মুক্তগদ্য
একজন শহীদ কাদরী ও নিউইয়র্কের কবিতার আসর
রওশন হাসান
পুবাকাশ
বিখ্যাত বহু কবি, সাহিত্যিক আছেন, যাঁদের গ্রন্থসংখ্যা খুবই কম। ফরাসি কবি বোদলেয়ারের বইয়ের সংখ্যা একটাই (লে ফ্লর দ্যু মাল)। কবিতার সংখ্যা ১৮০টি। প্রখ্যাত কবি জাঁ আর্তুর রাবো। তাঁর বই মাত্র দুটি। এই বিরলপ্রজ কবিদের কাতারে কবি শহীদ কাদরী এক অদ্বিতীয় সংযোজন। লেখকদের অজস্র বই সম্পর্কে কবির মন্তব্য ছিল ‘সাধারণত দেখা যায় কি, লেখকেরা তাদের প্রধান লেখাগুলোর পর সব পুনরাবৃত্তি হয়ে যায়।’ তাঁর কবিতায় তিনি নতুনত্বের সাক্ষর রেখেছেন।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান কবি শহীদ কাদরী। তাঁর কবিতায় মানবজীবনের গভীরতর ভাব-সৌকর্য, নাগরিক জীবন ও সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গে অবতারণা ঘটেছে । সাহিত্যে শব্দ চয়ন ও নির্মিতিতে এক নতুন ধারার উদঘাটন তাঁকে দিয়েছে স্বতন্ত্র পরিচয় l
গত ২৮শে আগস্ট ২০১৬ সালে কবি শহীদ কাদরী চিকিৎসাধীন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে নর্থশোর হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। কবি শহীদ কাদরীর জন্ম ও মৃত্যুও আগস্ট মাস- বাঙালীর জীবনে শোকাবহ মাস। এ মাসেই বাঙালির অনন্য এই আধুনিক কবির চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী পূর্ণ হলো। এ মাসেই একটি কবিতা সন্ধ্যা হারিয়েছিল একজন অভিভাবককে, আমরা হারিয়েছিলাম আমাদের প্রানের কবিকে l
বাংলাদেশে অবস্থানকালীন কবি শহীদ কাদরীর কবিতার প্রতি অনুরক্ত ছিলাম l কবিকে সশরীরে দেখা ও কবির সঙ্গে আলাপচারিতার অদম্য ইচ্ছে ছিল বহুদিনের l নিউইয়র্কের বইমেলায় অবগত হয়েছিলাম কবি শহীদ কাদরীর বাসভবনে একটি সাহিত্য আসর প্রতি তিনমাস অন্তর অনুষ্ঠিত হয়। প্রকাশিত অন্তত একটি কাব্যগ্রন্থ কবির কাছে পৌঁছে দিয়ে ‘একটি কবিতা সন্ধ্যা’র আসরে অংশগ্রহণ করা যায়। কবিপত্নী নীরা কাদরীর ফোনকলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। ২০১৪ সালে প্রথম ‘একটি কবিতা সন্ধ্যা’য় অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয় l প্রথম দেখাতেই কবির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ভিন্ন এক অনুভূতি জাগ্রত হয়। আসরে কবিতাপাঠের পাশাপাশি কবি তাঁর কাব্য জীবন ও নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন পিনড্রপ নীরবতায় উপস্থিত সাহিত্যমোদীদের সমুখে l সকল বিষয়ে তাঁর সম্যকজ্ঞান উপলব্ধিতে আলোড়ন তুলেছিল। তাঁকে মনে হয়েছিল একজন জীবন্ত বিশ্বকোষ। শহীদ কাদরীর প্রতি কবি,পাঠক, সাংবাদিক সকল গুণীজনের প্রবল আগ্রহ ছিল। এরপর প্রায় প্রতিটি কবিতাসন্ধ্যায় আড্ডা, কবিতাপাঠে অংশগ্রহণ করেছি এবং আবিষ্কার করেছি নতুন কবি, লেখকদের। স্বরচিত কবিতা ইমেইলের মাধ্যমে কবির কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো। কবির নির্বাচিত কবিতা পঠিত হতো আসরে। এ আসরটি নিউইয়র্কসহ বাংলাদেশে ও বিভিন্ন মিডিয়ায় ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। নিউইয়র্কের বহুল প্রচারিত বাংলা পত্রিকা সাপ্তাহিক বাঙালীর সম্পাদক কৌশিক আহমেদকে দেখেছি ক্যামেরা কলাকুশলীসহ কবির সাক্ষাৎকার গ্রহণে। বাংলা সাহিত্যের নানা বিষয়ে অবহিত হয়েছি প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে l কবি এভাবেই ঋণী করে গেছেন তাঁর অসংখ্য পাঠককে l
‘হাওয়ায়-হাওয়ায় অনেক উড়লে
গাছের সঙ্গে একটা দিন
না হয় কিছু জমলো ঋণ।’
(একটা দিন/ কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই) l
বিখ্যাত বহু কবি, সাহিত্যিক আছেন, যাঁদের গ্রন্থসংখ্যা খুবই কম। ফরাসি কবি বোদলেয়ারের বইয়ের সংখ্যা একটাই (লে ফ্লর দ্যু মাল)। কবিতার সংখ্যা ১৮০টি। প্রখ্যাত কবি জাঁ আর্তুর রাবো। তাঁর বই মাত্র দুটি। এই বিরলপ্রজ কবিদের কাতারে কবি শহীদ কাদরী এক অদ্বিতীয় সংযোজন l লেখকদের অজস্র বই সম্পর্কে কবির মন্তব্য ছিল ‘সাধারণত দেখা যায় কি, লেখকেরা তাদের প্রধান লেখাগুলোর পর সব পুনরাবৃত্তি হয়ে যায়।’ তাঁর কবিতায় তিনি নতুনত্বের সাক্ষর রেখেছেন l
এ বছর ২০২০ সালে আমরা প্যানডেমিকের
মধ্য দিয়ে সংকটকাল অতিবাহিত করছি l কবিরা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে জগৎকে নিরুপণ করেন l কবি বলেছিলেন, ‘সময় এসেছে আমাদের দায় মুক্তির। আমাদেরকে প্রকৃতির কাছে ক্ষমা চেয়ে পরিশুদ্ধ হতে হবে’। আজকের পরিস্থিতির সঙ্গে কবির মন্তব্য কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা অনুমেয় l
শহীদ কাদরী বহুল পঠিত কবি। যুগে যুগে তিনি আলোচিত থাকবেন l কবির কবিতায় খুঁজে পাই :
`বন্য শুকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা
মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ
কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা
ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ’
‘প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না…’
একজন কবির কবিতা কীভাবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে তাঁর কবিতাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ বহন করে। কবির চোখ দিয়ে আমরা যাপিত জীবনের দুঃখ টানাপোড়েনের সাদৃশ্য খুঁজে পাই l সমকালদ্রষ্টা কবির উচ্চারণ সম্মিলিত মানুষের উচ্চারণ।
কবি অমিয় চক্রবর্তীর মত কবি শহীদ কাদরীও ছিলেন নির্বাসিত। নিউইয়র্কেই অমিয় চক্রবর্তী রচনা করেছিলেন, লিখেছিলেন তাঁর কিছু শ্রেষ্ঠ কবিতা। কবি শহীদ কাদরী নির্বাসন প্রসঙ্গ টেনেছেন তাঁর কবিতায় :
আমিও সশব্দে নিসর্গের কড়া নেড়ে দেখেছিলাম
পুকুর পাড়ের ঝোপে চুপি চুপি
ডাকাত পড়ার ভয়ে স্পন্দমান নিঃশ্বসিত জল
কুলুপ লাগানো তার নড়বড়ে নষ্ট জানালায় l
(নিসর্গের নুন/ উত্তরাধিকার)
কবি শহীদ কাদরী’র প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা চারটি। উত্তরাধিকার (১৯৬৭), তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা (১৯৭৪) কোথাও কোন ক্রন্দন নেই (১৯৭৮), আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও (২০০৯)। মৃত্যু পরবর্তী প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অগ্রন্থিত কাব্যগ্রন্থ ‘তোমাকে আংটির মত পরেছি স্বদেশ’ ও ‘বেলাশেষের গান’ l
ড. কায়সার হক অনূদিত Selected poems of Shahid Quaderi একটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয় l
লেখক অধ্যাপক কায়সার হক লিখেছেন, “The acedia, subjectivism and nihilism which formed the emotional base of the poetic edifice of uttaradhikar have been exchanged for impersonality, extroversion and commitment.”
জীবনের উত্থান পতনে সুখদুঃখ বোধ প্রতিটি মানুষের জীবনের অংশ। প্রতিটি মানুষই একধরণের অন্তঃসারশূন্যতায় ভোগে। এ জাগরিত বেদনা থেকে পরিত্রাণের সুযোগ খোঁজে মানুষ এবং কবি, কবিতা জীবনভিত্তিক গ্রন্থের স্মরণাপন্ন হয় l কবি শহীদ কাদরীর কবিতার উপলব্ধি, জীবনবোধ আমাদের জীবনের তাৎপর্য স্মরণ করিয়ে দেয়। অসংখ্য অ-কবিতার চেয়ে সল্পসংখ্যক কবিতাই ধীসম্পন্ন কবির কাজ। সংহত আবেগে সংযত প্রকাশই কবি শহীদ কাদরীর কবিতার বৈশিষ্ট্য। কবি শহীদ কাদরী এই কারণেও অনন্য; জীবনে প্রায় ২৪ টি বছর কবিতায় সম্পৃক্ত থেকেও কবিতা না লিখে কাটিয়েছেন। তবুও বাংলাদেশের কবিতা চর্চায় তিনি চিরকালের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ ।
রওশন হাসান: কবি ও কথাকার। নিউইয়র্ক অভিবাসী।