ঘৃণা।। রওশন রুবী।। পুবাকাশ
জ্বরের ঘোরে আবল তাবল বকছে পুলক। গতপরশু পর দুনিয়ার খবর নেই। কেউ একজন এক বোতল পানি রেখে গেছে চৌকির পাশে টুলে। পুলক গলা শুকিয়ে যখন কাশি উঠে তখন একটু পানি খেয়ে নেয়। গরম গরম চা খেতে পারলে ভালো লাগতো। রুমের সবাই কাজে চলে গেছে। ঘুম জমে উঠেছিল। টেরপায়নি ওদের ছোঁয়ায় সকালের প্রকৃতি চঞ্চলতা। রাতের আগে তেমন কেউ ফিরবে না। রাতে ফিরেও তারা ক্লান্ত থাকে। একটু চায়ের কথা কাউকে বলারও ফুসরত পাওয়া যাবে না। কয়েকবার দোকানে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতে চেয়েছে পারেনি। শরীরটা দূর্বল হয়ে পড়েছে সাথে প্রচণ্ড ব্যথা।
ভ্যাপসা গরম আর জ¦রের প্রকোপে দম আটকে আসছে। বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে দিনের তীব্র আলো ঘরে ঢুকে পড়ছে। ভালো লাগছে সেই আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে তার। ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। সকালে এমন আলোকে ছুরি দিয়ে কেটেকুটে একাকার করতো। আলো যে কাটা যায় না তা বিশ্বাসই করতো না পুলক। সে ভাবতো তার কাটা আলোগুলো সূর্য দেবতা নিয়ে নিচ্ছেন এবং পরদিন ফিরিয়ে দিবেন।
একদিন তার মা তাকে বুঝিয়ে ছিল এটা তার ভুল। আলো হচ্ছে সূর্যের বিকিরণ। যা কেটে কুটে পৃথক করার কোন উপায় নেই। ধীরে ধীরে বড় হতে হতে পুলক অনুভব করেছে কথাটি সত্য। এও অনুভব করেছে আলো তার মা রমা বিশ্বাস। যিনি শত দুর্দশায়ও মুখে হাসি ফুটিয়ে কিরণ ছড়ান সংসারে।
মায়ের ফোন এসেছিল জ্বর আসবার দু’দিন আগে। বলেছেন,
-বাবা পূরবীর কাজের জায়গা ভালো পড়েনি। মালিক জালিম। খারাপ আচরণ করে ওর সাথে। তাই সে কাজ ছেড়ে চলে এসেছে। কমল সোনার দোকানে কাজ করতে গিয়ে আগুনের ফুলকি এসে চোখে পড়েছে। অবস্থা তেমন ভালো নয়। ডাক্তার বলেছেন, ঐ চোখে আর দেখতে পাবে না। মনে হয় তোর বাবার মতোই হয়েছে। আমি বোকা মানুষ অতশত বুঝি না। দু’জন এক চোখা মানুষ নিয়ে বড় বিপাকে আছি।
পুলক আনমনা হয়ে গিয়েছিল খবরটি শুনে। তবু মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল,
-মা, তুমি অত ভেব না। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমিই বলেছিলে নদীর এপাড় ভাঙে ওপাড় গড়ে। মানুষের এক জীবন নদীর এপাড়, অন্যজীবন ওপাড়। এখন আমাদের তাই চলছে। তোমার বড় ছেলে থাকতে তোমার চিন্তা কী? টাকা পয়সা কমে এসেছে বুঝি?
– সে আর বলতে ! অভাবি মানুষের টাকার পাহাড় না হলে অভাব দূর হয়?
-ঠিক আছে মা, তুমি ওসব নিয়ে ভেব না। শরীরের দিকে দেখ। তুমি না থাকলে কে ভালোবাসবে আমাদের? আমি কিছু যোগাড় করেই তোমাকে ফোন করবো।
মাকে বললো ঠিকই কিছু যোগাড় করবে পুলক। আজ দু’দিন পার হচ্ছে। কিন্তু টাকা যোগাড় করা কি চাট্টিখানি কথা? ইটের ভাটায় ছয় মাসের শ্রম বিক্রি করে অগ্রিম টাকা নিয়েছে। ছ’মাস শেষ হতে এখনো একমাস উনিশ দিন বাকি। এখন মালিককে কিছু বললে বলবে,
“আমি দানশালা খুলে বসেছি? তোরা আজ এটা, কাল ওটা অজুহাতে হাত পাতিস? এসব উছিলা বের করলে সোজা ছাটাই করে দিবো।”
বিপদ হবে সত্যি সত্যি তিনি সাহায্য না করলে। যতই ভয় লাগুক; বলতে হবে তবু তাকেই। তাই রাত আটটা কাজ শেষে মালিকের কাছে যায়। যারা শ্রম বিক্রি করেনি সবাই মজুরি নিয়ে চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো পুলক।
অবশেষে মালিক বোরহাদ উদ্দিন পুলকের কাছে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জানতে চাইলেন। সে যতটা সম্ভব গুছিয়ে বলে সবটুকু। সব শুনে বোরহান উদ্দিন আরাম কেদারায় আরো আরাম করে বসলেন। বন্ধ চোখের পাতায় দু’হাতের চার আঙুল চেপে ধরলেন। তারপর বললেন,
-তুই বিশ্বস্ত ছেলে। বছর তিনেক হলো এখানে কাজ করছিস্। কখনো দূর্নীতি দেখিনি তোর মধ্যে। অবিশ্বাসের কাজও করিসনি। তাই তোকে বিশ্বাস করতেই পারি। তবে একসাথে বেশি দিতে পারবো না। হাজার দুয়েক নিস্। পরের ছ’মাস শুরু হলে বাকিটা পাবি।
পুলক কাচুমাচু করে হাত কচলে বিনয়ের সাথে বলে,
-উপকার যখন করবেন আরো কিছু বাড়িয়ে দিন দাদাই।
বোরহান উদ্দিনের চেয়ারের দোলন থেমে গেল পুলকের কথায়। তিনি তার ঠাণ্ড চাহনী পুলকের মুখের উপর ফেললেন। সে চাহনীর দিকে তাকিয়ে পুলকের অন্তরাত্মা হীম হয়ে গেল। কিছু না বলে তিনি আবার চোখ বন্ধ করলেন। পুলক তদ্রুপ দাঁড়িয়ে থাকলো আর মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকলো।
আরাম কেদারার ক্যাচ ক্যাচ শব্দ চাপিয়ে তিনটে গাড়ি এসে থামলো। কয়েকজন লোকের কথাবার্তা শোনা গেল। তবে মৃয়মান। বোঝা যায় না কিছু। বোরহান উদ্দিনের চেয়ারের গতি বাড়লো। লোকগুলো ঘরে এসে ঢুকে ছড়িয়ে দাঁড়ালো। ওদের মধ্যে একজন বোরহান উদ্দিনের কানের কাছে ফিস্ ফিস্ করে কিছু বললো। তিনি চেয়ার রেখে দাঁড়ালেন এবং পুলককে বললেন,
-পুলক তোর উপর ভগবানের আর্শীবাদ আছে’রে। একটা কাজের খবর এসেছে যে করবে সে তার বিনিময়ে পাঁচ হাজার টাকা পাবে। যদি তুই চাস্ তবে করতে পারিস্। করবি?
-কি কাজ দাদাই?
-তুই রাজি থাকলে যেতে যেতে বলি?
একরাতে পাঁচ হাজার টাকা! পুলকের টাকা চাই। সে গড়িমসি না করে বলল,
-চলেন!
যেতে যেতে তিনি আর কাজের কথা কিছু বললেন না। কতদূর এলো কে জানে। প্রায় পোনে একঘন্টার মতো সময় তারা গাড়িতে। একেতো গ্রামের রাস্তা, তার উপর আকাশে ঘন মেঘ। চাঁদের আলোর প্রভাবও নেই। তাই পথঘাট চেনা যাচ্ছে না। এক সময় একটি বাড়ির সামনে গাড়ি থামলো। সবার সাথে পুলকও নেমে ভেতরের দিকে এগুলো।
ভেতরে উজ্জ্বল আলোময় একটি রুমের মাঝে সুদৃশ্য চেয়ারে বসে আছেন একজন মানুষ। তার মুখের তুলনায় নাক চ্যাপ্টা, চোখগুলো হাতির দেহের মধ্যে চোখ যেমন তেমনি ছোট। ভুড়িটা নড়ে উঠে কথা বললেই। তার সামনে লম্বা টেবিলে থরে থরে সাজানো রঙ পানীয়।
তিনি মুখ খুললেন,
– কাকে এনেছো?
বোরহান উদ্দিন আঙুল তুলে পুলককে দেখালো।
তিনি ভালো ভাবে আরো কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে হাত ইশারায় অন্যদের চলে যেতে বললেন। যেমন এসেছিল তেমনি সবাই চলে গেল। থেকে গেলেন বোরহান উদ্দিন ও পুলক।
তারা দুজন ড্রিঙ্কস্ করা শুরু করলো। কিন্তু পুলকের কি কাজ বুঝিয়ে দিল না। রাত গভীর হচ্ছে। ওদের মাতলামি বাড়ছে। পুলকের আর ভালো লাগছে না। সে চলে যেতে চায়। কিন্তু পথ চিনতে পারবে না। কতদূর, কোথায় গিয়েছে তারা কে জানে। ওদের কথাবার্তায় বোঝা গেছে লোকটি প্রতিমাসে একবার আসে এখানে। এই লোকটিই প্রকৃত মালিক ইটের ভাটার; বোরহান উদ্দিন নয়। লোকটির কি জানি কি ব্যামো আছে। সেই ব্যামো তাড়া করলেই সে বোরহান উদ্দিনের আশ্রয়ে ছুটে আসে। বোরহান উদ্দিন ছাড়া তার এই রোগের ঔষধ কেউ দিতে পারে না।
এতক্ষণ কাজের অপেক্ষা করতে করতে পুলক রুমের এক কোণে সোফার পাশে মেঝেতে বসে ঝিমোচ্ছিল। সুস্বাদু খাবার ভর্তি ট্রে ওর সামনে দিয়ে গেল একজন। লোকটি সেখানে খাবার রেখে যেতে যেতে বলল,
-খাবার খেয়ে নাও।
ঝিমুনি ধরা চোখ খুলে পুলক দেখল, লোকটিকেকেমন বিমর্ষ ও ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। তিনি নিচু গলায় স্নেহের সুরে ফের বললেন,
-খেয়ে নাও সোনা।
পুলকের খিদে পেয়েছে। সে অনেক খাবার গ্রো-গ্রাসে খেয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসে রইল। খাবার দেওয়া লোকটি এসে ট্রে’টি নিয়ে গেল।
খাবার খেয়ে চোখ জড়িয়ে আসছিল পুলকের। সে সময় সে লক্ষ্য করে তাকে চারজন লোক চেপে ধরে হাত পা বেঁধে ফেলছে। সে চিৎকার করে বোরহান উদ্দিনকে ডাকে দাদাই! দাদাই! দা-দা-ই! দা-দা-ই!
বোরহান উদ্দিন আর ঐ লোকটির ঘর ফাটানো হাসি শোনা যায়। তারপর পরই চাবুকের শপাং শপাং শব্দ আর পুলকের আর্তচিৎকারে জ্ঞান হারানো পর্যন্ত সে বাড়ির বাতাস কাঁপে। বিলাপ করে দেয়ালের ইট, কাঠ, সুরকি, সিমেন্ট। একজন শ্রমিকের রক্তে ভেসে যেতে থাকে রাক্ষুসে মানুষের নখর। এর সাথে চলে পাশবিক নির্যতন। পুলকের ঘৃণার থুথু পশুর মুখে ছিটাতেও ঘৃণা করে।
কে কখন ক্লান্ত হয়েছে কেউ জানে না। আগে পুলক না রাক্ষোস? কেবা কখন পুলককে তার ঘরে এনে ফেলে গেছে এও জানে না পুলক। শুধু এক অমানবিকের আত্মতৃপ্তির কিছু শব্দ তার কান জুড়ে খেলা করে,
“ঔষধ জব্বর আনছো বোরহান উদ্দিন! এর জন্য তোমারও পুরস্কার আছে।” এই শব্দ অজস্র মৌমাছির হয়ে কানের ভেতর দিয়ে মগজ খেয়ে ফেলছে পুলকের। সে চিৎকার করে। কিন্ত তার গলা দিয়ে স্বর বেরুয় না।
সকালে রুমমেটরা ঔষধের বড় প্যাকেট দেখিয়ে বলেছিল,
-বাহ্! বেশ খাতির যত্ন পাচ্ছে আমাদের পুলক। তা কি হয়েছিলরে? বলিস ফিরে এলে।
সেই থেকে আজ তিনদিন। ব্যথা কিছু কমেনি শরীরের। কথা বলার মতোও হয়নি তার অবস্থা। শরীর ভালো হলে কাজে ইস্তফা দিবে সে। শ্রমিক বলে পদে পদে শোষিত, শাসিত হবে তারা? শহরে গিয়ে শ্রমিকদের লিডার এনায়েত ভাইকে সব খুলে বলবে। তারাই তার ভরসা। নিশ্চয় তিনি এর একটা বিহিত করবেন। ঐ কুৎসিত কদাকার লোক আরো কতো জনকে এভাবে দিনের পর দিন আহত করে করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে কে জানে? আর কতো অত্যাচারিত হবে তারা? একবার তো জ্বলে উঠতেই হবে। কাজ করিয়ে একদিকে ন্যায্য মজুরি দিবে না, অন্যদিকে জুলুম অত্যাচার! রক্তচোষার দল আর কত রক্তচুষবে?
এসব ভাবতে ভাবতে সে দূর্বল শরীর নিয়ে উঠে। টিনের ভেজানো দরজাটি খুলে দেয়। দরজা দিয়ে বাতাস ঢুকছে। প্রাণ ভরে শ্বাস নেয় সে। বাহিরের দিকে দেখে খোলা দরজা দিয়ে। ইটের ভাটায় কাজরত অসংখ্য শ্রমিকদের দেখা যাচ্ছে। কেউ অবসর নেই। দু’হাতে কাজ তাদের। ওরা অনেকেই তার মতো ছ’মাসের শ্রম বিক্রি করে দিয়েছে ।
এসময় পুলক দেখে কাঠফাটা রোদ কেটে কেটে বোরহান উদ্দিন এগিয়ে আসছে। পুলকের ঘেন্না হলো খুব। তার দূর্বল শরীর শক্ত হয়ে উঠলো। সে সমস্ত শক্তি দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
বোরহান উদ্দিন কাছে এসে রহস্যময় হাসলো এবং তার পকেট থেকে টাকা বের করে পুলকের হাতে দিতে দিতে বললো,
-এক রাতে পাঁচ হাজার টাকা কামাতে হলে ধকল তো সইতেই হবে বাপ। অমন ক্ষেপে থাকলে চলবে? আজ মে দিবস। তোদের জন্য জ্বালাময়ী মিছিল মিটিং হচ্ছে। চল যাবি নাকি প্রতিবাদ করতে? আমাকে প্রধান অতিথি রেখেছে এক অনুষ্ঠানে। তুই শ্রমিকদের পক্ষে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দিবি!
পুলকের ঘেন্নায় গা পুড়ে যায়। সে একদলা থুথু ছিটায় পিচাশের মুখে। আর মনে মনে বলে,
-পৃথিবীর সব শ্রমিক একদিন এক পতাকা তলে দাঁড়াবে। শোষণ কারির পতন হবেই হবে।
রওশন রুবী: কবি ও কথাশিল্পী।
বেশ ভালো লাগলো
আন্তরিক ধন্যবাদ সুহৃদ