স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র


জাদুচোঙায় তৃতীয় বিশ্ব


জ্যোতির্ময় নন্দী


পুবাকাশ


গল্পে যেখানে তৃতীয় বিশ্বের কাঁচামাল থেকে তৈরি পণ্যে তৃতীয় বিশ্বের চাহিদা পূর্ণ না-হওয়ার ‘নববাস্তবতা’র দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করা হয়েছে বলে মনে হয়, সেখানে পিন্টু তার ছবিকে নিয়ে গেছেন ‘জাদুবাস্তবতা’র দিকে। স্বপ্নময়ের গল্পের হরিদাসের মতো পিন্টুর আলির চোঙ দিয়ে প্রার্থিত বস্তু না বেরুলেও বস্তুজগতের এক দিব্যদর্শন বেরিয়ে আসে।

আনোয়ার হোসেন পিন্টু’র স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিক’ (The Magic of the Third World) দেখে আমার বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের অভিজ্ঞতা হয়েছে বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। মাত্র বিশ মিনিটের ছবিটিতে অধিকার হারানো ও অধিকার হরণকারীর, শোষকের ও শোষিতের, নিপীড়ক ও নিপীড়িতের, প্রথম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতির ও বৈপরীত্যের স্বরূপ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে আমার মনে হয়েছে।

আনোয়ার হোসেন পিন্টু’র কাজ সম্পর্কে কথা বলতে গেলে প্রথমে তাঁর ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে জানা থাকা দরকার। তাঁর আজন্ম বসবাস চট্টগ্রাম শহরে। এ শহরকে তিনি অবশ্যই ভালোবাসেন এবং এর অলিগলি, অন্ধিসন্ধি সব তাঁর নিবিড়ভাবে চেনাজানা। তিনি এবং ছবিটির প্রযোজক হাসিনা বেগম (ব্যক্তিগত জীবনে যিনি তাঁর স্ত্রী), অর্থাৎ ছবিটির প্রযোজক-পরিচালক দুজনেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। তিনি চট্টগ্রামের অন্যতম বনেদি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান সিগনেট প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের সন্তান। অত্যাধুনিক মুদ্রণ, প্রকাশনা প্রভৃতির সঙ্গে তিনি আশৈশব পরিচিত। এ প্রেস থেকেই পরে প্রকাশিত হয় চট্টগ্রামের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা দৈনিক পূর্বকোণ, এবং এ পত্রিকার জন্মলগ্ন থেকেই পিন্টু যুক্ত আছেন। সহকারী সম্পাদক হিসেবে এ কাগজের নাট্য-চলচ্চিত্র পাতাটির সম্পাদনা এবং অন্যান্য দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি আজ প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর ধরে।

তবে আনোয়ার হোসেন পিন্টু’র সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি আজীবন ও আপাতমস্তক একজন চলচ্চিত্রপ্রেমী, এবং তার চেয়েও বেশি সত্যজিৎপ্রেমী মানুষ। সত্যজিৎ মানে সত্যজিৎ রায়– বিশ্ববরেণ্য বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাতা। চট্টগ্রামে তিনি সত্যজিৎ চর্চা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা। সত্যজিৎকে নিয়ে তাঁর বেশকিছু প্রকাশনা আছে, মুদ্রণ ও অলঙ্করণ সৌকর্ষ এবং বিষয়বস্তুর দিক থেকে যেগুলোর মান জাতীয়-আন্তর্জাতিক যেকোনো বিচারে সর্বোত্তমদের সারিতে বলেই আমার মনে হয়। চট্টগ্রামে তথা বাংলাদেশে সুস্থ ও শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র আন্দোলনের পথিকৃৎদের মধ্যে তিনি অন্যতম। চলচ্চিত্র বিষয়ে তাঁর লেখা বিভিন্ন সারগর্ভ প্রবন্ধের সঙ্কলন ‘চলচ্চিত্র প্রসঙ্গ’, যে-নামের মধ্যে সত্যজিতের ‘বিষয়ক চলচ্চিত্র’-এর প্রভাব আছে বলে মনে হয়। আনোয়ার হোসেন পিন্টু সম্পাদিত চলচ্চিত্র বিষয়ক তিনটি মুখপত্র হল ‘ইন্টারকাট’, ‘লুক-থ্রু’ ও ‘চলচ্চিত্র চিন্তা’।

সংক্ষেপে এই হল আনোয়ার হোসেন পিন্টু’র প্রেক্ষাপট, যেটা না জানলে তাঁর কাজ পুরোপুরি বোঝা যাবে না। ‘তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিক’ ছবিটি তিনি উৎসর্গ করেছেন সত্যজিৎ রায় আর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ খসরুকে, যাঁদেরকে তিনি তাঁর দুই শিক্ষক বলে উল্লেখ করেছেন।

পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তীর একটি অণুগল্প অবলম্বনে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে বলে ছবিটির শুরুতে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে ‘উন্নতিশীল দেশগুলোর সমস্যা’ শিরোনামের গল্পটিতে স্বপ্নময় যা বলতে চেয়েছেন, পিন্টু’র ‘তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিক’ তাকে অনেকটাই ছাড়িয়ে গেছে চিন্তা-চেতনার পরিধির দিক থেকে। গল্পে যেখানে তৃতীয় বিশ্বের কাঁচামাল থেকে তৈরি পণ্যে তৃতীয় বিশ্বের চাহিদা পূর্ণ না-হওয়ার ‘নববাস্তবতা’র দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করা হয়েছে বলে মনে হয়, সেখানে পিন্টু তার ছবিকে নিয়ে গেছেন ‘জাদুবাস্তবতা’র দিকে। স্বপ্নময়ের গল্পের হরিদাসের মতো পিন্টুর আলির চোঙ দিয়ে প্রার্থিত বস্তু না বেরুলেও বস্তুজগতের এক দিব্যদর্শন বেরিয়ে আসে। বস্তুতপক্ষে, গল্পটার সঙ্গে ছবিটার সাদৃশ্য নিতান্তই ক্ষীণ বা দুর্নিরীক্ষ বললেই চলে। সত্যি বলতে কী, গল্পটার কাছে আদৌ এ ছবির ঋণ স্বীকারের কোনো দরকার ছিল কিনা ভাবছি। পিন্টু অবশ্য বলেছেন, এ গল্পের মধ্যেই তিনি এ চলচ্চিত্র নির্মাণ ভাবনার বীজ পেয়েছেন। বীজের জন্যে বৃক্ষের ঋণ স্বীকার প্রকৃত সৌজন্য বটে!

তবে মাত্র নয়টি বাক্যের একটি গল্পের বীজ থেকে বিশ মিনিটের একটা ছবি বানিয়ে তোলা কম কথা নয়। ছবিটির সংলাপ, চিত্রনাট্য রচনায় পিন্টুকে যথেষ্ট ঘাম ঝরাতে হয়েছে অনুমান করা যায়। ছবির প্রটাগনিস্ট ময়লা কুড়ানো লোকটার অধিকার বঞ্চনাকে ফুটিয়ে তোলার জন্যে রেস্তোরাঁ, বিপণী বিতান প্রভৃতি দৃশ্যগুলো, তার ময়লার স্তূপে বসে চোঙে চোখ দিয়ে জ্ঞানচক্ষু উন্মিলন প্রভৃতি দৃশ্যগুলো সম্পূর্ণভাবে পিন্টুর স্বকপোলকল্পিত। সত্যি বলতে কী, কোনো গল্পকারের গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হওয়া বা তা থেকে নিজের নির্মাণের বীজ খুঁজে পাওয়ার কথা পিন্টু যতই স্বীকার করুন না কেন, সেই গল্প পাঠ এবং তার সঙ্গে তুলনার পর ‘অবলম্বনে’ কথাটার কোনো অর্থ আমরা খুঁজে পাই না, এবং ‘তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিক’-কে একটা সম্পূর্ণ মৌলিক ছবি বলতেই প্রলুব্ধ হই।

স্বল্পদৈর্ঘ্যের একটা ছবির ভেতর দিয়ে (প্রতীকীভাবে বলা যায়, যেন একটা চোঙের মধ্যে দিয়েই) বিশাল বিস্তৃত একটা জীবনের চকিত স্ফূরণতুল্য উপস্থাপনা এ ছবির বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ছবির দৃশ্যগুলোতে চট্টগ্রামের নিত্যদিনের জনজীবন যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। যান-জনের জট-জটলা, বিপণীশ্রেণি, উদ্যান ইত্যাদি জ¦লজ্যন্ত মূর্ত বাস্তবতায় ভরপুর নগরীর পথে পথে যেতে যেতে একসময় পরিচালক দর্শকদের টেনে নিয়ে যান বিশাল ময়লার স্তূপের চূড়ায় এক জাদুবাস্তবতার জগতে।

সত্যজিৎ রায়ের ছবি দেখতে দেখতে যেমন তাঁর গুরু জঁ রেনোয়াঁর কথা মনে পড়ে যায়, তেমনি একলব্য শিষ্য পিন্টু’র ‘তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিক’ দেখতে দেখতে প্রতি পদে পদে মনে পড়ে তাঁর দ্রোণগুরু সত্যজিৎ রায়ের কথা। ডিটেইলসের কাজে ভীষণ সতর্ক অনুপুঙ্খতা, শট বিভাজন, আলোক প্রক্ষেপণ– সবকিছুই সত্যজিৎ রায়ের কাজগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়, যদিও এক নান্দনিক বিপরীত বিন্দু থেকে। সত্যজিতের চলচ্চিত্র যেন সবসময়েই আমাদেরকে অতি সাধারণ বস্তুগত স্তর একটা সাবলাইম বা উচ্চ ভাবনার স্তরে নিয়ে যায় বা যেতে চায়।

কিন্তু পিন্টু’র ছবিতে আমাদের বাস্তবতা বোধের স্তরই বরং যেন আরো গাঢ়তর হয়। যে বিরূপ বাস্তবতার মধ্যে আমরা নিত্যদিন বেঁচে থাকি, ‘তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিক’-এ তার স্বরূপের খানিকটা শিল্পের চেহারায় আমাদের সামনে খানিকটা আবির্ভূত হয়ে আমাদেরকে নিজেদের অস্তিত্বের বিপন্নতাকেই চিনতে শেখায়, কোনো নান্দনিক উপলব্ধিতে পরিণত হয়ে হারিয়ে যেতে দেয় না।

দুটো উদাহরণ দেয়া যাক। পিন্টু’র ছবিতে ক্লোজ-আপে দেখানো নর্দমায় জমে থাকা থকথকে পাঁকে বুদবুদ উঠে ফেটে পড়ার দৃশ্য এবং মৃদু ধ্বনি কেন জানি মনে করিয়ে দেয় ‘পথের পাঁচালী’ ছবিতে ক্লোজ-আপে পুকুরের জলে জলপোকার ছোটাছুটি বা দুর্গার চুরি করা সোনার সিঁদুরের কৌটাটি অপু পানা ঢাকা ডোবার জলে ছুঁড়ে দেয়ার পর পানা সরে গিয়ে টুপ করে সেটার ডুবে যাওয়ার দৃশ্যটি কথা মনে পড়িয়ে দেয়। মনে হয়, দুজন দুই কথা বলছেন একই ভাষায়। ‘তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিক’-এ কেন্দ্রীয় চরিত্র আলীর ময়লার পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়া এবং তারপর একটা পাহাড়ের চূড়োয় উঠে যাওয়া দেখে মনে পড়ে যায় সত্যজিতের ‘নায়ক’ ছবিতে প্রটাগনিস্ট অরিন্দমের টাকার নোটের পাহাড়ে চড়ার দৃশ্যের কথা। সত্যজিতের ছবির চরিত্রটি টাকার নোটের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে আমাদেরকে টাকার অসারতার মহান বার্তা দিয়ে যায়, যেখানে পিন্টুর ছবির চরিত্রটি আমাদেরকে শুধু বাস্তবতার কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিষণ্ণতার গভীরে আমাদের নিমজ্জিত করে।

স্বল্পদৈর্ঘ্যের এ ছবিটিতে চরিত্রগুলোর বাচিক অভিনয়ের সুযোগ তেমন ছিল না বললেই চলে। তবে যেটুকু ছিল তাতে প্রত্যেকেই যথাযথভাবে প্রত্যাশা পূর্ণ করতে পেরেছেন বলে আমার মনে হয়েছে। লং, মিডিয়াম, মিডিয়াম-লং, ক্লোজ-আপ প্রভৃতি নানারকম শটে ছবিটির নির্মাতা তাঁর প্রিয় শহরকে ধরে রেখেছেন এ ছবিতে, যেন শহরটা নিজেও এ ছবির একটি চরিত্র, হরিদাসের মতোই তৃতীয় বিশ্বের প্রতিভূ। এক্ষেত্রে প্রধান সহকারী পরিচালক আবু জাফর আবদুল্লাহ্ সমীর এবং আলোকচিত্রীদ্বয় জাহাঙ্গীর চিশতি আর মোরশেদ হিমাদ্রী হিমু-ও প্রভূত সাধুবাদের দাবিদার হন এক দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যকাব্য উপহার দেয়ার জন্যে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঐশ্বর্যবান তৃতীয় বিশ্বের নগরীটি প্রথম বিশ্বের প্রযুক্তি আর প্রপাগান্ডার বদৌলতে কীভাবে আস্তাকুঁড় আর ময়লার পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যায়, তা এ ছবির সীমিত পরিসরে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ ছবিতে দেখা যাবে, তৃতীয় বিশ্বের কোনো একটি শহরে কিভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে প্রাকৃতিক পাহাড় আর স্বচ্ছ জলের উৎস ঝরনা বা জলাশয়, আর তার জায়গায় সৃষ্টি হচ্ছে দ্রুত স্ফীয়মান জনসংখ্যার বর্জ্যরে পাহাড় আর ময়লা দুর্গন্ধ জলাবদ্ধ নর্দমা। জমে থাকা ঘন থকথকে পাঁকের মধ্যে গ্যাস জমে উঠতে থাকা বুদবুদ অনেকককে মনে করিয়ে দিতে পারে, চট্টগ্রাম শহরের যে-জায়গাটিতে এই নর্দমা দেখানো হয়েছে, তার বিশ কিলোমিটারের মতো দূরত্বে সীতাকুণ্ড পাহাড়শ্রেণির অভ্যন্তরে রয়েছে বা ছিল প্রাকৃতিক নানা উৎস বা কুণ্ড, যেখানেও বুদবুদ ওঠে বা উঠত প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট নানা গ্যাসের কারণে, এবং মানুষ শুচিতা, পুণ্যলাভ, এবং নানা চর্মরোগ থেকে অরোগ্যলাভের জন্যে এসেব কুণ্ডে স্নান করে বা করত। এধরনের উৎসগুলো এখন বিলীন বা বিলীয়মান, কিন্তু নোংরা ময়লা জল আর থকথকে পাঁকের নর্দমা বা কুণ্ড ক্রমবর্ধমান। এটাও তৃতীয় বিশ্বের এক ম্যাজিক বটে।

এ ছবির আরেক বড় সম্পদ শব্দধারণ ও প্রক্ষেপণ, যেক্ষেত্রে পরিচালকের চাহিদা দারুণভাবেপূর্ণ করেছেন শব্দগ্রাহক মাণিক। সূক্ষ্মথেকে সূক্ষ্মতম শব্দাবলী– যেমন ভোরবেলার দূরশ্রুত আজানধ্বনি আর ঘুম ভাঙা পাখির মৃদু কলকাকলি, চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়ি এলাকার গভীরে দিনদুপুরে পিনপতন নৈঃশব্দ্যের মধ্যে ঝিঁঝির ডাক আর নানারকমের পাখপাখালির ডাক, নর্দমায় গ্যাসের বুদবুদ ফোটার অস্ফূট শব্দ, ময়লার স্তূপে মাছির ভনভনানি, অনতিদূরের সমুদ্র আর সৈকত থেকে ভেসে আসা গাংচিলের ডাক ইত্যাদি– নিপুণভাবে ধারণ করা হয়েছে এ ছবিতে। আবার এর বিপরীতে উচ্চকিত শব্দের মধ্যে সাইরেনের, লাউডস্পিকারের, ক্রেনের, অ্যরোপ্লেনের গর্জন, যা আজানের আধ্যাত্মিকতা, জনজীবনের শান্তি, পাখির কলকাকলির সুষমাকে কিভাবে বার বার ছিঁড়েখুঁড়ে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে, তাও পরিস্ফূট হয়ে উঠেছে নাটকীয়ভাবে। চট্টগ্রামের যে সিআরবি এলাকাটি রক্ষার জন্যে বর্তমানে জোর আন্দোলন চলছে, তার কিছু অপরূপ দৃশ্য ও ধ্বনি পিন্টুর এ ছবিতে বিধৃত রইল ভাবীকালের জন্যে।

বিশ মিনিটের ছবিটি আলির গয়ংগচ্ছ জীবনযাত্রার মতো ঢিমেতেতালা তালে চলতে চলতে শেষ চার-পাঁচ মিনিটের দিকে খুবই গতিমান হয়ে ওঠে। এ পর্বেই আবির্ভাব ঘটে স্বপ্নময়ের গল্পের সেই জাদুকরী চোঙের, এবং শিগগিরই যা গল্পের বীজকে বহুদূর ছাড়িয়ে গিয়ে পিন্টুর মহীরুহ হয়ে ওঠে। চোঙটা আলি খুঁজে পায় বিশাল এক ময়লার পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সেখানে দাাঁড়িয়ে থাকা ময়লা সরানোর অতিকায় ক্রেনের বাড়ানো হাতের তলা দিয়ে গিয়ে ময়লা ঘাঁটাঘাঁটির সময়– একটা প্লাস্টিক পাইপের হাতখানেকের কাটা অংশ, কোনো স্থাপনায় বাড়তি হলে যেগুলো মানুষ সাধারণত ফেলে দেয়। স্বপ্নময়ের গল্পের হরিদাসের মতো পিন্টুর আলি চোঙটা পেয়েই তা থেকে জিনিস বের করতে বসে যায় না। এধরনের একটা চোঙা পেলে বাচ্চারা সাধারণত যা করে, আলিও সেভাবেই ময়লার পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে চোঙটার একমুখ চোখে লাগিয়ে অন্যমুখ দিয়ে আকাশ দেখতে থাকে। চোঙের গোল মুখে একে একে আবির্ভূত হয় হেলিকপ্টার, দূর দিগন্তে সমুদ্র, আকাশে উড়ন্ত গাংচিল, আবার কোত্থেকে চলে আসে পিঠে পাঠ্যবইয়ের বিশাল ব্যাকপ্যাকের ভারে নুয়ে পড়া শিশু, পেছনে মুটের মাথায় ঝাঁকায় আরো বই। বর্তমান সময়ের বিদ্যার্থীর এ দুরবস্থা দেখে আলি হা হা করে হাসে। তার অট্টহাসি শুনে অদূরে আরেক স্তূপে কর্মরত এক যুবক এগিয়ে এসে হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলে আলি তার হাতে চোঙটা দিয়ে সেটার মধ্যে দিয়ে তাকে দেখতে বলে। আলি দেখার চেষ্টা করেও কিন্তু কিছু দেখতে পায় না। তখন আলি বলে, দিল সাফ থাকলে তবেই সব দেখা যায়, একটা চোঙের মধ্যে দিয়ে সারা জগৎ, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। সে অভিযোগ করে, ছেলেটার মন নিশ্চয় পরিষ্কার নয়, তাই সে দেখতে পাচ্ছে না। ছেলেটা আলিকে ‘পাগল’ ডেকে চলে যায়। তারপর ‘পাগল’ আলি অদ্ভুত চোঙটার ভেতরটা পরিষ্কার করার জন্যেই যেন সে ওটার ভেতরে কিছু ন্যাকড়া ভরে দিয়ে একটা মরচে পড়া, ময়লামাখা স্ক্রুর ডাঁটি দিয়ে ঠেলা দিতেই চোঙটার অন্যমুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে কাপড় দিয়ে বানানো কৃত্রিম গোলাপ, ভাঙা কাঁচের টুকরো ভরে দিরে বেরিয়ে আসে কাঁচের গেলাস, দড়ি ঢুকিয়ে দিলে বেরিয়ে আসে টাই, ছেঁড়া কাগজের টুকরো ঢুকিয়ে দিলে বেরিয়ে আসে মোনালিসার ছবি যাকে আলি চিনতে পারে না। আবার কাগজের টুকরো ঢুকিয়ে দিলে বেরিয়ে আসে ‘দা কিড’ ছবিতে চার্লি চ্যাপলিন আর শিশুর পাশাপাশি বসে থাকার ছবিটি, যেটা আলি চিনতে পারে, কারণ তার পরনের ছেঁড়া, ময়লা গেঞ্জিটির বুকে চার্লি চ্যাপলিনের একটা স্কেচ আঁকা আছে (প্রসঙ্গত, স্কেচটা ছবির পরিচালকের নিজের হাতে আঁকা)। এভাবে বিশে^র কোনো এক প্রান্তের আরো এক ভ্যাগাবন্ড ভবঘুরে সর্বহারা প্রলেতারিয়েতের সঙ্গে চ্যাপলিনকে আবারও একসুতোয় বেঁধে দেন পিন্টু। চ্যাপলিনের ছবিটিকে দেখে যেন কোনো আপন স্বজনকে দেখার আনন্দে আবারও দিল খোলা হাসিতে ফেটে পড়ে। কিন্তু তারপর আলি আবার চোখে চোঙ লাগিয়ে দুনিয়া দেখতে থাকে। এবার চোঙের মুখে দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয় সমান্তরালভাবে বাংলাদেশে একাত্তরের গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা আর শরণার্থীর স্রোত এবং মায়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা এবং শরণার্থীর কাফেলা, মায়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি আর সেনাবাহিনীর জেনারেলের করমর্দন, আবার গোলাগুলির শব্দ, হতাহত মানুষের আর্তনাদ…। হাতের চোঙা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আলি আর্তস্বরে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে।

ছবিটির পূর্ববর্তী অংশগুলোর তুলনায় এই শেষ পাঁচ মিনিটে দৃশ্য বা ঘটনার একটা ঘনঘটার সৃষ্টি হয়েছে, যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে হয়তো পারস্পরিক সামঞ্জস্যহীন মনে হলেও তাদের ভেতরে একটা আন্তঃসম্পর্কের সুতো অবশ্যই আছে, যা বুঝতে হলে দর্শকের সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর অভিজ্ঞতা বা অধ্যয়ন থাকা দরকার।

ছোটগল্প সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কাব্যোক্তি ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’ পর্দায় উৎক্ষেপণের মধ্যে দিয়ে চলচ্চিত্রটি শেষ হয়েছে। কিন্তু কথা হল, শেষ যে হয়নি সেটা না বললেও হয়তো চলত, যেহেতু দর্শকরা নিজেরাই তা বুঝতে পারবেন। কাহিনিটার একটা প্রথাগত উপসংহার হলে হয়তো আরো ভালো লাগত, সেটাই হয়তো কাঙ্ক্ষিত ছিল। কিন্তু আলিদের মতো ছন্নছাড়া ভবঘুরেদের জীবনে মৃত্যু ছাড়া আর কীই-বা উপসংহার হতে পারে, অথচ সেটা দেখানো তো পরিচালকের কাঙ্ক্ষিত নয়! তাই ময়লার স্তূপের মাথায় আর্তনাদ-ক্রন্দনরত আলিকে ছেড়ে দিয়ে তিনি বিদায় নিয়েছেন।

‘তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিক’ ছবিটির পরতে পরতে একজন পরিপক্ক চলচ্চিত্র বোদ্ধা তথা নির্মাতার স্বাক্ষর রয়েছে। এ ছবি চিরায়ত বা মহৎ চলচ্চিত্রের মধ্যে পড়ে কিনা সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। তবে আনোয়ার হোসেন পিন্টু’র এই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি একটি নির্মল, শিল্পসম্মত ছবির নিদর্শন হয়ে থাকবে এত সন্দেহ নেই। বাংলাদেশে নির্মল চলচ্চিত্র আন্দোলনের পথিকৃৎ মোহাম্মদ খসরুর ভাবশিষ্য পিন্টুর জন্যে সেটাই বিশাল সার্থকতা।


জ্যোতির্ময় নন্দী : আশিদশকের খ্যাতিমান কবি-কথাশিল্পী-অনুবাদক-শিল্পসমালোচক।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন