ফাল্গুন ১৪২৮ পুবাকাশ কবিতা সংখ্যা

ফেরার গল্প 🍂 তমিজ উদদীন লোদী

যখন ফিরি তখন দেখি
অতলছোঁয়া হৃদয়ের ধূসর দুপুর।
অন্ধনদী অন্ধকারে-
হাতড়ে ফিরছে উপচানো জল ও ঢেউ ।

ফিরে দেখি বাউল বিকেল
নিদ্রাহীন ক্ষয়া চাঁদের ফালির মতো একা।
দেখি অজস্র অসংখ্য ভঙ্গুর মুখ
ঝিকিয়ে ওঠা আয়নার ভাঙা কাঁচ ।
দেখি মর্মরিত অরণ্যের ছায়া-ধ্বনি
স্বপ্নের ভেতর থেকে জেগে ওঠা কিংবা ডুবে যাওয়া
পাথুরে অবয়ব
আয়না হয়ে যাওয়া নির্লিপ্ততা, শব্দহীন ব্যাকুল চোখ
অপরাহ্নবেলার সম্মোহন ।

মুখর কিংবা আত্মতায় লীন ধরণের অসংখ্য মানুষ
ধুলোময় শ্মশ্রুময় জটিল জীবন
মুষ্টিবদ্ধ কিংবা আলগা হয়ে আসা মুঠো
প্রত্যয়
হিংসা
রিরংসা কিংবা
যুদ্ধ,রক্ত,করোটি ও হাড়
উপরন্তু টুকরো টুকরো মানুষের মুখ, চোখ তার হয়ে ওঠা
ইত্যাদি নানান পিছুটান উপেক্ষা করে

দাঁড়িয়েছি চেনা নদীটির ধারে, ঋজু । আর
সেই সূর্যদোয়ের আলো এসে লাগছে শরীরে, কপোলে।


 

দু’টি কবিতা 🍂 রিজোয়ান মাহমুদ

কে দেবে প্রহরা

বুননে চেয়েছি কাব্য
তোমাকে পেয়েছি ঘামে
তোমার ঘুঙুরে  ইন্দ্রপুর
দেহের নোলকে থামে।

পা ‘ দুটো ভীষণ চিনি
যেনবা হলুদ-মাখন ও ডিম
মাটির চাষিনী মেঘ রাঁধে
নিশিরাত, নিধুবনে নিম।

কুসুম রসুন রৌদ্র তুমি
যখনি পোহাও মায়া
অন্যমনে পেয়েছি তখন
নিজের-ই গুঁড়ো ছায়া

যদি মন্দারে ভাসাও রাগ
কারা শুনবে বিলীন অনুরাগ
বিষ্ণুনারায়ণে রাগ আশাবরী
রাত্রিকালে বিষণ্ন বেহাগ।

বিবস্ত্র মৃদঙ্গ মধ্যরাত
কবিতা সুফিতে ধরা
বাতাসের দরবারে মীড়
ঝড়োরাত, কে দেবে প্রহরা!

দুপুর ঘুড়ি- ঝরাপাতা

ঝরা পাতার স্তুপ থেকে
দুপুর নেচে ওঠে
এ-সব দেখে না কেউ
সবই বিরূপ
বোন তুই আর আমি বুঝি
সন্ধ্যার স্বরূপ।
বোনেরে কাহিনি বলি,
ঘুড়িওয়ালার,
নাটাইয়ের গুতো খেতে খেতে
জাঁহাবাজ মেঘ অন্তিম সুন্দর
ভেসে যাওয়ার…
মাঞ্জাসুতোর ধারালো ছোবলে আকাশে ঘুড়ি
তেঁ বাঁকা পতনে ধরি – মেঘজালে
কোথাও ডুবে গেছে চর, মন বাড়িঘর
তবুও কাগুজে ঘুড়ি বদভ্যাসে
তোমার টিনের চালে।


 

শব্দ পুড়ে ছাই 🍂 ইউসুফ মুহম্মদ

বহু কিলোমিটারের পথ, অন্ধ—পরিপাটি । নক্ষত্রখচিত চোখের ওপর যে সব দৃশ্য বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে দাও, আমার নির্বোধ মন সে সকল ছায়ার সঙ্গম দেখে পাখিদের মিলন তিথিতে অনেক হেঁটেছে। মা বলছিলেন রিক্সার হুডের সাথে প্রাণ বেঁধে ভিজিও না। যে সমস্ত পাখি রিক্সায় ভিজিয়া ডানা নাড়ে তারা কখনো একক খাঁচায় থাকে না। জানালায় জানালায় ওড়ে, খুদ-কুঁড়া খেয়ে পালিয়ে বেড়ায়। আমার নিজস্ব চাঁদ, তার অতিশয় অন্ধকারগুলো প্রদীপের আলোয় মুড়িয়ে নাজেল হতেই মেঘের দোলায় উক্লা পতনের মত বুকের টোপর খুলে বেরিয়ে আসতো কামসিক্ত বাদাম।
সে সব বোঝাই করে  চাঁদ যায় পরের বাগানে । চাঁদের কলঙ্কগুলো বুকের গহীনে ফেলে রেখে তবু  আমার সমস্ত বৃষ্টি সারাবেলা শুকুতে  দিই প্রখর সুর্যের তাপে। পিপসার্ত দুঠোঁট  ভিজিয়ে রাখি ওই আদি জলে।
চন্দ্রোদয় ও সূর্যাস্তের যে সব গদ্য-পদ্য আমাকে অখণ্ড পান করতে দিয়ে  পাখি ডাল বদল করেছে, সে সবের সাথে হাজার আলোক বর্ষ ধরে পিতামহের নিবিড় যোগসূত্র ছিল। নিয়ন আলোর ছায়া ঘিরে বসে, ওসব প্রাচীন মুগ্ধতা মাথায় নিয়ে আমি গল্প করি। কম্পাসের দাঁত আজো পৌঁছুতে পারেনি পাখি সম্প্রদায়ের ওসব গদ্য ও পদ্যের রহস্যের কোমল কিনারে।
আস্তিনে ফোটেনি ফুল, গ্যালাক্সির স্পর্শ গ্রহণের কালে কে যেন আমাকে তাই গাড়ির চাকায় ছিটে দেয়া কাদার মতই ছুঁড়ে ফেলে। আমি রাস্তায় গড়িয়ে নিজেকেই খুঁজি ঝুলন্ত নূপুরে।
বিকেল গড়ালে প্রজাপতি গান গেয়ে ঘুমের গাড়িতে চড়ে, তারা ভোরাই সুরের সাথে জেগে ওঠে দেখে তাদের আদিম দরজায় শব্দ এক পুড়ে ছাই ঈষৎ অনলে।


 

শব্দের রঙ 🍂 মুজিব রাহমান

ভাষার মাস
শব্দ-চাষ
চলছে

বর্ণে বর্ণে
শব্দ-পুষ্প
ফলছে।

যত্ন কম
আগাছা বেশি
বাড়ছে

কাজের কাজ
কথার কাজী
কাড়ছে।

শব্দের রং
হৃদয়ের জং
তুলছে

শব্দের জোর
হৃদয়ের দোর
খুলছে।

শব্দের সারি
ভাবনার বাড়ি
ঘুরছে

শব্দের ঘুড়িম

নাকাশ জুড়ি

উড়ছে।

শব্দে শব্দে ভরছে আকাশ
শব্দের বল অনন্ত
শব্দের রঙে কীযে রঙিন
ভাষার সকল দিগন্ত!


 

শব্দেরা আসুক 🍂 আরিফ চৌধুরী

দরজাটা খুলে দাও
শব্দেরা আসুক ছুটে ছুটে
সকল বর্ণমালার বাঁধ ভাঙার উচ্ছাসে
শব্দেরা ছুটোছুটি করবে ঘরময়
আলোকিত করে নতুন আলোর জোছনায়
বেলা- অবেলায় আসুক শব্দেরা, তাদের সাহসী ঠিকানায়।
শীত বিকেলের ছায়া হেলে পড়লে
চন্দ্রাহত রাতের জোছনায় শব্দেরা
পাতবে সংসার উঠোন জুড়ে
জোছনায় উঁকি দেয়া চাঁদের সাথে
শব্দেরা করবে মিতালি
হিরন্ময় রাতের সুখে।
খসে পড়া বকুলের মতো,শব্দেরা ঝরতে চায়না
শব্দেরা আসুক আজ
স্মৃতিকাতর একুশের প্রহরবেলায়
স্বপ্নবোনা স্মৃতির মায়ায় শব্দেরা আসবে।
দরজাটা খুলে দাও
সোনালী চাদর বিছানো অপরুপ জোছনায়
শব্দেরা আসবে
আমাদের প্রানের অলিন্দ ছুঁয়ে।


 

সান্ত্বনার সুগন্ধি পাপড়ি 🍂 মহিবুর রহিম

কত প্লাস মাইনাস, মাইনাস প্লাসের জীবন
ধূর্তামীর অভিধান থেকে কাটা পড়ে যায় নাম
বাঁচতে হলেও পাকা খেলোয়াড় অয়ন লাগে
তা নাহলে শান্ত সুবোধ ছেলে, গো টু দ্য পেভেলিয়ন
আমার তো পেভেলিয়নও নেই প্রভু
অসংখ্য ছেঁড়া মর্মাহত উদযাপনের অক্তে
বোল্ড আউটের লাঞ্ছনা নিয়ে হেঁটে যাই
বিদ্রুপের জয়ধ্বনি শুনি চারপাশে
বিখ্যাত যুগের নীতি ছিড়ে খায় রোজ
প্রচেষ্টার ক্ষুদ্র সব আয়োজন। যখন শূন্য হাতে দাঁড়াই
কী আশ্চর্য, তুমি আবার পাঠাও সেই আবাবিল
পাথর নয়, চঞ্চুতে তাদের সান্ত্বনার সুগন্ধি পাপড়ি!


 

বসন্তের আগমনী 🍂 হাফিজুর রহমান

বিড়ালের মতো ভীরু নিঃশব্দ-চরণে
নামছেন তিনি মাটির পৃথিবী-কোলে
মেঘ ও বৃষ্টির যুগল বন্ধন দোলে,
পৃথিবীময় শীত-সঙ্গীত বেনু-বনে ;

মেঘ থমথম আকাশেও নেই নীল
ক্রন্দন বুঝিবা হিমের কন্যার নাম,
বুঝেছে সবাই নেই সেই স্বর্গধাম
তবুও স্বপ্নের সঙ্গীত থামেনা বর্ণিল।

শীতের বিকেলে গিয়েছিলে বেনু-বনে
তাইতো বাতাসে কেঁপেছিল দুটি পাতা
মাথার উপর ভাসছিল মেঘের দুহিতা,
হয়েছিল দ্যাখা প্রকৃতি কন্যার সনে।

হাওয়ায় হাওয়ায় দোলে বৃক্ষ-লতা
হৃদয়ে নাচিছে নতুন দিনের বারতা।

৭ মাঘ, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ


 

ফাগুন আলাপন 🍂 রওশন রুবী

কী করে দূরে যাবে আছে এক কঠিন দোহাই
চাঁদের কলংক থাকে চাঁদেই তোমারে জড়াই
শুনতে চেয়েও তুমি শোননিকো সেই কথা ফের
আঙুলে আঙুলে ধ্বনি ফাগুন বুনে যাই ঢের,

পলাশ শিমুল ফোটে অতঃপর আমাদের ভেতর
বন-ফাগুনে কাঁপায় আহা মন-ফাগুনের স্বর
উল্কা ও ধুমকেতু বিনিময় করে প্রগাঢ়-আবেগ
চাঁদেতে জড়িয়ে যায় জৈবিক-জোছনার বেগ।

আমরা এগিয়ে যাই পেছনে ভুলের কাঁটা
জীবনের সাতকাহন দারুণ-আলাপনে-আঁটা।


 

ইগনিশন 🍂 রওশান হাসান

আমি নীল শাড়ি পরলে আকাশের সঙ্গে সমন্ধ হতে পারে
জেনেছি তোমার কাছে, শুনেছি
নীল শাড়ির আঁচলে তুমি এনে দিতে পারো বিস্তীর্ণ নিঝুম জলধি l
রিনিঝিনি চুড়ির নীলে এনে দিতে পারো বহতা নুড়ির কলধ্বনি
মওসুমে এনে দিতে পারো ইঙ্গিত বদলের ইগনিশন্
মেঘপন্থী মালকোষ গীত এনে দিতে পারো আমার বাঁধনহারা চুলে
লিরিক্ আঙুলে বইয়ে দিতে পারো পাহাড়ী নদীর উপল ঢেউ
ঝুমকো কানে বইয়ে দিতে পারো বাতাসের হুইসপার্
ঠোঁটের সংলাপে শোনাতে পারো পাখিদের ব্যালাড্
চোখে চোখ রেখে মেলাতে পারো অস্ত গোধূলির পলাতকা প্রিজম্ l
তোমার হাতের মুঠোয় বন্দী করতে পারো নীল চাঁদোয়া বন্দেগী রাত
মাটি ছুঁয়ে নেমে আসা আঁধারবিনাশী জড়োয়া নীল জোৎস্নালোকে তোমার অকপট উচ্চারণে
ভালোবাসা ফোটে নীলকান্তমণি
কপালের নীল টিপের অরব স্ফুলিঙ্গে তুমি কি খুঁজে ফেরো তোমার জন্মান্তরের প্রবণ অভিলাষ ?


 

সভ্যতার ঐ পারে 🍂 সৈয়দ আহমদ শামীম

মদুনাঘাট গেলে আমার কীরূপ হয়ে পড়ে
সমস্ত বাজারঘাট ষড়যন্ত্র প্রাসাদ বিকেলের ছায়ার মতো ডুবে যায়
তারপর অপর সভ্যতার বাজার বসে হালদায়
একটি ইঞ্জিন বোট সাম্পানের ভাব ধরে নিঃশব্দে চলে যেতে থাকে ছোটবেলা থেকে যখন তীব্র ঘামের ঘ্রাণ সস্নেহে তাকিয়ে থাকে রমণীর আবক্ষ মাঝার যেথা স্কুল ছুটির শংকায় কিশোরেরা ঝাঁক বেঁধে নিঃসঙ্গ দুপুরে কাঁপতে কাঁপতে হালদার আব্রুর নীড়ে পাখির প্রসবের মতো অগণ্য যন্ত্রণা ভাসিয়ে ভাসিয়ে শেফালীর কণ্ঠ বেয়ে তীরে ফিরে
বিহ্বল সংগীত হয়ে সমাজের আনাচেকানাচে ঘুরে এক তাৎপর্যহীন বাতাস হয়ে বেড়াত
হা, শেফালী ঘোষ
বসালি কা রংবাজার
ওরে বন্ধু ন গরিস ছারহার


 

স্বপ্নচূড়ার লৌকিক চাবি 🍂 আবু জাফর সিকদার

উৎসবের আমেজে চলছে পাশাখেলার বাজি,
দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণে পঞ্চপাণ্ডবের কী বা আসে যায়!
ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলো বলে হস্তিনাপুর তো আর অক্ষত থাকেনি।
দুর্যোধন, দুঃশাসনের স্বার্থকে ঘিরে
কুরুক্ষেত্র সদাশয় উর্বর হয়েই থাকে।

বিস্মৃত ইতিহাসের কানাগলি মুখে
শোভা বর্ধন করে আপোষকামীর প্রতিকৃতি
হিমঘরে পড়ে থাকা কাটা লাশের মতো
মরার উপর খরার ঘা হয়ে চেপে বসেছে জগদ্দল পাথর।

ঘুমহীন চোখে রাত জেগে কবিতা লেখার ক্লান্তিহীন প্রয়াসের মতো,
কেবল বসন্তের প্রতীক্ষায় থাকে
গানের পাখিরা,
ঝরাপাতার শুকনো মর্মরের ভৌতিক আস্ফালন সুরের মুর্চ্ছনায় উদ্বায়ী হবেই!
জোনাকির আলো অপাংক্তেয় হয়ে যাবে ভরাপূর্ণিমায়,
তেজ কটাল মরা গাঙ্গে আনবে নব জোয়ার,
সুখের পায়রাগুলো জলপাই ঠোঁটে উড়াল দিবে মধ্য গগনে;
আতিপাতি খোঁজে নিবো হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নচূড়ার লৌকিক চাবি।

অর্চার্ড পার্ক
৩০ পৌষ ১৪২৮


 

মাটির কলস 🍂 দেলোয়ার হোসেন

অনেকবার ভেঙ্গেছি তৃষ্ণায়!
অনেক দূরের পথ পায়ে পায়ে ধুলোমাখা পা
আমায় ডাকছে পথে উইঢিবি বোন ঝোপ নদীমুখ নারী
ভেঙেছি হাতের আঙুল ভেঙেছি সবুজ
ভেঙেছি চোখের মন ভেঙেছি আকাশ
আমাকে ভেঙেছি আমি কেবল ভেঙেছি আমায়
মাটির কলসি দেখে তৃষ্ণা ভাঙি আর ভেঙ্গে ফেলি আমার আমায়!
পায়ের কাছে জমা সতেজ সূর্যমুখি ধুলো
বুকের ভেতর শুধু সজনেডাঁটা ভোর
মাটির কলস ভরা নদীমুখ নারী!


 

শীত 🍂রেজাউল করিম রোমেল

খট্ খট্ খট্ শব্দ করে
শীত এলোরে ভাই,
শীতের এই ঠান্ডাতে আজ
কারো নিস্তার নাই।

শীতের দিনে গরম কাপড়
আরো পড় মোজা,
না-হলে-তো ঠান্ডা তোমায়
কোরে দেবে সোজা।

ঐ দ্যাখ ভাই গরিব মানুষ
কাঁপছে যে থর থর,
শীতের কাপড় পাবে কোথায়
নেইতো তাদের ঘর।


 

১টি মন্তব্য

  1. প্রতিটি কবিতাই খুব সুন্দর।
    সবার জন্যে অশেষ শুভ কামনা ও ভালোবাসা।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন