প্রিয়দর্শিনী।। আহমেদ রেজা খান।। পুবাকাশ

মেয়েটির সাথে কাটানো সময়গুলো সুখের বা দুঃখের কোনটাই আমি বলতে পারবোনা।কারণ সুখের অনুভূতি নশ্বর।হারিয়ে যায়।আমি এই সময়ের অনুভূতিটা হারাতে চাইনা। আর দুঃখের বলতে পারবোনা এই কারণে যে,দুঃখকে লালন করতে হয়। সেই লালন করবার ক্ষমতা আমার নেই।

ট্রেনে উঠেই আমি ধাক্কা খেলাম। জীবনে কতশত ট্রেন জার্নি করেছি।প্রায়শই আমার সিট পড়ে হয় একেবারে পিছনে,সিঙ্গেল; নয়তো দেখি পাশে বসে আছে বেরসিক গোঁয়ার কোন মধ্যবয়সী পুরুষ।

এই প্রথম আমার পাশের সিটে, সুন্দরী কোন যুবতী নারী।তার সৌন্দর্য বর্ণণা পরে করা যাবে।আগে নিজেকে সামলিয়ে নেয়া যাক। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই মেয়েটি আমার জানালার পাশের সিট আবদার করে বসলো।যদিও জানালার পাশের সিটের প্রতি আমার অতিরিক্ত কোন আগ্রহ কোনকালেই ছিলোনা, পাছে তার প্রতি আমার প্রথম দেখাতেই দূর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাবে এই ভেবে আমি কোন সাড়া দিলামনা। তার উপর সুন্দরকে অগ্রাহ্য করতে পারার একটা বুনো আনন্দ তো আছেই।

সবুজ মাঠঘাট প্রান্তর পেরিয়ে চলছে আমাদের ট্রেন।জানালা দিয়ে বাইরের বিশাল প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে আছি ঠিকই কিন্তু আমার মন পড়ে আছে ট্রেনের ছোট্ট বগির আমার পাশের সিটটাতে। সুন্দরকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা অনেক পুরুষেরই আছে। কিন্তু আড়াল করবার ক্ষমতা কোন পুরুষের নেই। অপরপক্ষে আমি তো দেবদূত নই, রক্তমাংসের মানুষ! 

আমি যতক্ষণে মেয়েটির দিকে তাকালাম ততক্ষণে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। নির্বিকার। যেন পৃথিবীর সব চিন্তাকে সে বিদায় জানিয়ে একটু আরামের সন্ধান করছে। মনে মনে একটু খুশিও হলাম। তাকে চোখভরে দেখা যাবে। আবার নিজের ব্যক্তিত্বের ও হানি ঘটার তেমন জোরালো কোন সম্ভাবনা নেই।

মেয়েটিকে প্রথম দেখাতে আমার কাছে সুন্দর মনে হয়েছিলো। দ্বিতীয়বার দেখার পর মনে হলো শুধু সুন্দর নয়, বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দর। হয়তোবা প্রচলিত কবিদের কথামত,’ঘুমালে মেয়েদের সৌন্দর্য্য দ্বিগুণ হয়ে যায়।’অথবা হতে পারে মেয়েটি স্বভাবজাতভাবেই এরকম চোখ ধাঁধানো সুন্দর। এসব নিয়ে কোন চিন্তা নেই এই মুহূর্তে করতে চাইনা। আমি তাকে প্রাণভরে দেখে চোখ জুড়িয়ে নিতে চাই।

জসীমউদ্দীন নকশীকাঁথার মাঠে সাজুর রূপের বর্ণণা দিতে গিয়ে যেভাবে বলেছিলো,’সবুজ কচি ধানের পাতার মত মসৃণ তার গাল।’ আমার মনে হলো তার মুখখানা আরো বেশি মসৃণ।স্ফটিক স্বচ্ছ কাঁচের মত সাদা মুখটাতে যেন দেখা যাবে নিজেরই প্রতিবিম্ব! তার চোখের কাছে সহস্র বছর আগে পরাজিত হয়ে গেছে বনলতা সেন। কপালের ভাঁজে জোড়া ভ্রুয়ের মাঝে যেন খেলা করছে এক অমৃত সুধা। আসমান জমিন পাহাড় ঝর্ণার সব কল্লোল যেন থেমে যাবে তার এই রুপের বন্দনায়।

আমি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার তাকিয়ে রইলাম জানালার বাইরের দিকে।ভাবছি,এই মেয়ে কেন আমার পাশে! আমি তো এমন সৌন্দর্য্য কখনোই কাছ থেকে দেখতে চাইনি যা আমার নয়। রুপ অথবা গুণ হয়তো নিজের থাকতে হয় নইলে নিজের করে নিতে চায় মানুষ।যারা সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক দুটোই প্রদত্ত হয়, তারা সৌভাগ্যবান এটা স্বীকার করতে আমার কোন দ্বিমত নেই।

আমি সম্বিত ফিরে পেলাম মেয়েটির গুনগুন শব্দে।মানবেন্দ্র’র ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’…গানটা সে আনমনে গেয়েই চলছে।এই প্রথম মেয়েটির চেহারায় আমি দুঃখের ছাপ দেখতে পেলাম। আমি অনেক রুপবতী নারী দেখেছি যাদের কন্ঠে সুধা নেই।এই প্রথম কাউকে দেখলাম যার চেহারায় আগুন এবং কন্ঠ  যাদু দুটোই আছে।

মধ্যদুপুরের তির্যক রোদ এসে ভিড় করলো আমাদের জানালায়। চৈতালী হাওয়ায় উড়ছে মেয়েটির চুল।সোনালী রোদে চিকচিক করা সেই চুল মনে হচ্ছে,জলন্ত ভিসুভিয়াস।

আমি অপেক্ষা করছি,মেয়েটি কবে আমার কাছ থেকে আবার জানালার পাশের সিট আবদার করবে আর আমি সবকিছু ভুলে তার কাছে পরাজিত হয়ে আমার সিট তাকে সঁপে দেবো। এই পৃথিবীতে সৌন্দর্য্যের জন্য, সৌন্দর্য্যের একটু উত্তাপ পাবার জন্য মানুষ কতকিছুই না করে। আমি যদি সামান্য একটা সিট ছেড়ে দিয়ে তার একটু অনুগ্রহ পাবার বাসনা পোষণ করি,তাতে দোষ কিসের?

মেয়েটির কথা ভাবতে ভাবতে 

আমার এই অনাড়ম্বর, অভাবগ্রস্থ জীবনে রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার মত জেগে উঠলো আমার প্রাণ।হতাশাগ্রস্থ, বেদনাহত আকাশ যেনো হঠাৎ সুনীল রং ধারণ করে নিলো।মনে হলো এই পৃথিবীর সমস্ত সুখ জমা হয়ে আছে মেয়েটির টানাটানা দুটি চোখ,তার কন্ঠের যাদুতে।

একসময় এই মেয়েকে ছেড়ে যেতে হবে এই ভেবে বুকের ভেতরে বেদনার এক বীণ বেজে উঠলো।এই অপরিচিত,অজানা,অচেনা মেয়েটি ক্ষণিকের এই দেখায় কিভাবে আমার ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো তা আমার চিন্তার ষষ্টইন্দ্রিয়েরও বাইরে।হৃদয়ের লাগাম টেনে ধরবার ক্ষমতা তো সৃষ্টিকর্তা খুব মানুষকে দিয়েছে।আমি হয়তো তাদের মধ্যে নেই।আমার হৃদয় খুড়ে বেদনা জাগাতে যদি কেউ পারে,জাগাক। শক্তি, সম্ভাবনাকে থামিয়ে রাখবার মানুষ আমি নই।

হেমন্তের দুপুরে শান্ত রোদ স্তিমিত হবার সময় চলে এসেছে।তার সাথে পাল্লা দিয়ে থেমে চলছে আমাদের ট্রেন।এই ঘন্টাতিনেক’র জার্নি’র সব অনুভূতিকে একীভূত করলে আমার শুধু মনে পড়ছে শেক্সপিয়রের “The Merry Wives of Windsor” নাটকের সেই লাইন  ‘It’s better three hours too soon than one minute too late”..

মেয়েটির কাছ থেকে কোনকিছুই আশা করছিনা আমি।কতকিছু ছেড়ে এলাম এই জীবনে,কত আশা গুড়েবালি হয়ে গেলো,কত স্বপ্ন দেখার আগেই ভেঙে যাবার উপক্রম। আমার শত সহস্র ট্রেন জার্নি শেষে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে যেভাবে এই মেয়েটি আমার পাশে এসে বসেছিলো,সেভাবে যদি আগন্তুকের মত আমার জীবনে আসে, তবে আসুক।কিন্তু আমি আর আশা করে আশাহত হতে চাইনা।

ওয়ার্ডসওয়ার্থ এক দৃষ্টিতে দেখেছিলো দশহাজার ড্যাফোডিল। আমি এক দৃষ্টিতে দশহাজারবার দেখে নিলাম মেয়েটিকে। মনস্থির করলাম, সে যদি আমার অব্যক্ত কিন্তু প্রকাশিত ভালোবাসাকে বুঝতে পেরে পেছন থেকে ডাক দেয়, সারাজীবনের জন্য আমি তার হয়ে যাবো।

আমি হেটে চললাম প্লাটফর্ম ধরে…!

আহমেদ রেজা খান: গল্পকার।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন