ মেরে ফোন তুলে নিই।
তুমি এখনও ঘুমাওনি? রাত সাড়ে তিনটা বাজে,
ঘুমাও প্লিজ…বাচ্চারা কেমন আছে?
তখনও তুমি বাচ্চাদের কথা, আমার কথা ভাবছ।
তোমার কথা বলো, প্রেশার কমেছে?
হ্যাঁ কমেছে
কত এখন?
১৫৫।
সেও তো অনেক।
কমে যাবে, চিন্তা করো না। ওরা এখন আমার
হৃদয় নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।
কী সাংঘাতিক!
তুমি হেসে উঠলে।
ওটা তোমারই আছে, অন্য কেউ ওতে আঁচড় বসাতে পারবে না।
৪.
উইনথর্প হাসপাতালের শুভ্র বিছানা এখন উজ্জ্বল,
পুরো হাসপাতাল আলোকিত।
আমি জানি তোমার মঙ্গলময় উপস্থিতি
সুস্থ করে তুলবে সব রোগী।
আবারও তোমার ফোন।
এই শোনো
বলো
একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো প্লিজ, আমাকে নিয়ে
একদম চিন্তা করো না, I am in good hands.
আচ্ছা।
ঘুমাবে তো?
হ্যাঁ ঘুমাবো।
আর শোনো, ফেইসবুকে কোনো স্ট্যাটাস দিও না,
আম্মা জানতে পারলে খুব ভেঙে পড়বে।
আচ্ছা দেবো না। এখনও কি ইমার্জেন্সিতে?
হ্যাঁ, ইমার্জেন্সি ইউনিটের একটি রুমে আছি। এখানে আমিই একা।
তাহলে ওদের বলো যেনো তোমাকে একটু
ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা করে। গত দু’রাত তো একদম ঘুমাওনি।
আচ্ছা বলবো, এবার তুমি লক্ষী ছেলের মতো শুয়ে পড়ো।
৫.
রাত এখন চারটা। আসলে ভোর।
পাশের রুমে জল ঘুমাচ্ছে, পরের ঘরে নভো।
ওদের নিঃশ্বাসের শব্দ পাচ্ছি।
জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে।
আড়মোড়া ভাঙছে জল।
ও কী টের পেয়ে গেছে, মা হাসপাতালে?
ওর অদ্ভুত এক ক্ষমতা আছে।
যে দিনগুলোতে স্কুলে যেত, করোনা আসার আগে,
মাঝে মাঝে খুব দেরী করে ঘুম থেকে উঠত মেয়েটা।
আমরা তো অস্থির হয়ে পড়তাম,
আজ বুঝি স্কুল বাস এসে ফিরেই যাবে।
কিন্তু ঠিক ঠিক ওই দিনগুলোতে স্কুলবাস দেরী করে আসত।
কী করে ও বুঝত?
ওর বিছানায় আড়মোড়া ভাঙার শব্দ।
ঠিক তখনই আবার তোমার ফোন।
বাচ্চাদের দিকে খেয়াল রেখো,
কী করছে ওরা?
ডার্লিং, এখন রাত চারটা, ওরা তো ঘুমুচ্ছে।
ও, আমি ভেবেছি, সকাল হয়ে গেছে। তুমি ঘুমাওনি?
আমি মিথ্যে বলি,
হ্যাঁ ঘুমুচ্ছিলাম তো, তোমার ফোন পেয়ে উঠলাম।
তুমি হাসো,
আমি কি ভুলে গেছি তোমার ফোন মিউট করা থাকে?
এবার একটু ঘুমাও প্লিজ।
দুজন অসুস্থ হলে কী আমাদের চলবে, এই বিদেশ বিভুঁইয়ে?
একদম চলবে না।
জলের ঘরে পায়ের শব্দ।
৬.
আজও সময়ের নিয়মে সকাল হয়েছে,
কিন্তু কোথাও সূর্য ওঠেনি।
খুব অন্ধকার, ঘন এবং অনিশ্চিত।
ভয়ানক অন্ধকারে ডুবে আছে হলিসউড।
তুমিহীন এ লোকালয় অন্ধকারে ডুবে থাকবে এ-ই তো স্বাভাবিক।
অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে বেডসাইড টেবিলের নব ঘোরাই,
টেবিলল্যাম্প জ্বলে ওঠে।
খাটের দুপাশে দুটি বেডসাইড টেবিল।
ওদের আলোকিত করবে বলে
একজোড়া সুদৃশ্য টেবিলল্যাম্প কিনে এনেছিলে তুমি,
এই তো সেদিনের কথা,
অথচ দেখো ছ’বছর পার হয়ে গেছে।
আজকের এই অন্ধকার সকালও জীবনের গ্রন্থ থেকে মুছে যাবে,
একটি উজ্জ্বল গ্রন্থ আমরা দুজন
পাশাপাশি বসে পাঠ করবো আরো বহুদিন।
৭.
আমি ফোন আনমিউট করে রেখেছি।
কিছুতেই তোমার কল বা টেক্সট মিস করতে পারবো না।
টুং করে একটি শব্দ হয়।
তোমার টেক্সট?
না, ফেইসবুকে কমেন্ট করেছে আহমেদ জামিল।
মজিবুর রহমান দিলু করোনায় মারা গেছেন,
এই বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতি
শ্রদ্ধা জানিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম কাল রাতে।
জামিল ভাই তার স্মৃতির আবেগ ঢেলেছেন।
অনেকগুলো কমেন্ট এসেছে, আগে পড়া হয়নি।
দিলু ভাইয়ের বড় ভাই, আমাদের খুব কাছের মানুষ,
কবি মেহরাব রহমান ধন্যবাদ জানিয়ে মন্তব্য করেছেন,
সেখানে হৃদয়ের লাল রক্তের স্রোতধারা।
আবারো টুং,
এবার তোমার টেক্সট।
টুং, টুং, বেশ ক’বার।
প্রেশার কমেছে, ইকেজি নর্মাল। একদম চিন্তা করো না,
আই লাভ ইউ জান। কন্যাদের বলো, ওদের খুব মিস করছি।
ওদের দিকে খেয়াল রেখো।
আমার চোখ থেকে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে সেল্যুলার-স্ক্রিনে।
নুনের ভালোবাসায় ঝাপসা হয়ে যায় তোমার লেখাগুলো।
৮.
অন্ধকারের ভেতরে কেউ কী ছিটিয়ে দিয়েছে
আলোর উজ্জ্বল থুতু?
ভোরের আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে বসন্তের শুভ্র ম্যাগনোলিয়া।
বাগানের ঘাস, গাড়ির ছাদ, প্যাটিওর লাল ইট,
নিজেদের ভয়ঙ্কর অন্ধকার ঢেকে ফেলেছে তুষারের শুভ্র পাপড়িতে।
তুমুল আলোর বৃষ্টি হোক আজ পৃথিবীতে,
ধুয়ে যাক সব অন্ধকার।
৯.
এখন সকাল এগারোটা।
ব্লাইন্ডের ফাঁক দিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে অগ্নিপুষ্পঝাঁক।
ওরা ওক কাঠের ফ্লোরের ওপর
হাসতে হাসতে লুটোপুটি খায়,
একে অন্যের ওপর গড়িয়ে পড়ে ব্লাইন্ডের দুলুনি লেগে, অনিচ্ছায়।
আলোর একটি অত্যুজ্জ্বল পুষ্প তখন পাপড়ি মেলে সেলফোনের স্ক্রিনে।
উড়ে যাবার আগেই ওকে ধরে ফেলি।
একদম ভয় পেওনা,
আমাকে এখন কার্ডিয়াক ইউনিটে এনেছে।
রক্তের সব রিপোর্ট ভালো, শুধু পটাশিয়ামটা নেমে গেছে,
আচ্ছা পটাশিয়াম কমে গেলে কি হয়?
ছেলেরা পাগল হয়, আর মেয়েরা হয় রোমান্টিক।
হি হি হি।
আমি টেলিফোনের এপাশ থেকে বুঝতে পারি,
হাসিতে গভীর ক্লান্তি, যেন কত সহস্র রাতের অনিদ্রা সেখানে ভর করে আছে।
আর কিছু বলেছে ডাক্তার?
আল্ট্রাসাউন্ড করাবে, এরপর সিদ্ধান্ত নেবে কখন বাড়ি ফিরবো।
বাড়ি কথাটি তুমি এমনভাবে উচ্চারণ করলে
যেন কত যুগের নির্বাসনে তা ভারী…
১০.
এখন আকাশে ঝকঝকে রোদ,
তুষারের মিহি দানাগুলো কর্পুরের মতো মিইয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ পরেই রচিত হবে নতুন ইতিহাস,
এক হার্মাদের হাত থেকে মুক্ত হবে
পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর জাতি।
ক্যাপিটল হিলে লেডি গাগা গাইবে, ‘ও সে
ক্যান ইউ সি, বাই দ্য ডন’স আর্লি লাইট…’
জেনিফার লোপেজের কণ্ঠে কেঁপে উঠবে
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র।
স্পেনিশ নারীর কণ্ঠনালী ছিঁড়ে যখন ঝড় উঠবে,
‘দিস ল্যান্ড ইজ ইওর ল্যান্ড, দিস ল্যান্ড ইজ মাই ল্যান্ড’
আনন্দাশ্রুর বৃষ্টিপাতে তখন শুদ্ধ হবে ক্যাপিটল হিল।
কথা ছিল দুজন পাশাপাশি বসে
পরস্পরের হাতে হাত রেখে দেখবো মানুষের বিজয়…
কথা রাখোনি তুমি,
প্রতিজ্ঞা করেছি, দেখবো না,
আমিও দেখবো না একুশের এই বর্ণাঢ্য শো
আমি জানি, তুমি এখন হাসপাতালের শুভ্র বিছানায় শুয়ে
আমার জন্য রচনা করছ অন্য এক বিজয়,
আমি সেই বিজয়ের স্বাদ আস্বাদনের জন্য প্রতীক্ষায় থাকব।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২০ জানুয়ারি ২০২১।
কাজী জহিরুল ইসলাম : কবি-প্রাবন্ধিক ও কথাশিল্পী ।