শ্রদ্ধাঞ্জলি
শামসুর রাহমান: একটা যুগের নাম
মজিদ মাহমুদ।। পুবাকাশ
শামসুর রাহমান ছিলেন সূচনা লগ্ন থেকেই শক্তিশালী । ১৯৬০ সালে যখন তাঁর ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, তখন থেকে বাংলা কবিতার একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল। এমনকি চল্লিশের আধুনিক কবিরাও তাঁর কবিতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন। চল্লিশ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের অধিকাংশ কবি শামসুর রাহমানের ঘরানায় কবিতা লিখতেন।
বাংলা কবিতায় শামসুর রাহমান একটা যুগের নাম। কবিতার সাম্রাজ্যের নাম। ভালো কবিতা অনেকে লিখেছেন; কিন্তু তারা যুগকে শাসন করতে পারেননি। শামসুর রাহমান করেছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় তিনিই ছিলেন রাজা। তাঁর কবিতার সাম্রাজ্য নিয়ে সংশয় ছিল না। ভালো কবিতা লেখা আর তাঁর যুগকে শাসন করা এক নয়। জীবনানন্দ দাশ ভালো কবিতা লিখেছিলেন; কিন্তু তাঁর কালের উপরে নিয়ন্ত্রণ ছিল না। নিজের কালের কবিদের তিনি প্রভাবিত করতে পারেননি। জীবিত জীবনানন্দের চেয়ে মৃত জীবনানন্দ বেশি শক্তিশালী। শামসুর রাহমান ছিলেন সূচনা লগ্ন থেকেই শক্তিশালী । ১৯৬০ সালে যখন তাঁর ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, তখন থেকে বাংলা কবিতার একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল।এমনকি চল্লিশের আধুনিক কবিরাও তাঁর কবিতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন। চল্লিশ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের অধিকাংশ কবি শামসুর রাহমানের ঘরানায় কবিতা লিখতেন।
তাঁর পরের কবিদের অনেকে এখনো রাহমানের কালে পড়ে আছেন। তিনি অনেক লিখেছেন, অনেক রকম করে লিখেছেন। সময়ের প্রয়োজন মেটানো কবিতাগুলো সামনে আসে বলে এ কালে তাঁর প্রতিভা নিয়ে অনেকে ভুল বার্তা দিতে চেষ্টা করেন। আজ এই মহান কবির মৃত্যুদিন। প্রায় সাতাশ বছর আগে ১৯৯৫ সালে তাঁর একটি কবিতার ছন্দ নিয়ে ইত্তেফাকে ছোট একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। কবি আকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন- ‘প্রয়োজনীয় লেখা।’ তাঁর জন্মদিনে সেটি দিয়েই শ্রদ্ধা তর্পন করছি:
শামসুর রাহমানের ‘রূপালী স্নান’ – এর ছন্দ, দীপ্তি ত্রিপাঠীর বিশ্লেষণ বিভ্রাট
শামসুর রাহমানের কবিতার ছন্দ বিশ্লেষণে দীপ্তি ত্রিপাঠীর একটু ভুলের প্রতি ইঙ্গিত করছি। ত্রিপাঠী বাংলাদেশের আধুনিক কাব্য পরিচয়’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের কবিতায় গদ্য ছন্দের চলন বেশি। অনেক সময় গদ্যই কবিতা হয়ে উঠেছে, অনেক সময় কবিতাই গদ্য। অনেক কবিতায় হঠাৎ মিল পাওয়া যায় যাকে অন্ত্যানুপ্রাস অলঙ্কার বলাই সঙ্গত। এই জন্যেও অক্ষরবৃত্ত বা তানপ্রধান কবিতাগুলিকে ছকে ফেলা কঠিন। যেমন শামসুর রাহমানের ‘রূপালী স্নান’ কবিতার মধ্যে হঠাৎ মিল পাওয়া যায়।
শুধু দু’টুকরো শুকনো রুটির-১০/ নিরিবিলি ভোজ-৬
অথবা প্রখর ধূ ধূ-৮ পিপাসার আঁজলা ভরানো-১০/
পানীয়ের খোঁজ -৬/গোধূলির রঙে একদিন -১০/ শেষে
খুঁজে নিতে হবে-৮/ ঘাসের শয্যা -৬ ছন্দে ও মিলের কথা
বানানোর -১১/ আরক্ত কতো তীক্ষ্ন-৯
ছন্দলিপি দাঁড়ালো এই রকম :
১০+৬
৮+১০+৬
১০+৮+৬
১১+৯
তাহলেই দেখছেন কবিকে ছকে ফেলা যাচ্ছে না, যদিও কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত এবং মাঝে মাঝে মিলও আছে।”
দীপ্তি ত্রিপাঠী তিরিশের বাংলা কবিতার প্রধান প্রতিষ্ঠিত সমালোচক। আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ। এই গ্রন্থে তিনি তিরিশের যে পাঁচ প্রধান নির্মাতাকে আবিষ্কার এবং ব্যাখ্যা করেছিলেন, তা অতিক্রম করবার স্পর্ধা আমাদের সাহিত্যের অধ্যাপক এবং সমালোচকরা বড় একটা দেখাননি। ত্রিপাঠীর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, একটি পরিবর্তনের প্রতি ইঙ্গিত করবার জন্য। বিভিন্ন সময়ে সাহিত্যে যে কাল পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে, সেই পরিবর্তনকে দেখিয়ে দেবার জন্য নতুন আলোচকের প্রয়োজনীয়তাও অপরিহার্য। প্রবীণ আলোচক সেই পরিবর্তন ধরতে পারছেন না।
একটু পরিষ্কার করে বলি, তিরিশের পরে বাংলা কবিতার যে উল্লেখযোগ্য ধারার সৃষ্টি হয়েছে, সেটি হলো, পঞ্চশের দশকে বাংলাদেশে বাংলা কবিতা- যা বাংলা কাব্যের ইতিহাসে স্থায়িত্বের দিকে অগ্রসরমান। আর এই পরিবর্তনের প্রধান পুরোহিত শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরীসহ পঞ্চশের আরও ক’জন প্রধান নির্মাতা। আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, ফজল শাহবুদ্দীন, ওমর আলী, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান- এই পরিবর্তনের সামগ্রিক সম্পূরকতা দান করেছেন, যেমনিটি তিরিশে ঘটেছিল।
দীপ্তি ত্রিপাঠী এ ভুলটি কেন করলেন? ‘রূপালী স্নান’ এর মতো একটি বিখ্যাত কবিতা- যে কবিতা একজন প্রধান কবির পরিচয় নির্ণায়ক এবং যে কবিতায় কোথাও একটি মাত্রাও পতন ঘটেনি! তাহলে কি ধরে নেব ছন্দসংক্রান্ত ত্রিপাঠীর জ্ঞান অপরিক? না, যিনি তিরিশের বন্ধুর ছন্দের দুর্গে নিখুঁতভাবে যাতায়াত করেছেন, ছন্দ বিশ্লেষণের তাঁর জ্ঞান নিঃসন্দেহে পোক্ত। কিন্তু পাঠের স্থবিরতা এবং যুগ পরিবর্তনের অম্ল-মধুর হাওয়া তিনি ধরতে পারছেন না। তিরিশকে তিনি বাংলা কবিতার চরম উৎকর্ষ ভেবে হাল তুলে পাল গুটিয়ে নিয়েছেন। তাঁর জীবদ্দশায় এমন একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে, তিনি তা বুঝতে পারেননি। আলোচ্য কবিতাটি শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ গ্রন্থের অন্তর্গত প্রথম কবিতা। গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশকাল ১৯৬০। এই গ্রন্থ প্রকাশের প্রায় চৌত্রির বছর পর দীপ্তি ত্রিপাঠী লিখলেন ‘বাংলাদেশের আধুনিক কাব্য পরিচয়’। তিরিশের পরে বাংলা কবিতায় এমন একটি পরিবর্তন ঘটে গেছে, যা আমরা টের পাইনি। এই টের না পাওয়ার কারণ কি? এবং পরিবর্তনই বা কোথায়? ‘রূপালি স্নান কবিতাটি আলোচনা সাপেক্ষে একটু ইঙ্গিত করা যাক। কবিতাটির অংশবিশেষ উদ্ধার করছি :
শুধু দু’টুকরো-৬/শুকনো রুটির-৬/ নিরিবিলি ভোজ-৬
অথবা প্রখর-৬/ধু ধু পিপাসার-৬/আঁজলা ভরানো-৬
পানীয়ের খোঁজ-৬/
শান্ত সোনালী -৬/আল্পনাময়-৬/আপরহ্নের -৬/ কাছে
এসে রোজ -৬/
চাইনি তো আমি-৬/দৈনন্দিন-৬/ পৃথিবীর পথে-৬/ চাইনি শুধুই-৬
শুকনো রুটির -৬/টক স্বাদ আর-৬/ তৃষ্ণার জল-৬/ এখানো যে শুই-৬/
ভীরু -খরগোশ-৬/ব্যবহৃত ঘাসে-৬/ বিকেল বেলার-৬/কাঠবিড়ালিকে-৬ দেখি ছায়া নিয়ে-৬ শরীরের ছড়ায়-৬…
উপর্যুক্ত উদ্ধার অংশ একটু যত্ন করে লক্ষ্য করলেই পাঠক বুঝতে পারবেন, এই কবিতাটি মূলত মাত্রাবৃত্ত মুক্তকে লেখা। ছয় মাত্রার প্রবহমানতা কবিতার নিয়তিকে নতুন করে নির্ধারণ করেছে। মাত্রাবৃত্তের এরূপ ব্যবহার আমরা কি ইতোপূর্বে পাইনি? পেয়েছি, কিন্তু তার ধরন অন্যরকম। প্রথমত মাত্রাবৃত্তের একটি অপূর্ণ পর্ব পড়ুয়াকে একটু শ্বাস ফেলার অবসর দিয়েছে এবং ব্যতিক্রম ছাড়া মাত্রাবৃত্ত চরণের মধ্যে যতিপাতের স্বাধীনতা কম গ্রহণ করেছে। শামসুর রাহমান এই কবিতায় নতুন কোনো ছন্দ সৃষ্টি করেননি; কিন্তু ছন্দ প্রয়োগের স্বাধীনতা এবং দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। এই দক্ষতা তাঁকে নির্মাণ কুশলতার মর্যাদা দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের হাতে যে মাত্রাবৃত্তের জন্ম; নজরুল তাকে সর্বোচ্চ উৎকর্ষ দান করেছেন। দীপ্তি ত্রিপাঠী এখানেই ভুল করেছেন। শামসুর রাহমানের পূর্ব-সাধক তিরিশের কবিতা থেকে সমপর্যায়ের ছন্দভুক্ত কবিতার দু’-একটি উদাহরণ সংযোজন করা যেতে পারে। বুদ্ধদের বসুর কঙ্কাবতী’ কবিতাটি এক্ষেত্রে একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ; কেননা এই কবিতাটি অন্ত্যানুপ্রাসের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা গ্রহণ করেছে, সেই সঙ্গে মুক্তকের প্রধান্য রয়েছে।
অন্ধকারের-৬/অন্তর থেকে-৬/ তরঙ্গ-রোল,-৬/ ইতস্তত-৫
কেঁপে ফুটে ওঠে-৬/ কেটে বেজে যায়-৬/ ঢেউয়ের মুখের -৬/ফেনার মতো-৫(কঙ্কাবর্তী গো)
গড়ায়, দাঁড়ায়-৬/ সুপ্তির পরে-৬/স্বপ্নের ঘোরে-৬/ সমস্তরাত-৬;
তেমনি তোমার-৬ নামের শব্দ-৬/নামের শব্দ-৬/আমার কানে-৫
বাজে দিনরাত-৬/ বাজে সারারাত-৬/বাজে সারাদিন-৬, আমার প্রাণে-৬/ঢেউয়ের মত-৬/ ইতস্তত-৫;
অথচ কঙ্কাবতী’ কবিতাতেও ছয় মাত্রার চালের মধ্যে পাঁচমাত্রার একটি অপূর্ণ পর্ব রয়ে গেছে। তাছাড়া পূর্বানুবর্তনের ফলে রোমান্টিক সঙ্গীত মূর্ছনার সৃষ্টি হয়েছে, যা ‘রূপালী স্নানে’ পরিহার করা হয়েছে। রূপালী স্নানের সবচে কাছের একটি উদাহরণ, বিষ্ণু দের ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ কাব্যগ্রন্থের ‘পলায়ন’ কবিতাটি :
সফরী চোখের-৬/সরল চাহনি-৬/চোখের কোলের-৬/কালিমার মায়া-৬/চোখ ভুলিয়েছে-৬/চিকন কপোল-৬/সিলক মসৃণ-৬/শাদা আর ছোট-৬/ঘ্রাণ টানি মৃদু-৬/ শীতল আঁধারে-৬/সুরভি চুলের-৬।
উপর্যুক্ত চরণেও মাত্রাবৃত্তের বিলম্বিত লয় দূরীভূত হয়নি। মাত্রাবৃত্তের মৌল ঢংটি অব্যাহত রেখে অপূর্ণ পর্ববিহীন পঙ্ক্তি গঠনে নতুনত্বের উদাহরণ আছে অল্পই!
‘রূপালী স্নান’-পূর্ব মাত্রাবৃত্তের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য লক্ষণযোগ্য, তা হলো এই ছন্দের মূর্ছনা শ্রবণেন্দ্রিয় সজাগ করে রাখে, অর্থাৎ কানে শুনবার তৃপ্তি রয়েছে। প্রত্যেকটি শব্দ বিশ্লিষ্ট হয়ে শ্রবণেন্দ্রীয়কে জাগিয়ে রাখে। এতকাল মাত্রাবৃত্তের যে সীমাবদ্ধ দিক সম্বন্ধে আমরা অবহিত ছিলাম ‘রূপালি স্নান’ তার অবসান ঘটিয়েছে। পয়ারের মতো মাত্রাবৃত্তে একটি সীমাবদ্ধ দিক ছিল; অক্ষরবৃত্তের প্রবহমানতা পয়ারের অচলায়তন ভেঙ্গে দিয়েছিল। আমার বিবেচনায় শামসুর রাহমানের এই কবিতাটি কেবল তার আঙ্গিকের কারণেই বিশিষ্টতার দাবিদার হতে পারে। মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কঙ্কালটা এতোকাল ‘আছি’ বলে শরীরের ওপর যে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল, ‘রূপালি স্নান’ শরীরের সৌন্দর্য এবং প্রকাশভঙ্গিকে কাঠামোর ওপর ঠাই দিল।
তিরিশ এবং তিরিশ-পূর্ববর্তী কবিতা বিশ্লেষণ করে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছি যে, এ কৃতিত্ব শামসুর রাহমানের। শামসুর রাহমানের হাতে যে কেবল বিষয় বিস্তৃতি ঘটল তাই নয়, ছন্দ কাঠামোতেও নতুনত্ব এলো।
মজিদ মাহমুদ : আশিদশকের খ্যাতিমান কবি-কথাশিল্পী-প্রাবন্ধিক।