স্মরণ
একটি আইফেল টাওয়ারের বিদায়
মোহাম্মদ জাকের হোছাইন ।। পুবাকাশ
মোহাম্মদ আলী স্যার বললেন- “I presume you are Jaker Hussain. Be seated.” আমার কানে আজো বাজছে presume শব্দটার উচ্চারণ ধ্বনি। তিনি কতো সুন্দর করেই না ইংরেজি ভাষার শব্দগুলো উচ্চারণ করতেন। স্যারের inviting tone শুনে আমার সমস্ত nervousness কেটে গিয়েছিলো সেদিন। বিদগ্ধ পান্ডিত্যের অধিকারী হয়েও একজন ছাত্রকে কতো সহজ করে নিতেন তাঁর সান্নিধ্যে গেলেই সেটি বোঝা যেতো।
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের কিংবদন্তি প্রফেসর মোহাম্মদ আলী চলে গেলেন ২৪শে জুন ২০২১, বিষ্যুদবারের শেষ বিকেলে। তাঁর বয়স হয়েছিলো প্রায় ৮৬ বছর। চলে যাওয়ার সময় এটি। তবু মনে হয়, হঠাৎ চলে যাওয়া তাঁর উচিত হয়নি। বার্ধ্যকের কারণে একটু একটু করে বিদায়ের দিকে অগ্রসর হলে আমাদের একটা মানসিক প্রস্তুতি থাকতো। না, তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হঠাৎ চলে গেলেন। উচ্চ রক্তচাপের সাথে নিষ্ঠুর কোভিডের আক্রমণ তাঁকে কেড়ে নিলো। ১৯৩৪ সালের ১লা ডিসেম্বরে তাঁর জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পৈতৃক বাড়ি ফটিকছড়ির হাইদচকিয়া গ্রামে।
ভিসি মোহাম্মদ আলী, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী, ইউজিসির সদস্য মোহাম্মদ আলী – অনেক নামেই তিনি পরিচিত। কিন্তু তাঁর কথায় তাঁর সবচেয়ে বড় তৃপ্তি শিক্ষক পরিচয়ে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেনঃ “সত্যনিষ্ঠভাবে বলতে পারবো, যেসব মুহূর্তে ছাত্রদের সঙ্গে আমার অধীত জ্ঞান, আমার আনন্দ, আমার উপলব্ধি, আমার অন্তর্দৃষ্টি কিছু যদি share করতে পেরেছি সেই মুহূর্তগুলোই আমার সার্থকতম মুহূর্ত।”
তিনি আরো বলেন, অন্য কিছুতে ব্যর্থ হয়ে শিক্ষকতায় আসেননি। শিক্ষকতাকে ভালোবেসেই এ পেশায় এসেছেন। শিক্ষকতাকে তিনি ব্রত হিসেবেই নিয়েছেন। এই জ্ঞানতাপসের কাছ থেকে এরচেয়ে আলোকদীপ্ত কথা আর কী হতে পারে! প্রভাষক থেকে অধ্যাপক, সিনেট-সিন্ডিকেট সদস্য থেকে ভাইস চ্যান্সেলর- সবইতো হয়েছেন। কিন্তু নিজের সার্থক পরিচয় মনে করেন একজন শিক্ষক হিসেবেই। জ্ঞানের আলোকধারায় যাঁরা স্নাত হন তাঁদের কাছে এই পরিচয়টাই বুঝি মহত্তম পরিচয়। তাঁরা জীবনের সার্থকতা খুঁজে পান এই পরিচয়ে। প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ছাত্র হিসেবে ছিলেন তুখোড় মেধাবী। ১৯৫০ সালে চট্টগ্রাম মুসলিম হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৫২ সালে সমগ্র দেশের মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায়। তারপর তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। ১৯৫৫ সালে অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৫৬ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে তিনি দ্বিতীয় এমএ ডিগ্রি নেন। উজ্জ্বল শিক্ষার্থী থেকে তিনি উজ্জ্বল শিক্ষক হয়েছেন। এযেনো সোনার হাতে সোনার কাঁকন। একে অন্যের অলংকার — একে অন্যের পরিপূরক। তিনি কর্মজীবনে প্রথম যোগদান করেন ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম কলেজে। এখানে ১৯৫৬-১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তাঁর কর্ম পরিধি। তিনি ১৯৫৮-১৯৬৬ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে রীডার পদে নিয়োজিত ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি ১৯৬৬ সালে ইংরেজি বিভাগের প্রথম সভাপতি হিসেবে যোগদান করেন। একে একে তিনি সিনেট সদস্য, সিন্ডিকেট সদস্য হন। তিনি ১৯৮৫-১৯৮৮ সাল পর্যন্ত উপাচার্য পদে আসীন ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ এবং সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ -এ ভিসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্ণাঢ্য তাঁর ছাত্রজীবন, বর্ণাঢ্য তাঁর কর্মজীবন।
এই হিরোণ্ময় ব্যক্তিত্ব আন্তর্জাতিক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং অধিবেশনে দেশের প্রতিনিধি হিসেবে অসংখ্যবার প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানের লাহোরে জাতীয় সেমিনারে তিনি ‘Problems of Higher Education in Pakistan ‘ শিরোনামে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ১৯৭০ সালে লাহোরে আধুনিক ভাষা ও সাহিত্যের আন্তর্জাতিক সংস্থার সম্মেলনে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৭৪ সালে Socio Linguistics বিষয়ে সুইডেনে আন্তর্জাতিক সেমিনারে, ভারতের হায়দরাবাদে উসমানিয়া ইউনিভার্সিটির ‘International Seminar on Stylistics’, ১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ‘Seminar on Humanistic Studies’ এবং ১৯৭৭ সালে জেনেভায় ইউনেস্কোর Conference on Higher Education and Information -এ আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। তিনি ১৯৭৫-১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত ভাষাতত্ত্ব বিভাগে Common Wealth Staff Fellow হিসেবে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৪০তম অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
সাহিত্যিক জীবনে প্রফেসর মোহাম্মদ আলী খুব কম কিছু লিখে গিয়েছেন। তাঁর নিজের কথায় তিনি বিরলপ্রজ। এতোটা বছর এবং এতগুলো প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালন করে বেশি কিছু লেখার সময় করা সত্যিই এক দুঃসাধ্য কাজ। আবার এমনও হতে পারে লেখাজোখার ব্যাপারে অনেকে খুব choosy। এ প্রসঙ্গে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের নাম স্মর্তব্য। তিনি তো গুটি কয়েক প্রবন্ধ ছাড়া লিখিত বা সম্পাদিত কোনো গ্রন্থই রেখে যাননি। কিন্তু আবদুর রাজ্জাক তো বাংলাদেশে একজনই আছেন। প্রফেসর মোহাম্মদ আলীও বেশি কিছু লিখে যাননি। তাঁর সম্পাদিত, অনুদিত এবং লিখিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে – Rain and River with Sayed Ali Ahsan, Selected Poems of Hasan Hafizur Rahman, Islam in Bangladesh, Society and Culture in Bangladesh, Sayed Ali Ahsan Felicitation, Selected English Verse : from Spenser to Dryden Thomas, A Book of Modern Poems, Bengali -English Dictionary (Bangla Academy) উল্লেখযোগ্য।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন থেকে এসে তিনি আবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। আমরা তখোন মাস্টার্সের ছাত্র। আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। তখোন তাঁর বয়স ষাটোর্ধ্ব। কিন্তু তখনো কি স্মার্ট চলাফেরায়, কথাবার্তায়, ভাষণে- বক্তৃতায়, পোশাকে-আশাকে। তিনি যেনো A young man of sixty। তিনি আমাদেরকে Old English পড়িয়ে ছিলেন। ঐ সময়কার Archaic Language এর শব্দ বোঝা এবং অর্থ উদ্ধার করা দুঃসাধ্য কাজ। এই দুঃসাধ্য কাজটি তিনি সহজ করে দিয়েছিলেন আমাদের জন্য। তিনি অতি সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন সেই সময়কার কবিতা এবং কাহিনীকাব্য। আমার আজো মনে পড়ে মাস্টার্সের ভাইভা পরীক্ষার কথা। ভাইভা কক্ষের ভেতরে ছিলেন ইংরেজির রয়েল বেঙ্গল টাইগার। আমার সিরিয়াল এলে আমি দুরুদুরু বুকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলাম -“May I come in, sir?” “Yes, come in. মোহাম্মদ আলী স্যার বললেন- “I presume you are Jaker Hussain. Be seated.” আমার কানে আজো বাজছে presume শব্দটার উচ্চারণ ধ্বনি। তিনি কতো সুন্দর করেই না ইংরেজি ভাষার শব্দগুলো উচ্চারণ করতেন। স্যারের inviting tone শুনে আমার সমস্ত nervousness কেটে গিয়েছিলো সেদিন। বিদগ্ধ পান্ডিত্যের অধিকারী হয়েও একজন ছাত্রকে কতো সহজ করে নিতেন তাঁর সান্নিধ্যে গেলেই সেটি বোঝা যেতো। তিনি মেধাবী শিক্ষার্থী আর মেধাবী শিক্ষক ছিলেন বলেই হয়তো পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে ভালো নাম্বার দিতেন। ঐ সময়ে ইংরেজিতে সেকেন্ড ক্লাস মার্কস দিতে শিক্ষকরা খুব কার্পণ্যবোধ করতেন। অথচ স্যার আমাদেরকে ৫০% এর ওপরেও মার্কস দিয়েছেন। যিনি ছাত্রজীবনে ভালো মার্কস পেয়েছেন তিনি শিক্ষকজীবনে ভালো মার্কস দেবেন এটি একটি সহজ বিবেচনা।
ব্যক্তিগত জীবনে এবং কর্মজীবনে তিনি ছিলেন খুব choosy। তাঁর taste বা রুচির উৎকর্ষ বরাবরই চোখে পড়ার মতো। এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে ট্রাস্টিবোর্ডকে প্রথম দিনই জানিয়ে দিলেন ঃ ভিসির জন্য মানসম্পন্ন গাড়ি প্রয়োজন। ভিসি এই গাড়িতে চড়বেন না। যতোদিন গাড়ি কেনা না হয় ততোদিন আমি না হয় নিজের গাড়িতেই আসা-যাওয়া করবো। ট্রাস্টিবোর্ড তাঁর জন্য নতুন গাড়ি কিনলেন।
তাঁর চেম্বারের জগ আর মগ দেখে বললেন -ভিসি সাহেব এই জগে পানি খান না, এই মগে চা খান না। ট্রাস্টিবোর্ড ওগুলোও বদলালেন। তাঁর এই ধরণের আচরণ তাঁর অহংকার নয়। এটি তাঁর রুচিবোধ এবং তাঁর পদ বা অবস্থান সম্পর্কে সচেতনতার পরিচায়ক। অন্য কথায় এটি তাঁর Sense of Individuality বা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ।
আজকালকার শিক্ষা প্রশাসকদের মতো তিনি তেলবাজ ছিলেন না। ফায়দা লুটবার জন্যে তিনি কারো তাবেদার ছিলেন না অথবা নিজেকে কোনো বিশেষ দলের সদস্য ভাবতেন না। তিনি ইউক্যালিপটাস গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকতেন। ঝড়ো বাতাসে মাথা নোয়াতেন না। এই জ্যোতির্ময়ের চোখে চোখ রেখে কথা বলা যেতোনা। তাঁর অন্তর্ধান যেনো একটি আইফেল টাওয়ারের নরম মৃত্তিকার মাঝে শান্তসমাহিত হয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকা। পরম শান্তির অবিরল ধারায় স্নাত হোক তাঁর অন্তর্লোকের অন্তর্যাত্রা। তিনি ভালো থাকুক ওপারে স্রষ্টার অপার মহিমায়, মানুষের ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায়।
তথ্য ঋণঃ ১. Dossier of Professor Mohammad Ali, source: University of Chittagong, International Islamic University Chittagong, Southern University Bangladesh
২. Interview: কৃতিত্বে চট্টগ্রাম ঐতিহ্যে চট্টগ্রাম।
Interviewer- khorshedul Anwar.
লেখক: অধ্যক্ষ, পশ্চিম বাঁশখালী উপকূলীয় কলেজ।
প্রাক্তন ছাত্র, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।