কবিতা
শেষ বিকেলের গান
কাজী জহিরুল ইসলাম
পুবাকাশ
নীরিক্ষাপ্রবণ কবি কাজী জহিরুল ইসলাম স্বরবৃত্ত ছন্দে মৃত্যুচিন্তা বিষয়ক কবিতা লিখছেন। যারা মনে করেন স্বরবৃত্ত ছন্দে শুধু ছড়ার মত হালকা ধরনের কবিতা এবং গান লেখা যায় তাদের জন্য এ কবিতা নতুন চিন্তার খোরাক যোগাবে।
১.
পাচ্ছ কি টের, আমি যে রোজ একটু একটু যাচ্ছি মরে
চোখেরা নেই চিরচেনা সেই কোটরে
লক্ষ করো ভালো করে
ঠোঁটেরা কি এখনও সেই তটরেখায় আছড়ে পড়ে?
সেই যে তোমার দেবশিশুটি
কোথায় এখন? অন্ধকার এক গুহার ভেতর গুটিশুটি
কুঁকড়ে আছে।
তোমার কি আর সময় হবে, মুছে যাওয়া ছায়ার কাছে
বসবে এসে
হাত বুলাবে রুক্ষ ললাট, বলিরেখায়, ভালোবেসে?
দেখো আমার এলোমেলো রুক্ষ চুলে
ভিন্ন ঋতুর পাখি এসে ঘর বেঁধেছে
হয়ত ওরা ঠাঁই নিয়েছে
দূর অতীতের গৃহ ভেবে রাস্তা ভুলে…
২.
সমস্ত রাত এপাশ-ওপাশ
উষ্ণতাহীন দুটি মানুষ শুয়ে আছে, জীবন্ত লাশ,
পাশাপাশি।
তবুও তো বেঁচে আছি, হয়ত জীবন বড়ো বেশি ভালোবাসি
ভালোবেসেই স্বপ্ন দেখি এখনও সেই জোড়া শালিখ
স্বপ্ন দেখি এখনও এক দক্ষ নাবিক
পাড়ি দিচ্ছি অতলান্তিক ঝড়ের রাতে
তোমার সঙ্গে যুগল পায়ের চিহ্ন আঁকি
পাহাড়, মরু, জলপ্রপাতে
স্বপ্নে আমি ফুল ছড়িয়ে এখনো রোজ মৃত্যু ঢাকি।
৩.
অক্ষরেরা এলোমেলো, যাচ্ছে খসে গ্রন্থ থেকে
কোত্থেকে সব কালো কালো ধোঁয়া এসে দিচ্ছে ঢেকে
বুড়ো চোখের দৃষ্টি-প্রদীপ।
লাইনগুলো সব ঢেউয়ের মতো দুলছে শুধু,
স্মৃতির জলে রোজ ফেলি ছিপ
জল শুকিয়ে স্মৃতির পুকুর বিরাণ ধু ধু,
পাই না খুঁজে কোথায় যে শেষ, কোথায় শুরু?
সুন্দরী অপথালমোলজিস্ট কুচকে ভুরু
বললো সেদিন
চশমাটাকে ঠিক করে নিন,
দৃষ্টির ওপর কালের ধুলো জমেছে বেশ।
আলোর রেখা যাচ্ছে নিভে,
গল্পে ঠাশা কিশোরবেলার গ্রন্থখানি কে আমাকে পড়তে দিবে?
অন্ধকারে যাচ্ছে ডুবে দূরের স্বদেশ।
৪.
সবাই দেখে রঙ লেগেছে গাছের পাতায়
ঋতুর পাখি চঞ্চু দিয়ে
ঠুকরে ঠুকরে গল্প লেখে রঙের খাতায়।
হেমন্ত কি শেষ বিকেলে জ্বলে ওঠা এক ফালি রোদ?
মেঘের ফাঁকে হাসছে বিকেল কী নির্বিরোদ
পত্রবৃষ্টি ঝরছে কেবল
ঝরছে হলুদ, যাচ্ছে ঝরে লাল মহুয়া, অশ্রুসজল
বৃষ্টিপাতে যাচ্ছে ভেসে উত্তরার্ধ-বনভূমি
শুনতে কী পাও, বিষণ্নতা, শুনছো তুমি?
৫.
বইছে হাওয়া মৃদুমন্দ
গোরস্তানে, খুলির ভেতর, হাড়ের সাথে ঝড়ের দ্বন্দ্ব।
ভয়ঙ্কর এক অন্ধকারে যাচ্ছে ডুবে আয়ুর বেলা।
নিচ্ছে মেনে, নিচ্ছে সবাই, সুপ্রাচীন এই ঋতুর খেলা।
দার্শনিক আলবেয়ার কাম্যু নাম দিয়েছে হেমন্তকে
নতুন রূপে আবির্ভূত বসন্ত এক।
কফিন ভেঙে আনতে পারে নতুন জীবন, এমন লোক-এ,
এসব কথাই ওর জীবনের গ্রন্থাবলীর পাতায় পাতায় আছে উল্লেখ।
হেমন্তের এই পত্রবৃষ্টি বুকের ভেতর খুব চেনা এক শূন্যতাকে
উস্কে দিচ্ছে, উস্কে দিচ্ছে খুব গোপন এক যন্ত্রণাকে।
কাজী জহিরুল ইসলাম : কবি-কথাশিল্পী-প্রাবন্ধিক।