স্মরণ ও শ্রদ্ধা


ঈগলের চোখ আর নাবিকের মন


মাঈন উদ্দিন জাহেদ


পুবাকাশ


উঠ,- দুনিয়ার গরিব ভুখারে জাগিয়ে দাও।
ধনিকের দ্বারে ত্রাসের কাঁপন লাগিয়ে দাও।।

কিষান মজুর পায়না যে মাঠে শ্রমের ফল,
সে মাঠের সব শস্যে আগুন লাগিয়ে দাও।

স্রস্টা ও তাঁর সৃষ্টির মাঝে কেন আড়াল ?
মধ্যবর্তী মোল্লাকে আজ হাঁকিয়ে দাও।।

মূল : আল্লামা ইকবাল, অনুবাদ: কবি ফররুক আহমদ, কবিতা: খোদার ফরমান।

আজ১৯ অক্টোবর, সতত ন্যায়ের উচ্চারক, মনবতার কবি ফররুখ আহমদ এর ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৫৪ মনান্তরে যিনি ‘লাশ’ কবিতা লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন, ১৯৭৪ সালের এ দিনে নিজেই লাশ হয়ে গিয়েছিলেন।

লাশ
(তেরশো পঞ্চাশে)

যেখানে প্রশস্ত পথ ঘুরে গেল মোড়,
কালো পিচ-ঢালা রঙে লাগে নাই ধূলির আঁচড়,
সেখানে পথের পাশে মুখ গুঁজে প’ড়ে আছে জমিনের ‘পর;
সন্ধ্যার জনতা জানি কোনদিন রাখে না সে মৃতের খবর।
জানি মানুষের লাশ মুখ গুঁজে প’ড়ে আছে ধরণীর ‘পর,
ক্ষুধিত অসাড় তনু বত্রিশ নাড়ীর তাপে প’ড়ে আছে
নিঁসাড় নিথর,
পাশ দিয়ে চ’লে যায় সজ্জিত পিশাচ, নারী নর
-পাথরের ঘর,
মৃত্যু কারাগার,
সজ্জিতা নিপুণা নটী বারাঙ্গনা খুলিয়াছে দ্বার
মধুর ভাষণে,
পৃথিবী চষিছে কারা শোষণে, শাসনে
সাক্ষ্য তার রাজপথে জমিনের ‘পর
সাড়ে তিন হাত হাড় রচিতেছে মানুষের অন্তিম কবর।
প’ড়ে আছে মৃত মানবতা
তারি সাথে পথে মুখ গুঁজে।
আকাশ অদৃশ্য হ’ল দাম্ভিকের খিলানে, গম্বুজে
নিত্য স্ফীতোদর
এখানে মাটিতে এরা মুখ গুঁজে মরিতেছে ধরণীর ‘পর!
এ পাশব অমানুষী ক্রুর
নির্লজ্জ দস্যুর
পৈশাচিক লোভ
করিছে বিলোপ
শাশ্বত মানব-সত্তা, মানুষের প্রাপ্য অধিকার,
ক্ষুধিত মুখের গ্রাস কেড়ে নেয় রুধিয়া দুয়ার,
মানুষের হাড় দিয়ে তারা আজ গড়ে খেলাঘর;
সাক্ষ্য তার প’ড়ে আছে মুখ গুঁজে ধরণীর ‘পর।
স্ফীতোদর বর্বর সভ্যতা-
এ পাশবিকতা,
শতাব্দীর ক্রূরতম এই অভিশাপ
বিষাইছে দিনের পৃথিবী।
রাত্রির আকাশ।
এ কোন সভ্যতা আজ মানুষের চরম সত্তাকে
করে পরিহাস?
কোন ইবলিস আজ মানুষেরে ফেলে মৃত্যুপাকে
করে পরিহাস?
কোন আজাজিল আজ লাথি মারে মানুষের শবে?
ভিজায়ে কুৎসিত দেহ শোণিত আসবে
কোন প্রেত অট্টহাসি হাসে?
মানুষের আর্তনাদ জেগে ওঠে আকাশে আকাশে।
কোন প্রবৃত্তির কাছে আজ ওরা পড়িয়াছে বাঁধা?
গোলাবের পাপড়িতে ছুড়িতেছে আবর্জনা, কাদা
কোন শয়তান?
বিষাক্ত কামনা দিয়ে কে ভরায় আকাশের রঙিন খিলান?
কার হাতে হাত দিয়ে নারী চলে কাম সহচরী?
কোন সভ্যতার?
পাঁজড়ার হাড় কেটে নৃত্য সুর জেগে ওঠে কার?
শ্রমীকের রক্তপাতে পান-পাত্র রেঙে ওঠে কার?
কোন সভ্যতার?
মানুষ তোমার হাতে করিয়ছে কবে আত্মদান,
তারই শোধ তুলে নাও হে জড়-সভ্যতা শয়তান।
শিশুর শোণিত হেসে অনায়াসে করিতেছে পান,
ধর্ষিতা নারীর  দেহে অত্যাচার করিছ অম্লান,
জনতার সিঁড়ি বেয়ে উর্ধ্বে উঠি অতি অনায়াসে
তারে তুমি ফেলে যাও পথ-প্রান্তে নর্দমার পাশে।
জড়পিন্ড হে নিঃস্ব সভ্যতা।
তুমি কার দাস?
অথবা তোমারি দাস কোন পশুদল।
মানুষের কী নিকৃষ্ট স্তর।
যার অত্যাচারে আজ প্রশান্তি; মাটির ঘর: জীবন্ত কবর
মুখ গুঁজে প’ড়ে আছে ধরণীর ‘পর।
সুসজ্জিত-তনু যারা এই জড় সভ্যতার দাস,
যাদের পায়ের চাপে ডুকরিয়া কেঁদে ওঠে পৃথিবী, আকাশ,
তারা দেখে নাকো চেয়ে কী কলুষ দুর্গন্ধ পুরীষে
তাদের সমগ্র সত্তা পশুদের মাঝে চলে মিশে।
কক্কুর, কুক্কুরী
কোন ব্যাভিচারে তারা পরস্পর হানিতেছে ছলনার ছুরি,
আনিছে জারজ কোন মৃত সভ্যতার পদতলে।
উরুর ইঙ্গিত দিয়ে তাদের নারীরা আজ মৃত্যুপথে চলে,
মানুষের পথ ছেড়ে বহু নিম্নে মৃত্যুর অতলে।
তাহাদেরি শোষণের ত্রাস
করিয়াছে গ্রাস
প্রশান্তির ঘর,
যেথা মুখ গুঁজে আছে শীর্ণ শব ধরণীর ‘পর।
হে জড় সভ্যতা।
মৃত-সভ্যতার দাস স্ফীতমেদ শোষক সমাজ।
মানুষের অভিশাপ নিয়ে যাও আজ।
তারপর আসিলে সময়
বিশ্বময়
তোমার শৃঙ্খলগত মাংসপিন্ডে পদাঘাত হানি
নিয়ে যাব জাহান্নাম দ্বার-প্রান্তে টানি;
আজ এই উৎপীড়িত মৃত্যু-দীর্ণ নিখিলের অভিশাপ বও;
ধ্বংস হও
তুমি ধ্বংস হও ॥

সতত উচ্চারণ ছিলো যার ন্যায়ের, মনবতার, আপোষহীন সংগ্রামী চেতনার। তিনি তাঁর জনগোষ্ঠী কে তাঁর স্বাপ্নিক জগতের প্রেরণায় পংক্তির পর পংক্তি সাজিয়ে জাগাতে চেয়েছিলেন :

“কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হল জানিনা তা
নারঙ্গী বনে কাঁপছে সবুজ পাতা।
দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা
তবু জাগলে না? তবু তুমি জাগলে না?
সাত সাগরের মাঝি চেয়ে দেখো দুয়ারে
ডাকে জাহাজ
অচল ছবি সে, তসবীর যেন দাঁড়ায়ে
রয়েছে আজ।”

তাঁর ‘স্বর্ণ-ঈগল’ কবিতাটিতে লড়াকু সময়ের বর্ণনা করতে গিয়ে জাতিকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন তিনি।
” আল-বোরজের চূড়া পার হ’ল যে স্বর্ণ ঈগল /গতির বিদ্যুত নিয়ে, উদ্যাম ঝড়ের পাখা মেলে, /ডানা ভাঙ্গা আজ সে ধুলায় যায় পায় ঠেলে/ কঠিন হেলার কোটি গর্বোদ্ধত পিশাচের দল।/ মাটিতে লুটানো আজ সেই স্বর্ণপক্ষ, অনুতল! “/

কবিতাটি আজও যেনো বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বাস্তবতা। পারসিয়ার সুউচ্চ পাহাড় ডিঙিয়ে যে দল পার হলো আশির দশকে, আজ তাদের অস্তিত্ব বিলীন। নব্বইয়ের দশকে যাদের দাপট ছিলো, বিদ্যুত গতিতে ছিলো উদ্দাম, যারা ছিলো বাংলার আনাচে কানাচে, তারা আজ মৃয়মান। মাটিতে লুটানো আজ তারা। কি নির্মম বাস্তবতার ছবি এঁকেছেন, ভবিষ্যত ভাবনা, কি সুক্ষচিন্তা শক্তি! স্বর্ণ ঈগলের কবির।

স্বর্ণ ঈগল
আল-বোরজের চূড়া পার হ’ল যে স্বর্ণ-ঈগল
গতির বিদ্যুৎ নিয়ে, উদ্দাম ঝড়ের পাখা মেলে,
ডানা-ভাঙা আজ সে ধুলায় যায় তারে পায় ঠেলে
কঠিন হেলার কোটি গর্বোদ্ধত পিশাচের দল।
মাটিতে লুটানো আজ সেই স্বর্ণপক্ষ, তনুতল!
আলো, বাতাসের সাথী, তুফানের সওয়ার নির্ভীক
অস্তিম লগ্নের ছায়া দেখে আজ সে মৃত্যু-যাত্রিক,
অতল কূপের তীরে পাষাণ-সমাধি, জগদ্দল।
সূর্য আজ ডুব দিল অক্সাসের তটরেখা পারে,
আসন্ন সন্ধ্যায় কালি নিয়ে এল পুঞ্জীভূত শোক,
পাহাড় ভুলের বোঝা রুদ্ধপথে দাঁড়ালো নির্মম।
এখানে বহে না হাওয়া এ বিস্তীর্ণ প্রন্তরের ধারে,
এই অজগর রাত্রি গ্রাসিয়াছে সকল আলোক,
সোহরাবের লাশ নিয়ে জেগে আছে নিঃসঙ্গ রুস্তম।

কবি ফররুখ আহমদকে চরম দারিদ্রের সাথে জীবন যাপন করতে হয়েছে। কিন্তু অর্থের প্রতি, ক্ষমতার প্রতি তার কোন মোহ ছিল না। দারিদ্রতাকে তিনি সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। ভোগকে তিনি ঘৃণা করতেন। তার কবিতার মতই ছিল যাপিত জীবন। তাই তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে লিখেছিলেন-

“তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া
তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া।”

কবি ফররুখ আহমদের কাব্যগ্রন্থগুলো হলো- ‘সাত সাগরের মাঝি’ (১৯৪৪), ‘সিরাজাম মুনিরা’ (১৯৫২), ‘নৌফেল ও হাতেম’ (১৯৬১), ‘মুহুর্তের কবিতা’ (১৯৬৩), ‘ধোলাই কাব্য’ (১৯৬৩), ‘হাতেম তায়ী’ (১৯৬৬), ‘নতুন লেখা’ (১৯৬৯), ‘কাফেলা’ (১৯৮০), ‘হাবিদা মরুর কাহিনী’ (১৯৮১), ‘সিন্দাবাদ’ (১৯৮৩), ‘দিলরুবা’ (১৯৮৪)।
শিশু সাহিত্যেও তিনি অতুলনীয় ছিলেন। তার রচিত শিশুতোষ গ্রন্থ হলো- ‘পাখির বাসা’ (১৯৬৫), ‘হরফের ছড়া’ (১৯৭০), ‘চাঁদের আসর’ (১৯৭০), ‘ছড়ার আসর’ (১৯৭০), ‘ফুলের জলসা’ (১৯৮৫)।
বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত মহাকাব্য ‘মেঘনাদ বধ’ এর পরে অন্যতম মহাকাব্য ফররুখ আহমদ এর ‘হাতেম তায়ী’। তার ‘নৌফেল ও হাতেম’ একটি সফল ও জনপ্রিয় কাব্যনাটক। সনেট রচনায়ও সফল তিনি। বাংলা সাহিত্যে মাইকেলের পরে আর কোন কবি এত বেশি সফল সনেট রচনা করতে পারেন নি। তার সনেট গ্রন্থের মধ্যে- ‘মুহুর্তের কবিতা’, ‘দিলরুবা’, ‘অনুস্বার’ প্রধান। গদ্য কবিতায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন কবি ফররুখ আহমদ। তাঁর গদ্য কবিতার সংকলন-‘হাবেদা মরুর কাহিনী’ লিখে সফল তিনি। গীতিনাট্য ‘আনার কলি’ (১৯৬৬) ছিলো অনবদ্য ।

সমস্ত কবিতায় এক সুদূরপ্রসারী স্বাপ্নিক মন নিয়ে যিনি শব্দ সাজাতেন, যেনো ঈগলের চোখ আর নাবিকের মন নিয়ে সমুদ্র থেকে সমুদ্রে ঘোরা এক নাবিক, মানবিক বিশ্ব গড়ার স্বপ্নে তার জনগোষ্ঠীকে স্বপন দেখাতেন, তিনি এমনি দিনে লাশ হয়ে চলে গেলেন আমাদের নশ্বর পৃথিবী থেকে। কিন্তু আজও তাঁর স্বপ্ন জাগানো কবিতাগুলো মননশীল মানুষের হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়।তবে আজও তাঁর বাঙালী মুসলমান শিক্ষা-সংস্কৃতি-আলোহীন হয়ে যাপন করছে সীমাহীন এক তন্দ্রাচ্ছন্ন সময়। মননশীলতার এক অকালে কবির অনুভর তীব্র হচ্ছে।

কবি ফররুখ আহমদ কবি স্বীকৃতি হিসেবে অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার অন্যতম হলো- বাংলা একাডেমী (১৯৬০), প্রেসিডেন্ট পদক ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ (১৯৬৫), আদমজী পুরস্কার (১৯৬৬), ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৬), একুশে পদক (১৯৭৭-মরনোত্তর), স্বাধীনতা পদক (১৯৮০-মরনোত্তর)।
প্রভু, তাঁকে কাল থেকে কালান্তরে মর্যাদাশীল রাখো। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তাঁর জন্য নিরন্তর।


মাঈন উদ্দিন জাহেদ : কবি ও প্রাবন্ধিক। সম্পাদক : পুবাকাশ (সাহিত্য ও চিন্তার ওয়েবপোর্টাল)।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন