‘হার্ট অব ডার্কনেস’ বা ‘অন্ধকারের অন্তঃকরণ’-এর ঔপন্যাসিক জোসেফ কনরাড।। মুজিব রাহমান।। পুবাকাশ
স্যামুয়েল হাইনেস বলেছেন, তাঁর জানামতে কোন ভাষার কোন লেখকই এতো দেরিতে এতো পরিবর্তিত ব্যক্তিক বাস্তবতা নিয়ে সাহিত্যে আবির্ভূত হননি। দেশ ভিন্ন, ভাষাও ভিন্ন। মাতৃভাষা তো নয়ই, দ্বিতীয় ভাষাও নয়। ইংরেজি তাঁর তৃতীয় ভাষা। তাঁর জীবনের মধ্যভাগে এসে জোসেফ করযেনোভস্কি তাঁকে পুনরাবিষ্কার করলেন এবং হয়ে ওঠলেন যোসেফ কনরাড।
আদৌ ঔপন্যাসিক হবার জন্যে নয়, যাত্রা শুরু করেছিলেন নাবিক হবার দুর্মর ইচ্ছায়।
জোযেফ টিউডর কনরাড ন্যালেকয করযেনিউয়াস্কি [ Jozef Teodor Konrad Nalecz Korzeniowski ] জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৫৭ সালের ৩রা ডিসেম্বর।
কনরাডের ভাষায়,
‘সব উচ্চাকাঙ্ক্ষাই বৈধ কেবল সেগুলো ছাড়া যেগুলো মানবজাতির সহজ বিশ্বাসপ্রবণতা আর দুর্দশাকে পুঁজি করে তরতর করে উপরে ওঠার।’
‘আমরা বাঁচি, যেমন আমরা স্বপ্ন দেখি – একাকী’ – কনরাডের জীবনোপলব্ধি।
কনরাড আধুনিক তার আঙ্গিকগত স্বাতন্ত্র্যের জন্যে। মানুষের অসহায়ত্ব, দূষণযোগ্যতা, বিচ্ছিন্নতা, এবং চিত্তবিভ্রম ও বাস্তবতা এই কতিপয় বিষয়ে তাঁর অন্বেষা তাঁকে সহজেই একজন আধুনিকবাদের প্রবক্তা লেখক হিসেবে চিহ্নিত করে।
তাঁর গল্পের গল্প ও উপন্যাস বা উপন্যাসিকার গল্প আদতে দুঃসাহসিক অভিযান ও অভিযাত্রীর গল্প। রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের গল্প থেকে তাঁর গল্প আলাদা।
তাঁর লেখায় অসন্তোষ এবং ক্ষতির চেতনা ব্যাপকভাবে কিপলিং-এর ভাবনাবৃত্ত থেকে স্বতন্ত্র। কনরাড উপস্থাপিত উপন্যাসের বিশিষ্ট শৈলী তাঁর সহজাত সূক্ষ্মদর্শিতা ও জটিলতার জন্যেও আধুনিক ও সমসাময়িক।
সময়ের পরম্পরা আকস্মিকভাবেই ভেঙে যায় তাঁর উপন্যাসে। চরিত্রের ভূমিকার ভিন্নতা মতামতের ভিন্নতাকে স্পষ্ট করে তোলে তাঁর উপন্যাস। পৃথিবীর রহস্যময় কোণ তাঁকে আশৈশব আকর্ষণ করেছে। তিনি ব্যক্তিজীবনে নাবিক। আফ্রিকার গহন গহীনে নৌ-ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তাঁর জীবন। তাঁর উপন্যাসে অন্ধকার ও নিষেধাজ্ঞা হাত ধরাধরি করে চলে।
কনরাডের মাতৃভাষা পোলিশ। দ্বিতীয় ভাষা ফ্রেঞ্চ বা ফরাসি। এবং বিদেশি ভাষা ছিল ইংরেজি। বয়স একুশের আগে যিনি বলতে পারার কথা দূরেই থাক এক বর্ণ ইংরেজিও জানতেন না এবং তিরিশের আগে যিনি লিখালিখি শুরুই করতে পারেননি তিনিই কনরাড। তারপরও তিনিই হয়েছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ আধুনিক ঔপন্যাসিকদের একজন। জন্মগ্রহণ করেছিলেন রাশিয়া অধিগত ইউক্রেইনে যেখানে তাঁর রাজনীতি সচেতন পোলিশ বাবা ছিলেন রাজনৈতিক কারণে নির্বাসিত। পোল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্যে লড়েছিলেন তাঁর বাবা অ্যাপোলো ও মা ইভেলিনা ববরৌস্কি করযেনৌস্কি। পরিণামে ১৮৬২ সালে মেধাবী এই লেখক ও অনুবাদককে উত্তর রাশিয়ার ভোলোগদায় নির্বাসিত করা হয়েছিল। কনরাড তাঁর মাকে হারিয়েছেন পাঁচ বছর বয়সে ১৮৬৫ সালে। এরই মাঝে কনরাডের বার বছর বয়স হবার আগেই মারা যান তাঁর বাবা, ১৮৬৯ সালে। তারপর থেকেই তাঁর মামা থাডেউস ববরাউস্কির যত্ন-আত্মিতে বেড়ে ওঠতে থাকেন কিশোর কনরাড। তাঁকে পড়াশুনো চালাতে হয়েছিলো এই মামার তত্ত্বাবধানে থেকে পোল্যান্ডের ক্র্যাকাউতে।
পাঠ্য বইয়ের বাইরের বই পড়ার এক প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল কনরাডের। আর সৌভাগ্যক্রমে তাঁর লেখক এবং পণ্ডিত বাবার বিশাল লাইব্রেরির তিনি ছিলেন উত্তরাধিকার। এবং এখানেই তিনি পেয়েছিলেন পোলিশ এবং ফরাসি ভাষায় অনূদিত জেইমস ফেনিমোর কুপার, চার্লস ডিকন্স, শেইকসপিয়র, সারভেনটিস, হুগো এবং বিশিষ্ট অনেক কালজয়ী লেখকের অসামান্য রচনাবলী। বইয়ের প্রতি তাঁর ভালবাসা, পড়াপ্রীতি এবং সমুদ্র-জীবনের স্বপ্ন সেসময় তাঁর একাকী জীবনে সবচেয়ে বড় স্বস্তি, সান্ত্বনা ও পরম আশ্রয় হিসেবে কাজ করেছিল।
তাঁর মামা তাঁকে পোল্যান্ডের ক্রাকাউ থেকে সুইজারল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন। বাদ সেধেছিলেন নাবিক হবার পথে। কিন্তু বিদ্যালয়ের গণ্ডিবদ্ধ জীবন তাঁর নয়। বিরক্তিকর বিদ্যালয় জীবন ছেড়ে ষোলো বছর বয়সে ১৮৭৪ সালে কনরাড নাম লিখিয়েছিলেন শিক্ষানবিশ নাবিকের তালিকায়। তিনবার তিনি পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ বা ক্যারিবিয়ান দ্বীপসমূহে দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন। শেষ দু বার ফরাসি জাহাজের ক্রু হিসেবে। কুড়ি বছর বয়সে ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেন এবং ব্রিটিশ নৌ-বাণিজ্য বিভাগে যোগ দেন। এবং এই সময়ে তিনি কনসটানটিনোপল, ব্যাংকক, জাভা, সিঙ্গাপুর, এবং কঙ্গো ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। ৩৩ বছর বয়সে ক্যাপটেন হওয়া অবধি টানা কুড়ি বছর তিনি হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে পুরোদস্তুর একজন আদর্শ নাবিক হবার খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ৩৮ বছর বয়সে তাঁর প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হবার মাস কয়েক পর তিনি জেসি জর্জকে বিয়ে করে ইংল্যান্ডের দক্ষিণে স্থায়ী বসতি গড়েছিলেন। এবং জীবনের এই পর্বে তিনি জীবিকার জন্যে লেখালেখিতে সম্পূর্ণভাবে সঁপে দিয়েছিলেন নিজেকে। পাঠক- সমালোচকদের আনুকূল্য পেতে তাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। পঞ্চান্ন বছর বয়সে উপন্যাস ‘চান্স’-এর হাত ধরে ইংল্যান্ড ও অ্যামেরিকায় প্রথম তাঁর বহু কাঙ্ক্ষিত সাফল্য ধরা দেয়। ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হন তিনি। যদিও এ সময় হতেই বাত-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন কনরাড তবু আমৃত্যু চালিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর দুর্দমনীয় লেখনি।
এবং মৃত্যুর অব্যবহিত আগে আগেই তিনিই স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন বিশ শতকের একজন প্রতিনিধিত্বশীল আধুনিক ঔপন্যাসিক হিসেবে। ১৯০৬ সালে প্রকাশিত হলো কনরাডের অভিজ্ঞতার স্মৃতি বা আপন স্মৃতিকথাভিত্তিক জীবনী ‘সমুদ্রের মুকুরে’ এবং একই বিষয়ে ‘ব্যক্তিক বৃত্তান্ত’ ১৯১২ সালে। ১৯১৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর উপন্যাস ‘সোনার শর’ আর ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘উদ্ধার’।
কনরাডের শেষ উপন্যাসের নাম The Rover। ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকারদের মাঝে নক্ষত্র সমুজ্জ্বল এক নাম জোসেফ কনরাড।
সচেতনভাবে ‘হার্ট অব ডার্কনেস’ উপন্যাসের ভিত্তিতে ১৯৭৯ সালে ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা নির্মাণ করেছেন তাঁর চলচ্চিত্র Apocalypse Now। চলচ্চিত্রটিতে মি. কার্জ-এর চরিত্রে অভিনয় করেছেন মার্লন ব্রান্ডো এবং আখ্যান বর্ণনাকারী মার্লো তথা ক্যাপটেন উইলার্ড চরিত্রে মার্টিন শীন অভিনয় করেছেন অসামান্য দক্ষতায়।
কনরাডের জীবনীকার কার্ল ডি. বেনেটের লেখা ‘জোসেফ কনরাড’ কনরাড বিষয়ে আগ্রহীদের জন্যে এক অবশ্য পাঠ্য গ্রন্থ।
ছোটবেলা থেকেই সমুদ্র-জীবন যাপন করার দুর্দমনীয় ইচ্ছে ছিল কনরাডের। এ জন্যে সতের বছর বয়স বয়সে নাবিক হবার জন্যে তিনি বাড়ি ছেড়ে ছিলেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি সিম্যান থেকে মেইট, মেইট থেকে প্রথমে ফরাসি ও পরে ইংরেজ জাহাজের মাস্টার পদে উন্নীত হতে পেরেছিলেন। পরে তিনি বলেছিলেন, তিনি ইংরেজি শিখেছিলেন নাবিকদের কাছ থেকে, ইংরেজি পত্র-পত্রিকা হতে। তাঁর জীবনে তিনি কখনো ইংরেজি ব্যাকরণ শেখেননি। তেইশ বছর বয়সে এক পরীক্ষা পাশের ভেতর দিয়ে তিনি ইংরেজি ভাষা যে তাঁর অধিগত সে সক্ষমতা বুঝিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। ইংরেজি ভাষায় লেখার ইচ্ছে জাহাজে থাকতেই তাঁর ভেতর উদগত হয়েছিল এবং তিনি জাহাজে বসেই লিখেছিলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘অ্যালমেয়ার্স ফলি’।
তারপর বাণিজ্য জাহাজের চাকুরি ইস্তফা দিয়ে তিনি স্থিরভাবে লিখতে শুরু করেছিলেন। চাকরি ছেড়ে স্ত্রী ও দু সন্তানের ভরণ-পোষণে ঋণের নির্মম নিপীড়নে নিপীড়িত যেমন ছিলেন তেমনি লেখক হিসেবে সফল হবার নিরন্তর আকাঙ্ক্ষাও তাঁকে পীড়িত করে তুলেছিল।
কনরাডের গল্প-উপন্যাস মানে সমুদ্র। তিনি Heart of Darkness বা ‘অন্ধকারের অন্তঃকরণ’ উপন্যাসে সমুদ্রকে দেখিয়েছেন নাবিকের দেশ হিসেবে আর জাহাজকে তার বাড়ি। মার্কিন সাহিত্যে হারম্যান মেলভিলের মতো ইংরেজদের ইংরেজি উপন্যাসে কনরাডের মুখ্য পরিচয় সমুদ্রের গল্পকার, সাগরের কথাকার হিসেবে। তাঁর উপন্যাস ‘ভিক্টরি’ ‘লর্ড জিম’ এবং অন্যান্যে, তাঁর দীর্ঘ গল্প ‘দ্য সিক্রেট শেয়ারার’, ‘ইয়ুথ’, ‘টাইফুন’ এবং ‘ল্যাগুন’-এর মতো ছোটোগল্পসমূহে সমুদ্র তাঁর মন-মর্জি- মতি-গতি, নোনা স্বাদ আর তরঙ্গধ্বনি নিয়ে সতত প্রবহমান। কিন্তু বিশেষভাবে উল্লেখের বিষয় হলো কনরাডের গল্প ও উপন্যাসের কাহিনি travelogue নয়, নয় সমুদ্র ভ্রমণের নিছক বয়ান-বক্তৃতা বা চলচ্চিত্র। প্রাণশক্তির প্রাবল্যে ভরপুর কনরাড তাঁর সূক্ষ্ম মনোবিশ্লেষণক্ষমতা তথা অন্তর্দৃষ্টি ও অন্তর্বীক্ষণ প্রয়োগে সব সময় মানুষের মনের অবচেতনের তিমিরে অনুসন্ধান চালাতেন আর তুলে আনতেন যত সব গুপ্ত ও গুঢ় অভিপ্রায়, মতলব ও উদ্দেশ্য। প্রায়শ তাঁর চরিত্র বাড়ি থেকে দূরে, নিঃসঙ্গ, হতাশাগ্রস্ত, কখনো ক্ষুব্ধ-ক্রুদ্ধ কখনো পাপবিদ্ধ। সমুদ্রের রাজসিক বিশালতা, নিরক্ষীয় সামুদ্রিক বেলাভূমির দুর্জ্ঞেয় রহস্যময়তা কিংবা গোলমেলে ছায়াচ্ছন্ন নদীতট তাঁর চরিত্রসমূহের পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে কাজ করেছে।
Heart of Darkness আফ্রিকার কঙ্গোতে একজন ইংরেজের ত্রাসের রাজত্বের হিমশীতল বর্ণনা এবং সেপথ ধরে অন্ধকারের কৃষ্ণতম গহ্বরে অবতরণের ইতিবৃত্ত।
উপন্যাসটি পড়তে পড়তে মানুষের নৈতিক ভাবনা বিশ্ব নানা ভাবনায় আলোড়িত হতে বাধ্য। প্রশ্ন মাথা তুলবে –
আচরণিক ও বিশ্বাসগত কাঠামো যা অন্ধকারকে দূরে রাখে তা-ই কি সভ্যতা!
মোহের অন্ধকার কি এতটাই দুর্নিবার্য যে সভ্যতা তার বিরুদ্ধে কোনই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ!
মুজিব রাহমান: শিক্ষক, ইংরেজি, চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম।