সুসমাচার : মিথের পুন:নির্মাণ কিংবা কবিতা ফিউশন ।। মাঈন উদ্দিন জাহেদ ।। পুবাকাশ
১.
‘ গুরু আমার, মনের ময়লা যাইবো কেমনে,
আমি বইয়া আছি খেয়াখাটে
পরানি নাই মোর সনে
এই সংসারের মতিগতি
না বুঝিয়া
নিজের ঘরের সোনার চাবি
না-খুঁজিয়া-
আমি ঘুরলাম বনে বনে
ও বন্ধু, ঘুরলাম অঘোর বনে
আমি ধরতে চাইলাম ডাহুক পাখি
হায়রে, আমার মায়ার জীবন
ছায়ার মতোন ফাঁকি;
পরান বন্ধু, কোথায় থাকে
জিগাই জনে-জনে
ও মুর্শিদ, জিগাই জনে জনে।।
( সুসমাচার-০৭)
আশিদশকের কবিরা নতুন সৃষ্টির নেশায় বাংলাদেশের কবিতায় যে এলেবেলে অবস্থান তৈরী করেছিলো, বয়সের সাথে সাথে কিছুটা পরিণত পর্যায় এসেছে মনে হচ্ছে- সাম্প্রতিক কবিতা প্রয়াসে । সম্প্রতি আবু মুসা চৌধুরীর ‘সুসমাচার’ শিরোনামের দীর্ঘকবিতা সচেতন পাঠকের দৃষ্টি কেড়েছে।
পঞ্চাশের দশকে বাংলা কবিতার শেকড়ায়ন নামে সনাতন ও বৌদ্ধ মিথগুলো ব্যবহারে কবিরা যতো স্বতঃস্ফূর্ত ছিলো। বাঙালী মুসলমানের প্রাত্যহিক পরিভাষাগুলো ব্যাবহারে কিছুটা নাসিক্য কুঞ্চন পরিলক্ষিত হতো। যদিও মুসলিম মিথ বলতে কিছু কে চিহ্নিত করার অবকাশ নেই। তবু মোহিত-নজরুল-ফররুখ উত্তর বাংলা কবিতায় এসব ব্যবহার মৌলবাদী আচার হিসেবে চিহ্নিত করার একচোখা দৃষ্টি লক্ষ করা যেতো তথাকথিত সমালোচকদের মাঝে। জীবনের উপান্তে এসে পঞ্চাশের কবি আল মাহমুদ, ষাটের কবি ফরহাদ মজহার, চিন্তক সলিমুল্লাহ খান ভাষার এ প্রতিবন্ধী মানসিকতা ভেঙ্গে দেন। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক ভাষা ও পরিভাষা রূপকে সাহিত্য শিল্পে স্বতঃস্ফূর্ত করে তোলেন। এর সাথে নব্বই দশকের উত্তারাধুনিক কাব্য আন্দোলন ভাব ও ভাষায় বাংলা কবিতাকে প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের জনমানস ও শেকাড়ায়নে প্রণোদনা সৃষ্টি করে। তাই আমরা কলকাতার কবি সুধীর দত্ত ‘র থেকে পাচ্ছি ‘ জিব্রাইল কী বলেছিলেন ‘(২০১৮) নামের কাব্যগ্রন্থসহ আর অনেক কবিতা। আরও কিছু কবিতা তালিকা দিয়ে এর দীর্ঘ সারি তৈরী করা যাবে, তবে আজকের আলোচনা ‘সুসমাচার'(২০২০) নিয়ে।
২.
‘কবর কথা বলে
শুনেছি যতোবার,
শিউলি লতাটিও তসবির মতোন
শিয়রে বাবা-মার।’
(সুসমাচার-১১)
আশিদশকের অন্যতম কবি আবু মুসা চৌধুরী সপ্তম কাব্যপত্রে ‘সুসমাচার’ এ তেরটি কবিতা নিয়ে পরম্পরা সাজিয়েছেন।
প্রারম্ভে ও সমাপ্তিতে পবিত্র কোরআন থেকে হযরত মুসা আ. ফেরাউন কর্তৃক অত্যাচারিত হয়ে স্বদেশ ভূমি ত্যাগ ও নতুন ভাবে তাঁর কাওমকে প্রাণিত করার ঘটনাকে প্রতীকায়ন করে, মিথ বা ইতিহাসের পুন:সৃষ্টির করতে চেয়েছে কবি কাব্যযাত্রার এ নব প্রয়াসে। ভাষায় এনেছেন ভাববাচ্যের গাম্ভীর্য। নতুন ভাবনা উসকে দিতে চেয়েছেন পাশ্চাত্য বা মধ্যপ্রাচ্য নয়, বাঙলার শেকড়ায়নে ভেতর দিয়ে বস্তুগত মুক্তি নয়, ভাবগত উৎকর্ষ ও পরম মুক্তির কথা ভেবেছেন কবির চিরায়ত ভাবুকতায়। তাই বাস্তু জীবনের অক্ষমতাকে বিষয়ে মূখ্য করে তুললেও উপলব্ধির সতত প্রবাহ দেখি মৌলনা রুমীর মত রুহের বিলাপে।
তাই সুসমাচার কবিতা পরম্পরায় এক থেকে ছয় পর্যন্ত অক্ষমতার নানা মাত্রা কবিতার পাললিক স্বরে ভোর থেকে দুপুর ব্যাপি, বাটারবন থেকে সুন্দরবন ব্যাপি, নুরুন নাহার থেকে কাঁটা পাহাড় অবধি, বাদুর তলা থেকে থির্ দুপুরের ভেজা গলা ব্যাপি। এর পর কবি মনের ময়লা শুদ্ধি সাধনে খেয়াঘাটে বসে থাকার ধ্যান। কবি আবু মুসা চৌধুরী ধরতে চেয়েছেন বাঙলার চির বিরহী পাখি ডাহুকের গান। যে রাতভর সুর সাধনায় মগ্ন থেকে আত্মক্ষরণে লহু ঢালে নতুন সৃষ্টির প্রয়াসে। দিনের পর দিন কণ্ঠ নিসৃত লহু ঢেলে সে তা দেয় ডিম ফোঁটাতে, বাচ্চা সৃজনে। বস্তজীবনের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি, যাপনের ইহজাগতিক সমাপ্তি শেষেও জীবনের আরও একটি ব্যাপ্তির ব্যাকুলতা নিয়ে জীবনের সম্পূর্ণিমা। সে জীবনের জন্য আহ্, এমন বিরহী ব্যাকুল কবি ‘সুসমাচার’ এর উপান্তে যখন এসে এই বিভাষী কবির এলিজি টা উদ্ধৃতি দেন, তখন পুরো কবিতাই আলাদা ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে-
“দেয়ার’জ এ হােম দ্যাট লাইস বিওন্ড
হু পাসড ইটস গােল্ডেন ডাের,
অ্যাওয়েইটস্ দ্য ওয়ান হুজ গন অ্যাওয়ে
নট লস্ট জাস্ট গন বিফোর,
অ্যান্ড ইন দ্যাট হােম দ্যাট লাইস বিওন্ড
দ্য ম্যাটার উইল প্রিপেয়ার এ প্লেস ফর ইউ,
অ্যান্ড হােয়েন হি কল্ স্ ইউ’ল মিট
ইউর লাভড্ ওয়ানস্ টু…
তবে এ কোটেট এলিজির শেষ শব্দ দেয়ার ( there) আছে মূলপাঠে। কবির কাব্য যোজনায় ‘টু…’ দেয়া টা কি খুব প্রয়োজন ছিলো? উদ্ধৃতি অক্ষুন্ন রাখলেই ভালো হতো। কবি বিষয়টি পুন:ভাববেন আশা করি। এর সাথে সাথে কবি তার আরাধ্য পষ্ট করেছেন আলোচ্য পঙক্তিতে –
‘সেহেতু, আমরা সকলেই নিদ্রাগত
হবাে এমন নয়; কিন্তু অবশ্যই
আমরা রূপান্তরিত হবাে।।’
(সুসমাচার-১২)
কারণ কবির আত্মদর্শন বৈশ্ব পৃথিবীতে শেষ নয়, তার ব্যাপ্তি চিরকালের। তাই তার নশ্বর জীবন শেষ হবে, কিন্ত অনন্ত জীবন ক্ষয়হীন, লয়হীন এবং রূপান্তরিত। রূহ বা আত্মা সম্পর্কে বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। তবে ‘পার্থিব জগতে দেহের সাথে আত্মা সম্পর্কযুক্ত থাকে, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আত্মা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এই বিষয়ে প্রায় সব ধর্মের মধ্যে মতৈক্য দেখতে পাওয়া যায়। হিন্দু ধর্মে আত্মা শাশ্বত-চিরন্তন ও অমর ।
মৃত্যুতে দেহ বিচ্ছিন্ন হয়। আত্মা আবার নতুন দেহ গ্রহণ করে। পূর্বজন্মে কৃতকর্মের ফলভােগের ও প্রায়শ্চিত্তের জন্যই আত্মার নতুন দেহ গ্রহণ করতে হয়। আর আত্মার এই নতুন দেহ গ্রহণের প্রক্রিয়া ততােদিন চলতে থাকে যতােদিন আত্মা মােক্ষলাভ করে ব্রহ্মের সাথে মিলনের যােগ্যতা অর্জন করে। এটাই হিন্দু ধর্মের পুনর্জন্মবাদ। পক্ষান্তরে ইসলাম ধর্মে আত্মা অমর থেকে মৃত্যুর পর পূর্বের দেহে হাশরের দিন পুনরুথিত হবে এবং দুনিয়ার কৃতকর্মের বিচারের কাঠগড়া অতিক্রম করে জান্নাত অথবা জাহান্নামের বাসিন্দা হয়ে সুখ বা দুঃখ ভােগ করে। ইসলাম ধর্মে দেহসহ আত্মার পুনরুত্থানে বিশ্বাসী, পুনর্জন্মে নয়। পুনরুত্থানের পর আর কোনাে মৃত্যু বা দেহ থেকে আত্মা বিচ্ছিন্ন হবে না। ইহুদী ও খ্রিস্টধর্মের মতও প্রায় অনুরূপ।
সামগ্রিকভাবে আত্মা বিষয়টি অত্যন্ত রহস্যপূর্ণ। পবিত্র কোরআন মজীদে রূহ বা আত্মাকে আল্লাহ্ তা’আলার ‘হুকুম’ বলে উল্লেখ করে বলা হয়েছে তােমাদেরকে আত্মা সম্পর্কে নিতান্ত স্বল্প জ্ঞানই দেওয়া হয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-ও আত্মার রহস্য সকল মানুষের নিকট
প্রকাশ করেন নি । আধিবিদ্যক বিষয়ে সাধারণকে নিরুৎসাহিত করেছেন। জ্ঞান ও বােধশক্তির প্রতি লক্ষ্য করে তিনি এ কৌশল অবলম্বন করেছেন এবং এর সাহায্যে তিনি অবাঞ্ছিত বিতর্ক এড়াতে চেয়েছেন। আবার আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ লক্ষ করে তার অনেক প্রাজ্ঞ সাহাবীর নিকট অনেক রহস্য প্রকাশ করেছেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সূফী-সাধক, ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক আত্মার স্বরূপ ব্যাখ্যার প্রয়াস পেয়েছেন।
দ্বাদশ শতকের বিখ্যাত পণ্ডিত আল্লামা হাফিজ ইবনে কাইয়্যিম নামে সমধিক প্রসিদ্ধ ইমাম শামসুদ্দীন আবু আবদুল্লাহ ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়াহ্ রচিত ‘সিররুর-রূহ’-আত্মার রহস্য বিষয়ক একটি জ্ঞানগর্ভ ও মূল্যবান গ্রন্থ। মানব মনের স্বাভাবিক জিজ্ঞাসার আলােকে প্রশ্নোত্তর আকারে গ্রন্থটি সুবিন্যস্ত। এ নিয়ে মুসলিম কাব্য ও দর্শন চর্চায় যে সুফীবাদী ধারা তৈরী হয়েছে তার বিশাল কাব্যস্রোত আজও বাংলা কাব্য রসিকদের কাছে উন্মোচন হয়নি। কিছুটা গাযযালী, শামসতাবরেজ, রুমী’র কবিতা দর্শন চর্চায় বাংলা মুলুকে আলোচনার প্রাদপ্রদীপে পষ্ট হচ্ছে। তার বিম্বিত আলোকছটা আমরা ‘সুসমাচার’ এর কাব্যচর্চায় সাম্প্রতিক প্রায়াস লক্ষ করি।
৩.
কবিতার শুরুতে এবং উপান্তে কবি পবিত্র কোরআন থেকে নবী মুসা আ. এর ঘটনাকে উপস্থাপন করেছে চমৎকার শিল্পকৌশলে :
প্রবেশক
মহাপ্রভু মুসাকে তাঁহার নিদর্শনসমুদয়
পাঠাইয়াছিলেন (ও বলিয়াছিলেন) ‘তােমার
সম্প্রদায়কে অন্ধকার হইতে আলােয়
আনয়ন করাে আর তাহাদেরকে অতীতের
কথা স্মরণ করাইয়া দাও। পরম ধৈর্যশীল
ও পরম কৃতজ্ঞ ব্যক্তিদের জন্য নিশ্চয়ই
ইহাতে নিদর্শন রহিয়াছে।
এবং… এবং… এবং…
তিনি আরাে বিশদ করিয়াছিলেন যে, মুসা
ছিলেন শুদ্ধচিত্ত… তাঁহাকে ডাকা হইয়াছিলাে
তুর পর্বতের ডানদিক হইতে এবং গৃঢ়তত্ত্ব
জানাইবার জন্যই তিনি তাঁহাকে আহ্বান
করিয়াছিলেন।
উপান্তে
‘অতঃপর শিষ্য পরিবৃত মুসা সমুদ্রের সম্মুখে আসিয়া উপনীত হইলেন। ভয়ার্ত অনুগামীদের উদ্দেশে তিনি প্রদান করিলেন বরাভয়। এবং উত্তোলন করিলেন যষ্ঠী। আঘাত করিলেন লােহিত সমুদ্রে। ফর্সা আকাশ পরিপ্লাবিত হইয়া গেলাে নিকশ কালাে অন্ধকারে। বিদীর্ণ হইয়া গেলাে খরস্রোতা জলধি। প্রত্যেক অংশ হইয়া গেলাে যেনাে বৃহৎ পর্বত। অপিচ, মুসা এবং তাহার অনুসারীবৃন্দ পদব্রজে অতিক্রম করিলেন প্রমত্ত-সলিলা। সেহেতু,
তাহারা শস্য-শ্যমলা, গিরি-কুন্তলা উর্বরা ভূমিতে পদার্পণ করিলেন। সেখানেই তাে রহিয়াছে মহান প্রতিপালকের অফুরান উপাচার- পর্যাপ্ত আহার্য, সুপেয় পানীয় এবং পশুদের বিস্তৃত চারণভূমি। আমেন।।’
আর কবিতা পাঠকের কানে বারবার উচ্চারিত হতে থাকে :
দুনিয়ায় মানুষ মরে, কায়া ঝরে
রুহু মরে-নাই।
মাটির দেহ রইলো পড়ে
রহু ঘরে-নাই।
মাওলা, রুহু ঘরওে-নাই।
কোথায় হইতে আসে রহু
কোথায় যায় চলি,
উড়াল দিয়া পলায় পাখি
কিছুই নাই-বলি-
ও বন্ধু, আমার মনতো ভরে-নাই…
এইভব জগতের রঙ্গমেলায়
আবাল গেলো হেলায়-ফেলায়,
এখন মাটির দেহ ঘুমায় দেখো
রুহু পড়ে-নাই
দয়াল, রুহু পড়ে-নাই।।
(সুসমাচার-০৫)
কবি আবু মুসা চৌধুরী ‘সুসমাচার’ কাব্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, বস্তগত ও ভাবগত, নশ্বরজীবন ও পরম জীবন কে সমন্বিত করে বিশ্বজনীন এক কাব্য যোজনা তৈরী করেছেন কোভিড-১৯ এর বহমান সময়ে, বিশ্ব বাস্তবতায়। জীবনকে কোনো খণ্ডিত অবয়বে নয়, সামগ্রিক ও বহুমাত্রিক অধিবিদ্যায় আলো ফেলে, অনন্য কাব্যভঙ্গিতে উপস্হাপন করেছেন সচেতন পাঠকের সামনে। যেনো প্রত্যাশাদেশপ্রাপ্ত মরমী শব্দপুঞ্জ কবিতায়িত হয়ে ওঠে অলৌকিক ও ঐশীক শব্দের ইন্দ্রজালে। কবিকে অভিবাদন। মননশীল কবিতা পাঠক মাত্রই সুসমাচার এর সমাচারে প্লুত হবেন, ঋদ্ধ হবেন, প্রাণিত হবেন চিরায়ত বোধে।
৪.
কবিতাপত্রটি প্রকাশ করেছে খড়িমাটি প্রকাশনা, বের হয়েছে ২৮ অক্টোবর, ২০২০। মূল্য : ১০০ টাকা। পাওয়া যাচ্ছে বাতিঘর, নন্দন বইঘর, অমর বইঘর পিপলস বুক এজেন্সি, কারেন্ট বুক সেন্টারসহ চট্টগ্রামের অভিজাত পুস্তক বিপনিসমূহ এবং খড়িমাটি কার্যালয়ে, ফোরক ম্যানশন (৩য় তলা), কদম মােবারক লেন, ৩৫ মােমিন রােড, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।
মাঈন উদ্দিন জাহেদ : কবি ও প্রাবন্ধিক। সম্পাদক : পুবাকাশ।
আলোচনা সুন্দর হয়েছে।