কবিতা অন্তঃশীলিত উচ্চারণ

আল মাকসুদ

সিরিয়ার কবি আদোনিসের কাছে একটি প্রশ্ন ছিলো,-কবিতার কাছ থেকে আপনি কী পেয়েছেন? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন ‘কবিতা আমাকে তৈরি করেছে (শিল্পসাহিত্যের আলাপন, সাজ্জাদ শরিফ ২০১৯ : ৪৯)।’ তারও বহু বছর আগে ফরাসি দার্শনিক Gaston Bachelard (১৮৮৪-১৯৬২) এই উক্তিটি করেন : ‘Nothing is given, Everything is constructed।’ আমি বলি- কবিতা বিপ্রতীপ কিছু। ভাঙা-গড়া তার স্বভাব। গ্রন্থিত শব্দের সমবায়িক একটি গৃহ- তার নাম কবিতা। এই কবিতা-নির্মাণ-শিল্পী ভাঙতে জানেন, গড়তে জানেন;- কাদা মাটি ছেনে একটি অবয়ব তৈরি করা যেমন ভাস্করের কাজ তেমনি কিছু কাজ কবিতা নির্মাণ-শিল্পী করে থাকেন। যেমন : ‘প্রাসাদের কাচচূর্ণ অশ্রু হয়ে লেগে থাকে আমার দু’চোখে-/আমি তাকে জড়ো করি, দুই হাতে/বনে যাই দক্ষ কারিগর;/অসংখ্য অনন্ত-খণ্ড জোড়া দিতে দিতে/ বুনে চলি নকসী কাঁথা, নক্ষত্রের উল্কি-আঁকা/অনঙ্গ অভঙ্গ এক স্বপ্নের প্রাসাদ;/বুনতে বুনতে বেড়ে উঠি, বুনতে বুনতে বুড়ো হয়ে যাই;…(এই ডাঙা ছেড়ে যাই, আমরা তামাটে জাতি : মুহম্মদ নূরূল হুদা)।’ প্রকৃতার্থে কবিতার এই-ই ধর্ম। এবং বলা বাঞ্ছনীয়- কবি ও কবিতা অখণ্ড সত্তা। কবিতা নির্মাণ করতে পারে বলেই, কবিতা একই সঙ্গে ভেঙে ফেলতে পারে প্রচল অনেককিছুই- আমদানি করতে পারে সাদামাটা লোকজ প্রাচীন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের আটপৌরে শব্দরাজি; অথবা অতি বিজ্ঞানবাদী ধ্যান-ধারণার বৈশ্বিক ঘোরপ্যাঁচ । এটা কবিতার স্বাতন্ত্র্যশৈলী; কিন্তু কবিতার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞাও নেই; নেই ব্যাকরণও। যেটুকু আছে বলে আমরা দাবি করি- কবিতা তার ধার ধারে বলে মনে হয় না। এতে ‍সুবিধা-অসুবিধাটা হচ্ছে- নিয়মসূত্র না মেনে চলাতে সবাই কবি হতে পারার দুঃসাহস দেখায়-আবার শেষ অব্দি কবিতা লিখতে গিয়েই কলম থেমে যায় ভয়ংকরভাবে-এরা আর কোনোদিনই কিছু লিখতে পারে না; মোট কথা সৃজনশীল হয়ে উঠতে পারে না। এটাকে কাব্যঅভিশাপ বলতে পারি।
কবিতার শরীর ক্ষীণ, গদ্যের তুলনায় কিন্তু অনেক শানিত ধারালো- কোথাও ভীষণ কটকটে, কূটাভাসে আচ্ছন্ন। যেমন কবি শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) জীবনের সূচনালগ্নে কবিতা ভাবনা সম্পর্কে তার অনুভূতি জানিয়েছেন একটি সাক্ষাৎকারে এরকম- ‘আমার মনে হয়েছিল, কবিতা অসম্ভব সুন্দর কোনো কিছু। ম্যাড়মেড়ে বা ভোঁতা কিছু নয়। সুদর্শন তরুণীর মতো লাবণ্যময়।…’ এখানে ভোঁতা এবং লাবণ্যময় কথা দু’টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভোঁতা নয়,-মানে ধারালো; চকচকে। অন্যদিকে দেহের লাবণ্য নিশ্চয়ই দেখার, কিন্তু পাঠের ক্ষেত্রে- এই লাবণ্যের ব্যাখ্যাটা কী হতে পারে। অনুভবের, ভালোলাগার, স্বস্তির,- কণ্ঠে, হৃদয়ে এবং মননে লেগে থাকে এর স্বাদ; নিশ্চয়ই জিহ্বায় নয়।
কবিতা নিয়তিনির্ধারিত নাকি জগৎনির্ধারিত তা নিয়ে তর্ক করলে কবিতার রহস্যগামিতা বেড়ে যায়; কবিতার সংজ্ঞায়ন চিহ্নের দেখা মেলে না। মানুষ সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হয় দুর্জ্ঞেয় বিষয়ে; তাই কবিতা মানুষকে আকর্ষণ করেছে-কবিতা নিজে এই আকর্ষণবিধিকে উপভোগ করে দারুণভাবে। প্রতিশ্রুত সত্যের জলধিতে প্রতিবিম্বিত হওয়া কিছুকে কবিতা বলা যায় কিনা- তা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। অথবা যদি ভাবি- ‘জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ কবিতা/জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা’- তাহলেও কবিতার সংজ্ঞায়ন হয় না; কিন্তু কবিতার একটি রূপকল্প নির্মিত হয়। কবিতায় বস্তুত ইনার রিয়েলিটি বা গ্রাউন্ড রিয়েলিটি বলে কিছু নেই,- যা আছে তা হলো কবির অন্তঃশীলিত ভাবনার রূপায়ন। এবং এও মনে করি কবিতা অ্যাবসার্ড হতে পারে কিন্তু কোনোক্রমেই তা অ্যাবসার্ডিটি হয়ে উঠবে না- উঠতে পারে না; তাহলে সেটা কবিতা নয়; কবিতার নামে ডাহা ছ্যাবলামি।
ব্যক্তিক বিশ্বাসের উপরি কাঠামোর আড়ালে কবিতা নিঃশব্দে বাস করে; কোনো যুক্তির পরম্পরা বা ধর্মনীতি, সুসংস্কৃত মূল্যবোধ কিংবা উপদেশাবলি কবিতা এড়িয়ে যায়- কিন্তু কবিতায় হয়তো এসবের প্রত্যক্ষ অথাবা পরোক্ষ দাগ পড়ে যায়। কবিতাকে জোর করে হিউমানাইজেশন যেমন করা যায় না তেমনি অকারণ ডিহিউমানাইজেশনও করা যায় না। যখন কবিতা দেব-দেবি বা ঈশ্বরস্তুতিতেই সীমাবদ্ধ ছিলো তখনো কবিতা মানুষের হার্দিক ক্ষুধাকেই নিবারণ করতো। অন্তর্পুষ্টিকে পূর্ণতা দিতো। বার্নাড শ মনে করতেন ‘আমাদের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে আমরা আমাদের আয়ু বাড়াতে পারি।’ বস্তুত এখানে একটি ম্যাজিক আছে; এই ম্যাজিকটা কবিতায় খুবই প্রাসঙ্গিক। এটা যে শুধু আকাশচারী কল্পনার বিষয় এমন নয়; এখানে বাস্তবত পরিপার্শ্বও জড়িয়ে আাছে।
কবির যে ইনটুশন থাকে- তা থাকে কেবল অধ্যাত্মবাদী মহাপুরুষদের (শব্দটি সর্বলিঙ্গবাদী)। তাহলে কবি কি অধ্যাত্মবাদী কেউ? মোটেও না। কিন্তু অধ্যাত্মবাদীদের অনেককিছুই মনের অজান্তেই কবি ধারণ করেন- তাই তার ব্যবহৃত শব্দ সাধারণ হয়েও অসাধারণ বাকমধুরতা নিয়ে পাঠকের হৃদয়কে উদ্বেলিত করে। আবু সয়ীদ আইয়ুব যেমন বলেন ‘…মানুষ যে কেবল জৈবজগতের অধিবাসী তা নয়, অধ্যাত্মলোকেরও পরিব্রাজক, তারই অভিজ্ঞান রয়েছে এই শাশ্বত বিস্ময়বোধে। বিস্ময়বোধের অবলুপ্তিকে তাই আমি কাব্যের প্রগতি ব’লে মেনে নিতে কুণ্ঠিত।’ কবিতায় বিস্ময়বোধ থাকবে- এটা প্রগতিকে প্রাণ দেয়। তাই কবিতায় বিস্ময়বোধের অবলোপন তিনি চাননি। বিস্ময়বোধটা কী- বিস্ময়বোধ হলো কবিতায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জিজ্ঞাসার জন্ম দেয়া; সৃষ্টির অর্গল খুলে দেয়া, নন্দনাভূতিকে তীব্রতর করে তোলা।
কল্পনা কবিতার প্রবহমানতাকে প্রশ্রয় দেয়; কবি এবং কবিতা এইসূত্রে মর্তলোকের বাইরে পৌঁছোবার অবকাশ পায়। মর্তলোকের বাইরে কবিতার যাওয়া কি খুব জরুরি? কিন্তু ওই যে কথা আছে-‘আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী?/ বলো কোন পার ভিড়িবে তোমার সোনার তরী।/যখনই শুধাই ওগো বিদেশিনী,/ তুমি হাসো শুধু, মধুরহাসিনী/ বুঝিতে না পারি কী জানি কী আছে তোমার মনে।/ নীরবে দেখাও অঙ্গুলি তুলি…’ এ তো স্পষ্টই মর্তলোকের বাইরের আবাহন। এটা এক ধরনের কল্পনা; কল্পনার এই প্রসন্ন মনোহর রূপটি কবিতা ছাড়া আর কোথাও পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এ্ই কল্পনাবোধ জীবনানন্দ দাশের ‘মনমর্মর’ কবিতায় পাই দারুণভাবে-‘আমার মনের ভিতরে ছায়া আলো এসে পড়ে;/ যেইসব অনুভূতি ঝরে গেছে তাদের কঙ্কাল/ নদীকে দিযেছি আমি- বিকেলকে- নক্ষত্রের দাহনে বিশাল/ আকাশকে; ফিরে আসে নব দিকচিহ্ন নিয়ে মর্মের ভিতরে।/ সময়ের ঢের উৎস গ্রন্থ ছবি মননের পদ্ধতি সব/ নিয়ে যায় হৃদয়কে যেন কোন্ শেষ অনুশীলনের গানে;/অন্তহীন অন্ধকার রয়ে গেছে হয়তো সেখানে;/অসীম আলোর মতো তবুও করেছি অনুভব।’
অসীম আলোর মতো অনুভব করার বাসনায় লুকিয়ে থাকে ধ্বনিমর্মর। সুস্থির অথচ ধাবমান এমন বৈপরীত্যের জয়ধ্বনি তোলে কবিতার আসমান-জমিন। দুর্বোধ্য বিলাসের মগ্নতা কবিতার আরেক চরিত্র; কবিতা এখানে পাঠককের জন্য নয়- কবিতার জন্যই কেবল কবিতা হয়ে ওঠে। এটিও কবির অনন্য কৃৎগরিমা। এটা কি সব কবিই পারেন? না, সব কবিকে এমন হতে হবে কেনো? হওয়া প্রয়োজন নেই- তাতে কবিতার বহুগামিতা নষ্ট হয়। এবং বলা ভালো, কবিতার বিচিত্রমুখী হয়ে ওঠাকে কোনো ক্রূর সমালোচনার আঁচড়ে আঘাত করা প্রকৃত সমালোচকের কাজ নয়। বরং প্রতিটি কবিতার মাঝে কবিতাকেই খোঁজা উচিত। জীবনানন্দ দাশও বলেছেন ‘কবিতা অনেকরকম।’ তবে, সব কবিতাই কবিতা নয় এটা যেমন শাশ্বত তেমনি সব সমালোচনাই কবিতার প্রতি সুবিচার করতে পারে না; কারণ একাটই- কবিতাকে না চেনা, কবিতাকে ভালোবাসতে না পারা। কবিতা ভালোবাসা দাবি করে; কবিতা দ্বান্দ্বিক পার্থিবতাকে এড়িয়ে যায় না- কেননা পার্থিব মানুষই কবিতার পাঠক। দ্বন্দ্বমুখরতাকে কবিতায় ধরতে পারলেই মানবজিজ্ঞাসার বিচিত্র বিষয়কে কবিতার প্রকরণ হিশেবে গ্রহণ করার সুযোগ থেকে যায়। কোনো সীমানা প্রাচীর টানা বা সিলেবাস নির্ধারিত করে দেয়া মানে কবিতাকে সমাহিত করা; আর কবিকে জীবন্মৃত করে রাখা।
কবিতা বিষয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-২০১০)-এর ভাব-চেতনাকে যুক্ত করে কথা শেষ করতে চাই :
‘কবিতা মনোজগতের এত সূক্ষ্ম এত অধরা জিনিশ যে, কবিতার ঘোর কেটে গেলে আর তা পুনর্লিখন করা যায় না। কবিতা বানিয়ে তোলা ব্যাপার নয়, হয়ে-ওঠা বস্তু। এই আমার বিশ্বাস্। শুকনো মাটি। তাতে বৃষ্টির পানি পড়লো। তারপর একদিন সকালে উঠে দেখা গেল, ঘাসের দু’চারটি সবুজাভ অঙ্কুর মাটির বুক চিরে জেগে উঠছে। কবিতা আমার কাছে এরকম।[…] কবিতার কোনো সংজ্ঞা নেই। যেমন জীবনেরও। যেমন ভালোবাসারও (ভেসেছিলাম ভাঙা ভেলায় ২০০৯ : ৩৬-৩৭)।’
২৮ আষাঢ় ১৪২৭ / ১২ জুলাই ২০২০

আল মাকসুদ: কবি ও গবেষক। সহকারী অধ্যাপক – বাংলা। সরকারী আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ। 

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন