পাঠ-উন্মোচন


শিল্পী মেরুন ও কবি হরিয়ালের রক্তডানা


মাঈন উদ্দিন জাহেদ


পুবাকাশ


দু’পর্বের কবিতা। প্রথম পর্ব ‘অন্ধকারের হাত’। একুশটি কবিতা। দ্বিতীয় পর্ব ‘আমাদের চিৎকারগুলো’। বারটি কবিতা গ্রন্থিত হয়েছে। কবিতাগুলো সুখপাঠ্য, ইংগিতময়, প্রখর দৃষ্টি বৈভবে প্লুত। মেরুনের শিল্পীত চোখ সামাজিক চোখের সাথে রেল লাইনের মত বয়ে যায় সুদূর নীলিমায়। সেখানে স্বপ্ন থাকে প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কাঙ্খায়।

সাম্প্রতিক সময়ের অতিমারি নয়, যাপনের ভূগোলে যখন মুখ ও মুখোশের আড়ালে সামন্তবাদের জিগির হয়ে ওঠে, প্রযুক্তি যুগের কবি মাক্সবাদী নয়, হয়ে ওঠেন মাস্কবাদী। হিউমার, বক্রোক্তি, হাহ্ হা, হিহ্ হি তখন বাঙ্ময় হয়ে ওঠে কবির শব্দ যোজনায়। কবিকেও ভাবতে হয়- পায়ের তলার মাটি, বেঁচে থাকার ফাঁক ফোকর, ভাবতে হয় যাপনে হলুদিয়া বেঙ্গমা-বেঙ্গমিকে নিয়ে।

‘মাস্কবাদী কবিতা’ শিল্পী মেরুন হরিয়ালের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। বইমেলা ২০২২ এর শেষ পর্বে মার্চেই প্রকাশ হয়ে এলো বেঙ্গমা প্রকাশনী থেকে। মূল্য : ১৩০ টাকা।

অতএব ভ্রু পেয়ে গেল ভাষা
সে আজ কথার গানচিল
নীল মাস্কের ঢেউয়ের সাথে রেখেছে ডানা
মুখ হয়ে বলে, ‘ না না,
কাছে এসো না, ভালোবাসা একচোের পথ থেকে’…
……………………………
ভ্রু আজ নিজেই নিজেকে দিচ্ছে ভোট
নিজেই নিজের নির্বাচন কমিশন।
(ভ্রু- মাস্কবাদী কবিতা – পৃ: ২৯ )

অথবা মেরুন যখন দেখে সমাজপ্রতির প্রতিশ্রুতির বৃষ্টিতে জ্বরলিপি লেখা জরুরী মনে করেন। ৯৮.৫ ° ডিগ্রী জ্বর তখন যাপনের অসহিষ্ণু রেখাচিত্র হয়ে যায়:

ভিজে গেছি প্রতিশ্রুতির
বৃষ্টিতে। কুয়াশাও ঢুকছে
কু- আশার সাথে পেঁচিয়ে
মাথায় রিনরিনে ব্যথারসুরে সুর তুলছে গিটার
হয়তো জ্বর এসে পড়ছে!
তুমি এত দূরে কেন
অভিমানী থার্মোমিটার?

তখন আর মাপতে হয় না কবির বোধের পৃথিবী। জ্বর যতই বাড়ুক, শব্দে শব্দে ধনুক বেঁকে যায় মূল লক্ষে। কবিতার স্বরে বিরোধী সমাজ মনোচৈতন্য ১০১° ডিগ্রী জ্বরে দশকের রাজনীতি মেপে ফেলেন:সমাজ, বুদ্ধিজীবীতা, রাজনীতি, মনোচৈতন্যের ভূগোল এসব আত্মবৈপরিত্য শব্দের পলে পলে মুদ্রিত হয়ে ওঠে একালের ইতিহাস হয়ে:

এই তো ব’সে মিস্‌ডকল খাচ্ছি
তোমাকে না ছুঁয়েই ছুঁয়ে যাচ্ছি
কেন বুঝেসুঝে নেটওয়ার্কে
মাংশ হয়ে ছড়িয়ে পড়ো!
তোমাকে তো আমি প্রতিকলেই ধ’রে ফেলি
কেন তবু মিস্‌ড কলে ডাক পাড়ো?
(মিস্‌ড কল : পৃষ্ঠা: ৩০)

ব্যাক্তিগত প্রসঙ্গগুলোও যখন কবিতা যাপিত স্বরে আর্তনাদে উচ্চারিত হয়, কবির জন্মগাঁ ফটিকছড়িও তখন স্বপ্নীল ফড়িংছড়ি হয়ে বলে ওঠে:

এমন সময় ফড়িংছড়ি নামি। দেখি
রাস্তাগুলো কমলা রঙের, ব্রিজগুলোতে হাড়
বলি, হাড়ের একটি নদী যখন আছে
হাড়ের একটি আকাশ কেন নেই?

এম্নি ভাবে আরও গাঢ় হয়ে পাঠকের বোধকে মোচড় দিয়ে মেরুন হরিয়াল কবিতায় নিজ্বস্বর তৈরী করেন, যেখানে আলাদা হয়ে ওঠে মাস্কবাদী কবিতা। মেরুনের লেবু রসায়ন:

লেবুভ্যানের একদিকে আমি
অন্যদিকে তুমি
যথারীতি কালো নেকাবে
মুখ ঢাকা, চেনে নি।
লেবুর এত দাম! এত বেশি!
আহ, লেবু কেনো নি!
আড় ফিরে ডাক দিলে, ‘এই ট্যাক্সি!’
লেবুর মতো সবুজ
উঠে চ’লে গেলে।
হায়, আমারও কেনা হলো না!
তুমি চ’লে যাচ্ছ
হুম, আমিও ‘ফিরলেম’
চ’লে যাচ্ছে লেবুগাড়িও
কালো পিচের ঠিক নীচে কাঁদছে
কমলালেবুর মতো ম্যাকাডেম।
(লেবু: পৃষ্ঠা: ৩১)

দু’পর্বের কবিতা। প্রথম পর্ব ‘অন্ধকারের হাত’। একুশটি কবিতা। দ্বিতীয় পর্ব ‘আমাদের চিৎকারগুলো’ এ বারটি কবিতা গ্রন্থিত হয়েছে। কবিতাগুলো সুখপাঠ্য, ইংগিতময়, প্রখর দৃষ্টি বৈভবে প্লুত। মেরুনের শিল্পীত চোখ সামাজিক চোখের সাথে রেল লাইনের মত বয়ে যায় সুদূর নীলিমায়। সেখানে স্বপ্ন থাকে প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কাঙ্খায়।

প্রথম পর্বের চেয়ে দ্বিতীয় পর্বের কবিতাগুলো শপাং শপাং চিৎকারে তীব্রতর হয়ে ওঠে। কবির প্রেম-কাম-ভালোবাসা সামাজিক অসংগতির কাছে অসহায় দ্যোতকে শিল্পীত হয় শ্লেষ ও কটাক্ষের বাক্যবানে। ‘বেবুন’ দশার কবি ‘পাথর’ সময়ের ভেজাল নিশ্বাসে প্রবল প্রতিপক্ষ আবরাহাকে ডাকেন। ”নাভিশ্বাস ‘ লিখে যান:

ক্ষমতার স্বাদ এখনও জিজ্ঞেস করে
নাভি থেকে কইমাছের মতো কানকো-দাঁড় বেয়ে
কোনও অরণ্যভিমুখে হারিয়ে যাচ্ছে নাভিশ্বাস
বেড়ে যাচ্ছে পারদস্তর, দেয়াললিখন মুছে
বিস্বাদে ভরিয়েছে গ্রাফিতি
কোন গুপ্ত প্রজা-পতি মুছে দিচ্ছে সিঁদুর
এমনকী যত্নে-আঁকা সিঁথি?

আহমদ ছফা’র গাভী বিত্তান্ত, মেঘ চৌধুরী, নোটিশ ও ২০২০ এর বিষময় সময়ের বিষাক্ত সমকাম, নীল মাছির লাভা ও জীবাণুময় সমকালেও কবি মেরুন হরিয়াল আকাশ দেখার স্বপ্ন জাগিয়ে রেখেছেন:

‘তোমরা যারা আকাশ দেখো
আকাশ লেখো নীলের খাতায়
তারা আমার পাশে-পাশে থেকো।
……………………………………….

আকাশ কোথায় থাকে?
আকাশ কোথায় পাওয়া যায় জানো?
সূচবালিকার নীল লাঞ্চ ক্যারিয়ারে একটু আকাশ এনো।

মেরুন হরিয়াল এর ‘শিকার’, ‘জাহালাম’, ‘কর্মসূচি’ কবিতাগুলো যেনো কবিতার বুলেট হয়ে প্রতিবাদী পংক্তির শিল্পীত শিলান্যাস হয়ে ওঠে এ পর্বে।

‘আমি জাহালাম’, বলে জাহালাম
বিফল এত কাল!
আমলাতন্ত্রের আঁটি চোষে নামতন্ত্রের
নুচ্ছা বৃহন্নলা।

কিংবা বাড়ির পাশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কুটাচল নিয়ে কবি মেরুন হরিয়াল যখন বলে ওঠেন :

আমাদের স্তব্ধ নিশ্বাস
কষ্টচাপ, কোঁত-পাড়া কোষ্ঠ, বদ্ধবিকার…
আমাদের হাসিগুলাে
পানকৌড়ির ডুবসাঁতার, ডুবুডুবু শিকার
আমাদের কথাগুলাে
শববাহকদের সুরে-সুরে-মেলানাে গান
আমাদের চিৎকারগুলাে
শিৎকারের চাইতেও বেশি গুপ্ত স্লোগান!

জ্বলছে আমাদের চিন্তা
ভাবনা মধ্যরাতে গুলিবিদ্ধ কাতরায়
এমনকী লিখে রাখাও মানা
আজ ভাসানচরে শুকোচ্ছি রক্তডানা!

তখন মেরুনের কবিতা আর মেরুনের থাকেনা। সচেতন নাগরিক সমাজের, বিবেকের কণ্ঠস্বর হয়ে পংক্তিগুলো আমার, আপনার, তোমার হয়ে ওঠে।

একান্ত প্রেমের কবিতা ‘কাকচিরি’, ‘বিল’, ‘তোমায় দেখি’, ‘সংলাপ’, ‘জিরকনের ছাত্রী’, ‘হেয়ার ক্লিপ’ও যখন ব্যাক্তিক থাকে না। বিশেষ করে ‘হেয়ার ক্লিপ’ অনুভূতির অনন্য মাত্রায় ছুঁয়ে যায়। এবং কিছু কিছু শব্দ যেমন কাকচিরি, উড়াধুরা, র‍্যাফফ্লেশিয়া, শুয়োবিল, জিরকন, ম্যাগ্রোভ-মন, মহিজুরি,জাহালাম এর ব্যাবহার চমৎকার লেগেছে।
মেরুনের প্রেম শেষপর্যন্ত ব্যাক্তিক থেকে সামষ্টিক চেতনায় বিকষিত হয়েছে। মেরুন জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক মনোচৈতন্যের কলাকার হয়ে, হরিয়াল হয়ে যান বাংলা কবিতা আকাশে। স্বাগতম, মেরুনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মাস্কবাদী কবিতা’ কে। জয় হোক, কবি অনুভূতির, জয় হোক কবিতার। শিল্পী মেরুন ও কবি হরিয়ালের জন্য ভালোবাসা। রক্তডানার মুক্তিগান শ্রুত হোক পাঠক হৃদয়ে হৃদয়ে ।


মাঈন উদ্দিন জাহেদ : কবি ও প্রাবন্ধিক। 

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন