সম্পাদকীয় বাছাই
বাংলায় তালাল আসাদ
মানস চৌধুরী
পুবাকাশ
‘পাশ্চাত্য ও সেক্যুলারবাদ প্রসঙ্গে’ পুস্তিকার ভূমিকা পুনঃপাঠ-সম্পাদক পুবাকাশ
তালাল আসাদের এত সংক্ষিপ্ত পুস্তক বানানাের প্রধান কারণ এই যে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন প্রকাশন’ এই মাপের পুস্তকে অভ্যস্ত। তাছাড়া কোনাে এককালে একটা ঢাউস কাজ জড়াে হবে এই অপেক্ষায় এই মুহুর্তের আগ্রহী পাঠকের সঙ্গে সামান্য যােগাযােগ না করার কোনাে মানে হয় না। ম্যাজিক লণ্ঠন প্রকাশন’-এর এই বিবেচনাবােধকে আমি দারুণ পছন্দ করি। তাছাড়া তালাল আসাদকে প্রকাশের প্রসঙ্গে ভাবতে গিয়েই প্রকাশকের হাতে ইতােমধ্যেই অনূদিত দুটো কাজ পৌঁছেছে। এই পুস্তক পরিকল্পনার মােটামুটি প্রেক্ষাপট এরকম।
আরাে কিছু বিষয়বস্তুর মতাে তালাল আসাদও বাংলাদেশে পরিচিত হয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের কয়েকজন শিক্ষকের কারণে। কিন্তু একজন ‘ঘরের লােক হিসেবে আমি বলতে পারি যে কয়েকজন শিক্ষকও আদিতে ও আদতে একজন শিক্ষক। রেহনুমা আহমেদ।
আমি তাঁর জৈবনিক রচনার দায়িত্ব নিই নাই, তিনি তাতে উৎসাহী হবেন বলেও আমার মনে হয় না। কিন্তু রেহনুমার শিক্ষকতা-প্রজ্ঞা-পদ্ধতি নানান প্রসঙ্গেই
চলে আসে তার বিশিষ্টতার কারণেই। কেননা তিনি বিলাত থেকে ঢাকায় আসার পর তাঁর পরিচিতরা নতুন নতুন চিন্তকের সাথে পরিচিত হয়েছেন; আর অনেক ডিগ্রিশিকারী ঢাকায় পৌছানাের পর নিছক কিছু সাফল্যের গল্প শােনা যায় সেই প্রশ্নগুলাে আসলে পেশাজীবীর পদ্ধতিগত আর জগতবীক্ষাগত। তিনি আসাদের অন্তত দুটো বই আর বেশ কিছু প্রবন্ধ সঙ্গে
করে ফিরেছিলেন ইংল্যান্ড থেকে ১৯৯৪ সালে। সাথে ব্যাপক ভাবনাচিন্তা। কিছুদিনের মধ্যেই ফরমেশনস (২০০৩) বইটিও তাঁর হাতে আসে। এই সময়ের মধ্যে
আসাদ ব্রিটেনের হাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কিনের নিউ স্কুল হয়ে জন্স হপকিন্স-এ যান। নেটে খুঁজে নিখুত তথ্যাদি দেওয়া যেতাে। কিন্তু সেটা জরুরি নয়। বিষয় হলাে তাঁর জিনিয়লজিস (১৯৯৩) বইখানি, একটু
ধীরে ধীরে হলেও, জগদ্বিখ্যাত হবার কারণে আলাদা করে আসাদকে পপুলারাইজ করানােটা কঠিন কোনাে ব্রত হয়নি পরের বছরগুলােতে।
কিন্তু ঢাকায় আসাদ পাঠ ও কাউকে পঠানাের ক্লেশ গুরুতর কঠিন ছিলাে। আসাদের বংশসূত্রীয় দেশ সৌদি আরবে কী ঘটে, কিংবা বৃহত্তর আরবভাষী অঞ্চলে তাঁকে নিয়ে কী ঘটে থেকেছিলাে সেসব নিয়ে আমার কৌতুহল আছে, যত্ন করে মেটানাে হয়নি।
ঢাকায় প্রাথমিকভাবেই আসাদ খারিজ হতে থাকলেন। মােটের ওপর যাঁদেরকে বামপন্থী বলা হয়ে থাকে। তাদের কাছ থেকে। কখনাে কখনাে এই খারিজি ভাষা চমকে যাবার মতাে ছিলাে। বস্তুত বাংলাদেশের যেসব ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলকে আসাদ কখনাে নাও চিনে থাকতে পারেন, তাঁকে সাব্যস্ত করা হতে । থাকলাে এমনকি সেসব দলের বিদেশি এজেন্ট হিসেবে। খারিজকারীদের সেই তালিকাটা কৌতুককর হতে পারে, কিন্তু উল্লেখ করতে যাওয়ার আহাম্মুকি করবাে না।
আমার মনে পড়ে, দুয়েকবার আসাদকে রক্ষা করতে আমি দুচার জায়গায় বলে বসেছিলাম যে তিনি তাে মার্ক্সবাদও পড়ান বা ইত্যাদি। উত্তরকালে আমার এই ওকালতি নিয়ে নিজেই অস্বস্তিবােধ করেছি। সরকারি প্রাইমারি স্কুলে, কে না জানে, প্রায়ই অংকের শিক্ষক আরবী ক্লাসে চলে যান, অন্তত এই কারণে যাতে বাচ্চারা হৈচৈ না করে। আমার শ্রোতারা যে কেউ ধমক দিয়ে আমাকে এইরকম একটা উদাহরণ শুনিয়ে দেননি সেটাই বরং সৌভাগ্য হিসেবে আমি নিশ্চিত হয়েছি। বামপন্থীদের কথা আলাদা করে এলাে এইজন্য নয় যে তারা আসাদকে বাড়তি শত্রুতা করেছিলেন; বরং এইজন্য যে কেবল তারাই আসলে ।
আসাদকে পড়ছিলেন। সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ম নিয়ে, ইউরােপীয় সেক্যুলারবাদ নিয়ে, ইসলাম নিয়ে । আসাদের ব্যাখ্যাগুলাে। এযাবৎকালপর্যন্ত যেসব আন্দাজ-অনুমান-মীমাংসার ওপর এই অঞ্চলীয়
‘প্রগতিবাদী’ এবং/বা ‘মার্ক্সবাদী’ জ্ঞান-বিদ্যারাজনীতিজগৎ প্রতিষ্ঠিত, সেগুলােকে নস্যাৎ করে দেয়। তালাল আসাদ সম্ভবত প্রথম দিকের এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যাকর্মীদের একজন, যদি একমাত্র
না হন, যিনি মার্ক্সবাদী চিন্তক হবার জন্য প্রগতিবাদী হওয়াকে শর্তযুক্ত দেখেননি। আর অনেকে যা ভাবেন তাঁর বিপরীতে, এই বীক্ষা তার দেখা দিয়েছিলাে অনেক আগে। সত্তর দশকের প্রথমভাগে তার সম্পাদিত নৃবিজ্ঞান ও ঔপনিবেশিক অভিঘাত (১৯৭৩) গ্রন্থে যখন নৃবিজ্ঞান আর উপনিবেশের সম্পর্ক তদন্ত করছেন তাঁরা, তখনই তিনি প্রগতিবাদের পিচ্ছিল পথ নিয়ে রাজনৈতিকভাবে সতর্ক ছিলেন। আসাদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, তাকে রক্ষা করতে আমার বা আমাদের মতাে শিক্ষকদের দরকার পড়েনি।
পুস্তকের বাজারই সেটা করতে পেরেছে।
তালাল আসাদ বৈশ্বিকভাবে সর্বাপেক্ষা পরিচিত সেক্যুলারবাদ নিয়ে তাঁর অতীব ক্রিটিক্যাল পর্যালােচনার কারণে। আবার সেটাই ধর্মপন্থীদের অনেকেরই আসাদকে নিয়ে উৎসাহের কারণ, সন্দেহ নেই। তবে আসাদের কার্যপরিধিতে দুর্দান্ত বিশ্লেষণ
এসেছে প্রগতি নিয়ে, পাশ্চাত্য সভ্যতা নিয়ে, উপনিবেশ নিয়ে, আধুনিক রাষ্ট্রের শাসনপদ্ধতি নিয়ে। সুনিশ্চিত যে, এগুলাে সম্পর্কিত প্রসঙ্গও বটে।
এই পুস্তক যে দুটি মাত্র রচনার অনুবাদ নিয়ে গঠিত, তার একটি রচনা পাশ্চাত্য সভ্যতার অবধারিত গতিমুখ নিয়ে, যে অবধারিত্ব নিবর্তনমূলক। অন্যটি নারমীন।
শেখ-এর নেওয়া একটি সাক্ষাৎকার যা ধর্ম ও সেক্যুলারবাদ নিয়ে তাঁর ভাবনার একটা প্রাথমিক রূপরেখা হাজির করে। রেহনুমার অনুবাদটি প্রথমে সমাজ নিরীক্ষণ পত্রিকাতে, পরে জেনেছি অন্য সংকলনেও পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। আমি যে অনুবাদটি
করি, সেটি কম-আয়াসে তালাল আসাদকে জানতে পারার এক সহজ উপায়। তার কিছুদিন আগেই তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় (২০০২)। এর আগেও আমি আসাদের দুইটা বা তিনটা রচনা অনুবাদের
উদ্যোগ নিই, এবং অজস্র না-হওয়া কাজের তালিকাই বাড়ে তাতে। এটি শেষ করার পরও আসাদ থেকে। নানান অনুবাদের ইচ্ছা হয়েছে, সাধিত হয়নি। এটিও সমাজ নিরীক্ষণ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিলাে। ফলে পাঠক এই নাতিদীর্ঘ পুস্তকে পাচ্ছেন তালাল আসাদের সামান্য কিছু ধারণা যাতে তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতাকে তদন্ত করছেন, আর সেক্যুলারবাদকে তদন্ত করছেন। ভূমিকাটি লিখতে দায়িত্ব পাবার পর প্রকাশক তথা প্রকাশনাসংস্থা ‘ম্যাজিক লণ্ঠন প্রকাশন’-এর সঙ্গে আমার স্পষ্ট আলাপ হয়েছে। সংখ্যায় যতই কমতে থাকুক এই দলটি, এখনাে বাংলাদেশে বিদ্যাজগতের যেকজন মানুষ তাত্ত্বিক-চিন্তকদের স্থানীয় ভাষায়
হাজির করার তাগিদ বােধ করেন এই প্রকাশক ও আমি উভয়েই সেই কাতারে পড়ি। এখনাে আমরা বাংলাভাষায় সমাজপাঠের গুরুত্ব গোঁয়ারের মতাে
বােধ করতে থাকি। এই পুস্তকের পাঠকেরা যদি তালাল আসাদকে আরাে আরাে বাংলায় পেতে চান, তার জন্য বাড়তি পরিশ্রম করার ইচ্ছা প্রকাশকের
আছে। তবে সেগুলাে পাঠক তরফেও সাধিত হতে পারে। তালাল আসাদের বিপুল কাজের মধ্য দিয়ে।
তাঁর গ্রন্থাবলী ও প্রবন্ধগুলি থেকে ৫/৭/১০টি অগ্রগুরুত্ব দিয়ে বাছাই করে ফেলা কঠিন কিছু হবে না।
কঠিন হবে পেশাবাজারের বর্তমান যে হালহকিকত। তার মধ্যে অনুবাদকদের পাওয়া। সেখানেই পাঠকেরা যােগ দিতে পারেন। চিন্তাভাবনা বা পড়ালেখার দুনিয়াকে কিছুটা গণতান্ত্রিক বানাতে চাইলে
আপনাদের অংশগ্রহণের কোনাে বিকল্প নেই। যদি এই পুস্তকের পাঠকেরা পুস্তকটিকে কিছুমাত্র কাজের
বিবেচনা করে থাকেন, তাহলে অনুবাদক হিসেবে আমি বা রেহনুমা আহমেদ, প্রকাশক হিসেবে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন প্রকাশন’ কেবল ভালাে বােধই করবাে তা নয়,
বরং চাইব আপনারাও অনুবাদে শামিল হউন। আর পরের পুস্তকটি সেভাবেই তৈরি হতে পারবে।