নৈতিকতা ও মানবিকতা ।। সবুজ ভট্টাচার্য্য।। পুবাাকাশ

হয়তো নৈতিকতা এবং মানবতার বহু সংজ্ঞা পাওয়া সম্ভব এবং এটাও আমাদের অজানা কথা নয় যে আমরা আমাদের সন্তানদেরকে এ দু’টো শব্দ ধারণ করার ব্যবস্থা না করে, বিভিন্ন রকম চরিত্র গঠন মূলক রচনা মুখস্থ করিয়ে নিজের প্রকৃত দায়িত্ব এড়িয়ে যাই। একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, কোন কিছু জানা এক বিষয়, মান্য করা এক এক বিষয় কিন্তু বিশ্বাস করা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। কোন একটা বিষয় কারো কাছ থেকে আপনি জানতে পারেন এবং জোরপূর্বক সেটা হয়তো মানতে পারেন কিন্তু আপনি যদি সেটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস না করেন তাহলে সেটা হৃদয়ে ধারণ করা অসম্ভব এবং তার প্রকৃত সদ্ব্যবহার অকল্পনীয়। তাই এই নৈতিকতা এবং মানবিকতা দুটো বিষয় হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। তাহলেই তা মান্য করা হবে সঠিক উপায়ে।

মূল আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে আমি এ দুটি শব্দ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই। যেমন নৈতিকতা বলতে কোন একটি নির্দিষ্ট স্থান কাল পাত্র ভেদে বহুকাল ধরে মেনে আসা হচ্ছে এমন কিছু নিয়ম মান্য করা অথবা মান্য করার প্রবণতা কে নির্দেশ করে কিন্তু একটা বিষয় লক্ষ্য করলে আমরা যেটা দেখতে পাই সেটি হচ্ছে রাজনৈতিক নীতি, সামাজিক নীতি, ধর্মীয় নীতি এবং সর্বসাকুল্যে ব্যক্তিগত নীতি একটি থেকে অন্যটি ভিন্ন হয়ে থাকে এবং ব্যক্তি স্বার্থে তা প্রচন্ড রকম ভিন্নতা প্রদর্শন করে থাকে। অপরদিকে মানবিকতা বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। মানবিকতা বলতে আমরা মানুষের কার্যাবলীর সেই সব গুণাবলীর সমষ্টিকে নির্দেশ করি যা মানুষের জন্য হিতকর। এখন মূল বিষয়টা যেখানে দাঁড়ায় সেটি হচ্ছে আমরা মানুষ শব্দটার মধ্যেও বিভিন্ন বিভেদের দেয়াল দিয়ে বসে আছি। সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্ম-গোত্র-বর্ণ; এগুলো আমাদেরকে বিভিন্নভাবে আলাদা করে রেখেছে। যার কারণে মানবিকতা থেকেও সংকীর্ণমনা কিছু সস্তা নৈতিকতার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে যেখানে আমরা নৈতিকতা বলতে একটি আদর্শ জীবনধারাকে বুঝিয়ে থাকি, সেখানে এই নৈতিকতা শব্দটি এখন রূপ বদলে ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে যা সাধারণ মানুষের বোধগম্য হওয়ার ক্ষেত্রে ক্রমাগত কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে ।

শত কথার প্যাঁচ না বাড়িয়ে এবার আসল কথায় আসা যাক। আমার আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে,

আমরা প্রতিনিয়ত নিজেদেরকে সংকীর্ণমনা হিসেবে গড়ে তুলছি অথচ সেটা আমরা বুঝতে পারছি না। যেমন ধরুন একটি রাজনৈতিক দল অন্য একটি রাজনৈতিক দল থেকে নৈতিক দিক থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ধারনা পোষন করে থাকেন যেখানে তারা মোটেও জনসাধারণের প্রকৃত লাভের কথা একটিবারও চিন্তা করে থাকেন না। তাহলে প্রশ্ন আসে তাদের এই নীতি কাদের জন্য এবং বিশদ চিন্তায় আমাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে যে ধারণার জন্ম হয় তা নিতান্তই তাদের নিজের স্বার্থকে সমর্থন করে বলে আমার বিশ্বাস।

এবার আসা যাক ধর্মীয় নৈতিকতার ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে ভুল প্রচার এবং প্রসারের কারণে মানুষের মধ্যে ধর্মে ধর্মে একটি হিংসাত্মক মনোভাব নিরবে গড়ে ওঠে যার প্রমাণ আমরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সহিংসতার মাধ্যমে পেয়ে থাকি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ধর্মীয় নীতি গুলো অন্য ধর্মের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। যার কারণে একজনের ভালোলাগা অন্যের কাছে ধর্ম অবমাননার কারণ হয়ে থাকে। যে নীতি একজনের কাছে সুন্দর, ভালো এবং স্বর্গীয় ঠিক সেই নীতিই অন্যের কাছে অসভ্য, অশুভ, অসুন্দর এবং পাপ সমতুল্য এবং এ কারণে প্রতিটি মুহূর্তে মানুষের বিভিন্ন কার্যাবলীর মধ্যে মানুষ নৈতিকতার প্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে থাকেন এবং এর জন্য মনের ভেতরে এক ধরনের অদ্ভুত হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করে থাকেন; অস্বীকার করলেও বাস্তবতা শতভাগ সত্যি।

স্থান কাল পাত্র ভেদে নৈতিকতা ভিন্ন হোক; ভিন্ন হোক আমাদের মন-মানসিকতা।  কিন্তু আমরা সবাই যেহেতু মানুষ, সেহেতু মানুষ হয়ে মানুষের ধর্ম মানবতা আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাওয়া উচিত। আপনার কাছে যেটা নৈতিক মনে হয় আমার কাছে সেটা নৈতিক মনে নাও হতে পারে কিন্তু মানবিক বিষয়গুলো দুজনের কাছেই সমান মনে হওয়া উচিত এবং মানবিকতার স্বার্থে আমরা আমাদের নৈতিকতাকে বিসর্জন দিতে শিখলেই শিখলেই তবে আমরা বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব এর ছায়াতলে সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ একটি পৃথিবী গড়ে তুলতে সমর্থ হব; যেখানে শান্তির মোড়কে হিংসা, বিদ্বেষ এবং হিংস্রতা থাকবে না। থাকবে পরস্পরের প্রতি পরস্পরের ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ। যে দায়িত্ববোধ অন্যের সুখে নিজেকে সুখী এবং অন্যের দুঃখে নিজেকে দুঃখী হতে শেখাবে।

তাই নৈতিকতা নামের যে সংকীর্ণতার কুঁড়েঘরে আমরা বাস করি, সেই কুঁড়েঘর থেকে বের হয়ে মানবিকতার বিশ্বভ্রাতৃত্বের রাজপ্রাসাদে আমাদেরকে আসতে হবে।  বুঝতে হবে নিজের ভালোলাগা না লাগার জন্য; নিজের স্বার্থের জন্য অন্যের ভালোলাগার, অন্যের স্বার্থে আঘাত করাটা  সংকীর্ণ মন-মানসিকতায় অনৈতিক মনে না হলেও তা অমানবিক। অনেকে হয়তো বলবেন ইংরেজিতে আপনার কাছে যেটা সিক্স সেটা আমার কাছে নাইন। কিন্তু আমি মনে করি আমরা উভয়ে যদি ভাতৃত্ববোধ ও মানবিকতার আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে একই পাশে এসে দাঁড়াই, তাহলে দুজনের কাছেই সেটা একই সংখ্যা মনে হবে। যার কারণে ভিন্ন দেহে ভিন্ন মন নিয়ে একই পৃথিবীতে বাস করার পরেও আমাদের মন-মানসিকতা হবে একই; যা শুধু পৃথিবীর বুকে ”মানুষের জন্য মানুষ” এই বাণীতে পৃথিবীকেই স্বর্গ হিসেবে গড়ে তুলবে।

সবুজ ভট্টাচার্য্য: সম্পাদক: ত্রৈমাসিক ঊষাবার্তা।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন