পাঠ উন্মোচন 

গনি ও উত্তর প্রজন্ম: ভেতরে যাবার আগে ।। আহমেদ মনসুর।। পুবাকাশ

শ্বেত বণিকের কাল, চাঁদ-তারার পালা’ ও ‘লাল-সবুজের ভাটিগা’ তিনখাণ্ডে বিভক্ত ‘গনি ও উত্তর প্রজন্ম’ উপন্যাস। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত তিনখণ্ডের উপন্যাসে কালপরিক্রমায় অবস্থা ও অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেছে।

এ অঞ্চলের জনসাধারণের মনোজগতে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া বিবিধ দৃষ্টিকোণ থেকে রেখাপাত করেছে। ঔপন্যাসিক শাহিদ হাসান তিন কালখণ্ডের সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলাে দেখানাের চেষ্টা করেছেন।

উপন্যাসটির করণকৌশলগত দিক থেকে অভিনব হচ্ছে, ত্রি-বন্দ্যোপাধ্যায় (মানিক-তারাশঙ্কর-বিভূতি) থেকে আজ পর্যন্ত রচিত উপন্যাসে অতিমাত্রায় পরিবেশ বা দৃশ্যের বর্ণনা। বর্ণন্যর ঘনঘটা সচেতন পাঠকের মনে বিরক্তির উদ্রেক ঘটায়। লাগামহীন বর্ণনার কারণে মন্থর গতির এসব উপন্যাসে সংলাপ গৌণ হয়ে পড়ে। সংলাপ রচনায় এ ধরার ঔপন্যাসিকরা মুন্সিয়ানা দেখাতে পারেননি।

‘গনি ও উত্তর প্রজন্ম’ উপন্যাসে অসহ্য বর্ণনার ঘনঘটা ঔপন্যাসিক সজ্ঞানে পরিত্যাগ করে সচেতনভাবে সংলাপ ব্যবহার করেছেন। এ উপন্যাসে শাহিদ হাসান দেখিয়েছেন বর্ণনার চেয়ে সংলাপ গুরুত্বহীন নয়। পিনদ্ধ বর্ণনা ও
প্রমিত সংলাপ ‘গনি ও উত্তর প্রজন্ম’ উপন্যাসে সমান ভূমিকা রেখেছে।

অহেতুক বর্ণনা ও মন্থর গতির উপন্যাস প্রযুক্তিনির্ভর আজকের পাঠক পড়তে চায় না। আজকের পাঠককে গতিময় প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে গতিময় জীবনের সঙ্গে সমন্বয় করে ঔপন্যাসিক ‘মােশান নভেল’-এর সূত্রটি ব্যবহার করেছেন। এধরনের উপন্যাস মূলত গতিনির্ভর। বাংলাদেশে এটাই প্রথম মােশান নভেল।

 

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের মুসলমান দুস্থ কৃষক গনিকে নিয়ে রচিত গল্পে বয়ান করা হয়, ‘গনি মিঞা একজন কৃষক। তার নিজের জমি নেই, অন্যের
জমিতে চাষ করে। এ মিথ বা ধারণাটি সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দিয়েছেন সচেতনভাবে ঔপন্যাসিক শাহিদ হাসান। তার গনি আত্মপ্রত্যয়ী একজন আধুনিক মানুষ। মিথ সমতুল্য দুস্থ গনির চরিত্রকে দীর্ঘকাল পর নতুন দৃষ্টিভঙ্গির
মাধ্যমে প্রযুক্তিকালের সচেতন পাঠকের সমীপে উপস্থাপন করেছেন শাহিদ হাসান।

দৈশিক ও বৈশ্বিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ‘গনি ও উত্তর প্রজন্ম’ উপন্যাসে সংলাপ ব্যবহার করেছেন ঔপন্যাসিক চরিত্রানুসারে প্রমিত বাংলা, আঞ্চলিক ও উর্দু ভাষায় ।
বাংলা ভাষার উপন্যাস সাধারণত দীর্ঘ বাক্যে রচিত হয়। শাহিদ হাসান মাঝারি ও ছােট বাক্যে রচনা করেছেন তার ‘গনি ও উত্তর প্রজন্ম’ উপন্যাস।

দোদুল্যমান দৃষ্টিভঙ্গির ঔপন্যাসিকরা সমাজবাস্তবতার কথা উপন্যাসে বলতে গিয়ে পেন্ডুলামের মতাে দুলতে থাকেন। এক্ষেত্রে জাতীয়তাবােধ, ধর্মীয় চেতনা ও রাজনৈতিক দর্শন পরিষ্কার না হলে উপন্যাসের গতি-প্রকৃতি সঠিকভাবে ধরা যায় না। শাহিদ হাসানের ‘গনি ও উত্তর প্রজন্ম’ উপন্যাস পাঠ শেষে তার চিন্তন প্রক্রিয়ার গভীরতা ও স্পষ্টতা অতি সহজে চোখের সামনে ভাসে।

আলােচ্য উপন্যাসে বর্তমানের পাটাতনে দাড়িয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে সমুজ্জ্বল ভােরের কথা বলেছেন ঔপন্যাসিক। সেকালে চট্টগ্রাম অঞ্চলের পুরুষরা পড়ালেখা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গ ও বার্মায় যেতাে। এ অঞ্চলের ভুলে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ‘গনি ও উত্তর প্রজন্ম’ উপন্যাসে পাওয়া যায়।

চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে এ উপন্যাসের কাহিনীর বিস্তার হলেও মননগত দিক থেকে স্থানিক ও দৈশিক পরিধি পেরিয়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে উপনীত হয়েছে।
‘গনি ও উত্তর প্রজন্ম’ উপন্যাসটি কালােত্তীর্ণ হবে কিনা তা সময়ের কাছে ছেড়ে দিতে হবে। যতদিন পর্যন্ত পৃথিবীতে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সংকট বিরাজমান থাকবে ততদিন পর্যন্ত এ উপন্যাস প্রাসঙ্গিক।

আহমেদ মনসুর: গল্পকার ও প্রাবন্ধিক

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন