ছোটগল্প
স্বাধীনতা
সাবিনা পারভীন লীনা
পুবাকাশ
মুনিয়া কিছুই বললো না।হাসি হাসি মুখটার একটু নিচে গঙ্গা যমুনা পাড়ের ভাঁজে একটা দীর্ঘশ্বাস ঘুরপাক খেতে লাগলো। তার পায়ের সুতলিটা যদি খুলতে পারতো! যদি কেউ খুলে দিত!!
মা… মা…অ মা,ইক্কা আইয়ু। ইবা কি চাই য তাড়াতাড়ি।আঁর হাতত্তুন বাঁচিত্ নঅ ফারে,ধরি ফালাই। তাড়াতাড়ি আইয়ু অ মা…
রিজুয়ানের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, ঠোঁট দুটো কুঁচকে আছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে বলে নাকের চামড়া ফুলে ফুলে উঠছে। দু হাতে ঘুঘুটিকে এমনভাবে পেটের কাছে ধরে রেখেছে, যাতে পালাতে না পারে। নিরীহ চোখে পাখিটি কোনদিকে তাকিয়ে আছে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
–অ ফুত্, তুই এই কাম্ কেনে গইরলি? ফাইক্ ইবা ছাড়ি দে। আঁর আব্বা নয় না, ফাইক্ ছাড়ি দে। আলমারির উয়রে ইবার তিননুয়া ছা আছে। মারে তুই ধরি রাখিলি, ছা অল্ কাঁদিবু। গুনাহ অইবু, ছাড়ি দে।
–না…, নঅ ছাইরগুম আঁই। আঁরে এক্কান সুতলি দও, ঠ্যাং অত বাঁধি দিয়ুম। কোন মিক্কা যেন যাইত্ ন পারে। তু্ঁই আগে আঁরে কও, ফাইক্ ইবার নাম কি। চোখ দুনুয়া ছোট গরি আঁর মিক্কা চাই কা থাইক্কি! গলার কিনারে সাদা সাদা ফোডাগুন কী সোন্দর লাগের!
— আজিয়া দু্ঁইরগা আবাজ্ হুনিয়েরে তুই আঁরে ফুছ্ গইরগিলি। অ মা, ইবা কি এ ডাকের। আঁই এঁত্তে কি কইলাম, মনত্ নাই? ন কইলাম, ইবা খঅল্ এ ডাকের।ফাইক্ ইবার কথা কইলাম দে এরি, খঅল্, খঅল্ পাখি। ঘরত্ মানুষ ন থাকিলি খাইল্লা ঘরত্ ফাইক্ অল বা বাঁদে,বাইচ্চা দেয়। তোর আব্বারে কতো কইলাম, ঘরগান আবার বাইন্তু। ঘরর ছাল অ দি পানি পড়ের, মেডিত্ অঁন্দুরে গাঁত কুড়ি রাইক্কি হত্তর হত্তর। আঁর হতা কেউ ফাত্তা ন দেয়।
দরজায় শিকল নাড়ার শব্দ শুনে সালেহা দ্রুত হেঁটে এগিয়ে গেল বসার ঘরের দিকে। কাছে যেতেই কানে এলো,খালাম্মা,খালাম্মা…।
ছিটকিনি খুলে দেখে, মুনিয়া দাঁড়িয়ে আছে। উঠানে পা দিতেই শুনেছে আজ সকালে এসেছে, তার মুনিয়া। কিন্তু ঘরের বেহাল অবস্থাকে জোড়াতালি দিয়ে ঠেকাতে গিয়ে মুনিয়ার খবর নিতে পারেনি এতোক্ষণ। খালা-ভাগ্নি শহরেই থাকে, কিন্তু কেউ কারো দেখা পায় না বহুকাল। তার আত্মীয়স্বজনের প্রতি স্বামীর উন্নাসিকতা, সবার কাছ থেকে দূরে রেখেছে তাকে। একটু শান্তির জন্য নিজের কতো কতো ভালোলাগা জলাঞ্জলি দিয়েছে এতোদিন। কোন বাক্য বিনিময় না করে একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরে আছে তারা। ভেতর থেকে ছেলের ডাকাডাকিতে সম্বিত ফিরে পেল। সালেহাকে অনুসরণ করতে গিয়ে দেখল, মেঝের বিভিন্ন জায়গায় দেবে গেছে, স্যাঁতসেঁতে। টিনের চাল এর ভাঙা অংশ বেহায়ার মতো তাকিয়ে আছে তার দিকে। কৈশোরে স্কুল ছুটির দিনগুলোতে এই বাড়ি গমগম করতো। এমন শীতের দিনে মাটির চুলার ধারে বসে কতো গল্প, হাসিঠাট্টা , চোঙাতে ফুঁক দিয়ে চুলার খড়ে আগুন ধরানো, ভাপা পিঠার মাঝখানে থাকা গুড় নারকেলের স্বাদ! ভীষণ মনে পড়ে মুনিয়ার, ভীষণ।
— আঁর রিজুয়ানঅরে এক্কানা বুজাই কও, মুনিয়া। খঅল্ উগ্গা ধরি, আঁর মাথা খাই ফালার। আঁই ইতারে আর বুজাইত ন ফারির। আর কতো মিক্কা সামলাইয়ুম! ইতার বাপ তো পাড়া বেড়াইতু গেইয়ি।
রিজুয়ানের সাথে মুনিয়ার ঘন্টাখানেক আগে দেখা হয়েছিল, তাই সে বেশ হাসিমুখে গলার রগ ফুলিয়ে ঘুঘু ধরার গল্প শুরু করে দিল। ঘুঘুর খোঁজ কিভাবে পেল, চেয়ারে দাঁড়িয়ে আলমারির উপর থেকে কিভাবে নামালো, সব। হাতল ভাঙা চেয়ারের পায়ের সাথে ঘুঘুর পা বাঁধা সুতলিটা গেরো দেওয়া। কয়েকটা ধান ছড়ানো আছে মাটিতে।
রিজুয়ান, তুঁই পাখির ঠ্যাং কা বাঁধি রাইক্কু,ভাইয়া। ভালা গরি ইবার মুকখান চ,কী কষ্ট পার্! মুখে কিছু ন কইলিও মনে মনে তোয়ারে বদদোয়া দিবু। পাখিরে বান্দি রাখন্ ঠিক ন। ইতারা থাকে গাছর ডালত্, আর যেঁত্তে মনে কয় এঁত্তে আসমানত্ উড়ি বেড়ায়। যে যেইল্লা থাইকতু চায়, ইবারে এইল্লা থাইকতু দেঅন পরে। আর তুঁই হইয়ুদে, ইবার বাইচ্চা আছে।তই! ইতারারে হঅনে ছাইবু,হঅনে খাবাইবু। তুঁই চিন্তা করো অ ভাই। আফু এখন যাইরগুই, আবার আইস্সুম। কেবারগান্ লাগাই দও, কুত্তা বিলাই ঢুকিবু আবার।
বিকেলে মুনিয়া চা এর দাওয়াতে গেল মেজ মামার বাসায়। নানাবাড়ির আদর এখনো আছে আগেরমতো। হয়তো তার মায়ের বড় সন্তান বলে,হয়তো ভালোবাসা নিম্নগামী বলে। দুপুরে একটু ঘুমঘুম ভাব এলেও ঘুম কেটে গেল মইনুল এর ফোনে। কোথাও গেলে এতো বেশি ফোন করে সে, যেন তার শূন্যতায় সে বিরহী হয়ে উঠেছে ! ফোন না ধরলে বা ধরতে দেরী হলে রেগে যায় খুব।তার মা-বাবা বেঁচে আছে, তাদেরও একমাত্র মেয়ে মুনিয়ার জন্য চিন্তা হয়। মেয়ের উপর অধিকার ও অনেক। কই, তাদেরতো সারাক্ষন জবাবদিহি করতে হয় না!
শুধু এক রাত থাকতে চেয়েছিল সে নানাবাড়িতে। এরমধ্যে বারবার ফোন করে চলে যেতে তাগাদা দিচ্ছে। এভাবে যে বিরক্ত করবে সে জানতো, তাই মইনকে সাথে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু সে সাথে আসবে না, আবার মনগড়া গল্প বানিয়ে কথায় কথায় খোঁচা মারবে।
সুজির খেজুর পিঠা মুখে দিতেই জানালার ফাঁক দিয়ে দেখলো, রিজুয়ান দৌড়ে আসছে।
মুনিয়া চেয়ার ছেড়ে ঘরের দাওয়ায় দাঁড়ালো।
আফু…,আফু…সুতলি খুলি খঅল্ ইবারে উডানত্ ছাড়ি দিই। সুতলি খুইল্লি মত্তর ফইর দুনুয়ান ফট্ ফট্ আবাজ গরি ইবা বাদি গাছর ঠেইলত্ যাই বইস্সি। তারফর হুইক্কা গেইলগুই, আর ন দেখি। বাইচ্চাঅলর কাছে গেইয়ি ফানলার্।
মুনিয়া কিছুই বললো না।হাসি হাসি মুখটার একটু নিচে গঙ্গা যমুনা পাড়ের ভাঁজে একটা দীর্ঘশ্বাস ঘুরপাক খেতে লাগলো। তার পায়ের সুতলিটা যদি খুলতে পারতো! যদি কেউ খুলে দিত!!
সাবিনা পারভীন লীনা : কবি ও কথাকার।