আর্থার মিলার, মেরেলিন মনরো ও পুঁজিবাদী সমাজের মুখোশ ।। মুজিব রাহমান ।। পুবাকাশ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর অ্যামেরিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক আর্থার মিলার। ১৭ অক্টোবর ১৯১৫ সালের আজকের দিনে নিউ ইয়র্কে তাঁর জন্ম।

পারিবারিক সম্পর্ক এবং সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়সমূহ তাঁর অধিকাংশ নাটকের উপজীব্য।
তাঁর All My Sons নাটকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মুনাফালোভী শিল্পপতি জো কেলার এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রত্যাবর্তিত সেনা-পাইলট পুত্র ক্রিসের সম্পর্ক অন্য এক মানবিকমাত্রায় খতিয়ে দেখেছেন নাট্যকার।
জো কেলার অতি মুনাফার জন্যে নিজের দেশের সেনাবাহিনি ব্যবহৃত যুদ্ধ বিমানে ত্রুটিপূর্ণ ইনজিন বসিয়ে দিয়েছিলেন।ত্রুটিপূর্ণ ইনজিনের কারণে অজস্র বৈমানিক নিহত হয়। তাঁর বৈমানিক সন্তানের ফিরে আসার ভেতর দিয়ে অন্য সব বৈমানিকদের অর্থাৎ অন্য বাবাদের সন্তানদের জন্য তাঁর মাঝে উপলব্ধির যে উদগম ঘটে বিবেকের যে নবজন্ম ঘটে তাঁরই নাট্যরূপ উপস্থাপিত হয়েছে মিলারের এই নাটকটিতে। জো কেলার প্রত্যেক বিমানসেনা যাঁরা তাঁর ত্রুটিপূর্ণ ইনজিনের কারণে নিহত হয়েছে তাঁদেরকে নিজের সন্তান ভাবতে শুরু করে। এবং তাঁদের মৃত্যু অজস্র পুত্র হারানোর শোকের মতো তাঁকে শোকাহত করতে থাকে। বিবেকের এ দংশন বড়ো অরুন্তুদ, মর্মঘাতী। পুঁজিবাদী সমাজের মুখোশ উন্মোচক এ নাটক।

একইভাবে ১৯৫০-এর দশকের ‘লাল-শঙ্কা’ বা সমাজতন্ত্র ভীতি আধুনিক অ্যামেরিকানদের কীভাবে তাদের ইতিহাসের গোড়ার পর্বের সালেম গ্রামে নিয়ে গিয়েছিলো The Crucible বা ‘অগ্নিপরীক্ষা’ নাটকে তা জাজ্বল্যমান হয়ে ওঠেছে। সালেমে ১৬৯১-১৬৯২ সালে অপরাধ এবং দোষারোপের বানোয়াট আবহ তৈরি করে ডাকিনি-ডাইনি সন্দেহে ১৯ জন কিশোরীকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে মারা হয়েছিল।

একইভাবে কমিউনিস্ট সন্দেহে ব্যক্তিকে অবাঞ্চিত ও বিদ্রোহী -দেশদ্রোহী সাব্যস্ত করে ১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে আধুনিক গণতান্ত্রিক অ্যা মেরিকায় সেনেটর জোসেফ ম্যাককার্থি শুরু করেছিলেন এক কালো তালিকা প্রণয়ন। যার শিকার হয়েছিলেন গণমানুষের নাট্যকার মিলার।

পুঁজিবাদী সমাজে ব্যক্তি মানুষও পণ্য।
এই পণ্যায়নের বিরুদ্ধে অ্যামেরিকান নাট্যকার আর্থার মিলার সোচ্চার ছিলেন আমৃত্যু।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর গণতান্ত্রিক সময়ে মিলার ট্র‍্যাজেডিকে পুনশ্চ সংজ্ঞায়িত করেছেন। ব্রডওয়ে নাট্যশালা পুন খুলে দেওয়ার পরপরই নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে তিনি যুক্তি প্রদর্শন করে বললেন,

” the common man is as apt a subject for tragedy in its highest sense as kings were.”

তাঁর অঙ্গীকৃত অকৃত্রিম বিশ্বাসের কথা –

‘সবচেয়ে মহৎ যে বিবেচনায় রাজারা ট্র‍্যাজেডির বিষয়বস্তু হবার জন্যে উপযুক্ত সাধারণ মানুষও সে বিবেচনায় ততটাই উপযুক্ত।’
এ পৃথিবীতে একজন মানুষের যথাযথ স্থানটি খুঁজে পাবার যে সংগ্রাম, এ জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করার যে প্রস্তুতি এবং প্রয়োজনে নিজের মর্যাদা সুরক্ষিত করার যে অন্তর্গত তাগিদ তাকে তাড়িত করে মিলারের মতে এই বোধ থেকেই আধুনিক ট্র‍্যাজেডির উদ্ভব ও উদ্ভাস।

তাঁর বিখ্যাত নাটক, স্বপ্নভঙ্গের নাটক Death of a salesman। সেলসম্যান উইলি লোম্যান। সামান্য মানুষ। স্বপ্ন, মিথ্যা প্রত্যয়, আত্মবঞ্চনা উইলি লোম্যান চরিত্রের কুললক্ষণ। অলীক অধরা স্বপ্নের হাতে মার খেতে খেতে পর্যুদস্ত হতে হয়েছে উইলিকে। সত্যিকারের মূল্যবোধ হতে তাঁর বিচ্যুতি, নিজে যা নন সে উচ্চতায় নিজেকে স্থাপনের বিভ্রম তাঁকে মর্যাদারিক্ত করে তুলেছিল, ঠেলে দিয়েছিল আত্মবিলোপনের দিকে, আত্মহত্যার দিকে। তাঁর মৃত্যুতে বীমার টাকায় জ্যেষ্ঠ পুত্র বিফের বিভবের আকাশ-কুসুম কল্পনা, তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় মানুষের ঢ্ল নামবে এমন সুদূরপরাহত উচ্চাশা সবই শেষমেশ মিথ্যের চোরাবালিতে দেবে গেছে।
সেলসম্যান হিসেবে টানা ছত্রিশ বছরের ক্যারিয়ার তাঁকে শেষ পর্যন্ত কিছুই দেয়নি। ভেবেছিলেন তাঁর হাসি, চমৎকার ব্যবহার তাঁকে সেলসম্যান কিংবদন্তী ডেভ সিঙ্গেলম্যানের উচ্চতায় উন্নীত করবে। তাঁর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে শত শত সেলসম্যান, ক্রেতার জোয়ার নামবে। নামেনি।

মুনাফা মানুষ ও মনুষ্যত্ব্যের বিবেচনা করেনা। মানবিকতা বিবর্জিত বিকিকিনি-সভ্যতায় উইলির সখেদ উচ্চারণ:

“I put thirty-four years into this firm, Howard, and now I can’t pay my insurance! You can’t eat the orange and throw the peel away – a man is not a piece of fruit!”

সমাজের উপর তলার মানুষের পতন tragic, আর নিচু তলার মানুষের পতন pathetic, এই ধারণার গোড়ায় কোপ বসিয়েছিলেন মিলার।

পুঁজিবাদী অ্যামেরিকায় তাঁর এসব ভাবনার জন্যে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে মিলারকে।
অ্যামেরিকান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত House of Un-American Activities Committee (HUAC)-এর কাছে ১৯৫৬ সালে হাজির হতে হিয়েছিল তাঁকে। জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কল্পিত ও তথাকথিত ‘কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র’ সম্পর্কে। তিনি কমিউনিস্ট নন এ মর্মে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী নিতে এবং ষড়যন্ত্রীদের নাম বলতে তাঁর ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল। তিনি নতি স্বীকার করেননি। আদালত অবমাননার অভিযোগে তাঁকে জরিমানা করা হলো। কারাদণ্ড হলো মিলারের। ১৯৫৮ সালে আপিলে তার বিরুদ্ধে মামলা খারিজ হয়ে গেলো। তাঁকে আর জেল খাটতে হলো না।

কলেজে পড়াকালিন শুরু হয় তাঁর লেখালেখি। ১৯৪৭ সালে বত্রিশ বছর বয়সে তিনি প্রথম সাফল্যের মুখ দেখেন। All My Sons তাঁর প্রথম কীর্তি। তার দু বছর পর Death of Salesman এবং পুলিৎজার পুরস্কার।
তিনি দু ধরনের বাস্তবের কথা বলতেন। আর মঞ্চের বাস্তব কে মনে করতেন বাস্তবের চাইতে অনেক বেশি বাস্তব।

The Crucible মিলারের বিখ্যাত নাটক। ১৯৫৩ সালে ম্যানহ্যাটনের ব্রডওয়েতে প্রথম মঞ্চস্থ হবার পর রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতার কারণে বেলজিয়ান একটি নাট্যগোষ্ঠী যখন নাট্যদলসহ তাঁকে আমন্ত্রণ জানালো মার্কিন সরকার তাঁকে যেতে দিলেন না। তাঁর পাসপোর্ট আর নবায়িত হলো না। সেই থেকে শুরু হলো রাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁর ঠোকাঠুকি।

আধুনিক ট্র‍্যাজেডির ব্যাখ্যাতা প্রিয় নাট্যকার আর্থার মিলার হলিউডের সর্বকালের সেরা হৃৎ-কাঁপানো নায়িকা ‘বাস স্টপ’ (১৯৫৬) ‘সাম লাইক ইট হট’ এবং ‘দ্য মিসফিট’ অভিনয়-খ্যাত ম্যারিলিন মনরো ( জন্ম: ১ জুন, ১৯২৬ – মৃত্যু: ৪ আগস্ট ১৯৬২) কে বিয়ে করেন। তখন মনরোর ত্রিশ। নাট্যকারকে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হয়ে পরম ভালবাসায় গৃহী হতে চেয়েছিলেন মনরো। হলিউডি জীবনকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিলেন।

তাঁর জীবনাভিজ্ঞতার সারাৎসার মূর্ত হয়ে আছে তাঁর নানান কথায়, উক্তিতে ও উচ্চারণে। এমনই একটি কথা হলো:

“হলিউড এমন এক জায়গা যখানে একটি চুমুর জন্য তোমাকে তারা হাজার ডলার দেবে আর তোমার আত্মার বিনিময়ে দেবে আধা ডলার।”

এই বিশ্ববিশ্রুত নায়িকা মিলারের দুর্দিনে যখন তাঁর ওপর HUAC-এর সামনে হাজির হবার সপিনা-সমন তাঁকে সাহচর্য দিয়েছিলেন, নিয়ে গিয়েছিলেন আদালতে। এবং সেসময় তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লিখেছেন মিলারকে নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা –

“I am so concerned about protecting Arthur. I love him – and he is the only person – human being I have ever known that I could love not only as a man to which I am attracted to practically out of my senses – but he is the only person – as another human being that I trust as much as myself…”

মিলারের শেষের দিকের চিত্রনাট্য The Misfit-এ অভিনয় করেছিলেন মেরেলিন মনরো।

স্বল্পকথায় এই ছিলেন নাট্যকার আর্থার মিলার।

মুজিব রাহমান : সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ।

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন