গল্প


নিজের সাড়ে তিনহাত


রিজোয়ান মাহমুদ


পুবাকাশ


সে মুহূর্তে ভাবে মায়া মমতা নিয়ে তার এতখানি বিভ্রম তৈরি হলো কেন!! হঠাৎ ছোট ছেলের ডাকে সে সম্বিৎ ফিরে পায়। ছোট ছেলে মৃদুস্বরে বলে মা ‘ তোমাকে ডাকছে চল। অতঃপর দু’জনে দু-হাত ধরে কবরস্থানের বাইরে ঠেলতে থাকে, তাদের বাবাকে।

মামুন সাহেব হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেল। এঘর ওঘর, পুরনো বাড়ি নতুন বাড়ি, কোথাও নেই। বাসার সামনে ঔষধের দোকানে সেখানেও নেই।  কখনো এরকমটা হয়নি। অবস্থাদৃষ্টে শান্তশিষ্ট সুবেশধারী মিষ্টভাষী এবং কিছুটা বদরাগী অস্থির মানুষটা সর্বদা ঘরের এক কামরা এবং কামরা লাগোয়া এক চিলতে বারান্দায় সময় কাটাতো। কখনো গান শোনা , কখনোবা লেখাপড়া সিনেমা দেখে দিনের অধিকাংশ সময় পার করা এটাই বলতে গেলে নিত্যদিনের রুটিন কাজ। এই তো সেদিন অফিস কামাই করে ভরদুপুরে সিনেমা দেখতে বসে গেলো। ভিত্তোরিও ডি সিকার দ্য বাইসাইকেল থিফ ” কয়েকবারের দেখা সিনেমাগুলো বারবার রিভিও দেখা মামুনের বিরক্তিকর একটা শখ। ভীষণ সাধারণ জীবনের গল্প নিয়ে ঘটনা। সেটি-ই  নিউ রিয়ালিজম চলচ্চিত্রের সূচনার ইতিহাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতালির প্রতিকূল সামাজিক অর্থনৈতিক ও মানস সংকটের কাল। নিরেট উদ্ভুত সংকটাপন্ন আদর্শিক বাস্তবতার ঘনঘটা। এটি হরহামেশা বাংলাদেশের গ্রাম শহরের অলিতে-গলিতে ঘটে। এরচেয়েও মারাত্মকভাবে ঘটে। কিন্তু মামুন এ-সব নিয়ে দিন দিন উতলা হয়ে পড়ছে, বোঝা যায়। ইদানীং রবীন্দ্রনাথের গানের সুরে অস্তিত্বহীনতার সংকট খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার ধারণা রবীন্দ্রনাথের কিছু গানের কথা ও সুরে দু’পায়ে মানুষরা একদিন সর্বস্বান্ত হবে। সাধারণ আরও একটি খবর ; তিনি অর্থাৎ মামুন সাহেব মাস দুয়েক পরে অবসরে যাবেন। সেটিও চিন্তার বিষয় যেন মহাবিশ্ব সংকট।  অথচ তার পরিবারে তেমন কোনো ঝামেলা নেই। মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। ছেলেকে বিয়ে করিয়ে নতুন একটা টুকটুকে বউ নিয়ে এসেছে ঘরে। এরইমধ্যে  খেলার সাথিও জুটেছে। মেয়ের ঘরের নাতনী মেফতা’র সাথে রাতবিরেত ভিডিও কল নিয়ে মেতে থাকে। সাত মাস বয়সী নাতনীর জেস্চার বোঝার চেষ্টা করে মামুন। একদিন ভিডিওতে নাতনীর সাথে হা -হু -হা, না করলে পাগলের মতো আচরণ করে। তা, দেখে পরিবারের অন্যান্য সদস্যারা হাসাহাসি বিরক্তি প্রকাশ করে মাঝেমধ্যে। কিন্তু এতে তিনি বিন্দুবৎ দমেনা। উল্টো পাগলামো  আচরণ আরও  ফড় ফড় করে বাড়তে থাকে। ছোট ছেলে এসব বোঝে তাই বাবাকে বেশি ঘাটাতে চায় না। সে বাবাকে আপাদমস্তক চেনে। আবেগ বোঝারও চেষ্টা করে। ছোট ছেলে আকাশের জন্য মামুন অস্থির থাকে সবসময়। অবসরের পর ছেলের লেখাপড়ার খরচ কতদূর টানতে পারবে, লেখাপড়া আদৌ শেষ করতে পারবে কিনা। এ নিয়ে মন তাকে অস্থির করে তোলে। পক্ষান্তরে, মামুনের স্ত্রী মার্জিনা একদম চিন্তামুক্ত না হলেও স্বামীকে বুঝতে  দেন না অনেক কিছু, পাছে টেনশন করে, সেই ভয়ে। মার্জিনা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক সাহসী, বাস্তবমুখী দয়ার্দ্র চিত্ত এক মহিলা। মামুন সাহেব যখন বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তখন তাদের সংসার তেমন স্বচ্ছল ছিলনা। বিয়ে করার সময় পকেটে এক কানা কপর্দক ছিলনা। পকেটেই বা থাকবে কেন। চাকরি যার নেই বেকার যে, তার পকেট থাকবে এটি উদ্ভট এক কল্পনা। কোর্তা শরীরের এমন এক আবরণ যার এককোণে ছোট্ট একটি পকেটের  জায়গা করে দেয় স্বয়ং কোর্তা।  পকেট পুরুষের অহংকার, পুরুষত্বও বটে। নিজের কামাই করা অর্থের শতাংশ যদি পকেটভর্তি থাকে তো কথা থাকে না। অথচ  ঢুডু ঘুরে বেড়ানো এক যুবক বিয়ে করবে, বর সেজে শ্বশুরবাড়ি যাবে এ – যেন একঘাটে বাঘ মহিষের দেখা হওয়া, খেলা করা। একদিকে ভয় অন্যদিকে রোমাঞ্চ মামুনের যুবক শরীরে বিদ্যুৎ তাপিত হয়েছিল । পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাবার বউ’মা দেখার সখ হয়েছিল, তার ইচ্ছাকে দাম দিতেই বিয়ে করা। বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকায় বিয়ে করা মামুন বিয়ের বছরান্তে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেছিল বেশ কিছু সময়।

মার্জিনা চালচুলোহীন মামুনের সংসারে এসে বিত্ত বৈভব না দেখলেও চিত্ত বৈভব দেখে অবাক হয়েছে। বিস্ময়াভিভূত হয়েছে স্বামীর গানের গলা শোনে । মার্জিনা বাপের বাড়ি নাইয়র গেলে শ্বশুরকুলের বিত্তবৈভব ও কালচারের গপ্পো করতো। শ্বশুর বাড়ি ফিরে এলে নিজের বাপেরবাড়ির গল্পে মেতে থাকতো। এটি একধরনের ম্যানেজিং ক্যাপাসিটি। মামুন বুঝে দুকুল রক্ষার অন্যতম কৌশল। এতো অভাব অনটনের মধ্যে থেকেও মার্জিনা  একচুল পরিমাণ বিচ্যুত হন নি কখনো । নামাজ দোয়া কোরআন তেলওয়াত করে সংসারের সমৃদ্ধিসহ স্বামীর একটি ভালো ও সম্মানজনক চাকরি প্রাপ্তি ছিল মার্জিনার প্রতিদিনকার প্রার্থনার বিষয়।

মামুন মধ্যবিত্ত থেকে মোটামুটি সামাজিক মানের উচ্চমধ্যবিত্তে  প্রমোটেড্ হয়েছে। ভালো মোটা বেতনের চাকরিসহ গাড়ি -বাড়িও করেছে। তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে মামুনের স্ত্রী খুবই খুশি। বড় ছেলে নিসর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকে একটি বহুজাতিক বিদেশী কোম্পানিতে চাকরিরত। মেয়েও সুসজ্জিত একটা প্রাইভেট ব্যংকে জব করছে। ছোট ছেলে ইকনমিকস ও ব্যাংকিং বিষয়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। বড় ছেলের বউ ঘরে বসে নেই, আপাতত একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক।
মামুন সাহেব প্রচণ্ড স্মৃতি বিধুর একজন মানুষ।  সুখের মধ্যেও দুঃখের চাষাবাদ করেন। তবে, কেউ কেউ এমনতর আচরণকে দুঃখবিলাসী বল্লেও, সে গায়ে মাখে না।

কষ্ট কোথা থেকে উদগত হয়, যে অনুভব করে সেই কেবল বোঝে।  ইদানিং শুইয়ে বসে আল্লামা জালাল উদ্দিন রুমী, শামস তাবরিজি, তুরস্কের ইউনুচ এমেরে, গ্রিসের সাফো নিয়ে ব্যস্ত দিনক্ষণ পার করছে। এসব মরমি সাধক কবিরা মন- প্রাণ প্রায় উতলা করে রাখে। জীবন ও জগৎ, রূপরস, বৈচিত্র্য, মানুষের উদ্ভব ও বিকাশ মোহগ্রস্ত করে রাখে তাকে। মামুন পৃথিবীতে আরও কিছু বছর বাঁচতে চায়। মানুষের যতই বয়স বাড়ে ততই শিশু হতে থাকে।

স্নিগ্ধ দুরন্ত শৈশব ফিরে পেতে চায়। মামুন জেদি একরোখা স্বভাবে, কিন্তু দুর্দান্ত রকমের আত্মপ্রত্যয়ী। অভিনব আকুলতা তাকে সারাক্ষণ ঘিরে মহাকাব্য লিখিয়ে নিতে চায়। এভাবে,রবীন্দ্রদর্শন অলক্ষ্যে তাকে পেয়ে বসেছে কী! মরিতে চাহিনা এই সুন্দর ভূবনে… মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই। মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার স্বপ্ন সেতো এক বিশাল ব্যাপার। কিন্তু মামুনের কী আছে গোটা কয়েক কবিতা গ্রন্থ, প্রবন্ধ ও গল্প ছাড়া, সে কী চাইছে! মামুনের অতৃপ্তি কী লেখালেখিতে নাকি চাকরি বা অন্য কোথাও! এই অপ্রাপ্তি মেলাতে পারেনা কখনোই।

মামুন দীর্ঘদিন থেকে এক অতৃপ্ত দহনে ভুগছে। না পাওয়া লম্বা সংগীতের মর্মর দহন তাকে কাবু করে ফেলছে। ঘরে বসে থেকে শেকড় গজিয়ে ফেলেছে। তার মনে হচ্ছে সে কখনো কারো ছিলনা কেউ তার নয়। এটি শূন্য মানুষ সত্তার নো ফিলজফি, সে। এই তো সে- দিন রাত দুইটা হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। তড়িঘড়ি বিছানা ছেড়ে ওয়াল আলমিরার আয়নার সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। নিজের নাক, চোখ, মুখ, বলিরেখা সবই প্রত্যক্ষ করে। একসময় সে আবিষ্কার করে সে কাঁদছে। লুই ক্যারলের এলিসের প্রতি তার অনির্ণীত মায়া জন্মে যায়। কবে সে এলিস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ড পড়েছিল, মনে নেই। তবু উপন্যাসের কোনো কোনো চরিত্র থাকে তা মন থেকে মুছে যায় না একেবারেই।  এলিস তার নিজের চোখের জলে ভেসে যাওয়াকে সে নিয়তি ভেবে মিলিয়ে নিতে চাইছে তার নিয়তিতে।  কিন্তু এই চিন্তা সূত্রের কোনো গতি করতে পারেনা। আবার  কান্নাকেও পৃথক করতে পারে না।

মামুন জোরেশোরে কোদাল চালিয়ে মাটি খুঁড়ছে। ছুরি দিয়ে আশেপাশের জংগল সাফ করছে। চারিদিকে নীরবপুরের গভীর নীরবতা নেমে এসেছে। মাটি ও জংগল কাটার শব্দ অনেকদূর থেকেও শোনা যায়। দরদর করে ঘাম ঝরছে কপোল থেকে। হাত, মুখ, বুক- ঘামের নোনতা ময়লা জলে একাকার। আচমকা নীরবতা ভেঙে একটি শব্দে মামুনের কোদাল থেমে যায়। শব্দের গতি ও উৎস খোঁজার চেষ্টা করে। গা ছমছম করা ভয়ে এদিক – ওদিক তাকায়! আশেপাশে কোনো মানুষ জনের হদিস দেখেনা। মনের ভুল ভেবে আবারও দু -এক কোপ দিতে আওয়াজটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
– তুমি এখানে এসে এভাবে মাটি তুলছ কেন? নতুন কেউ কি আসবে?
– মামুন হাত মুখ কপালের ঘাম মুছে নির্ভয়ে জবাব দিল, ‘ নিজের জন্য।
-নিজের জন্য মানে! একটি বিস্ময়সূচক প্রশ্ন :
-নিজের জন্য মানে নিজের জন্য। মামুনের একদম দৃঢ় নির্ভীক উত্তর।
মামুন লক্ষ্য করে কোথাও কেউ নেই। কিন্তু এই গায়েবি আওযাজ কোত্থেকে আসছে! এই আওয়াজ কি গোরের আওয়াজ! একবার মায়ের কবরে আরেকবার বাবার কবরে নিজের ডান কান পেতে শব্দটি শুনতে চেষ্টা করে। তার মা কী কথা বলছে!  না বাবা! অত:পর বিড় বিড় করে বলতে শুরু করে পৃথিবীতে এক আশ্চর্য মহামারি শুরু হয়েছে। যার নাম করোনা কোভিড ১৯,  গ্রাম শহর উজাড় হয়ে যাচ্ছে। মৃতের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। মৃত ব্যাক্তির আশেপাশে কেউ থাকে না। গোর দেবার জন্য আত্মীয় সজন আসে না। বাবার মৃত্যু হলে বউ ছেলে মেয়ে কেউ আসে না। এ-ই তো সেদিন এক করোনা আক্রান্ত বাবাকে মৃত্যুর পূর্বে তার ছেলেরা মাঠের এককোণে ফেলে এসেছে। যদি মৃত্যু হয় রাস্তাঘাটে পড়ে থাকব। বিলাই কুত্তা লাশ নিয়ে টানা হ্যঁাচড়া করবে এই আশঙ্কায় নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে নিজের কবর নিজে খুঁড়তে এসেছি।
আবারও গায়েবি জবাব এলো যেন কোত্থেকে!
– পৃথিবীর অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছে! আমরা এখানে যারা আছি তারাও চাই কেয়ামত নামুক এবার। জানো, আমরা যারা দীর্ঘদিন তোমাদের সাথে নেই, এখানে হাঁপিয়ে উঠেছি। বিনা বিচারে আর কতদিন এই গুমোট অন্ধকারে পড়ে থাকব!  কিন্তু তুমি তো মরনি!  নিজের কবর নিজে প্রস্তুত করতে পারে না। শরীয়তের কোনো বিধান নেই, মনে হয়।
– মামুন বলে, “মহামারি  যেভাবে শুরু হয়েছে এ – বিধান অচিরেই বলবৎ হবে। মানুষ-ই নিজের প্রয়োজনে হুকুমমত তামিল করে নেবে ।
মামুনের ঘোর ভাঙে। কানের পাশ দিয়ে সাঁই করে একটি কবরপাখি উড়ে মুহূর্তে কোথাও যেন অদৃশ্য হয়ে যায়। হঠাৎ মামুন শুনতে পায় কোথাও সামান্য শোরগোল। এটি ক্রমশ আরও স্পষ্ট হতে থাকে। খালি পায়ের ধড়াস ধড়াস আওয়াজ ক্রমশ সামনে আসতে থাকে। ইতোমধ্যে, কয়েকজন মানুষ একেবারে কাছাকাছি চলে আসে। মামুন দেখতে পায়, আকাশ ও নিসর্গ। দু’জনের চোখ বেয়ে অঝোরে ঝরছে জল।
– নিসর্গের গলা ফাটানো বিস্মায়াবিষ্ট  জিজ্ঞাসা ! বা… বা আ্যঁ… তুমি এখানে  কী করছ!? মামুন কথাহীন শুকনো পাতার মতো অভিযোগহীন চেয়ে থাকে। সে মুহূর্তে ভাবে মায়া মমতা নিয়ে তার এতখানি বিভ্রম তৈরি হলো কেন!! হঠাৎ ছোট ছেলের ডাকে সে সম্বিৎ ফিরে পায়। ছোট ছেলে মৃদুস্বরে বলে মা ‘ তোমাকে ডাকছে চল। অতঃপর দু’জনে দু-হাত ধরে কবরস্থানের বাইরে ঠেলতে থাকে, তাদের বাবাকে।


রিজোয়ান মাহমুদ : কবি ও সম্পাদক।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন