ছোটগল্প
সুখ নেই বৈভবে
ফয়সল সৈয়দ
পুবাকাশ
টাইগার পাস মাজারের পাশে রেলওয়ের পরিত্যক্ত জায়াগায় থাকে আমেনার পরিবার। মরিয়মের বাপ চাচারা মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর সময় এসে বসত করে এখানে। সরকার কয়েকবার নোটিশ পাঠিয়েছে, অবৈধ সব স্থাপণা উচ্ছেদ করবে । উচ্ছেদ অভিযান শুরু করলে রাস্তায়, ফুটপাতে থাকতে হবে তাদের।
ভাবতে গিয়ে অন্ধকার হয়ে যায় বিবি মরিয়মের পৃথিবী, অন্ধকার মানে নিকষ কালো অন্ধকার- সেই অন্ধকারে নিজের হাতও দেখতে পায় না; ভূতুড়ে অন্ধকার।
বিবি মরিয়ম বিয়ের দেড় বছরের মাথায় স্বামী ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়। বিয়ের পর মেয়ের জামাই আক্কাস মিঞার একের পর এক আবদার মিটিয়েও মেয়ের সংসার টিকিয়ে রাখতে পারেনি বিধবা মা আমেনা বেগম।
আমেনা বেগমের সংসারে মেয়ে বিবি মরিয়ম আর দশ বছর বয়সের ছেলে মারুফ। ছোট পরিবার তাতে টানাটানি। নূন আন্তে পান্তা ফুরায় । এরমধ্যে মেয়ের জামাইয়ের একের পর এক অন্যায় আবদারে অতিষ্ট হয়ে উঠে আমেনা বেগম। ইপিজেডে একটি গার্মেন্টসের ক্লিনাররের কাজ করে, জেনারেল ডিউটি, ওটি মিলে ১৫/১৬ হাজার টাকার মতো পায়। তাই দিয়ে সংসার চলে, ছোট ছেলেটির লেখা পড়ার খরচ চালাতে রীতিমতো হাফিয়ে উঠছে আমেনা। মেয়ের জামাই রিকশা চালাবে। ভাড়া রিকশা চালিয়ে পোষায় না তার। প্রতিদিন ৫০ টাকা করে দিতে হয় রিকশার মালিককে। নিজে রিকশা কিনে চালাতে চায়- আক্কাস মিঞা। টাকা জোগাড় করতে চাপ দেয় মরিয়মকে। শাশুড়ী আমেনা বেগম সুদে ৩০ হাজার টাকা জোগাড় করে মেয়ের জামাইর হাতে তুলে দেয়। তিন মাস যেতে না যেতে রিকশা বিক্রি করে দেয় আক্কাস। রিকশা চালাতে বল লাগে , শক্তি লাগে। এত শ্রম তার শরীরে সহে না। কয়েকদিন সবজি ব্যবসা করে সুবিধা করতে পারে না । সিদ্ধান্ত নেয় পানের ব্যবসা করবে । দোকান দেখে এসেছে আক্কাস। মরিয়মকে নিয়েও একবার দেখে এসেছে দোকান। অগ্রীম ৫০ হাজার টাকা, মাসে ভাড়া তিন হাজার টাকা। রাতে ঘুমাতে গিয়ে আক্কাস মরিয়মকে জড়িয়ে ধরে বলে, তুই একবার তোর মা’রে ক বউ। তুই কইলে না করবো না। মাত্র ৫০ হাজার টাকা। মরিয়ম আগের ৩০ হাজার টাকার হিসাব চায়।
আমতা আমতা করে হিসাব দিতে গিয়ে হিসাব দিতে পারে না আক্কাস। মাথা বিগড়ে যায় তার, আবোল তাবোল বকতে থাকে। টাকা আমার লাগবুই, তুই তোর মা’র তোন ৫০ হাজার টাকা নিয়ে আইবি। রেগে ফোসফাস করে আক্কাস।
টাইগার পাস মাজারের পাশে রেলওয়ের পরিত্যক্ত জায়াগায় থাকে আমেনার পরিবার। মরিয়মের বাপ চাচারা মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর সময় এসে বসত করে এখানে। সরকার কয়েকবার নোটিশ পাঠিয়েছে, অবৈধ সব স্থাপণা উচ্ছেদ করবে । উচ্ছেদ অভিযান শুরু করলে রাস্তায়, ফুটপাতে থাকতে হবে তাদের।
স্বামীর অত্যাচার দিন দিন বাড়তে থাকে মরিয়মের উপর। চরম পর্যায়ে চলে যায় । মরিয়মের পোয়াতী শরীরে উঠতে বসতে কষ্ট হয়, তার উপর স্বামীর পৈশাচিক নির্যাতন। সব মুখ বুজে সহ্য করে। তার শরীরের ভেতরে যদি আরেকটি শরীর বেড়ে না উঠতো। এসপার ওসপার একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতো সে। পেটে বাচ্চা নিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকে স্বামীর সংসারে। প্রতিদিন রাতে ঘরে ফিরে স্বামী মরিয়মকে প্রহার করে। স্বামীর অত্যাচারে শরীর নেতিয়ে যায়, মরিয়ম চোখ তোলে তাকায়, রাগে,ক্ষোভে, ঘৃণায়। ঐ হারামজাদি, মাগি চোখ তোলে কি চাস, ডর দেখাস। দুই পয়সার মোরদ নাই চোখ রাঙাস, বেশি বাড়াবাড়ি করলে জ্যান্ত পুতে ফেলুম মাটিতে। আক্কাস মরিয়মের পেটে লাথি মেরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
ও আল্লাহ গো বলে বাইন মাছের মতো ছটফট করতে থাকে মরিয়ম মাটিতে । রক্তে ভেসে যায় দু’পা। মরিয়মের চিৎকারে ছুটে আসে প্রতিবেশিরা।
প্রচুর রক্তক্ষরণে নষ্ট হয়ে যায় মরিয়মের পেটের সন্তান। সন্তান হারিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে যায় সে। মা আমেনা বেগমের অনুরোধেও স্বামীর ঘরে যেতে রাজি হয় না। গার্মেন্টসের অপারেটর হিসাবে কাজ নেয় মরিয়ম। মা-মেয়ে দু’জনে এখন আয় করে। টাইগার পাস দখলের জায়াগাতে ভাড়া দিতে হয় না। তাই একটি ডিপোজিট একান্ডট খোলে বাকি টাকা সংসারে খরচ করে। ভালো যাচ্ছিল মা-মেয়ে, এক ভাই নিয়ে তাদের সংসার। আক্কাস মিঞার কথা ভুলে গেছে। ভুলে থাকতে চায় মরিয়ম; ভয়ংকর, বিভীষীকাময় সেই দিনগুলো।
কয়েকদিন থেকে আমেনা বেগমের শরীর দূর্বল লাগে, একটু কাজ করলে হাফিয়ে উঠে। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা অথচ কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। মুখে রুচি নেই। বমি বমি ভাব। গ্যাস্টিকের ঔষুধ, পেটের ব্যথার, বমির ঔষুধ খেয়েছে। অসুখ সারে না। পেটের ব্যথায় ছটফট করতে থাকে, গোঙাতে থাকে। কত কবিরাজের ধারস্ত হয়েছে কিছুতে কিছু বুঝা যাচ্ছে না। মা’য়ের শরীর দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। এই ডাক্তার সেই ডাক্তার কত ডাক্তারের শরাপন্ন হয়েছে ইয়ত্তা নেই। সি আর সিআরের ডাক্তার সাকেরাকে দেখায়, কয়েকটি টেস্টে করিয়ে বলেন, আপনারা বেশি দেরি করে ফেলেছে।
রোগীর পাকস্থলীতে ক্যান্সার। আকাশ ভেঙ্গে পড়ে বিবি মরিয়মের মাথায়। ডাক্তার জানায়, স্তন ক্যান্সার, জরায়ুর মুখের ক্যান্সার, ক্ষুদ্রান্তের প্রাথমিকে পর্যায়ে ধরা পড়ে, দুঃখজনক হলেও সত্য পাকস্থলীর ক্যান্সার জন্য এমন কোন স্ক্যানিং স্টেস্ট নেই বা অন্য কোন স্টেস্ট নেই যাতে প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা যায়।
মায়ের অসুস্থতার পিছনে মরিয়মের বেতনের পুরা টাকায় খরচ হয়ে যাচ্ছে। ছোট ভাই মারুফকে কোয়ালিটি হেল্পার পদে ডুকাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
১৭ বছরের কম কোন ছেলেকে চাকুরীতে নেয় না তারা। সংসারের দৈন্যদশা । আমেনা বেগম বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ে থাকে সারাক্ষণ। যে মেয়ে এখন তার সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা, স্বামী আদরে ফুরফুরে মেজাজে থাকার কথা। সে পড়ে পড়ে অসুস্থ মা, ভাইয়ের ঘানি টানছে।
প্রতিবেশী একজন মরিয়মের সংসারের দূর্দশা দেখে পরামর্শ দেয়, তুই মাকে নিয়ে ভিক্ষা করলে প্রচুর টাকা কামাতে পারবি। মানুষ ক্যান্সারের রোগীকে দান করতে দ্বিধা করে না- শুনে চটে যায় মরিয়ম। মা আমেনা বেগমের সাথে সলা পরামর্শ করে। এটা কুপরামর্শ না সুপরামর্শ বলে আমেনা বেগম। পেটের ক্ষুধা পৃথিবীর কোন নিয়ম নীতি মানে না, জাত, ধর্ম দেখে না। নজরুলের “মৃত্যুক্ষুধা” উপন্যাসে পেটের ক্ষুধায় মেঝবউ ধর্মান্তরিত হতে কুন্ঠাবোধ করেনি।
মাকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে মরিয়ম। রুটিন করে ভিক্ষা করে। শুক্রবার মসজিদের সামনে বাকি ছয় দিন রাস্তায় । সংসারের স্বচ্ছলতা খুঁজে পায় মরিয়ম। প্রতিদিন হাজারের উপর আয় ।
স্বামী আক্কাস মিঞা মরিয়মকে নিয়ে আবার সংসার শুরু করতে চায়, সুখের সংসার। অতীতের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত সে। মরিয়ম প্রথমে গো ধরে পরে ভাবে এখন তার পাশে একজন পুরুষ খুব দরকার। টাকা থাকলে চোখ ফুটতে দেরী। মরিয়মের ভেতরে একধরনের টাকার নেশা চেপে ধরে। ভ্যানগাড়ীতে করে এখন ভিক্ষা করে মরিয়ম। আক্কাস ভ্যান মসজিদের প্রবেশমুখে রেখে আসে, রেখে আসে মরিয়ম আর আমেনা বেগমকে। দূরত্বে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে টানতে মুস্ললিদের দানের টাকা গুনতে থাকে বিড়বিড় করে। শকুনের চোখ তার। আমেনা বেগম নিস্তজ শরীরে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে ভ্যানে, জীর্ণশীর্ণ শরীর।
মাথার কাছে ঝুলে লেমোরেটিং করা একটি কাগজ, যাতে লেখা আছে,
একটি মানবিক আবেদন
দীর্ঘদিন ধরে দূরোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত গার্মেন্টস কর্মী আমেনা বেগম। ক্যান্সারের চিকিৎসার পাশাপাশি সংসারের খরচ চালালো তার পরিবারের পক্ষে অসম্ভব। তাই নিরুপায় হয়ে মানবিকভাবে তাকে সাহায্যে আকুল আবেদন জানাচ্ছি।
বিনীত,
আমেনা বেগমের হতভাগ্য মেয়ে
বিবি মরিয়ম
ভ্যানে আমেনা বেগমের মাথার একপাশে হাঁটু গেড়ে পবিত্র কোরআন শরীফ খোলে ও ও করে সারা শরীর নাড়তে থাকে মরিয়ম। বুদ্ধিটি তাকে স্বামী আক্কাস দেয়, বউ, মা’র পাশে একটি কোরাআন শরীফ খুলে বসবি।
— কোরআন শরীফ নিয়ে আমি কি করুম, আমি কোরআন শরীফ পড়তে জানি না বলে মরিয়ম।
— না জানলে সমস্যা নেই। তুই কোরআন শরীফ নিয়ে বিড় বিড় করে ও ও করে সুর তোলবি । খবরদার গলা আওয়াজ বেশি বড় করতে পারবি না। কিছু হইলে বাকিডা আমি সামলামু। আশ্বস্ত করে আক্কাস।
মরিয়ম কোরআন শরীফ পড়ছে। ভ্যানের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে একজন যুবক শুনতে চেষ্টা কোন সুরা পড়ছে। অবস্থা বেগতিক দেখে মরিয়মের বুক ধক ধক করতে থাকে।
এ বেটা, যদি জিজ্ঞেস করে এখানে কি লিখেছে বল। ভয়ে চকরবগর করতে থাকে মরিয়ম। সে এখন কি করবে? কোরআন শরীফ নিয়ে পালাবে নাকি কোরআন শরীফ রেখে পালাবে। আক্কাস দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে টানতে তামাসা দেখছে। ঘরে যাই শালা সিগারেট পাজায় ডুকায় দিমু আইজকা। মনে মনে বলে মরিয়ম।
—ভাই কিছু দিলে দেন। বেগানা মাইয়া মানুষের কাছে বেশীক্ষণ দাঁড়ানো ঠিক না। আল্লাহ নারাজ হয়। গলা উঁচু করে বলে আক্কাস।
বুকে পানি আসে মরিয়মের। মুহূর্তের ভেতরে সব ভয় কেটে যায়। লোকটি কিছু না বলে পা বাড়ায়।
বগুড়ার ছেলে রাজু ভিক্ষাবৃত্তি করে মাসিক আয় ৪০ হাজার টাকা। তার পার্টির সিনিয়র ভাইস চেয়ারপারসন কাছে ধর্ণা দিয়ে আদায় করেন চিকিৎসা ভাতাসহ বগুড়ায় ৫০ শতাংশ জমি । ভিক্ষা করে লাখ লাখ টাকা খরচ করে পাঁচ বোনকে বিয়ে দেয়। রাজু অনায়াসে ভাঙ্গতে পারে শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গ; এটি তার হাতিয়ার, মেধা, কৌশল। মরিয়ম ভাবে এভাবে যদি সেও বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান বা শেখ হাসিনার ছেলে মেয়ের পা ধরে আকুতি বিনতি কিছু হাতিয়ে নিতে পারে। কেল্লা ফতেহ। আক্কাস জানায়, ওদের নাগাল পাবি কই ওরা তো দেশে থাকে না।
আমেনা বেগমের অবস্থা শোচনীয়। কিছু খেতে পারছে না। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে দৌড়াচ্ছে । কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। ডাক্তাররা কেউ আশাব্যঞ্জক কথা বলছে না। ডাক্তার সাহেব টাকার কোন সমস্যা না, আপনি বলেন কেমনে আমার মারে বাঁচাতে পাররুম। মরিয়ম ব্যাকুল কন্ঠে ডাক্তারকে বলে।
ডাক্তার আশ্বাস দিতে পারে না।
আমেনা বেগমের খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। স্যালাইন দিয়ে যতটুকু পারছে, শরীরকে সতেজ রাখার চেষ্টা চলছে ।
আক্কাস আর বিবি মরিয়ম ঘরের বিভিন্ন জায়গায় রাখা সব টাকা এক সাথে করে । গুনে তিন লাখ ক্যাশ আছে, সুদে খাটিয়েছে লাখ খানিক টাকা। সেখান থেকে উদ্ধার করে চল্লিশ হাজার টাকা। ব্যাংকের টাকাগুলো তোলে না । বিপদ আপদের হাত পা নেই। যখন লাগবে তখন উঠাবে। আক্কাস একটি মাইক্রো ভাড়া করে, ভোর হলে ওরা যশোর দিয়ে বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়ায় চলে যাবে। ইয়াবা ব্যবসায়ী আক্কাস এসব জায়গা ভালো চিনে। নখে দর্পণে।
মায়ের উন্নত চিকিৎসা করার আনন্দে রাতে অন্ধকারে জ্বল জ্বল করতে থাকে মরিয়মের চোখ।
সকাল গড়িয়ে দুপুর আসে, দুপুর পর বিকাল, বিকালের পর সন্ধ্যা নামে। প্রচন্ড বৃষ্টিতে ভিজে মারুফ কয়েকবন্ধু মিলে ঘরে ডুকে বলে, বুবু গোড়া শহর তন্ন তন্ন করে চইসসা ফালাইছি। কোথাও দুলাভাইরে খুঁজে পাইনি।
আমেনা বেগম, বিবি মরিয়ম কেউ আজ সারাদিন কিছু মুখে তোলেনি।
একফোঁটা পানিও না।
কেউ রোগে, কেউ শোকে।
ফয়সল সৈয়দ : কবি ও কথাশিল্পী।