নানির কথা


আবু জাফর সিকদার।। পুবাকাশ


দোহাজারী চাগাচরে যখন জাপানিরা বোমা ফেলছিল, একটি ঐতিহাসিক তথ্য মতে, ১৪ মে, ১৯৪৪। চুয়াল্লিশের সেই দিনেই নানি বিয়ের পিড়িতে বসেছিলেন! বোমার বিকট আওয়াজে নাকি বিয়ের আসর প্রায় পণ্ড হয়ে গিয়েছিলো, তড়িঘড়ি করে বর কনেকে নিয়ে ঘরে ফিরেন বরযাত্রীরা। সাঁচি সিকদার বাড়ির মেজ ছেলে,সৈয়দ আহমদ সিকদার ছিলেন বর আর কনে হলেন আমার নানি বদরুন নেছা!

এক.

স্মৃতি আনন্দের, স্মৃতি বেদনার, স্মৃতি কখনও বা কাঁদায়, আবার কখনও বা হাসায়!
সেই স্মৃতি যখন একান্ত পরম আত্মীয়, আত্মীয়াকে ঘিরে আবর্তিত হয়, তখন সেটা রোমন্থন করে আমরা পুলকিত হই, আপ্লুত হই, হয়ে পড়ি নষ্টালজিক। আমার অতি প্রিয়জন, নানি’র সাথে সীমা পরিসীমাহীন যে বর্ণাঢ্য স্মৃতির পাহাড় জমে আছে সেরকম কিছু সেরা মুহুর্তে এখানে তুলে আনতে চেষ্টা করবো!

এটা হয়তো কারো কারও কাছে মনে হতে পারে, কেবল নাতি নানির একান্তই ব্যক্তিগত কিছু ঘটনা পরম্পরা। কিন্তু তা শুধু নয়। এটা আমাদের দুই প্রজন্মের যে অনন্যসাধারণ হৃদ্যতা, ভালোবাসা, আন্তরিকতার সম্পর্ক তারই একটি নির্মোহ চিত্র। আশা করি, যারা এই রকম সম্পর্ককে কাছ থেকে উপভোগ করতে পেরেছেন তাদের কাছে যেমন ভালো লাগবে, কিন্তু যারা এরকম সম্পর্কের সংস্পর্শ থেকে যে কোনভাবে হোক বঞ্চিত থেকেছেন (বিশেষ করে, নতুন প্রজন্ম বেশি করে এই বঞ্চনার শিকার!) তারাও এর সামাজিক গুরুত্ব ও মানসিক প্রশান্তির তাৎপর্য অনুধাবনে সক্ষম হবেন।

যা হোক, নিজের ভেতরের একটা তাড়না থেকেই এই স্মৃতিরোমন্থন। নানি, আমার জীবন ক্যানভাসে একটি ধ্রুব তারার মতো। ছোট বেলায় কিংবা বড় হবার পরও কখনও তিনি আমাকে বকাবকি করেছেন বলে মনে পড়ে না! তিনি গলা চড়িয়ে কারও সাথে ঝগড়া করেছেন এমনটাও আমার চোখে পড়েনি! এটা কীভাবে সম্ভব? তিনি আসলে নিতান্তই অমায়িক মানুষ ছিলেন, অল্পতে তুষ্টি অথবা যেটুকু আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকার এক অনন্য ধৈর্য ও তৃপ্তিবোধ ছিলো তার মাঝে। তার এই গুণটা কিঞ্চিৎ হলেও আমাকে সংক্রমিত করতে পেরেছে বলে আমি প্রথমেই তার এই চারিত্রিক সৌরভের কথা উল্লেখ করলাম।

আমি এতটাই হতভাগা যে, আমার দাদা-দাদি ও নানার আদর থেকে জন্মের পর থেকে বঞ্চিত ছিলাম। দাদা-দাদি জন্মের আগেই গত হয়েছেন, নানা আমার বছর দেড়েক বয়সেই নাকি ইন্তেকাল করেন। একমাত্র নানিই ছিলেন সেই প্রজন্মের চেরাগ! তবে হ্যাঁ, আমার চাচাতো জেঠাতো দাদা দাদি এবং নানা নানি অনেকেই জীবিত ছিলেন, তাদের কাছ থেকেও আমি অনেক অনেক ভালোবাসা, স্নেহ আদর পেয়েছি যা পরিমাপ করা সম্ভব নয়।

দোহাজারী চাগাচরে যখন জাপানিরা বোমা ফেলছিল, একটি ঐতিহাসিক তথ্য মতে, ১৪ মে, ১৯৪৪। চুয়াল্লিশের সেই দিনেই নানি বিয়ের পিড়িতে বসেছিলেন! বোমার বিকট আওয়াজে নাকি বিয়ের আসর প্রায় পণ্ড হয়ে গিয়েছিলো, তড়িঘড়ি করে বর কনেকে নিয়ে ঘরে ফিরেন বরযাত্রীরা। সাঁচি সিকদার বাড়ির মেজ ছেলে,সৈয়দ আহমদ সিকদার ছিলেন বর আর কনে হলেন আমার নানি বদরুন নেছা! নানি আমার ব্ল্যাক ডায়মন্ড! গায়ের রঙ কালো, বেঁটেখাটো গড়নের হলেও চেহারায় যে কমনীয়তা, লালিত্য ও সুশ্রী অবয়ব, পরিনত কিংবা শেষ বয়সেও আমরা দেখেছি তা এক কথায় ব্যতিক্রমী। অপরিণত বয়সেই তিনি নববধু হয়ে এসেছিলেন! বয়স বার, তের কিংবা ষোলই হবে। সেই থেকে শুরু! যাপনের পরতে পরতে নানা ঘাত প্রতিঘাত সয়ে সয়ে একটি সুদীর্ঘ সংগ্রামী জীবনাবসান হলো গত ১৬ জুন ২০২১, ০২ আষাঢ় ১৪২৮,০৫ শাওয়াল ১৪৪২। সঠিক জন্মসন জানতে পারিনি,তবে তার বিয়ের বছর ১৯৪৪ থেকে আনুমানিক ১৩ বছর পেছনে গিয়ে হিসাবে করলে বয়স ৯০ পার হয়ে গেছে!

দুই.

আমার নানি খুব বিখ্যাত কেউ নন। তিনি খুবই সাধারণ একজন গৃহিণী। তবে তার কী এমন বিশেষত্ব আছে যে তাকে নিয়ে লিখতে হবে, এ প্রশ্ন হয়তো কারও কারও মনে উঁকি দিতেই পারে! যারা অসাধারণ তাদের নিয়ে তো সবাই লেখেন কিন্তু যারা খুবই সাধারণ তাদের জীবন নিয়ে, তাদের যাপন নিয়ে, তাদের হাসি, কান্না, কষ্ট, সংগ্রাম নিয়ে আমরা তেমন ভাবি না। পথের ধারের দুর্বাঘাসের মতো কিংবা বনে জঙ্গলে অনাদরে অবহেলায় বেড়ে উঠা বন্য ফুলের মতো তারা ফোটে, সৌরভ বিলায় আর যথানিয়মে ঝরে যায়! আমরা, আমার নানির মতো, আরও শত সহস্র সাধারণের খোঁজ রাখি না; রাখার প্রয়োজন অনুভব করি না! কিন্তু তাদের সংগ্রাম, ত্যাগের বিনিময়েই তৈরি হয়ে শত সহস্র পরিবারের ভীত, সেখান থেকে বের হয়ে আসছে মধ্যবিত্তের সুযোগ্য সন্তানেরা। কিন্তু আমরা তাদের অবদানকে না হয় ভুলে যাই, নয়তো অস্বীকার করি, অবজ্ঞা কবি, করি চরম অবহেলা! এই সমাজে একজন মধ্যবিত্ত ঘরের ‘মা’ কিংবা ‘বাবা’র কী অসহনীয় ত্যাগ, তিতিক্ষা সয়ে সয়ে ছেলে মেয়েদের একটি একটি সিঁড়িপথ রচনা করে দিয়ে নিজেরা দিনে দিন নিঃস্ব, নিঃশেষ হয়ে যান তার খবর আমরা কয়জনে রাখি? খেয়ে, না খেয়ে, দিন রাত পরিশ্রম করে, একজন পুরুষ যেটুকু অবদান রাখতে পারেন, সেই পুরুষ মানুষটির অবর্তমানে একজন অবলা,বিধবা নারীর উপর যখন ঘরে বাইরের সকল দায়দায়িত্ব চেপে বসে তখন সেই নারী কীভাবে এর হাল ধরে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পুরো সংসার সমুদ্র পাড়ি দেন, তাদের লড়াইটা কত মহৎ, কত বিরাট, কত কঠিন, তা কী আমাদের কখনও আলোড়িত করে? হয়তো কাউকে কাউকে করে, কারও হয়তো তা ভাবার কোন ফুরসতই নেই! কিন্তু আমার মনে হয়েছে, তাদের দিকে একটু দৃষ্টিপাত করা
ভীষণ জরুরী! না হয় একসময় হয়তো শহুরে সংস্কৃতির মতো, প্রতিটি গ্রামে গ্রামে ঐ সব নারী পুরুষদের জন্যও ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গড়ে তুলতে হবে!

যা হোক, নানির কথায় ফেরা যাক। আমি আগেও বলেছি, এটা শুধু আমার নানির গল্প নয়;

একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত সংগ্রামী নারীর পৌনে একশত বছরের জীবন যাপনের আলেখ্য। বিষয়টিকে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে পড়লে আশা করি কিছুটা হলেও আমার লেখার প্রয়াস সার্থক হবে।

তিন.

দুই যুগের মধুপর্ব, কিছুটা কম বেশি হতে পারে, নানির ‘সধবাকাল’ নিয়ে আমার তেমন কোন স্মৃতি নেই! আম্মা বা মামাদের কাছ থেকেও এবিষয়ে খুব একটা কিছু জানা হয়ে উঠেনি! এটুকু শুধু বলে রাখা ভালো, আম্মা থেকে শোনা, নানা নানির সম্পর্ক খুবই মধুর ছিল। এই সম্পর্ক ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ টাইপের প্রদর্শন সর্বস্ব না হলেও সেটা ছিলো অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো সতত প্রবাহমান এক চিরন্তন অটুট হার্দিক বন্ধন। একজন আরেকজনকে যথেষ্ট সম্মান ও মর্যাদা দিতেন।
আমার আম্মারা পাঁচ বোন ও চার ভাই, আম্মাই সবার বড় । নানা জীবিত থাকা অবস্থায় কেবল মাত্র আম্মা এবং বড় মামা ও মেজ খালার বিয়ে দিয়ে যেতে পেরেছিলেন।

নানা নাকি দেখতে বেশ সুপুরুষ ছিলেন, বড় নানা, ছোট নানাকে তো আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো। তাদের রূপ লাবন্য শারীরিক গঠন না মামারা কেউ পেয়েছেন, না আমরা উত্তরপ্রজন্মের কপালে তা জুটেছে! মানুষ যেন ধীরে ধীরে খর্বকায় ও হীনবল হয়ে যাচ্ছে! একদিন মানুষেরা সত্যিই জোনাথন সুইফটের লিলিপুট হয়ে যায় কিনা কে জানে!

আমার নানাকে একটি মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়! ঘটনাটি ছিলো অভিনব, অত্যন্ত মর্মন্তুদ,হৃদয়বিদারক! তিনি সেদিন পাহাড়ে গিয়েছিলেন সম্পূর্ণ সুস্থ সবল মানুষ, সাথে ছিলেন আরও একজন বন্ধু। তিনি পেশাদারি মৌয়াল না হলেও সৌখিন মধুশিকারি ছিলেন। বনে বনে ঘুরে ঘুরে মধু আহরণ ছিলো তার শখ। আমাদের গ্রামের অদূরেই বান্দরবনের বিশাল ও গভীর বনাঞ্চলের এক অভয়ারণ্য। সেখানে তারা মধু আহরণে মশগুল থাকতেন। বড় নানা আবার ছিলেন পশু শিকারি! মাসের পর মাস নাকি তিনি হরিণের পেছনে ওঁত পেতে কাটিয়ে দিতেন, তিনি হুবহু হরিণের মত ডাকতে পারতেন। সেতো আর এক কাহিনী। শেষদিন যখন নানা পাহাড়ে গেলেন, সেটাই কাল হলো তার জন্য! দুই বন্ধু পাহাড়ে ভেতর চলতে গিয়ে এক দাঁতাল, হিংস্র শুকরের মুখোমুখি হন। দৌঁড়ে পালাতে গিয়ে আমার নানা পড়ে যান চোরাবালিতে! কাদার এই চোরাবালি এমন এক ভয়াবহ মরণফাঁদ, এখানে কেউ পড়লে যত উঠতে চেষ্টা করে ততই ভেতরে দেবে যেতে থাকে। একদিকে ছুটে আসছে ভয়াল, দাঁতাল শুয়োর, অন্যদিকে চোরাবালির গভীর ফাঁদ। সাথের বন্ধু না শুয়োরকে প্রতিহত করতে চেষ্টা করলো, না চোরাবালিতে পড়ে যাওয়া বন্ধুকে টেনে তোলার চেষ্টা করলো!

ভাল্লুক ও দুই বন্ধুর গল্পের চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি! সেদিন সাথের বন্ধু পালিয়ে বাঁচলো, হিংস্র শুয়োরটিও আক্রমণ করতে পিছপা হলো না । নানা ভীষণভাবে আক্রান্ত হলেন এবং খবর গ্রামে পৌঁছার পর বাড়ি আনতে আনতে তিনি মারা গেলেন।

প্রায় অপ্রস্তুত অবস্থায় একজন জলজ্যান্ত মানুষ এভাবে চলে গেলেন, রেখে গেলেন এক বিধবার হাতে নয়টি এতিম সন্তান! সাঁচি সিকদারের জমিদারি তাল্লুক হাতছাড়া হওয়ার দরুন নানার পৈতৃক জমিজমা খুব বেশি ছিলো না।যেটুকু ছিলো একটি বর্ধিত সংসারে টেনেটুনে চলে যাচ্ছিলো। নিজেদের হালচাষ করতে হতো! নানার সাথে সাথে বড় মামাদেরও তাকে সহযোগিতা করতে হতো। বড় মামা তখন বোধ হয় ডিগ্রি পড়ছিলেন অথবা সদ্য পাশ করে বের হয়েছেন। সেজ মামা ছাড়া বাকীরা সবাই ছোটই বলা যায়! আকাশ ভেঙ্গে পড়া বলতে ঠিক যা বুঝায় নানির মাথায় যেন তাই পড়েছিল তখন!
জীবনের রূপ রঙ যেন নিমিষে বদলে গেল!

ক্রমশ:


আবু জাফর সিকদার : কবি ও গল্পকার।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন